alt

উপ-সম্পাদকীয়

কোনো শাসকই অপরাজেয় নয়

আনোয়ারুল হক

: রোববার, ২০ জুলাই ২০২৫

কথাটা তো ধ্রুব সত্য। বিরোধী দলে থাকলে সবাই শাসকের দিকে আঙুল তুলে বলে ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। আবার শাসক হলে ভুলে যায়। ভিন্ন দেশের উদাহরণ তো প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো এত জনপ্রিয় কোন নেতা দেখার সুযোগ তো আমাদের হয় নাই। আমাদের গুরুজনদের মধ্যে যারা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছেন তাদের কাছে শুনেছি পূর্ব বাংলা থেকে যারাই প্রেসিডেন্সি কলেজে বা কলকাতায় পড়তে যেতেন তরুণ মুজিব সবার আগে তাদের সামনে হাজির। হোস্টেলের সিট থেকে শুরু করে যে কোনো সমস্যার মুশকিল আসানে শেখ মুজিব। ইদানীং কিছু মতলববাজ ১৯৭১ এর গৌরবজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কৌশলে বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্য দিবানিশি ’৪৭ ’৪৭ জপ করে থাকেন। তাদের সব আয়োজন শেখ মুজিবকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয়ার জন্য। ওরা ’৪৭-এর ইতিহাসও ঠিক মতো জানে না। ’৪৭-এ হক-ভাসানী- সোহরাওয়ার্দীর পাশে মুজিবও ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন।

আবার অনেকে অভিযোগ করেন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ভাঙতে চাননি। যে তরুণ পাকিস্তান তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে, সে চট করে পাকিস্তান ভাঙতে চাইবে কেন? তাহলে পাকিস্তান ভেঙেছে কে? সোজা উত্তর, পাকিস্তানিরাই ভেঙেছে। দেশ ভাগের পর পাকিস্তানিরা যে নয়া ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের শৃঙ্খলে পূর্ব বাংলাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল মুজিব সেই শৃঙ্খল ভাঙার এক সুদীর্ঘ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং পরিণতিতে জনরায় পেয়েছিলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনী রায় পূর্ববঙ্গের মানুষের অবিসংবাদিতা নেতা হিসেবে শেখ মুজিবকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল। আর সেই রায়কে অস্বীকার করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাকিস্তান ভেঙে ফেলাকে অনিবার্য করেছে। আর স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক হিসেবে এক অতুলনীয় জনপ্রিয়তা নিয়ে শেখ মুজিব স্বাধীন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেই শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তাও কিন্তু মাত্র দুই-তিন বছরের মাথায় অনেকটাই কমে গিয়েছিল। সুনির্দিষ্ট ভাবে কতটুকু কমেছিল? তা যাচাই করার সুযোগ পাওয়া যায়নি। যাচাইয়ের রাস্তা মুজিবই বন্ধ করে দিয়েছিলেন একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হয়ে। তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশ ওই সময়টাতে প্রগতিমুখীন অগ্রযাত্রাকে নিশ্চিত করার জন্য এ ধরনের পথে অগ্রসর হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কোন দেশের জন্যই তা ভালো ফল বয়ে আনেনি। বাংলাদেশের জন্যও নয়। বাংগালির অবিসংবাদিত নেতাকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বলি হতে হলো। ইতিহাসের নৃশংসতম এক হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে তিনি সপরিবারে নিহত হলেন।

স্বল্প সময়ে নানা রক্তাক্ত পালাবদলের মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হন। ’৭১-এর মার্চেই চট্টগ্রাম থেকে তার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্প্রচার করায় এবং মুক্তিবাহিনীর প্রথম নিয়মিত সশস্ত্র ব্রিগেড জেড ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে জেনারেল জিয়া দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় রাজনীতির ধারা ফিরিয়ে আনায় প্রশংসিত হলেও তিনি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসন কাঠামো ও সামরিক শাসন অব্যাহত রেখে সকল ক্ষমতা তার হাতে কেন্দ্রীভূত করেন। রাজনৈতিক ভারসাম্য অনুকূলে আনতে তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার সুযোগ করে দেন। এই সুযোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী দল ও শক্তিসমূহ রাজনীতির মাঠে নামে। অবশ্য এ বিষয়ে জিয়ার প্রকাশ্য দৃষ্টিভঙ্গি ছিলÑ “ধর্মের অবদান থাকতে পারে রাজনীতিতে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ধর্মকে কেন্দ্র করে হতে পারে না”। অপ্রকাশ্যে অন্য কিছু ছিল কিনা জানা নাই।

একটি সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে জেনারেল জিয়া প্রায় সাড়ে তিন বছর সামরিক শাসনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করেন। সামরিক শাসন বহাল রেখে এবং সেনাপ্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকা অবস্থায় গনভোট অনুষ্ঠান ও রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন এবং রাজনৈতিক দল গঠন করায় তিনি সমালোচিত হন। তবে তিনি তার গঠিত দলকে একটি রাজনৈতিক ভিত্তি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ওই সময়ে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে এক বৈরী পরিস্থিতিতে এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। অভিযোগ আছে ১৯৭৯ এর সাধারণ নির্বাচন নানা সংস্থার পরিকল্পনা ও ছকে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে কিছুটা প্রভাবমুক্ত নির্বাচন হলেও আসন সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা ছাড়া সামরিক শাসকের সমর্থনপুষ্ট দলকে পরাজিত করার মত বাস্তবতা ছিলো না বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। কিন্তু রাজনীতিতে ও ক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর আধিপত্যের পরিণতিতে বাহিনীর কোন্দলের শিকার হন জেনারেল জিয়া। চট্টগ্রাম সফরকালে সামরিক বাহিনীর একাংশের ষড়যন্ত্রে তিনি নিহত হন।

