জিয়াউদ্দীন আহমেদ
‘সংস্কার সংস্কার সংস্কার’Ñ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এভাবে তিনবার উচ্চারণ করে সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি সবাইকে সংস্কার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানিয়েছেন, সংস্কার নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা-পর্যালোচনা করতে তিনি বারবার অনুরোধ করেছেন।সংস্কারের তীব্র আকাক্সক্ষা থেকে তিনি চটজলদি অনেকগুলো সংস্কার কমিশনও গঠন করে দিয়েছিলেন। কমিশনগুলো তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে, কয়েকটি কমিশনের সুপারিশের ওপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামতও নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এই মতামতের ভিত্তিতে তৈরি হবে ‘জুলাই চার্টার’, যাতে থাকবে রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষর। কিন্তু এই সব কর্মকা- অবাস্তব ও বাস্তবায়ন অযোগ্য স্বপ্ন। বাম আর ডানের আদর্শের পার্থক্য উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুর দূরত্বের সমান। তাই ‘জুলাই চার্টার’ দিয়ে যে সংস্কার হবে তা হবে খুবই সীমিত, তা দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের উদ্ভব ঠেকানো যাবে না। আমি আমার আগেকার কয়েকটি লেখায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছি যে, রাজনৈতিক দলগুলোর মত, পথ ও আদর্শ ভিন্ন। এই ভিন্ন মত ও আদর্শ দিয়ে ঐকমত্যের চার্টার হবে সীমিত ও সীমাবদ্ধ। কারণ, ‘কেউ ভারতের দালাল, কেউ পাকিস্তানের’। কেউ ত্বড়িৎ নির্বাচন চায়, কেউ নিজের দলকে গুছিয়ে নেয়ার সময় চায়। কেউ চব্বিশের ভক্ত, কেউ একাত্তরের। জাতির এই বিভাজনের অবসায়ন প্রায় অসম্ভব। ড. ইউনূসের পক্ষে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ ছিল। তিনি এক পরিবারের কথা বলেছিলেনও। কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটেননি।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ মোতাবেক দলের মনোনয়ন নিয়ে বিজয়ী কোন সংসদ সদস্য দল থেকে পদত্যাগ করলে, অথবা সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোটদান করলে সংসদে তার আসনটি শূন্য বলে বিবেচিত হবে- এমনতর বাধ্যবাধকতা থাকায় সংসদে দলীয় সাংসদদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে না, দলের তরফ থেকে উপস্থাপিত সব বিলে বাধ্য হয়ে দলীয় সাংসদদের হাত তুলে ভোট দিতে হয়, ভিন্নমত পোষণের কোন সুযোগ থাকে না। তাই সংবিধান থেকে এই অনুচ্ছেদ বাতিলের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই অনুচ্ছেদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সাংসদদের দলের প্রতি শর্তহীন অনুগত রাখা। তবে এর প্রয়োজনও আছে। বাংলাদেশে নীতি-নৈতিকতার যে ধস নেমেছে তার মধ্যে ৭০ অনুচ্ছেদ থাকায় সংসদ সদস্যদের নিয়ে বেচাকেনা সম্ভব হচ্ছে না। তবে শুধু ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করলেই যে স্বাধীন মত প্রকাশের পথ সুগম হবে, তা কিন্তু নয়। কণ্ঠভোটে ‘হ্যাঁ-না’ বলার রীতি বহাল রাখা হলে ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করলেও কোন সংসদ সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোট দিতে সাহস করবে না। এই ক্ষেত্রে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা নেয়া হলে কিছুটা ফলপ্রসূ হতে পারে।
