ফজলে রাব্বি মোহাম্মদ আহ্সান
এ বছর পিরোজপুরের একটি স্কুলের সকল পরীক্ষার্থী মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে এবং শিক্ষকেরা এর পেছনের কারণ হিসেবে ছাত্রীদের বিবাহিত হওয়াকে উল্লেখ করেছেন। এ সংবাদটি আমাদের সমাজের গভীরে থাকা একটি সংকটের দিকে নির্দেশ করে, যা কেবল দারিদ্র্য বা অবকাঠামোর অভাব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। প্রচলিত অর্থনীতি হয়তো একে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তের মাপকাঠিতে বিচার করবে; কিন্তু আচরণগত অর্থনীতি আমাদের একটি গভীরতর ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। এ শাস্ত্রের আলোকে দেখলে, ওই ছাত্রীদের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি শুধু কিছু ব্যক্তিগত ভুল সিদ্ধান্তের সমষ্টি নয়। বরং এটি মানুষের আচরণ এবং সামাজিক পরিম-লে গভীরভাবে প্রোথিত কিছু অদৃশ্য শক্তির এক অবশ্যম্ভাবী ফলাফল।
সামাজিক প্রথার অপ্রতিরোধ্য প্রভাব : এ সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সামাজিক প্রথার এক শক্তি। আচরণগত অর্থনীতি বলে, মানুষ বিচ্ছিন্ন কোনো যুক্তিবাদী সত্তা নয়। বরং সে তার চারপাশের মানুষের চিন্তা ও কর্ম দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। আমাদের অনেক গ্রামীণ সমাজে মেয়েদের জন্যে বাল্যবিবাহ কেবল একটি বিকল্প নয়। বরং এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সামাজিক বিধানÑজীবনের এক অবধারিত অধ্যায়। যখন একজন তরুণী দেখে যে তার সব সঙ্গী, বড় বোন বা নিকটাত্মীয়রা একই পথ অনুসরণ করছে, তখন সেই প্রথার বাইরে যাওয়াটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং একঘরে হয়ে পড়ার সামিল বলে মনে হয়।
এ মানসিকতাকে দলবদ্ধ আচরণ বা হোর্ডিং বলা হয়। পিরোজপুরের ওই ছাত্রীদের কাছে সম্ভবত পছন্দটি ‘শিক্ষা বনাম বিয়ে’ হিসেবে আসেনি। বরং তাদের সামনে থাকা একমাত্র পথটিই ছিল বিয়ে, কারণ সমাজের আর সবাই তাই করছে। নিজেকে সমাজের অংশ হিসেবে টিকিয়ে রাখার এবং ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে পরিচিত হওয়ার আকাক্সক্ষা তখন শিক্ষার মতো একটি বিমূর্ত ও দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্নের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। স্কুলটির শতভাগ ছাত্রী বিবাহিত হওয়ার কারণে অকৃতকার্য হওয়া এ দলবদ্ধ আচরণেরই এক করুণ পরিণতি।
বর্তমানের মোহ : হাইপারবোলিক ডিসকাউন্টিং আচরণগত অর্থনীতির একটি মূলনীতি হলো হাইপারবোলিক ডিসকাউন্টিং বা বর্তমান কেন্দ্রিকতা। এটি মানুষের একটি সহজাত প্রবণতা। যার ফলে আমরা ভবিষ্যতের বড় কোনো প্রাপ্তির চেয়ে বর্তমানের ছোট কোনো পুরস্কারকে বেশি গুরুত্ব দেই। শিক্ষার সুফলÑ যেমন ভালো চাকরি, আত্মনির্ভরশীলতা বা উন্নত জীবনÑএগুলো সবই দূরবর্তী ভবিষ্যতের বিষয়। এগুলো বিমূর্ত এবং অনিশ্চিত।