স্বাধীনতার ১০ বছর পার হয়ে গেলেও তখন পর্যন্ত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের ধারা দেশে প্রতিষ্ঠিত হলো না। এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন জেনারেল এরশাদ। দীর্ঘ সময় সামরিক শাসনের মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে বিরোধী শিবিরে ভাঙন সৃষ্টির সুযোগ নিয়ে ‘মিডিয়া ক্যু’ হিসাবে কথিত একটি নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা করে তিনি একটানা নয় বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে অবশেষে এক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন। তার আগে বিগত বিশ বছরে সরকার পরিবর্তন হয়েছে ষড়যন্ত্রমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই প্রথম জনআকাক্সক্ষার ভিত্তিতে সরকারের পরিবর্তন হয়।

দেশে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করে। আসন সংখ্যা লাভে বড় পার্থক্য থাকলেও দুই প্রধান দলের ভোট প্রাপ্তির হার ছিল প্রায় সমান। বিএনপি ৩০.৮১ % এবং আওয়ামী লীগ ৩০.০৮ % ভোট পায়। এবং তখন থেকেই রাজনীতিতে এবং সংসদে দ্বিদলীয় রাজনীতির ধারা একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের ন্যায় ১৯৯৬ সনের নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করার জন্য আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধনের দাবি উত্থাপন করে। কিন্তু বিএনপি শেষ পর্যন্ত এ দাবি না মানতে অনড় থাকায় আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় রাজপথের আন্দোলন করে দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করে। স্বল্প মেয়াদের জন্য একটি একতরফা নির্বাচন ও পার্লামেন্ট গঠন করে সংবিধানে সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪% ও বিএনপি ৩৩.৬% ভোট পায় এবং আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি ও জাসদ(রব)-এর সমর্থনে সরকার গঠন করে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন করার সুযোগ না দিয়ে নিজ উদ্যোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কায়েম করলে বিএনপিকে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে হারানো কঠিন হতো। যাহোক বিএনপিকে মসনদ ছাড়তে হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১-এর নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে। তখনও জয়নাল হাজারী, শামীম ওসমানরা তাদের বাহাদুরি নিয়ে ছিলেন, তখনও আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে দরবেশ ছিলেন; তারপরেও আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়নি। ২০০১ এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪০.১৩% ভোট পেয়েও আসন পায় মাত্র ৬২টি। আওয়ামী লীগ অপেক্ষা মাত্র ০০.৮৪% ভোট বেশি পেয়ে অর্থাৎ ৪০.৯৭% ভোট পেয়ে বিএনপি আসন পায় ১৯৩টি। বিএনপি সরকার গঠন করে এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়ে ইতিহাসের চাকাকে পেছনে ঠেলে দেয়। নির্বাচনী ফলাফল বের হওয়ার রাত থেকেই দেশের বেশ কিছু এলাকায় বিএনপি ও জামায়াত দলীয় লোকজন আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, নির্যাতন শুরু করে এবং শুরুতেই দুই দল মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়।

বিএনপির এই দ্বিতীয় দফা শাসনকালে দেশের বুকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদের তৎপরতা বেড়ে যায়। বাংলা ভাইয়ের উত্থান, একযোগে দেশের শতাধিক স্থানে বোমা হামলা, সিনেমা হলে গ্রেনেড হামলা এবং একের পর এক হত্যাকা-Ñ শাহ্ এএমএস কিবরিয়া ও আহসানুল্লাহ মাস্টার হত্যাকা-, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ও অধ্যাপক ইউনুস হত্যাকা- জনমনে গভীর শঙ্কা সৃষ্টি করে। বিশেষত ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে তার জনসভায় মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ২৪ জনকে হত্যা ও ৩০০ জনের অধিককে আহত করার ঘটনা নজিরবিহীন। এ ঘটনার পরে শাসকদলের পরিহাসপূর্ণ কথাবার্তা এবং এর বিচার নিয়ে নানা হাস্যকর নাটক বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গভীর ও

দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে এই আমলে হাওয়া ভবন কেন্দ্রিক সমান্তরাল ক্ষমতা বলয় সৃষ্টির ফলে তার নেতিবাচক প্রভাবও রাজনীতি ও সমাজে নানা অস্থিরতার সৃষ্টি করে। বিএনপির জনসমর্থন হ্রাস পায়।

এমনিতেই ১৯৯১-এর পর থেকে দ্বিদলীয় মেরুকরণে প্রতি নির্বাচনেই ক্ষমতার হাত বদলের ধারা পরিলক্ষিত হয়। এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুবিধা ‘বাই ডিফল্ট’ বিরোধী দল পায়। সেটা বিবেচনায় নিয়ে ২০০৬ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনের সময় সুবিধা আদায়ের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে পছন্দের প্রধান বিচারপতিকে মনোনীত করার উদ্দেশে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রধান বিচারপতির অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে দিয়ে দেশের বুকে এক জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন এবং কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেন।

এরপরে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের আন্দোলনসহ নানা ঘটনাবলি ও সংঘাতময় এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নানা পালাবদলের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবরনে যে সরকার আসীন হয় সেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সেনাবাহিনী। সেনাসমর্থিত সরকার হিসেবে বা সংক্ষেপে ১/১১-র সরকার নামে তা পরিচিতি অর্জন করে। তৎকালীন সামরিক নেতৃত্ব উগ্রকতৃত্ববাদী মনোভাব নিয়ে রাজনৈতিক সংস্কারের নামে রাজনৈতিক নেতাদের ওপর, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের ওপর ঢালাওভাবে চড়াও হয়। রাজনৈতিক সংস্কারের সে উদ্যোগকে নাগরিক সমাজের অনেকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন করলেও মাইনাস টু ফর্মুলা হিসেবে খ্যাত বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংস্কার উদ্যোগ কার্যত ব্যর্থ হয়। ওই সময়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠন করার প্রচেষ্টা নিয়ে ব্যর্থ হন।