বাংলাদেশে যে তিনটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ছিল সেই তিনটি রাজনৈতিক দল পরিবারতন্ত্রে আবদ্ধ। দলের জ্ঞানী-গুণী-দক্ষ-অভিজ্ঞ নেতার চেয়ে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, জি এম কাদেরের গুরুত্ব অনেক বেশি। দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র না থাকায় কেউ কাউকে মানে না, তাই দলের ভাঙন রোধে শেখ হাসিনাকে বিদেশ থেকে এনে দলের সভাপতি করা হয়, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর গৃহবধূ খালেদা জিয়াকে বিএনপির হাল ধরতে হয়, হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের অবর্তমানে দলের নেতৃত্বে রওশন এরশাদ বা জি এম কাদেরের বাইরে অন্য কাউকে চিন্তাও করা যায় না। দেশের জনগণও এই সব নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ আনুগত্যে বিভোর। দলের শীর্ষ নেতারা দলের জন্য তাদের এই অপরিহার্যতা অনুধাবন করে ফ্যাসিস্ট আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন, তাদের কথাই দলের জন্য অলঙ্ঘনীয় আইন, এই আইন ভঙ্গ করার হিম্মত দলের কোন সদস্যের থাকে না। তাই ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করা হলেও কোন সদস্য দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কথা বলবে না, সংসদে দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট দিলে পরেরবার আর মনোনয়ন পাবে না। দলের কথা না শুনে প্রেসিডেন্ট বি চৌধুরীকেও অপদস্ত হতে হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা শীর্ষ নেতার কথায় উঠবস করে। এই অবস্থায় সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ থাকা, না থাকার মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই।
দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে নাÑ সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশের সঙ্গে বিএনপি ভিন্নমত পোষণ করে বলছে, দুইবার নয়, তিনবার। দুইবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এক টার্ম গ্যাপ দিয়ে তৃতীয়বার একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে। বিএনপি জানে আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে না থাকলে নির্বাচনের মাঠে তারাই চ্যাম্পিয়ন, রাশিয়ার পুতিনের মতো দুইবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট, চতুর্থবার আবার প্রধানমন্ত্রী। বিএনপি চাচ্ছে বর্তমানে প্রচলিত নিয়মানুযায়ী দলের মনোনীত প্রার্থী কন্সটিটিউয়েন্সিতে আসন জিতে সংসদে যাবে, কিন্তু সংস্কার কমিশনসহ জামায়াতে ইসলাম চাচ্ছে সারা দেশে দলের নির্বাচনি প্রতীকে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সংসদে দলের আসন বণ্টন হবে, দল থেকে কোন প্রার্থী নির্বাচনে থাকবে না, জনগণ ভোট দেবে প্রতীকে। নিশ্চিত জয় যেখানে ধরনা দিচ্ছে সেখানে বিএনপি তাদের মত থেকে সরবে বলে মনে হয় না। সংস্কার কমিশনের আরেকটি প্রস্তাব হচ্ছে যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন তিনি তার দলের প্রধান থাকতে পারবেন না। কিন্তু এটি একটি তাৎপর্যহীন প্রস্তাব। আগেই উল্লেখ করেছি যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল চলে দলের শীর্ষ ব্যক্তির একক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে, তাই তিনি যেখানেই থাকুন না কেন তা দেশ বা দল পরিচালনায় গুরুত্বহীন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি বা মধ্যপ্রাচ্যের রাজা-বাদশাহর মতো তার কথায় রাজনীতি ও প্রশাসন চলবে। আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের সব কিছুতেই বলতেন ‘প্রধানমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী’। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও একই পরিভাষা প্রযোজ্য। এরশাদ সাহেব তো ঘোষণা দিয়ে বলতেন, ‘জাতীয় পার্টিতে আমি যা বলব তাই আইন’। দলের শীর্ষ নেতার কর্তৃত্ব দেশবাসী দেখেছে আবদুর রহমান বিশ্বাসের আনুগত্যে। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও খালেদা জিয়া ডাকছেন শুনেই তার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন, প্রটোকল মানার কথা মনে আসেনি। তাই শীর্ষ নেতা ‘প্রধানমন্ত্রী’ থাকবেন, না ‘দলীয় প্রধান’ থাকবেন, না উভয় পদে থাকবেন তা আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ করা অর্থহীন।
