alt

উপ-সম্পাদকীয়

পার্বত্য চট্টগ্রাম : প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

উজ্জ্বলেন্দু চাকমা

: শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাংশে, দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাংশে এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি অনন্য ভৌগোলিক অঞ্চল। এটি একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য, অন্যদিকে অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় সমৃদ্ধ। প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, বনজ সম্পদ, পর্যটন এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কর্মক্ষমতাÑএই সবকিছুকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো গেলে এই অঞ্চল জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

এই অঞ্চল পূর্বে ‘কার্পাসমহল’ নামে পরিচিত ছিল। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে এ অঞ্চলকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে একটি পৃথক জেলা ঘোষণা করা হয়। ১৯৩৭ সালে এখানকার প্রশাসনিক দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের হাতে তুলে দেয়া হয়, আর স্থানীয় রাজাদের রাখা হয় উপদেষ্টা হিসেবে। পরে ১৯৮৪ সালে সামরিক শাসক এরশাদের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভাগ করে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নামে তিনটি জেলা গঠন করা হয়। এই তিন জেলায় সমন্বয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তন ১৩,১৮৪ বর্গ কিলোমিটার, যা বাংলাদেশের মোট ভূখ-ের প্রায় এক দশমাংশ।

প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও জনসংখ্যা

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু অঞ্চল। এখানকার ভূমিরূপ, জলবায়ু এবং জীববৈচিত্র্য বাংলাদেশের সমতলভূমির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ অঞ্চলে পাহাড়ি নদী, ঝরনা, গিরিখাত, বনভূমি এবং শস্যভূমি মিলিয়ে এক অনন্য প্রাকৃতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এখানকার আবহাওয়া গরম ও আর্দ্র, তবে উচ্চতায় তার তারতম্য দেখা যায়।

এই অঞ্চলে প্রায় ১২টি জাতিগোষ্ঠীসহ বাঙালি জনগোষ্ঠীর মিলিত বসবাস রয়েছে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, বম, খিয়াং, খুমি, লুসাই, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, লাকেরা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনব্যবস্থা আছে, যা দেশের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে ইতিহাসের নানা পর্বে এই জনগোষ্ঠী উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত থেকেছে এবং এখনো তারা অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার দিক দিয়ে পিছিয়ে।

কৃষি ও জুমচাষ

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য পাহাড়ে চাষাবাদের জন্য একদিকে যেমন সুযোগ সৃষ্টি করে, অন্যদিকে কিছু সীমাবদ্ধতাও তৈরি করে। এখানকার প্রধান কৃষি ব্যবস্থা হলো জুমচাষ, যেখানে পাহাড়ি জমি জ্বালিয়ে চাষযোগ্য করা হয়। এতে দ্রুত ফসল পাওয়া গেলেও বন ধ্বংস এবং মাটির উর্বরতা হ্রাসের ঝুঁকি রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার পরিবার জুমচাষের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।

পার্বত্য অঞ্চলে ধান, ভুট্টা, আদা, হলুদ, আলু, মরিচ, বেগুন, বরবটি, নানা রকম শাকসবজি চাষ হয়। কৃষি সম্প্রসারণের মাধ্যমে এখানকার কৃষিকে আরও আধুনিক করা গেলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।

ফলদ সম্পদের সম্ভাবনা

এই অঞ্চলে আম, লিচু, কমলা, আনারস, ড্রাগন ফল, মাল্টা, কুল, জাম্বুরা, কাজুবাদাম, কফি, সফেদা, জলপাইসহ ৩৮টির বেশি জাতের ফল উৎপাদিত হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পার্বত্য তিন জেলায় ফল উৎপাদন হয় প্রায় ১৯ লাখ টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। তবে এই বিপুল পরিমাণ ফলের একটি অংশ সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়।

এই সমস্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের অভাব, সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থা না থাকা এবং সংরক্ষণ সুবিধার ঘাটতি। সরকারের সহযোগিতায় ফল প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র, শীতলীকরণ সংরক্ষণাগার ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করলে এই সম্পদ দেশীয় অর্থনীতিতে আরও বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।

বনজ সম্পদ ও পরিবেশগত ভারসাম্য

চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেশের বড় বনভূমি অবস্থিত। এই বনে গর্জন, শাল, শিমুল, গামারি, চম্পা, বাঁশ, বেত প্রভৃতি গাছ জন্মে, যা কাঠশিল্প ও নির্মাণ খাতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অতিরিক্ত বন নিধন, কাঠ পাচার, এবং রাবার-সেগুন চাষে বনভূমি হ্রাস পাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য হুমকি।

