alt

উপ-সম্পাদকীয়

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মনিরুল হক রনি

: সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

তীক্ষè দৃষ্টিসম্পন্ন, বড় ডানাওয়ালা একটি গুরুত্বপূর্ণ পাখি শকুন। এক সময় গ্রাম-গঞ্জ, শহরের আনাচে-কানাচে পরিচিত এই পাখিটি এখন বিলুপ্তপ্রায়। মৃত প্রাণীর দেহ খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার রাখার কারণে শকুনকে বলা হয় প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী। এই পাখিটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই বিপন্নের তালিকায়। অথচ পরিবেশ সংরক্ষণ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় শকুনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মৃত পশুর দেহ খেয়ে এরা যেমন জীবাণু ছড়ানো ঠেকায়, তেমনি রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। শকুনের পাকস্থলীর অম্লীয় জারণ ক্ষমতা এতই বেশি যে, অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা, কলেরা, খুরা বা জলাতঙ্কের এত রোগজীবাণু শকুনের শরীরে ঢুকেই ধ্বংস হয়ে যায়।

শকুন কমে যাওয়ার ফলে মৃত পশুর দেহ এখন কুকুর, শিয়াল, কাক, ইঁদুর বা চিলের খাদ্যে পরিণত হচ্ছে, যারা শকুনের এত রোগ ধ্বংস করতে পারে না। ফলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশে, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।

বাংলার আকাশে এক সময় অসংখ্য শকুন উড়ে বেড়াত। এখন তা বিরল। শকুনের সংখ্যা যেভাবে হ্রাস পেয়েছে, তা পৃথিবীর আর কোনো বড় পাখির ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাণিবিজ্ঞান সংস্থা ‘আইইউসিএন’ শকুনকে ইতোমধ্যেই ‘রেড লিস্টে’ অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ তালিকায় একটি প্রাণী তখনই স্থান পায়, যখন তার ৯০ শতাংশেরও বেশি জনসংখ্যা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

প্রায় ২৬ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীতে শকুনের অস্তিত্ব থাকলেও বাংলাদেশে বর্তমানেটিকে আছে মাত্র ২৬০টির মতো। পৃথিবীতে শকুনের ১৮টি প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে দেখা যায় ৭টিÑ বাংলা শকুন, রাজ শকুন, গ্রীফন শকুন, হিমালয়ী শকুন, সরুঠোঁট শকুন, কালা শকুন ও ধলা শকুন। এর মধ্যে রাজ শকুন পুরোপুরি বিলুপ্ত, বাকিগুলোর অবস্থাও সংকটাপন্ন। ১৯৭০ সালে দেশে শকুনের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ হাজার, ২০০৯ সালে তা নেমে আসে দুই হাজারের নিচে, আর ২০১৪ সালের শুমারিতে দেখা যায় সংখ্যা কমে মাত্র ২৬০টি হয়েছে।

শকুন বিলুপ্তির প্রধান কারণ মানুষের অসচেতনতা। গবাদিপশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন নামক যেসব ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে, তা শকুনের জন্য মারাত্মক বিষ। এই সোডিয়ামজাতীয় ওষুধগুলো শকুনের পরিপাকতন্ত্রে হজম হয় না। ফলে, ডাইক্লোফেনাক গ্রহণের ৩ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শকুন মারা যায়।

শুধু ওষুধ নয়, খাদ্যসংকটও শকুনের অস্তিত্ব বিপন্ন করেছে। আগে অসুস্থ বা বৃদ্ধ গবাদিপশু বেশি মারা যেত, এখন চিকিৎসা ও খামার ব্যবস্থাপনা উন্নত হওয়ায় পশুর মৃত্যুহার কমে গেছে। ফলে মৃত পশু কমে যাওয়ায় শকুনের খাদ্যের উৎস সংকুচিত হয়েছে। এর পাশাপাশি বাসস্থানের সংকটও প্রকট। পুরোনো গাছ যেমন- বট, পাকুড়, অশ্বত্থ, শিমুলÑ যেখানে শকুন বাসা বাঁধে, তা নির্বিচারে কাটা হচ্ছে। শহরায়ন, শিল্পায়ন ও বনভূমি দখলের ফলে শকুনের আবাসস্থল হারিয়ে যাচ্ছে।

আইইউসিএনের সহযোগী সংস্থা বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনালের মতে, অতিরিক্ত কীটনাশক, সারের ব্যবহার, পানি দূষণ, কুসংস্কারবশত কবিরাজি চিকিৎসায় শকুনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার, ঘুড়ির সুতায় জড়িয়ে পড়া, ট্রেন-বিমানের সঙ্গে সংঘর্ষ, ইউরিক অ্যাসিডজনিত রোগ ইত্যাদিও শকুন মৃত্যুর কারণ।