সেনাসমর্থিত সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় এসে নির্বাচন করে বিদায় হয়। আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে বিজয়ী হলেও নানা রাজনৈতিক সমীকরণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার অনেকটাই ১/১১-র সরকারের বর্ধিত সংস্করণে পরিণত হয়। ফলে ১৯৯১ থেকে দ্বিদলীয় মেরুকরণে প্রধান দুই দল পালাক্রমে সরকার পরিচালনার সময়ে সীমিত অর্থে যতটুকু গণতান্ত্রিক পরিসর ছিল তা-ও ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে থাকে। নির্বাচনে দলীয় সুবিধা পেতে জনমতকে উপেক্ষা করে শুধু পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করেন। এবং পর পর তিনটি একতরফা নির্বাচন করে বিরোধী দলকে ক্ষমতার বাইরে রাখাটা নিশ্চিত করেন। দীর্ঘ সময় জোর করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার পরিণতি আজ তারা ভালোভাবেই টের পাচ্ছেন। জুলাই হত্যাকা-ের কুশীলবদের শুধু বিচারের মুখোমুখিই হতে হবে না, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ সময় এক অনিশ্চয়তার গিরিখাতে ধুঁকতে হবে।

শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাতে জুলাই অভ্যুত্থান সফল হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন এক সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থা ও ধর্মাশ্রয়ী ধারা এক উগ্রমূর্তি নিয়ে উপস্থিত হয়। ড. ইউনুসের সহযোগিতায় এবং পশ্চিমা দুনিয়ার কিছু শক্তির সমর্থনে অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের বড় অংশসহ তরুণদের একটি রাজনৈতিক দলও আত্মপ্রকাশ করে। মধ্যমপন্থার রাজনীতি করার ঘোষণা দিলেও এবং দলের নেতৃত্বে আধুনিকমনস্ক কিছু তরুণ-তরুণী থাকলেও তারা ঝুঁকে পড়ছেন ডানপন্থার দিকেই। ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গেই এখন পর্যন্ত তাদের সখ্যতা। এবারের গণঅভ্যুত্থান যেহেতু মূলত শহরকেন্দ্রিক ছিল তাই শহরকেন্দ্রিক তরুণদের মধ্যে তাদের ভালো প্রভাব আছে। আবার গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসা ছাত্ররা যখন গ্রামে পরিবারের কাছে যাচ্ছে তাদের চিন্তা-ভাবনা গ্রামীণ সমাজে অল্প বিস্তর প্রভাব ফেলছে। তবে দলটি নানা ইস্যুতে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে, নেতাদের কারো কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। দ্বিদলীয় রাজনীতির যে ধারা দীর্ঘ সময় যাবত গড়ে উঠছিল তা এখনো অনেকটাই অটুট। এর মধ্যে একটি রাজনৈতিক দল গ্রামে প্রকাশ্যে বা আধা প্রকাশ্যে এবং শহরে আছে গোপনে বা একেবারে নিশ্চুপ।

জামায়াত ইসলামের সংগঠনগতভাবে একটা উত্থান হয়েছে। জামায়াত সংগঠনগতভাবে ও দলীয় আর্থিক সক্ষমতায় সবসময় সুসংগঠিত ছিল। দীর্ঘ সময় বেআইনি বা আধা বেআইনি অবস্থায় থাকার পরেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তারা যে সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে আর কখনই তারা তা পায়নি। এমনকি জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার আমলেও তাদেরকে সরকারের সঙ্গে একধরনের সমঝোতার মধ্য দিয়ে চলতে হতো। বাংলাদেশের জন্ম যুদ্ধের বিরোধিতা করায় তাদের মাথানত করেই থাকতে হতো। বাড়াবাড়ি করলেই সেই জিয়ার আমল থেকে সব আমলেই সরকার সরাসরি কোনো ব্যবস্থা না নিলেও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রতিবাদে রাজপথে নেমে তাদের কণ্ঠস্বরকে নামিয়ে দিত। বর্তমান সরকার তাদের ‘কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’ পরিস্থিতির সুযোগ করে দেয়ায় ঝাঁকুনি দিয়ে কোমল পানীয়ের বোতল খুললে যেভাবে ফস করে উঠে এবং ফেনাসহ পানীয় উপচে পড়ে বর্তমানে জামায়াত সে ধরনের উচ্ছ্বাসে উপচে পড়ছে, যা আবার একটা পর্যায়ে ওই পানীয়র বোতলের ফেনার ন্যায় মিলিয়ে যাবে। শুধু ’৭১ এর ভূমিকার জন্য নয়, এ দেশের সাধারণ মানুষ এমনকি ধর্মভীরু মানুষও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকে বা রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনা খুব একটা পছন্দ করে না।

এ ধরনের এক রাজনৈতিক বিন্যাসে কেউ পছন্দ করুক আর না করুক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন নির্বাচন হলে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত। যদিও ইতোমধ্যে দখলদারিত্ব চাঁদাবাজি আর খুনোখুনির কারণে বিএনপি নিন্দিত হচ্ছে কিন্তু এর চেয়ে ভালো বিকল্প না পেলে মানুষেরই বা কী করার আছে। শেখ হাসিনা বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে ফন্দি ফিকিরের নির্বাচন করেছেন। এখন আবার ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো এবং নতুন দল বিএনপি ঠেকাও নীতি নিয়ে নানা কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। সরকার ও সরকার-সমর্থক দলগুলোর পক্ষ থেকে তাদের মতো করে সংস্কার অনেকটা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন কথিত জুলাই সনদ নিয়ে আবার মব সৃষ্টির প্রচেষ্টা নেয়া হতে পারে।