সংস্কার কমিশন সংসদের দুটি কক্ষের প্রস্তাব করেছেÑ উচ্চকক্ষ আর নিম্নকক্ষ। এছাড়া সংসদের আসন সংখ্যা বৃদ্ধির প্রস্তাবও করা হয়েছে। স্বৈরাচার ঠেকানোর জন্য উচ্চকক্ষ নাকি অপরিহার্য, কারণ নিম্নকক্ষে পাস হওয়া সব আইন প্রস্তাবে পুনরায় উচ্চকক্ষের অনুমোদন লাগবে। সংস্কার কমিশনের এই উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতভেদ আছে। বিএনপি চাচ্ছে নিম্নকক্ষে আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন করা হবে, কিন্তু অন্যদের প্রস্তাব হচ্ছে এই আসন বণ্টন হবে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে। বিএনপির প্রস্তাব মেনে নিলে নিম্নকক্ষ এবং উচ্চকক্ষ উভয় কক্ষে ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। ফলে উচ্চকক্ষ দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নিম্নকক্ষের আইন প্রণয়নে স্বেচ্ছাচারিতা বাধাগ্রস্ত হবে না। বিএনপির প্রস্তাব মোতাবেক উচ্চকক্ষ গঠিত হলে তা হবে ধনী ও সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের বিনোদনের ক্লাব। অন্যন্য দলের কথা মেনে নিয়ে সংসদ নির্বাচনে দলের মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টন করা হলে বিরোধী দলগুলো উচ্চকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে। কারণ আজ পর্যন্ত কোন একক দল সুষ্ঠু নির্বাচনে ৫০ শতাংশ ভোট পায়নি, কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেয়া বাকি দলগুলোর প্রার্থী ও স্বতন্ত্র সদস্যদের ভোট ৫০ শতাংশের বেশি ছিল। তাই প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হলে উচ্চকক্ষে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রাধান্য থাকবে। এতেও সমস্যা, বিল পাসে স্থবিরতা তৈরি হতে পারে, তখন উচ্চকক্ষের সাংসদ বেচাকেনার সামগ্রী হয়ে উঠতে পারেন।
ঘুষ-দুর্নীতি বিরোধী সংস্কারে হাত দিলে তার বিরুদ্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতো সব প্রতিষ্ঠানে সব দলের সমর্থকদের মধ্য ইস্পাত-কঠিন ঐক্য গড় ওঠবে। শুধু ঐক্য হয়নি ব্যাংকে আমানতকারীদের মধ্যে।নীতি নির্ধারকদের উল্টাপাল্টা কথা দিয়ে ব্যাংকের সংস্কার যেদিন থেকে শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই জনগণ আর তাদের জমা টাকা ফেরত পাচ্ছে না। প্রথমে বলা হলো দেউলিয়াগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে এক টাকাও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেয়া হবে না, কিন্তু পরে ৫২ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হলো। কিন্তু আস্থা নষ্ট হওয়ার কারণে বস্তাভর্তি টাকা দিয়েও এখন আর দেউলিয়া ঠেকানো যাচ্ছে না। ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে এখন আমানতকারীদের চোর-পুলিশ খেলা শুরু হয়েছে, ব্যাংকের ধারেকাছে কোন আমানতকারীকে দেখলেই শাখা ব্যবস্থাপক ভয় পায়, লুকাতে চায়, গেইট বন্ধ করে দেয়। আওয়ামী লীগ আমলে ব্যাংক যখন লুট হয়েছে তখনও এই সমস্যা এত মারাত্মক আকার ধারণ করেনি, সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে সংস্কার শুরু হওয়ার পর থেকে। কিন্তু দেশের অর্থনীতি সুস্থ না হলে শুধু ব্যাংকের চিকিৎসা করে রোগ নিরাময় করা সহজ হবে না।
গণতন্ত্র দিয়ে সংস্কার হয় না, দেশের বেশির ভাগ লোক চিন্তা-চেতনায় পশ্চাৎগামী। যারা যুগের চেয়ে অগ্রগামী চিন্তক ছিলেন তাদের ‘পাগল’ গণ্য করা হয়েছে, বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে, জিহ্বা কেটে দেয়া হয়েছে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, টুকরো টুকরো করে কেটে হিংস্র পশুকে খাওয়ানো হয়েছে। তাই সংস্কারে কর্তৃত্ববাদী হতে হয়, স্বৈরাচার হতে হয়। আইয়ুব খান সামরিক শাসক না হলে পাকিস্তানের মতো দেশে পারিবারিক আইন করতে পারতেন না। এই আইনের বিরুদ্ধে তখনো ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছিল, কিন্তু আইয়ুব খান ছিলেন অটল, তাকে টলানো সম্ভব হয়নি। তাই ক্ষমতার মোহ আর জনপ্রিয় হওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা থাকলে বিপ্লবী-সংস্কারে হাত না দেয়াই উত্তম।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫
‘সংস্কার সংস্কার সংস্কার’Ñ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এভাবে তিনবার উচ্চারণ করে সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি সবাইকে সংস্কার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানিয়েছেন, সংস্কার নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা-পর্যালোচনা করতে তিনি বারবার অনুরোধ করেছেন।সংস্কারের তীব্র আকাক্সক্ষা থেকে তিনি চটজলদি অনেকগুলো সংস্কার কমিশনও গঠন করে দিয়েছিলেন। কমিশনগুলো তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে, কয়েকটি কমিশনের সুপারিশের ওপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামতও নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এই মতামতের ভিত্তিতে তৈরি হবে ‘জুলাই চার্টার’, যাতে থাকবে রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষর। কিন্তু এই সব কর্মকা- অবাস্তব ও বাস্তবায়ন অযোগ্য স্বপ্ন। বাম আর ডানের আদর্শের পার্থক্য উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুর দূরত্বের সমান। তাই ‘জুলাই চার্টার’ দিয়ে যে সংস্কার হবে তা হবে খুবই সীমিত, তা দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের উদ্ভব ঠেকানো যাবে না। আমি আমার আগেকার কয়েকটি লেখায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছি যে, রাজনৈতিক দলগুলোর মত, পথ ও আদর্শ ভিন্ন। এই ভিন্ন মত ও আদর্শ দিয়ে ঐকমত্যের চার্টার হবে সীমিত ও সীমাবদ্ধ। কারণ, ‘কেউ ভারতের দালাল, কেউ পাকিস্তানের’। কেউ ত্বড়িৎ নির্বাচন চায়, কেউ নিজের দলকে গুছিয়ে নেয়ার সময় চায়। কেউ চব্বিশের ভক্ত, কেউ একাত্তরের। জাতির এই বিভাজনের অবসায়ন প্রায় অসম্ভব। ড. ইউনূসের পক্ষে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ ছিল। তিনি এক পরিবারের কথা বলেছিলেনও। কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটেননি।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ মোতাবেক দলের মনোনয়ন নিয়ে বিজয়ী কোন সংসদ সদস্য দল থেকে পদত্যাগ করলে, অথবা সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোটদান করলে সংসদে তার আসনটি শূন্য বলে বিবেচিত হবে- এমনতর বাধ্যবাধকতা থাকায় সংসদে দলীয় সাংসদদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে না, দলের তরফ থেকে উপস্থাপিত সব বিলে বাধ্য হয়ে দলীয় সাংসদদের হাত তুলে ভোট দিতে হয়, ভিন্নমত পোষণের কোন সুযোগ থাকে না। তাই সংবিধান থেকে এই অনুচ্ছেদ বাতিলের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই অনুচ্ছেদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সাংসদদের দলের প্রতি শর্তহীন অনুগত রাখা। তবে এর প্রয়োজনও আছে। বাংলাদেশে নীতি-নৈতিকতার যে ধস নেমেছে তার মধ্যে ৭০ অনুচ্ছেদ থাকায় সংসদ সদস্যদের নিয়ে বেচাকেনা সম্ভব হচ্ছে না। তবে শুধু ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করলেই যে স্বাধীন মত প্রকাশের পথ সুগম হবে, তা কিন্তু নয়। কণ্ঠভোটে ‘হ্যাঁ-না’ বলার রীতি বহাল রাখা হলে ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করলেও কোন সংসদ সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোট দিতে সাহস করবে না। এই ক্ষেত্রে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা নেয়া হলে কিছুটা ফলপ্রসূ হতে পারে।