এছাড়া শকুনের প্রজনন প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর। বছরে একটি ডিম দেয়, যার সফলতা মাত্র ৪০ শতাংশ। ফলে প্রাকৃতিকভাবে দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধিও সম্ভব হয় না। অনেক মানুষ শকুনকে অশুভ হিসেবে মনে করে, শিকারো করে থাকে। এটিও বিলুপ্তির একটি সামাজিক কারণ।

তবে এখন প্রশ্ন হওয়া উচিতÑ শকুনের অতীত নিয়ে আলোচনা নয়, বরং কীভাবে এখনকার অস্তিত্বকে রক্ষা করা যায়। সরকার ইতোমধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১০ সালে ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ২০১৩ সালে গঠিত হয়েছে ‘জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি’, ২০১৪ সালে দুইটি ‘সেইফ জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে।

২০১৬ সালে ১০ বছর মেয়াদি শকুন সংরক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। রেমা-কালেঙ্গা ও সুন্দরবনে ফিডিং স্টেশন স্থাপন, দিনাজপুরের সিংড়ায় শকুন পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং শকুনের প্রজনন সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলাÑ এসবই গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।

এসব উদ্যোগ ইতিবাচক ফলও দিচ্ছে। আইইউসিএন সূত্রে জানা যায়, রেমা-কালেঙ্গায় শকুনের প্রজনন সফলতা ২০১৪ সালের ৪৪ শতাংশ থেকে ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৫৭ শতাংশ। এটা আশার সঞ্চার করে।

কিন্তু এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে ঘাটতি থাকলে অর্জন ভেস্তে যাবে। তাই প্রতিটি কর্মসূচির জন্য চাই নিরবচ্ছিন্ন তদারকি ও জবাবদিহিতা। নিষিদ্ধ ওষুধের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারে কারা জড়িত, তা শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

সংরক্ষিত বনাঞ্চল, প্রাচীন বৃক্ষ ও প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষায় পরিকল্পিত পদক্ষেপ জরুরি। পাশাপাশি কৃত্রিম প্রজননের সুযোগ বাড়ানো, স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

পরিবেশকে পরিষ্কার রাখা, রোগব্যাধি ছড়ানো ঠেকানো এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে শকুনের অবদান অপরিহার্য। একে অশুভ বা তুচ্ছ ভেবে অবহেলা করা মানে আমাদের নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনা।

শকুন শুধু একটি পাখি নয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি। একে হারিয়ে গেলে প্রকৃতি ও জনস্বাস্থ্যÑ দুটিই হুমকির মুখে পড়বে। তাই শকুন রক্ষার আন্দোলনে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এখনই।

[লেখক : প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ, সাভার সরকারি কলেজ]

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মনিরুল হক রনি

সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

তীক্ষè দৃষ্টিসম্পন্ন, বড় ডানাওয়ালা একটি গুরুত্বপূর্ণ পাখি শকুন। এক সময় গ্রাম-গঞ্জ, শহরের আনাচে-কানাচে পরিচিত এই পাখিটি এখন বিলুপ্তপ্রায়। মৃত প্রাণীর দেহ খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার রাখার কারণে শকুনকে বলা হয় প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী। এই পাখিটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই বিপন্নের তালিকায়। অথচ পরিবেশ সংরক্ষণ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় শকুনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মৃত পশুর দেহ খেয়ে এরা যেমন জীবাণু ছড়ানো ঠেকায়, তেমনি রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। শকুনের পাকস্থলীর অম্লীয় জারণ ক্ষমতা এতই বেশি যে, অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা, কলেরা, খুরা বা জলাতঙ্কের এত রোগজীবাণু শকুনের শরীরে ঢুকেই ধ্বংস হয়ে যায়।

শকুন কমে যাওয়ার ফলে মৃত পশুর দেহ এখন কুকুর, শিয়াল, কাক, ইঁদুর বা চিলের খাদ্যে পরিণত হচ্ছে, যারা শকুনের এত রোগ ধ্বংস করতে পারে না। ফলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশে, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।

বাংলার আকাশে এক সময় অসংখ্য শকুন উড়ে বেড়াত। এখন তা বিরল। শকুনের সংখ্যা যেভাবে হ্রাস পেয়েছে, তা পৃথিবীর আর কোনো বড় পাখির ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাণিবিজ্ঞান সংস্থা ‘আইইউসিএন’ শকুনকে ইতোমধ্যেই ‘রেড লিস্টে’ অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ তালিকায় একটি প্রাণী তখনই স্থান পায়, যখন তার ৯০ শতাংশেরও বেশি জনসংখ্যা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

প্রায় ২৬ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীতে শকুনের অস্তিত্ব থাকলেও বাংলাদেশে বর্তমানেটিকে আছে মাত্র ২৬০টির মতো। পৃথিবীতে শকুনের ১৮টি প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে দেখা যায় ৭টিÑ বাংলা শকুন, রাজ শকুন, গ্রীফন শকুন, হিমালয়ী শকুন, সরুঠোঁট শকুন, কালা শকুন ও ধলা শকুন। এর মধ্যে রাজ শকুন পুরোপুরি বিলুপ্ত, বাকিগুলোর অবস্থাও সংকটাপন্ন। ১৯৭০ সালে দেশে শকুনের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ হাজার, ২০০৯ সালে তা নেমে আসে দুই হাজারের নিচে, আর ২০১৪ সালের শুমারিতে দেখা যায় সংখ্যা কমে মাত্র ২৬০টি হয়েছে।