বহুপক্ষের অংশগ্রহণে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন সেখানে জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে চাইলে বিভাজন আরো বাড়বে। গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ দেখে না বোঝার কোনো কারণ নেই যে, কঠিন এক সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ এবং পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ শূন্য রাজনীতির মাঠেও অপরাপর রাজনৈতিক শক্তি একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে লড়াইয়ে নেমে পড়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার নীরবতায় মনে হচ্ছে সরকারি ছত্রছায়ায় কোনো কোনো মহল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই হাঁটছেন বিভাজনের পথে। তাদের হাঁকডাক দেখে মনে হচ্ছে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা হচ্ছে যাতে করে ব্যালটের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সুযোগ বন্ধ করে দেয়া যায়।

প্রধান উপদেষ্টা বারংবার বলেছেন সংক্ষিপ্ত সংস্কার হলে ডিসেম্বরের মধ্যে আর বড় পরিসরে সংস্কার হলে জুন ’২৫-এর মধ্যে নির্বাচন হবে। ডিসেম্বর বাদ দিয়ে ফেব্রুয়ারির ফাঁদে পা দিয়ে বিএনপি কি ‘ধরা’ খেলো। প্রধান উপদেষ্টা জুন বাদ দিয়ে ফেব্রুয়ারিতে রাজি হওয়া মানে তো এক অর্থে সংক্ষিপ্ত সংস্কারের মাধ্যমেই নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় যেয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ বেছে নেয়া। কিন্তু বিষয়টি তিনি ঝুলিয়ে রেখে এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে দেশকে ঠেলে দিচ্ছেন। সংক্ষিপ্ত সংস্কার করে নির্বাচনে যাওয়া মানে এই নয় যে বড় সংস্কারের প্যাকেজের সবকিছুই নাকচ করে দেয়া হলো। এসব প্রস্তাব রাজনীতির মাঠে থাকবে। গণতন্ত্রে উত্তরণ পর্ব সফল হলে ভবিষ্যতে অনেক বিষয়ই হয়তোবা বিবেচনায় নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার কিছু পদক্ষেপকে অনেক রাজনৈতিক দল সন্দেহের চোখে দেখছে। যেমন প্রধান বিচারপতি এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে প্রধান উপদেষ্টার আনুষ্ঠানিক বৈঠক। নির্বাহী বিভাগের প্রধানের সাথে এই দুই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানের আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ বা বৈঠক বিরল ঘটনা। জনমনেও সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক যে, নির্বাহী বিভাগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নির্বাচন বা বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা হবে কিনা। উপরন্তু এ প্রশ্ন ইতোমধ্যে উঠেছে যে, নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অর্থাৎ উপদেষ্টা পরিষদে যেহেতু এনসিপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং এনসিপি গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত দুইজন উপদেষ্টা আছেন এবং প্রধান উপদেষ্টাও দল গঠনে তাদের উৎসাহ জুুগিয়েছেন তাই অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন, বিচার,সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে কতা নিরপেক্ষ থাকতে পারবে। সব মিলিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের যে আকাক্সক্ষা নিয়ে গণঅভ্যুত্থান হলো মানুষ তার উল্টো স্রোত দেখতে পাচ্ছে।

ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা নিয়েও কথা উঠেছে। দেশ কিন্তু আসলেই ভালোভাবে চলছে না। অনির্বাচিত সরকার যত প্রলম্বিত হবে তত সংকট ঘনীভূত হবে। নির্বাচিত সরকারের মধ্যে অন্তত আইন শৃঙ্খলা এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটা অন্তর্নিহিত শক্তি থাকে। তাই বর্তমান অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা থেকে বেরিয়ে আসতে ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার’ করে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই। মনে রাখা প্রয়োজন এ পর্যন্ত বাংলাদেশে একমাত্র নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বা শাসক পরিবর্তন শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। এর বাইরে হয় দেশি-বিদেশি চক্রান্তে হত্যা ও জিঘাংসার মাধ্যমে অথবা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শাসক পরিবর্তন হয়েছে। নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া ভিন্ন পথে হেঁটে সম্মানজনক বিদায় কারো হয়নি। দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়ে আসা এক এগারোর সরকারকে তো নির্বাচন দিয়েও শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে ভাগতে হয়েছে।

ইতিহাস বলছে কোনো ক্ষমতাই অপ্রতিদ্বন্দ্বী নয় এবং কোনো শাসকই অপরাজেয় নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব নোবেলজয়ী এই প্রবীণ মানুষটির এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধি কয়েকজন সম্মানিত উপদেষ্টার শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক প্রস্থানের জন্যও দ্রুত অতিদ্রুত জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ করে দেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। এই সত্যটি সম্মানিত উপদেষ্টা পরিষদ যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন তত সবার জন্য মঙ্গল।

[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]

পিরোজপুরের স্কুলটির ফলাফল বিপর্যয় এবং আচরণগত অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : বাঙালিকে রুচির দৈন্যে টেনে নামানো হচ্ছে

জনসংখ্যা ও যুবশক্তির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

রাষ্ট্রের কাছে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই

পার্বত্য চট্টগ্রাম : প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ইউরেশিয়ায় তৃতীয় বিকল্প গালফ কূটনীতি