বিপরীতে বিয়ের আপাত সুবিধাগুলো তাৎক্ষণিক এবং বাস্তব। ওই ছাত্রীদের কাছে এর অর্থ ছিল সামাজিক স্বীকৃতি, পারিবারিক প্রত্যাশা পূরণ এবং এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ। অন্যদিকে তাদের দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছে মেয়ের বিয়ে দেওয়া মানে একজন সদস্যের খাবারের চিন্তা কমা এবং মেয়ের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা, যদিও তা ভ্রান্ত ধারণা। এ পরিস্থিতি একটি ‘বর্তমান কেন্দ্রিকতার ফাঁদ’ তৈরি করে। বিয়ের তাৎক্ষণিক, নিশ্চিত ও সামাজিকভাবে স্বীকৃত ‘পুরস্কার’-এর কাছে শিক্ষার অনিশ্চিত, দূরবর্তী ও কষ্টসাধ্য ‘পুরস্কার’-এর মূল্য অনেক কমে যায়। বিবাহিত ছাত্রী হিসেবে সাংসারিক দায়িত্ব, ঘরের কাজ এবং অল্প বয়সে মাতৃত্বের চাপ সামলে এসএসসি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করাটা তাদের কাছে এক অসাধ্য সাধন বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক।
সিদ্ধান্ত উপস্থাপনের ধরণ এবং হারানোর ভয় : একটি সিদ্ধান্ত আমাদের সামনে কিভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তার ওপর আমাদের পছন্দ অনেকাংশে নির্ভর করে। আচরণগত অর্থনীতির সম্ভাবনা তত্ত্ব অনুযায়ী, এ ছাত্রীদের সামনে সিদ্ধান্তটি সম্ভবত এভাবে উপস্থাপন করা হয়নি যে, শিক্ষা গ্রহণ করো, ভবিষ্যৎ গড়ো। বরং তাদের সামনে থাকা বার্তাটি ছিল ক্ষতি এড়ানোর।
লোকসানের ভয় বা লস এভারশন : এ তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মূল কথা হলোÑ কোনো কিছু পাওয়ার আনন্দের চেয়ে সমমূল্যের কোনো কিছু হারানোর কষ্ট আমাদের মনে প্রায় দ্বিগুণ প্রভাব ফেলে। যে সমাজে অল্প বয়সে বিয়ে করাই নিয়ম, সেখানে একটি মেয়ের জন্যে বিয়ে না করার ক্ষতিগুলো ভয়াবহ হিসেবে উপস্থাপিত হতে পারেÑ সামাজিক মর্যাদা হারানো, ভালো পাত্র না পাওয়ার ভয় এবং পরিবারের জন্য ‘বোঝা’ হয়ে ওঠার ঝুঁকি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, বিয়ে করাটা কোনো কিছু পাওয়ার জন্য ইতিবাচক পছন্দ নয়, বরং এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি এড়ানোর একটি রক্ষণাত্মক পদক্ষেপ। শিক্ষার সম্ভাব্য সুবিধার বিমূর্ত ধারণার চেয়ে সামাজিক পরিত্যাগের বাস্তব ও তীব্র ভয় অনেক বেশি শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।
স্বল্পতার মানসিকতা : সবশেষে দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপট এক বিশেষ মানসিকতা তৈরি করে, যাকে বলা হয় স্বল্পতার মানসিকতা। আচরণগত গবেষণায় দেখা গেছে, যখন মানুষ ক্রমাগত সম্পদ বা সময়ের অভাব নিয়ে চিন্তিত থাকে, তখন তাদের দূরদর্শী পরিকল্পনা করার মানসিক ক্ষমতা বা বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর মারাত্মকভাবে কমে যায়।
একটি দরিদ্র পরিবারের কাছে, যাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকাটাই মূল সংগ্রাম, সেখানে মেয়ের দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষার জন্য পরিকল্পনা করা বা বিনিয়োগ করাটা এক ধরনের বিলাসিতা বলেই মনে হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে বিয়ে দেওয়াটাকেই তাদের কাছে নানাবিধ অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ থেকে মুক্তির একটি সহজ সমাধান বলে মনে হয়। এ মানসিকতা বাবা-মা এবং তাদের মেয়ে উভয়কেই প্রভাবিত করে। যার ফলে শিক্ষার দীর্ঘ ও কষ্টকর পথটি তাদের কাছে অবাস্তব ও অসম্ভব একটি স্বপ্ন বলে প্রতীয়মান হয়।