বাংলাদেশে যে তিনটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ছিল সেই তিনটি রাজনৈতিক দল পরিবারতন্ত্রে আবদ্ধ। দলের জ্ঞানী-গুণী-দক্ষ-অভিজ্ঞ নেতার চেয়ে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, জি এম কাদেরের গুরুত্ব অনেক বেশি। দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র না থাকায় কেউ কাউকে মানে না, তাই দলের ভাঙন রোধে শেখ হাসিনাকে বিদেশ থেকে এনে দলের সভাপতি করা হয়, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর গৃহবধূ খালেদা জিয়াকে বিএনপির হাল ধরতে হয়, হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের অবর্তমানে দলের নেতৃত্বে রওশন এরশাদ বা জি এম কাদেরের বাইরে অন্য কাউকে চিন্তাও করা যায় না। দেশের জনগণও এই সব নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ আনুগত্যে বিভোর। দলের শীর্ষ নেতারা দলের জন্য তাদের এই অপরিহার্যতা অনুধাবন করে ফ্যাসিস্ট আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন, তাদের কথাই দলের জন্য অলঙ্ঘনীয় আইন, এই আইন ভঙ্গ করার হিম্মত দলের কোন সদস্যের থাকে না। তাই ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করা হলেও কোন সদস্য দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কথা বলবে না, সংসদে দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট দিলে পরেরবার আর মনোনয়ন পাবে না। দলের কথা না শুনে প্রেসিডেন্ট বি চৌধুরীকেও অপদস্ত হতে হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা শীর্ষ নেতার কথায় উঠবস করে। এই অবস্থায় সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ থাকা, না থাকার মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই।
দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে নাÑ সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশের সঙ্গে বিএনপি ভিন্নমত পোষণ করে বলছে, দুইবার নয়, তিনবার। দুইবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এক টার্ম গ্যাপ দিয়ে তৃতীয়বার একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে। বিএনপি জানে আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে না থাকলে নির্বাচনের মাঠে তারাই চ্যাম্পিয়ন, রাশিয়ার পুতিনের মতো দুইবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট, চতুর্থবার আবার প্রধানমন্ত্রী। বিএনপি চাচ্ছে বর্তমানে প্রচলিত নিয়মানুযায়ী দলের মনোনীত প্রার্থী কন্সটিটিউয়েন্সিতে আসন জিতে সংসদে যাবে, কিন্তু সংস্কার কমিশনসহ জামায়াতে ইসলাম চাচ্ছে সারা দেশে দলের নির্বাচনি প্রতীকে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সংসদে দলের আসন বণ্টন হবে, দল থেকে কোন প্রার্থী নির্বাচনে থাকবে না, জনগণ ভোট দেবে প্রতীকে। নিশ্চিত জয় যেখানে ধরনা দিচ্ছে সেখানে বিএনপি তাদের মত থেকে সরবে বলে মনে হয় না। সংস্কার কমিশনের আরেকটি প্রস্তাব হচ্ছে যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন তিনি তার দলের প্রধান থাকতে পারবেন না। কিন্তু এটি একটি তাৎপর্যহীন প্রস্তাব। আগেই উল্লেখ করেছি যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল চলে দলের শীর্ষ ব্যক্তির একক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে, তাই তিনি যেখানেই থাকুন না কেন তা দেশ বা দল পরিচালনায় গুরুত্বহীন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি বা মধ্যপ্রাচ্যের রাজা-বাদশাহর মতো তার কথায় রাজনীতি ও প্রশাসন চলবে। আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের সব কিছুতেই বলতেন ‘প্রধানমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী’। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও একই পরিভাষা প্রযোজ্য। এরশাদ সাহেব তো ঘোষণা দিয়ে বলতেন, ‘জাতীয় পার্টিতে আমি যা বলব তাই আইন’। দলের শীর্ষ নেতার কর্তৃত্ব দেশবাসী দেখেছে আবদুর রহমান বিশ্বাসের আনুগত্যে। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও খালেদা জিয়া ডাকছেন শুনেই তার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন, প্রটোকল মানার কথা মনে আসেনি। তাই শীর্ষ নেতা ‘প্রধানমন্ত্রী’ থাকবেন, না ‘দলীয় প্রধান’ থাকবেন, না উভয় পদে থাকবেন তা আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ করা অর্থহীন।