‘বিপ্লবী সংস্কার’ কি সম্ভব

রম্যগদ্য : ‘ব্যাংক, ব্যাংক নয়’

মবতন্ত্রের জয়

ডিজিটাল ক্লান্তি ও ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ সংস্কৃতির শ্রেণীগত রাজনীতি

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কোনো শাসকই অপরাজেয় নয়

আনোয়ারুল হক

রোববার, ২০ জুলাই ২০২৫

কথাটা তো ধ্রুব সত্য। বিরোধী দলে থাকলে সবাই শাসকের দিকে আঙুল তুলে বলে ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। আবার শাসক হলে ভুলে যায়। ভিন্ন দেশের উদাহরণ তো প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো এত জনপ্রিয় কোন নেতা দেখার সুযোগ তো আমাদের হয় নাই। আমাদের গুরুজনদের মধ্যে যারা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছেন তাদের কাছে শুনেছি পূর্ব বাংলা থেকে যারাই প্রেসিডেন্সি কলেজে বা কলকাতায় পড়তে যেতেন তরুণ মুজিব সবার আগে তাদের সামনে হাজির। হোস্টেলের সিট থেকে শুরু করে যে কোনো সমস্যার মুশকিল আসানে শেখ মুজিব। ইদানীং কিছু মতলববাজ ১৯৭১ এর গৌরবজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কৌশলে বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্য দিবানিশি ’৪৭ ’৪৭ জপ করে থাকেন। তাদের সব আয়োজন শেখ মুজিবকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয়ার জন্য। ওরা ’৪৭-এর ইতিহাসও ঠিক মতো জানে না। ’৪৭-এ হক-ভাসানী- সোহরাওয়ার্দীর পাশে মুজিবও ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন।

আবার অনেকে অভিযোগ করেন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ভাঙতে চাননি। যে তরুণ পাকিস্তান তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে, সে চট করে পাকিস্তান ভাঙতে চাইবে কেন? তাহলে পাকিস্তান ভেঙেছে কে? সোজা উত্তর, পাকিস্তানিরাই ভেঙেছে। দেশ ভাগের পর পাকিস্তানিরা যে নয়া ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের শৃঙ্খলে পূর্ব বাংলাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল মুজিব সেই শৃঙ্খল ভাঙার এক সুদীর্ঘ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং পরিণতিতে জনরায় পেয়েছিলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনী রায় পূর্ববঙ্গের মানুষের অবিসংবাদিতা নেতা হিসেবে শেখ মুজিবকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল। আর সেই রায়কে অস্বীকার করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাকিস্তান ভেঙে ফেলাকে অনিবার্য করেছে। আর স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক হিসেবে এক অতুলনীয় জনপ্রিয়তা নিয়ে শেখ মুজিব স্বাধীন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেই শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তাও কিন্তু মাত্র দুই-তিন বছরের মাথায় অনেকটাই কমে গিয়েছিল। সুনির্দিষ্ট ভাবে কতটুকু কমেছিল? তা যাচাই করার সুযোগ পাওয়া যায়নি। যাচাইয়ের রাস্তা মুজিবই বন্ধ করে দিয়েছিলেন একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হয়ে। তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশ ওই সময়টাতে প্রগতিমুখীন অগ্রযাত্রাকে নিশ্চিত করার জন্য এ ধরনের পথে অগ্রসর হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কোন দেশের জন্যই তা ভালো ফল বয়ে আনেনি। বাংলাদেশের জন্যও নয়। বাংগালির অবিসংবাদিত নেতাকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বলি হতে হলো। ইতিহাসের নৃশংসতম এক হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে তিনি সপরিবারে নিহত হলেন।

স্বল্প সময়ে নানা রক্তাক্ত পালাবদলের মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হন। ’৭১-এর মার্চেই চট্টগ্রাম থেকে তার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্প্রচার করায় এবং মুক্তিবাহিনীর প্রথম নিয়মিত সশস্ত্র ব্রিগেড জেড ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে জেনারেল জিয়া দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় রাজনীতির ধারা ফিরিয়ে আনায় প্রশংসিত হলেও তিনি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসন কাঠামো ও সামরিক শাসন অব্যাহত রেখে সকল ক্ষমতা তার হাতে কেন্দ্রীভূত করেন। রাজনৈতিক ভারসাম্য অনুকূলে আনতে তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার সুযোগ করে দেন। এই সুযোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী দল ও শক্তিসমূহ রাজনীতির মাঠে নামে। অবশ্য এ বিষয়ে জিয়ার প্রকাশ্য দৃষ্টিভঙ্গি ছিলÑ “ধর্মের অবদান থাকতে পারে রাজনীতিতে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ধর্মকে কেন্দ্র করে হতে পারে না”। অপ্রকাশ্যে অন্য কিছু ছিল কিনা জানা নাই।

একটি সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে জেনারেল জিয়া প্রায় সাড়ে তিন বছর সামরিক শাসনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করেন। সামরিক শাসন বহাল রেখে এবং সেনাপ্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকা অবস্থায় গনভোট অনুষ্ঠান ও রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন এবং রাজনৈতিক দল গঠন করায় তিনি সমালোচিত হন। তবে তিনি তার গঠিত দলকে একটি রাজনৈতিক ভিত্তি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ওই সময়ে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে এক বৈরী পরিস্থিতিতে এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। অভিযোগ আছে ১৯৭৯ এর সাধারণ নির্বাচন নানা সংস্থার পরিকল্পনা ও ছকে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে কিছুটা প্রভাবমুক্ত নির্বাচন হলেও আসন সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা ছাড়া সামরিক শাসকের সমর্থনপুষ্ট দলকে পরাজিত করার মত বাস্তবতা ছিলো না বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। কিন্তু রাজনীতিতে ও ক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর আধিপত্যের পরিণতিতে বাহিনীর কোন্দলের শিকার হন জেনারেল জিয়া। চট্টগ্রাম সফরকালে সামরিক বাহিনীর একাংশের ষড়যন্ত্রে তিনি নিহত হন।