সেগুন ও রাবার চাষ একদিকে কাঠ ও রাবার উৎপাদনে সহায়ক হলেও অন্যদিকে পরিবেশগত দিক দিয়ে ক্ষতিকর। এসব গাছ প্রচুর পানি শোষণ করে, মাটির আর্দ্রতা কমায় এবং অন্যান্য উদ্ভিদ জন্মানোর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

তুলনামূলকভাবে বাঁশ ও আগর চাষ পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। বাঁশকে প্রাকৃতিক এয়ার কন্ডিশনার বলা হয়, কারণ এটি বায়ু বিশুদ্ধ রাখতে সাহায্য করে এবং নানা পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আগর থেকে তৈরি আতর ও সুগন্ধি তেল আন্তর্জাতিক বাজারে ‘লিকুইড গোল্ড’ নামে পরিচিত এবং উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। এই শিল্পকে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নেয়া হলে বৃহৎ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

পর্যটনশিল্প : সম্ভাবনা ও সতর্কতা

পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যটনের অপার সম্ভাবনার এক উৎস। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়ি সংস্কৃতি, আদিবাসীদের জীবনধারাÑসব মিলিয়ে এটি পর্যটকদের জন্য এক আকর্ষণীয় গন্তব্য। সাজেক, নীলগিরি, নাফাখুম, রিছাং ঝরনা, বগা লেক, কেওক্রাডং, থানচি-লেইখ্যাং লেকসহ বহু স্থান পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হচ্ছে।

তবে পর্যটন উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের ভূমি অধিগ্রহণ, তাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ এবং সংস্কৃতিগত আগ্রাসনের অভিযোগ উদ্বেগজনক। যেমন, রাঙামাটির সাজেকে পর্যটন অবকাঠামো তৈরির সময় বহু পরিবার তাদের বসতভিটা হারিয়েছে। সরকারের উচিত হবে স্থানীয় জনগণের মতামত ও অধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যটন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন ও উন্নয়নের অগ্রগতি

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য শান্তিচুক্তি শান্তি ও উন্নয়নের আশাব্যঞ্জক সূচনা করেছিল। কিন্তু দীর্ঘ ২৮ বছরেও এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধারা বাস্তবায়িত হয়নি। এতে স্থানীয় জনগণের মধ্যে অসন্তোষ, অনাস্থা এবং হতাশা তৈরি হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ, জবাবদিহিতা এবং স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ায় প্রকৃত উন্নয়ন থমকে আছে।

কৌশলগত সুপারিশ

প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি সম্প্রসারণ : পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য উপযোগী ফসল এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলা : ফলদ ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

স্থানীয়দের অংশগ্রহণে পর্যটন উন্নয়ন : পর্যটন পরিকল্পনায় স্থানীয়দের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

পরিবেশ সংরক্ষণে পরিকল্পিত বননীতি : রাবার ও সেগুনের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব গাছ রোপণে উৎসাহ দিতে হবে।

শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন : দীর্ঘ প্রতীক্ষিত চুক্তির ধারাগুলো বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।

অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পপার্ক : পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুললে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বেকারত্ব কমবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ আর শুধু একটি পাহাড়ি অঞ্চল নয়; এটি সম্ভাবনার এক বিস্তৃত ক্ষেত্র। কৃষি, বনজ সম্পদ, পর্যটন, সংস্কৃতি এবং মানবসম্পদÑসবকিছু মিলিয়ে এই অঞ্চল জাতীয় অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। কিন্তু এর জন্য চাই পরিকল্পিত উদ্যোগ, শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে উন্নয়ন নিশ্চিত করা। পাহাড়কে শুধু প্রাকৃতিক সম্পদের আধার নয়, একটি সম্মানজনক, অংশগ্রহণমূলক এবং ন্যায্য উন্নয়নের মডেল হিসেবে গড়ে তোলাই এখন সময়ের দাবি।

[লেখক : সভাপতি, তুরুক্কে লতা মেমোরিয়াল বই’য়ো বাআ (পাঠাগার), রাঙামাটি]

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : বাঙালিকে রুচির দৈন্যে টেনে নামানো হচ্ছে

জনসংখ্যা ও যুবশক্তির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

রাষ্ট্রের কাছে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই

ইউরেশিয়ায় তৃতীয় বিকল্প গালফ কূটনীতি

‘বিপ্লবী সংস্কার’ কি সম্ভব

রম্যগদ্য : ‘ব্যাংক, ব্যাংক নয়’