সংস্কার কমিশন সংসদের দুটি কক্ষের প্রস্তাব করেছেÑ উচ্চকক্ষ আর নিম্নকক্ষ। এছাড়া সংসদের আসন সংখ্যা বৃদ্ধির প্রস্তাবও করা হয়েছে। স্বৈরাচার ঠেকানোর জন্য উচ্চকক্ষ নাকি অপরিহার্য, কারণ নিম্নকক্ষে পাস হওয়া সব আইন প্রস্তাবে পুনরায় উচ্চকক্ষের অনুমোদন লাগবে। সংস্কার কমিশনের এই উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতভেদ আছে। বিএনপি চাচ্ছে নিম্নকক্ষে আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন করা হবে, কিন্তু অন্যদের প্রস্তাব হচ্ছে এই আসন বণ্টন হবে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে। বিএনপির প্রস্তাব মেনে নিলে নিম্নকক্ষ এবং উচ্চকক্ষ উভয় কক্ষে ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। ফলে উচ্চকক্ষ দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নিম্নকক্ষের আইন প্রণয়নে স্বেচ্ছাচারিতা বাধাগ্রস্ত হবে না। বিএনপির প্রস্তাব মোতাবেক উচ্চকক্ষ গঠিত হলে তা হবে ধনী ও সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের বিনোদনের ক্লাব। অন্যন্য দলের কথা মেনে নিয়ে সংসদ নির্বাচনে দলের মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টন করা হলে বিরোধী দলগুলো উচ্চকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে। কারণ আজ পর্যন্ত কোন একক দল সুষ্ঠু নির্বাচনে ৫০ শতাংশ ভোট পায়নি, কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেয়া বাকি দলগুলোর প্রার্থী ও স্বতন্ত্র সদস্যদের ভোট ৫০ শতাংশের বেশি ছিল। তাই প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হলে উচ্চকক্ষে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রাধান্য থাকবে। এতেও সমস্যা, বিল পাসে স্থবিরতা তৈরি হতে পারে, তখন উচ্চকক্ষের সাংসদ বেচাকেনার সামগ্রী হয়ে উঠতে পারেন।
ঘুষ-দুর্নীতি বিরোধী সংস্কারে হাত দিলে তার বিরুদ্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতো সব প্রতিষ্ঠানে সব দলের সমর্থকদের মধ্য ইস্পাত-কঠিন ঐক্য গড় ওঠবে। শুধু ঐক্য হয়নি ব্যাংকে আমানতকারীদের মধ্যে।নীতি নির্ধারকদের উল্টাপাল্টা কথা দিয়ে ব্যাংকের সংস্কার যেদিন থেকে শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই জনগণ আর তাদের জমা টাকা ফেরত পাচ্ছে না। প্রথমে বলা হলো দেউলিয়াগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে এক টাকাও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেয়া হবে না, কিন্তু পরে ৫২ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হলো। কিন্তু আস্থা নষ্ট হওয়ার কারণে বস্তাভর্তি টাকা দিয়েও এখন আর দেউলিয়া ঠেকানো যাচ্ছে না। ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে এখন আমানতকারীদের চোর-পুলিশ খেলা শুরু হয়েছে, ব্যাংকের ধারেকাছে কোন আমানতকারীকে দেখলেই শাখা ব্যবস্থাপক ভয় পায়, লুকাতে চায়, গেইট বন্ধ করে দেয়। আওয়ামী লীগ আমলে ব্যাংক যখন লুট হয়েছে তখনও এই সমস্যা এত মারাত্মক আকার ধারণ করেনি, সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে সংস্কার শুরু হওয়ার পর থেকে। কিন্তু দেশের অর্থনীতি সুস্থ না হলে শুধু ব্যাংকের চিকিৎসা করে রোগ নিরাময় করা সহজ হবে না।
গণতন্ত্র দিয়ে সংস্কার হয় না, দেশের বেশির ভাগ লোক চিন্তা-চেতনায় পশ্চাৎগামী। যারা যুগের চেয়ে অগ্রগামী চিন্তক ছিলেন তাদের ‘পাগল’ গণ্য করা হয়েছে, বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে, জিহ্বা কেটে দেয়া হয়েছে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, টুকরো টুকরো করে কেটে হিংস্র পশুকে খাওয়ানো হয়েছে। তাই সংস্কারে কর্তৃত্ববাদী হতে হয়, স্বৈরাচার হতে হয়। আইয়ুব খান সামরিক শাসক না হলে পাকিস্তানের মতো দেশে পারিবারিক আইন করতে পারতেন না। এই আইনের বিরুদ্ধে তখনো ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছিল, কিন্তু আইয়ুব খান ছিলেন অটল, তাকে টলানো সম্ভব হয়নি। তাই ক্ষমতার মোহ আর জনপ্রিয় হওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা থাকলে বিপ্লবী-সংস্কারে হাত না দেয়াই উত্তম।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]