শেষ কথা : পিরোজপুরের স্কুলটির ঘটনা আচরণগত অর্থনীতির এক বাস্তব উদাহরণ। এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, এ ধরনের সামাজিক সমস্যার মূল বুঝতে হলে আমাদের সরল যুক্তির ঊর্ধ্বে তাকাতে হবে। ওই ছাত্রীদের ব্যর্থতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এটি অপ্রতিরোধ্য সামাজিক প্রথা, বর্তমানকেন্দ্রিক মানসিকতা, হারানোর ভয় থেকে জন্ম নেওয়া সিদ্ধান্ত এবং দারিদ্র্যপীড়িত স্বল্পতার মানসিকতার এক সম্মিলিত ফল। ওই ছাত্রীরা অযৌক্তিক নয়। তারা তাদের পারিপার্শ্বিক অদৃশ্য মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক শক্তির কাছে এক করুণ ও যোগ্য উপায়ে সাড়া দিয়েছে মাত্র। সুতরাং, বাল্যবিবাহ এবং শিক্ষায় এর প্রভাব মোকাবিলা করতে হলে কেবল অর্থনৈতিক সাহায্য বা নতুন স্কুল তৈরিই যথেষ্ট নয়। বরং আচরণগত দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে; যা মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। সামাজিক প্রথা বদলাতে পারে এবং দারিদ্র্যের মানসিক চাপ কমাতে পারে।
[লেখক : ডেপুটি চিফ (প্লানিং), ঢাকা ওয়াসা]
ফজলে রাব্বি মোহাম্মদ আহ্সান
রোববার, ২০ জুলাই ২০২৫
এ বছর পিরোজপুরের একটি স্কুলের সকল পরীক্ষার্থী মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে এবং শিক্ষকেরা এর পেছনের কারণ হিসেবে ছাত্রীদের বিবাহিত হওয়াকে উল্লেখ করেছেন। এ সংবাদটি আমাদের সমাজের গভীরে থাকা একটি সংকটের দিকে নির্দেশ করে, যা কেবল দারিদ্র্য বা অবকাঠামোর অভাব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। প্রচলিত অর্থনীতি হয়তো একে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তের মাপকাঠিতে বিচার করবে; কিন্তু আচরণগত অর্থনীতি আমাদের একটি গভীরতর ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। এ শাস্ত্রের আলোকে দেখলে, ওই ছাত্রীদের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি শুধু কিছু ব্যক্তিগত ভুল সিদ্ধান্তের সমষ্টি নয়। বরং এটি মানুষের আচরণ এবং সামাজিক পরিম-লে গভীরভাবে প্রোথিত কিছু অদৃশ্য শক্তির এক অবশ্যম্ভাবী ফলাফল।
সামাজিক প্রথার অপ্রতিরোধ্য প্রভাব : এ সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সামাজিক প্রথার এক শক্তি। আচরণগত অর্থনীতি বলে, মানুষ বিচ্ছিন্ন কোনো যুক্তিবাদী সত্তা নয়। বরং সে তার চারপাশের মানুষের চিন্তা ও কর্ম দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। আমাদের অনেক গ্রামীণ সমাজে মেয়েদের জন্যে বাল্যবিবাহ কেবল একটি বিকল্প নয়। বরং এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সামাজিক বিধানÑজীবনের এক অবধারিত অধ্যায়। যখন একজন তরুণী দেখে যে তার সব সঙ্গী, বড় বোন বা নিকটাত্মীয়রা একই পথ অনুসরণ করছে, তখন সেই প্রথার বাইরে যাওয়াটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং একঘরে হয়ে পড়ার সামিল বলে মনে হয়।