মবতন্ত্রের জয়

ডিজিটাল ক্লান্তি ও ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ সংস্কৃতির শ্রেণীগত রাজনীতি

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পার্বত্য চট্টগ্রাম : প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

উজ্জ্বলেন্দু চাকমা

শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাংশে, দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাংশে এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি অনন্য ভৌগোলিক অঞ্চল। এটি একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য, অন্যদিকে অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় সমৃদ্ধ। প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, বনজ সম্পদ, পর্যটন এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কর্মক্ষমতাÑএই সবকিছুকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো গেলে এই অঞ্চল জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

এই অঞ্চল পূর্বে ‘কার্পাসমহল’ নামে পরিচিত ছিল। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে এ অঞ্চলকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে একটি পৃথক জেলা ঘোষণা করা হয়। ১৯৩৭ সালে এখানকার প্রশাসনিক দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের হাতে তুলে দেয়া হয়, আর স্থানীয় রাজাদের রাখা হয় উপদেষ্টা হিসেবে। পরে ১৯৮৪ সালে সামরিক শাসক এরশাদের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভাগ করে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নামে তিনটি জেলা গঠন করা হয়। এই তিন জেলায় সমন্বয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তন ১৩,১৮৪ বর্গ কিলোমিটার, যা বাংলাদেশের মোট ভূখ-ের প্রায় এক দশমাংশ।

প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও জনসংখ্যা

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু অঞ্চল। এখানকার ভূমিরূপ, জলবায়ু এবং জীববৈচিত্র্য বাংলাদেশের সমতলভূমির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ অঞ্চলে পাহাড়ি নদী, ঝরনা, গিরিখাত, বনভূমি এবং শস্যভূমি মিলিয়ে এক অনন্য প্রাকৃতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এখানকার আবহাওয়া গরম ও আর্দ্র, তবে উচ্চতায় তার তারতম্য দেখা যায়।

এই অঞ্চলে প্রায় ১২টি জাতিগোষ্ঠীসহ বাঙালি জনগোষ্ঠীর মিলিত বসবাস রয়েছে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, বম, খিয়াং, খুমি, লুসাই, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, লাকেরা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনব্যবস্থা আছে, যা দেশের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে ইতিহাসের নানা পর্বে এই জনগোষ্ঠী উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত থেকেছে এবং এখনো তারা অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার দিক দিয়ে পিছিয়ে।

কৃষি ও জুমচাষ

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য পাহাড়ে চাষাবাদের জন্য একদিকে যেমন সুযোগ সৃষ্টি করে, অন্যদিকে কিছু সীমাবদ্ধতাও তৈরি করে। এখানকার প্রধান কৃষি ব্যবস্থা হলো জুমচাষ, যেখানে পাহাড়ি জমি জ্বালিয়ে চাষযোগ্য করা হয়। এতে দ্রুত ফসল পাওয়া গেলেও বন ধ্বংস এবং মাটির উর্বরতা হ্রাসের ঝুঁকি রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার পরিবার জুমচাষের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।

পার্বত্য অঞ্চলে ধান, ভুট্টা, আদা, হলুদ, আলু, মরিচ, বেগুন, বরবটি, নানা রকম শাকসবজি চাষ হয়। কৃষি সম্প্রসারণের মাধ্যমে এখানকার কৃষিকে আরও আধুনিক করা গেলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।

ফলদ সম্পদের সম্ভাবনা

এই অঞ্চলে আম, লিচু, কমলা, আনারস, ড্রাগন ফল, মাল্টা, কুল, জাম্বুরা, কাজুবাদাম, কফি, সফেদা, জলপাইসহ ৩৮টির বেশি জাতের ফল উৎপাদিত হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পার্বত্য তিন জেলায় ফল উৎপাদন হয় প্রায় ১৯ লাখ টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। তবে এই বিপুল পরিমাণ ফলের একটি অংশ সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়।

এই সমস্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের অভাব, সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থা না থাকা এবং সংরক্ষণ সুবিধার ঘাটতি। সরকারের সহযোগিতায় ফল প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র, শীতলীকরণ সংরক্ষণাগার ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করলে এই সম্পদ দেশীয় অর্থনীতিতে আরও বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।