শকুন বিলুপ্তির প্রধান কারণ মানুষের অসচেতনতা। গবাদিপশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন নামক যেসব ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে, তা শকুনের জন্য মারাত্মক বিষ। এই সোডিয়ামজাতীয় ওষুধগুলো শকুনের পরিপাকতন্ত্রে হজম হয় না। ফলে, ডাইক্লোফেনাক গ্রহণের ৩ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শকুন মারা যায়।

শুধু ওষুধ নয়, খাদ্যসংকটও শকুনের অস্তিত্ব বিপন্ন করেছে। আগে অসুস্থ বা বৃদ্ধ গবাদিপশু বেশি মারা যেত, এখন চিকিৎসা ও খামার ব্যবস্থাপনা উন্নত হওয়ায় পশুর মৃত্যুহার কমে গেছে। ফলে মৃত পশু কমে যাওয়ায় শকুনের খাদ্যের উৎস সংকুচিত হয়েছে। এর পাশাপাশি বাসস্থানের সংকটও প্রকট। পুরোনো গাছ যেমন- বট, পাকুড়, অশ্বত্থ, শিমুলÑ যেখানে শকুন বাসা বাঁধে, তা নির্বিচারে কাটা হচ্ছে। শহরায়ন, শিল্পায়ন ও বনভূমি দখলের ফলে শকুনের আবাসস্থল হারিয়ে যাচ্ছে।

আইইউসিএনের সহযোগী সংস্থা বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনালের মতে, অতিরিক্ত কীটনাশক, সারের ব্যবহার, পানি দূষণ, কুসংস্কারবশত কবিরাজি চিকিৎসায় শকুনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার, ঘুড়ির সুতায় জড়িয়ে পড়া, ট্রেন-বিমানের সঙ্গে সংঘর্ষ, ইউরিক অ্যাসিডজনিত রোগ ইত্যাদিও শকুন মৃত্যুর কারণ।

এছাড়া শকুনের প্রজনন প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর। বছরে একটি ডিম দেয়, যার সফলতা মাত্র ৪০ শতাংশ। ফলে প্রাকৃতিকভাবে দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধিও সম্ভব হয় না। অনেক মানুষ শকুনকে অশুভ হিসেবে মনে করে, শিকারো করে থাকে। এটিও বিলুপ্তির একটি সামাজিক কারণ।

তবে এখন প্রশ্ন হওয়া উচিতÑ শকুনের অতীত নিয়ে আলোচনা নয়, বরং কীভাবে এখনকার অস্তিত্বকে রক্ষা করা যায়। সরকার ইতোমধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১০ সালে ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ২০১৩ সালে গঠিত হয়েছে ‘জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি’, ২০১৪ সালে দুইটি ‘সেইফ জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে।

২০১৬ সালে ১০ বছর মেয়াদি শকুন সংরক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। রেমা-কালেঙ্গা ও সুন্দরবনে ফিডিং স্টেশন স্থাপন, দিনাজপুরের সিংড়ায় শকুন পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং শকুনের প্রজনন সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলাÑ এসবই গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।

এসব উদ্যোগ ইতিবাচক ফলও দিচ্ছে। আইইউসিএন সূত্রে জানা যায়, রেমা-কালেঙ্গায় শকুনের প্রজনন সফলতা ২০১৪ সালের ৪৪ শতাংশ থেকে ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৫৭ শতাংশ। এটা আশার সঞ্চার করে।

কিন্তু এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে ঘাটতি থাকলে অর্জন ভেস্তে যাবে। তাই প্রতিটি কর্মসূচির জন্য চাই নিরবচ্ছিন্ন তদারকি ও জবাবদিহিতা। নিষিদ্ধ ওষুধের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারে কারা জড়িত, তা শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

সংরক্ষিত বনাঞ্চল, প্রাচীন বৃক্ষ ও প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষায় পরিকল্পিত পদক্ষেপ জরুরি। পাশাপাশি কৃত্রিম প্রজননের সুযোগ বাড়ানো, স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

পরিবেশকে পরিষ্কার রাখা, রোগব্যাধি ছড়ানো ঠেকানো এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে শকুনের অবদান অপরিহার্য। একে অশুভ বা তুচ্ছ ভেবে অবহেলা করা মানে আমাদের নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনা।

শকুন শুধু একটি পাখি নয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি। একে হারিয়ে গেলে প্রকৃতি ও জনস্বাস্থ্যÑ দুটিই হুমকির মুখে পড়বে। তাই শকুন রক্ষার আন্দোলনে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এখনই।

[লেখক : প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ, সাভার সরকারি কলেজ]

back to top