এ মানসিকতাকে দলবদ্ধ আচরণ বা হোর্ডিং বলা হয়। পিরোজপুরের ওই ছাত্রীদের কাছে সম্ভবত পছন্দটি ‘শিক্ষা বনাম বিয়ে’ হিসেবে আসেনি। বরং তাদের সামনে থাকা একমাত্র পথটিই ছিল বিয়ে, কারণ সমাজের আর সবাই তাই করছে। নিজেকে সমাজের অংশ হিসেবে টিকিয়ে রাখার এবং ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে পরিচিত হওয়ার আকাক্সক্ষা তখন শিক্ষার মতো একটি বিমূর্ত ও দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্নের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। স্কুলটির শতভাগ ছাত্রী বিবাহিত হওয়ার কারণে অকৃতকার্য হওয়া এ দলবদ্ধ আচরণেরই এক করুণ পরিণতি।
বর্তমানের মোহ : হাইপারবোলিক ডিসকাউন্টিং আচরণগত অর্থনীতির একটি মূলনীতি হলো হাইপারবোলিক ডিসকাউন্টিং বা বর্তমান কেন্দ্রিকতা। এটি মানুষের একটি সহজাত প্রবণতা। যার ফলে আমরা ভবিষ্যতের বড় কোনো প্রাপ্তির চেয়ে বর্তমানের ছোট কোনো পুরস্কারকে বেশি গুরুত্ব দেই। শিক্ষার সুফলÑ যেমন ভালো চাকরি, আত্মনির্ভরশীলতা বা উন্নত জীবনÑএগুলো সবই দূরবর্তী ভবিষ্যতের বিষয়। এগুলো বিমূর্ত এবং অনিশ্চিত।
বিপরীতে বিয়ের আপাত সুবিধাগুলো তাৎক্ষণিক এবং বাস্তব। ওই ছাত্রীদের কাছে এর অর্থ ছিল সামাজিক স্বীকৃতি, পারিবারিক প্রত্যাশা পূরণ এবং এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ। অন্যদিকে তাদের দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছে মেয়ের বিয়ে দেওয়া মানে একজন সদস্যের খাবারের চিন্তা কমা এবং মেয়ের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা, যদিও তা ভ্রান্ত ধারণা। এ পরিস্থিতি একটি ‘বর্তমান কেন্দ্রিকতার ফাঁদ’ তৈরি করে। বিয়ের তাৎক্ষণিক, নিশ্চিত ও সামাজিকভাবে স্বীকৃত ‘পুরস্কার’-এর কাছে শিক্ষার অনিশ্চিত, দূরবর্তী ও কষ্টসাধ্য ‘পুরস্কার’-এর মূল্য অনেক কমে যায়। বিবাহিত ছাত্রী হিসেবে সাংসারিক দায়িত্ব, ঘরের কাজ এবং অল্প বয়সে মাতৃত্বের চাপ সামলে এসএসসি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করাটা তাদের কাছে এক অসাধ্য সাধন বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক।
সিদ্ধান্ত উপস্থাপনের ধরণ এবং হারানোর ভয় : একটি সিদ্ধান্ত আমাদের সামনে কিভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তার ওপর আমাদের পছন্দ অনেকাংশে নির্ভর করে। আচরণগত অর্থনীতির সম্ভাবনা তত্ত্ব অনুযায়ী, এ ছাত্রীদের সামনে সিদ্ধান্তটি সম্ভবত এভাবে উপস্থাপন করা হয়নি যে, শিক্ষা গ্রহণ করো, ভবিষ্যৎ গড়ো। বরং তাদের সামনে থাকা বার্তাটি ছিল ক্ষতি এড়ানোর।