বনজ সম্পদ ও পরিবেশগত ভারসাম্য

চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেশের বড় বনভূমি অবস্থিত। এই বনে গর্জন, শাল, শিমুল, গামারি, চম্পা, বাঁশ, বেত প্রভৃতি গাছ জন্মে, যা কাঠশিল্প ও নির্মাণ খাতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অতিরিক্ত বন নিধন, কাঠ পাচার, এবং রাবার-সেগুন চাষে বনভূমি হ্রাস পাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য হুমকি।

সেগুন ও রাবার চাষ একদিকে কাঠ ও রাবার উৎপাদনে সহায়ক হলেও অন্যদিকে পরিবেশগত দিক দিয়ে ক্ষতিকর। এসব গাছ প্রচুর পানি শোষণ করে, মাটির আর্দ্রতা কমায় এবং অন্যান্য উদ্ভিদ জন্মানোর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

তুলনামূলকভাবে বাঁশ ও আগর চাষ পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। বাঁশকে প্রাকৃতিক এয়ার কন্ডিশনার বলা হয়, কারণ এটি বায়ু বিশুদ্ধ রাখতে সাহায্য করে এবং নানা পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আগর থেকে তৈরি আতর ও সুগন্ধি তেল আন্তর্জাতিক বাজারে ‘লিকুইড গোল্ড’ নামে পরিচিত এবং উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। এই শিল্পকে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নেয়া হলে বৃহৎ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

পর্যটনশিল্প : সম্ভাবনা ও সতর্কতা

পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যটনের অপার সম্ভাবনার এক উৎস। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়ি সংস্কৃতি, আদিবাসীদের জীবনধারাÑসব মিলিয়ে এটি পর্যটকদের জন্য এক আকর্ষণীয় গন্তব্য। সাজেক, নীলগিরি, নাফাখুম, রিছাং ঝরনা, বগা লেক, কেওক্রাডং, থানচি-লেইখ্যাং লেকসহ বহু স্থান পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হচ্ছে।

তবে পর্যটন উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের ভূমি অধিগ্রহণ, তাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ এবং সংস্কৃতিগত আগ্রাসনের অভিযোগ উদ্বেগজনক। যেমন, রাঙামাটির সাজেকে পর্যটন অবকাঠামো তৈরির সময় বহু পরিবার তাদের বসতভিটা হারিয়েছে। সরকারের উচিত হবে স্থানীয় জনগণের মতামত ও অধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যটন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন ও উন্নয়নের অগ্রগতি

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য শান্তিচুক্তি শান্তি ও উন্নয়নের আশাব্যঞ্জক সূচনা করেছিল। কিন্তু দীর্ঘ ২৮ বছরেও এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধারা বাস্তবায়িত হয়নি। এতে স্থানীয় জনগণের মধ্যে অসন্তোষ, অনাস্থা এবং হতাশা তৈরি হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ, জবাবদিহিতা এবং স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ায় প্রকৃত উন্নয়ন থমকে আছে।

কৌশলগত সুপারিশ

প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি সম্প্রসারণ : পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য উপযোগী ফসল এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলা : ফলদ ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

স্থানীয়দের অংশগ্রহণে পর্যটন উন্নয়ন : পর্যটন পরিকল্পনায় স্থানীয়দের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

পরিবেশ সংরক্ষণে পরিকল্পিত বননীতি : রাবার ও সেগুনের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব গাছ রোপণে উৎসাহ দিতে হবে।

শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন : দীর্ঘ প্রতীক্ষিত চুক্তির ধারাগুলো বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।

অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পপার্ক : পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুললে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বেকারত্ব কমবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ আর শুধু একটি পাহাড়ি অঞ্চল নয়; এটি সম্ভাবনার এক বিস্তৃত ক্ষেত্র। কৃষি, বনজ সম্পদ, পর্যটন, সংস্কৃতি এবং মানবসম্পদÑসবকিছু মিলিয়ে এই অঞ্চল জাতীয় অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। কিন্তু এর জন্য চাই পরিকল্পিত উদ্যোগ, শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে উন্নয়ন নিশ্চিত করা। পাহাড়কে শুধু প্রাকৃতিক সম্পদের আধার নয়, একটি সম্মানজনক, অংশগ্রহণমূলক এবং ন্যায্য উন্নয়নের মডেল হিসেবে গড়ে তোলাই এখন সময়ের দাবি।

[লেখক : সভাপতি, তুরুক্কে লতা মেমোরিয়াল বই’য়ো বাআ (পাঠাগার), রাঙামাটি]

back to top