স্বাধীনতার ১০ বছর পার হয়ে গেলেও তখন পর্যন্ত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের ধারা দেশে প্রতিষ্ঠিত হলো না। এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন জেনারেল এরশাদ। দীর্ঘ সময় সামরিক শাসনের মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে বিরোধী শিবিরে ভাঙন সৃষ্টির সুযোগ নিয়ে ‘মিডিয়া ক্যু’ হিসাবে কথিত একটি নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা করে তিনি একটানা নয় বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে অবশেষে এক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন। তার আগে বিগত বিশ বছরে সরকার পরিবর্তন হয়েছে ষড়যন্ত্রমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই প্রথম জনআকাক্সক্ষার ভিত্তিতে সরকারের পরিবর্তন হয়।

দেশে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করে। আসন সংখ্যা লাভে বড় পার্থক্য থাকলেও দুই প্রধান দলের ভোট প্রাপ্তির হার ছিল প্রায় সমান। বিএনপি ৩০.৮১ % এবং আওয়ামী লীগ ৩০.০৮ % ভোট পায়। এবং তখন থেকেই রাজনীতিতে এবং সংসদে দ্বিদলীয় রাজনীতির ধারা একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের ন্যায় ১৯৯৬ সনের নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করার জন্য আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধনের দাবি উত্থাপন করে। কিন্তু বিএনপি শেষ পর্যন্ত এ দাবি না মানতে অনড় থাকায় আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় রাজপথের আন্দোলন করে দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করে। স্বল্প মেয়াদের জন্য একটি একতরফা নির্বাচন ও পার্লামেন্ট গঠন করে সংবিধানে সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪% ও বিএনপি ৩৩.৬% ভোট পায় এবং আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি ও জাসদ(রব)-এর সমর্থনে সরকার গঠন করে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন করার সুযোগ না দিয়ে নিজ উদ্যোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কায়েম করলে বিএনপিকে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে হারানো কঠিন হতো। যাহোক বিএনপিকে মসনদ ছাড়তে হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১-এর নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে। তখনও জয়নাল হাজারী, শামীম ওসমানরা তাদের বাহাদুরি নিয়ে ছিলেন, তখনও আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে দরবেশ ছিলেন; তারপরেও আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়নি। ২০০১ এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪০.১৩% ভোট পেয়েও আসন পায় মাত্র ৬২টি। আওয়ামী লীগ অপেক্ষা মাত্র ০০.৮৪% ভোট বেশি পেয়ে অর্থাৎ ৪০.৯৭% ভোট পেয়ে বিএনপি আসন পায় ১৯৩টি। বিএনপি সরকার গঠন করে এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়ে ইতিহাসের চাকাকে পেছনে ঠেলে দেয়। নির্বাচনী ফলাফল বের হওয়ার রাত থেকেই দেশের বেশ কিছু এলাকায় বিএনপি ও জামায়াত দলীয় লোকজন আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, নির্যাতন শুরু করে এবং শুরুতেই দুই দল মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়।

বিএনপির এই দ্বিতীয় দফা শাসনকালে দেশের বুকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদের তৎপরতা বেড়ে যায়। বাংলা ভাইয়ের উত্থান, একযোগে দেশের শতাধিক স্থানে বোমা হামলা, সিনেমা হলে গ্রেনেড হামলা এবং একের পর এক হত্যাকা-Ñ শাহ্ এএমএস কিবরিয়া ও আহসানুল্লাহ মাস্টার হত্যাকা-, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ও অধ্যাপক ইউনুস হত্যাকা- জনমনে গভীর শঙ্কা সৃষ্টি করে। বিশেষত ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে তার জনসভায় মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ২৪ জনকে হত্যা ও ৩০০ জনের অধিককে আহত করার ঘটনা নজিরবিহীন। এ ঘটনার পরে শাসকদলের পরিহাসপূর্ণ কথাবার্তা এবং এর বিচার নিয়ে নানা হাস্যকর নাটক বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গভীর ও

দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে এই আমলে হাওয়া ভবন কেন্দ্রিক সমান্তরাল ক্ষমতা বলয় সৃষ্টির ফলে তার নেতিবাচক প্রভাবও রাজনীতি ও সমাজে নানা অস্থিরতার সৃষ্টি করে। বিএনপির জনসমর্থন হ্রাস পায়।

এমনিতেই ১৯৯১-এর পর থেকে দ্বিদলীয় মেরুকরণে প্রতি নির্বাচনেই ক্ষমতার হাত বদলের ধারা পরিলক্ষিত হয়। এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুবিধা ‘বাই ডিফল্ট’ বিরোধী দল পায়। সেটা বিবেচনায় নিয়ে ২০০৬ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনের সময় সুবিধা আদায়ের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে পছন্দের প্রধান বিচারপতিকে মনোনীত করার উদ্দেশে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রধান বিচারপতির অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে দিয়ে দেশের বুকে এক জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন এবং কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেন।