লোকসানের ভয় বা লস এভারশন : এ তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মূল কথা হলোÑ কোনো কিছু পাওয়ার আনন্দের চেয়ে সমমূল্যের কোনো কিছু হারানোর কষ্ট আমাদের মনে প্রায় দ্বিগুণ প্রভাব ফেলে। যে সমাজে অল্প বয়সে বিয়ে করাই নিয়ম, সেখানে একটি মেয়ের জন্যে বিয়ে না করার ক্ষতিগুলো ভয়াবহ হিসেবে উপস্থাপিত হতে পারেÑ সামাজিক মর্যাদা হারানো, ভালো পাত্র না পাওয়ার ভয় এবং পরিবারের জন্য ‘বোঝা’ হয়ে ওঠার ঝুঁকি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, বিয়ে করাটা কোনো কিছু পাওয়ার জন্য ইতিবাচক পছন্দ নয়, বরং এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি এড়ানোর একটি রক্ষণাত্মক পদক্ষেপ। শিক্ষার সম্ভাব্য সুবিধার বিমূর্ত ধারণার চেয়ে সামাজিক পরিত্যাগের বাস্তব ও তীব্র ভয় অনেক বেশি শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।
স্বল্পতার মানসিকতা : সবশেষে দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপট এক বিশেষ মানসিকতা তৈরি করে, যাকে বলা হয় স্বল্পতার মানসিকতা। আচরণগত গবেষণায় দেখা গেছে, যখন মানুষ ক্রমাগত সম্পদ বা সময়ের অভাব নিয়ে চিন্তিত থাকে, তখন তাদের দূরদর্শী পরিকল্পনা করার মানসিক ক্ষমতা বা বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর মারাত্মকভাবে কমে যায়।
একটি দরিদ্র পরিবারের কাছে, যাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকাটাই মূল সংগ্রাম, সেখানে মেয়ের দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষার জন্য পরিকল্পনা করা বা বিনিয়োগ করাটা এক ধরনের বিলাসিতা বলেই মনে হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে বিয়ে দেওয়াটাকেই তাদের কাছে নানাবিধ অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ থেকে মুক্তির একটি সহজ সমাধান বলে মনে হয়। এ মানসিকতা বাবা-মা এবং তাদের মেয়ে উভয়কেই প্রভাবিত করে। যার ফলে শিক্ষার দীর্ঘ ও কষ্টকর পথটি তাদের কাছে অবাস্তব ও অসম্ভব একটি স্বপ্ন বলে প্রতীয়মান হয়।
শেষ কথা : পিরোজপুরের স্কুলটির ঘটনা আচরণগত অর্থনীতির এক বাস্তব উদাহরণ। এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, এ ধরনের সামাজিক সমস্যার মূল বুঝতে হলে আমাদের সরল যুক্তির ঊর্ধ্বে তাকাতে হবে। ওই ছাত্রীদের ব্যর্থতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এটি অপ্রতিরোধ্য সামাজিক প্রথা, বর্তমানকেন্দ্রিক মানসিকতা, হারানোর ভয় থেকে জন্ম নেওয়া সিদ্ধান্ত এবং দারিদ্র্যপীড়িত স্বল্পতার মানসিকতার এক সম্মিলিত ফল। ওই ছাত্রীরা অযৌক্তিক নয়। তারা তাদের পারিপার্শ্বিক অদৃশ্য মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক শক্তির কাছে এক করুণ ও যোগ্য উপায়ে সাড়া দিয়েছে মাত্র। সুতরাং, বাল্যবিবাহ এবং শিক্ষায় এর প্রভাব মোকাবিলা করতে হলে কেবল অর্থনৈতিক সাহায্য বা নতুন স্কুল তৈরিই যথেষ্ট নয়। বরং আচরণগত দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে; যা মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। সামাজিক প্রথা বদলাতে পারে এবং দারিদ্র্যের মানসিক চাপ কমাতে পারে।
[লেখক : ডেপুটি চিফ (প্লানিং), ঢাকা ওয়াসা]