এরপরে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের আন্দোলনসহ নানা ঘটনাবলি ও সংঘাতময় এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নানা পালাবদলের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবরনে যে সরকার আসীন হয় সেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সেনাবাহিনী। সেনাসমর্থিত সরকার হিসেবে বা সংক্ষেপে ১/১১-র সরকার নামে তা পরিচিতি অর্জন করে। তৎকালীন সামরিক নেতৃত্ব উগ্রকতৃত্ববাদী মনোভাব নিয়ে রাজনৈতিক সংস্কারের নামে রাজনৈতিক নেতাদের ওপর, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের ওপর ঢালাওভাবে চড়াও হয়। রাজনৈতিক সংস্কারের সে উদ্যোগকে নাগরিক সমাজের অনেকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন করলেও মাইনাস টু ফর্মুলা হিসেবে খ্যাত বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংস্কার উদ্যোগ কার্যত ব্যর্থ হয়। ওই সময়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠন করার প্রচেষ্টা নিয়ে ব্যর্থ হন।

সেনাসমর্থিত সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় এসে নির্বাচন করে বিদায় হয়। আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে বিজয়ী হলেও নানা রাজনৈতিক সমীকরণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার অনেকটাই ১/১১-র সরকারের বর্ধিত সংস্করণে পরিণত হয়। ফলে ১৯৯১ থেকে দ্বিদলীয় মেরুকরণে প্রধান দুই দল পালাক্রমে সরকার পরিচালনার সময়ে সীমিত অর্থে যতটুকু গণতান্ত্রিক পরিসর ছিল তা-ও ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে থাকে। নির্বাচনে দলীয় সুবিধা পেতে জনমতকে উপেক্ষা করে শুধু পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করেন। এবং পর পর তিনটি একতরফা নির্বাচন করে বিরোধী দলকে ক্ষমতার বাইরে রাখাটা নিশ্চিত করেন। দীর্ঘ সময় জোর করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার পরিণতি আজ তারা ভালোভাবেই টের পাচ্ছেন। জুলাই হত্যাকা-ের কুশীলবদের শুধু বিচারের মুখোমুখিই হতে হবে না, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ সময় এক অনিশ্চয়তার গিরিখাতে ধুঁকতে হবে।

শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাতে জুলাই অভ্যুত্থান সফল হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন এক সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থা ও ধর্মাশ্রয়ী ধারা এক উগ্রমূর্তি নিয়ে উপস্থিত হয়। ড. ইউনুসের সহযোগিতায় এবং পশ্চিমা দুনিয়ার কিছু শক্তির সমর্থনে অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের বড় অংশসহ তরুণদের একটি রাজনৈতিক দলও আত্মপ্রকাশ করে। মধ্যমপন্থার রাজনীতি করার ঘোষণা দিলেও এবং দলের নেতৃত্বে আধুনিকমনস্ক কিছু তরুণ-তরুণী থাকলেও তারা ঝুঁকে পড়ছেন ডানপন্থার দিকেই। ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গেই এখন পর্যন্ত তাদের সখ্যতা। এবারের গণঅভ্যুত্থান যেহেতু মূলত শহরকেন্দ্রিক ছিল তাই শহরকেন্দ্রিক তরুণদের মধ্যে তাদের ভালো প্রভাব আছে। আবার গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসা ছাত্ররা যখন গ্রামে পরিবারের কাছে যাচ্ছে তাদের চিন্তা-ভাবনা গ্রামীণ সমাজে অল্প বিস্তর প্রভাব ফেলছে। তবে দলটি নানা ইস্যুতে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে, নেতাদের কারো কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। দ্বিদলীয় রাজনীতির যে ধারা দীর্ঘ সময় যাবত গড়ে উঠছিল তা এখনো অনেকটাই অটুট। এর মধ্যে একটি রাজনৈতিক দল গ্রামে প্রকাশ্যে বা আধা প্রকাশ্যে এবং শহরে আছে গোপনে বা একেবারে নিশ্চুপ।

জামায়াত ইসলামের সংগঠনগতভাবে একটা উত্থান হয়েছে। জামায়াত সংগঠনগতভাবে ও দলীয় আর্থিক সক্ষমতায় সবসময় সুসংগঠিত ছিল। দীর্ঘ সময় বেআইনি বা আধা বেআইনি অবস্থায় থাকার পরেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তারা যে সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে আর কখনই তারা তা পায়নি। এমনকি জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার আমলেও তাদেরকে সরকারের সঙ্গে একধরনের সমঝোতার মধ্য দিয়ে চলতে হতো। বাংলাদেশের জন্ম যুদ্ধের বিরোধিতা করায় তাদের মাথানত করেই থাকতে হতো। বাড়াবাড়ি করলেই সেই জিয়ার আমল থেকে সব আমলেই সরকার সরাসরি কোনো ব্যবস্থা না নিলেও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রতিবাদে রাজপথে নেমে তাদের কণ্ঠস্বরকে নামিয়ে দিত। বর্তমান সরকার তাদের ‘কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’ পরিস্থিতির সুযোগ করে দেয়ায় ঝাঁকুনি দিয়ে কোমল পানীয়ের বোতল খুললে যেভাবে ফস করে উঠে এবং ফেনাসহ পানীয় উপচে পড়ে বর্তমানে জামায়াত সে ধরনের উচ্ছ্বাসে উপচে পড়ছে, যা আবার একটা পর্যায়ে ওই পানীয়র বোতলের ফেনার ন্যায় মিলিয়ে যাবে। শুধু ’৭১ এর ভূমিকার জন্য নয়, এ দেশের সাধারণ মানুষ এমনকি ধর্মভীরু মানুষও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকে বা রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনা খুব একটা পছন্দ করে না।

এ ধরনের এক রাজনৈতিক বিন্যাসে কেউ পছন্দ করুক আর না করুক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন নির্বাচন হলে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত। যদিও ইতোমধ্যে দখলদারিত্ব চাঁদাবাজি আর খুনোখুনির কারণে বিএনপি নিন্দিত হচ্ছে কিন্তু এর চেয়ে ভালো বিকল্প না পেলে মানুষেরই বা কী করার আছে। শেখ হাসিনা বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে ফন্দি ফিকিরের নির্বাচন করেছেন। এখন আবার ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো এবং নতুন দল বিএনপি ঠেকাও নীতি নিয়ে নানা কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। সরকার ও সরকার-সমর্থক দলগুলোর পক্ষ থেকে তাদের মতো করে সংস্কার অনেকটা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন কথিত জুলাই সনদ নিয়ে আবার মব সৃষ্টির প্রচেষ্টা নেয়া হতে পারে।

বহুপক্ষের অংশগ্রহণে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন সেখানে জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে চাইলে বিভাজন আরো বাড়বে। গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ দেখে না বোঝার কোনো কারণ নেই যে, কঠিন এক সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ এবং পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ শূন্য রাজনীতির মাঠেও অপরাপর রাজনৈতিক শক্তি একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে লড়াইয়ে নেমে পড়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার নীরবতায় মনে হচ্ছে সরকারি ছত্রছায়ায় কোনো কোনো মহল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই হাঁটছেন বিভাজনের পথে। তাদের হাঁকডাক দেখে মনে হচ্ছে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা হচ্ছে যাতে করে ব্যালটের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সুযোগ বন্ধ করে দেয়া যায়।

প্রধান উপদেষ্টা বারংবার বলেছেন সংক্ষিপ্ত সংস্কার হলে ডিসেম্বরের মধ্যে আর বড় পরিসরে সংস্কার হলে জুন ’২৫-এর মধ্যে নির্বাচন হবে। ডিসেম্বর বাদ দিয়ে ফেব্রুয়ারির ফাঁদে পা দিয়ে বিএনপি কি ‘ধরা’ খেলো। প্রধান উপদেষ্টা জুন বাদ দিয়ে ফেব্রুয়ারিতে রাজি হওয়া মানে তো এক অর্থে সংক্ষিপ্ত সংস্কারের মাধ্যমেই নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় যেয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ বেছে নেয়া। কিন্তু বিষয়টি তিনি ঝুলিয়ে রেখে এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে দেশকে ঠেলে দিচ্ছেন। সংক্ষিপ্ত সংস্কার করে নির্বাচনে যাওয়া মানে এই নয় যে বড় সংস্কারের প্যাকেজের সবকিছুই নাকচ করে দেয়া হলো। এসব প্রস্তাব রাজনীতির মাঠে থাকবে। গণতন্ত্রে উত্তরণ পর্ব সফল হলে ভবিষ্যতে অনেক বিষয়ই হয়তোবা বিবেচনায় নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার কিছু পদক্ষেপকে অনেক রাজনৈতিক দল সন্দেহের চোখে দেখছে। যেমন প্রধান বিচারপতি এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে প্রধান উপদেষ্টার আনুষ্ঠানিক বৈঠক। নির্বাহী বিভাগের প্রধানের সাথে এই দুই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানের আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ বা বৈঠক বিরল ঘটনা। জনমনেও সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক যে, নির্বাহী বিভাগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নির্বাচন বা বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা হবে কিনা। উপরন্তু এ প্রশ্ন ইতোমধ্যে উঠেছে যে, নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অর্থাৎ উপদেষ্টা পরিষদে যেহেতু এনসিপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং এনসিপি গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত দুইজন উপদেষ্টা আছেন এবং প্রধান উপদেষ্টাও দল গঠনে তাদের উৎসাহ জুুগিয়েছেন তাই অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন, বিচার,সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে কতা নিরপেক্ষ থাকতে পারবে। সব মিলিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের যে আকাক্সক্ষা নিয়ে গণঅভ্যুত্থান হলো মানুষ তার উল্টো স্রোত দেখতে পাচ্ছে।

ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা নিয়েও কথা উঠেছে। দেশ কিন্তু আসলেই ভালোভাবে চলছে না। অনির্বাচিত সরকার যত প্রলম্বিত হবে তত সংকট ঘনীভূত হবে। নির্বাচিত সরকারের মধ্যে অন্তত আইন শৃঙ্খলা এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটা অন্তর্নিহিত শক্তি থাকে। তাই বর্তমান অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা থেকে বেরিয়ে আসতে ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার’ করে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই। মনে রাখা প্রয়োজন এ পর্যন্ত বাংলাদেশে একমাত্র নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বা শাসক পরিবর্তন শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। এর বাইরে হয় দেশি-বিদেশি চক্রান্তে হত্যা ও জিঘাংসার মাধ্যমে অথবা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শাসক পরিবর্তন হয়েছে। নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া ভিন্ন পথে হেঁটে সম্মানজনক বিদায় কারো হয়নি। দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়ে আসা এক এগারোর সরকারকে তো নির্বাচন দিয়েও শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে ভাগতে হয়েছে।

ইতিহাস বলছে কোনো ক্ষমতাই অপ্রতিদ্বন্দ্বী নয় এবং কোনো শাসকই অপরাজেয় নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব নোবেলজয়ী এই প্রবীণ মানুষটির এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধি কয়েকজন সম্মানিত উপদেষ্টার শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক প্রস্থানের জন্যও দ্রুত অতিদ্রুত জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ করে দেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। এই সত্যটি সম্মানিত উপদেষ্টা পরিষদ যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন তত সবার জন্য মঙ্গল।

[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]

back to top