জাহাঙ্গীর আলম সরকার
মার্কিন রাজনীতি যেন আবারও অগ্নিপরীক্ষার মুখে দাঁড়িয়েছে। কট্টর ডানপন্থী নেতা চার্লি কার্কের হত্যাকা- সেই আগুনে নতুন স্ফুলিঙ্গ ছড়াল। ঘটনার তদন্ত এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে, খুনির উদ্দেশ্য অজানা, সত্য উন্মোচিত হয়নি—তবু রাজনৈতিক অঙ্গন ইতোমধ্যেই উত্তাল। এ উত্তালতা যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রে বিদ্যমান ভারসাম্যহীনতার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে।
ঠিক এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া যেন ঘটনার গুরুত্বকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনি তদন্তের ফলাফলের অপেক্ষা না করেই দ্রুত বামপন্থীদের দিকে আঙুল তুলেছেন, প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছেন। এটি নিছক আবেগতাড়িত প্রতিক্রিয়া নয়; বরং তার রাজনীতির এক দীর্ঘস্থায়ী ধারা—সহিংসতাকে বৈধ করে তোলা, বিভাজনকে জিইয়ে রাখা, এবং শত্রুভীতিকে রাজনৈতিক অস্ত্রে রূপান্তরিত করা।
চার্লি কার্কের রক্তে ভেজা এই ট্র্যাজেডি তাই শুধু একজন নেতার মৃত্যু নয়; এটি যেন মার্কিন রাজনীতির অন্তর্লীন সহিংস স্রোতকে নগ্নভাবে সামনে টেনে এনেছে। প্রশ্ন জাগে—এই স্রোতকে কি ট্রাম্প শুধু সহ্য করছেন, নাকি এটিকেই তিনি রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন?
ট্রাম্পের রাজনৈতিক যাত্রায় সহিংসতাকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে বৈধতা দেওয়ার প্রবণতা একাধিকবার স্পষ্ট হয়েছে। প্রকাশ্যে তিনি বলেছেন, সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া যদি আক্রমণাত্মক হয়, সেটি ‘সহনীয়’ বা কখনো কখনো ‘ন্যায্য’। এর সবচেয়ে আলোচিত দৃষ্টান্ত ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি কংগ্রেস ভবনে হামলার ঘটনা। গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র কংগ্রেসে আক্রমণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়। পরবর্তী সময়ে দোষী সাব্যস্ত বহু সহিংস অংশগ্রহণকারীকে ট্রাম্প ক্ষমা করেছেন এবং তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক পরিসর এই ঘটনাকে বিদ্রোহ নয়, বরং দেশপ্রেমিকদের আত্মরক্ষার পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছে। যে ঘটনাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের চেষ্টা হিসেবে দেখা হয়, ট্রাম্প—শিবির সেখানে তৈরি করেছে ‘বৈধ প্রতিরোধের’ আখ্যান।
চার্লি কার্ক হত্যাকা-ের পর প্রতিক্রিয়ায়ও সেই প্রবণতার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। উদারপন্থী মহলে কিছু বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য দেখা গেলেও মূলধারার সমালোচকেরা স্পষ্টভাবে সহিংসতাকে নিন্দা করেছেন এবং কার্ককে একজন বিতর্কিত হলেও নীতিনিষ্ঠ প্রতিপক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অপরদিকে, ডানপন্থী শিবিরে প্রতিক্রিয়ার ধারা ছিল আরও আক্রমণাত্মক—প্রতিশোধ, দমননীতি, এমনকি সরাসরি ‘যুদ্ধের’ ডাক পর্যন্ত উঠেছে। কেউ কেউ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার বিতর্কিত অতীতকে তুলে ধরে এফবিআইয়ের সাবেক প্রধান জে. এডগার হুভারের বেআইনি কৌশল অনুসরণের কথা বলেছেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই এই হত্যাকা-কে ব্যবহার করছেন তার অপছন্দের নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলোর ওপর আক্রমণের অজুহাত হিসেবে, যা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সম্পর্ককে বিপজ্জনকভাবে অস্পষ্ট করে দিচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপট শুধু মার্কিন রাজনীতির সংকট নয়; এটি এক বিস্তৃত আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনীয়। ইতিহাসে দেখা গেছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন বিরোধী পক্ষকে শুধু প্রতিদ্বন্ধী নয়, বরং ‘রাষ্ট্রের শত্রু’ হিসেবে আখ্যা দেয়, তখন গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পড়তে দেরি হয় না। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় ইউরোপের ১৯৩০—এর দশক। জার্মানিতে হিটলার এবং ইতালিতে মুসোলিনি রাজনৈতিক সহিংসতাকে একদিকে উসকে দিয়েছেন, অন্যদিকে সেটিকে ‘জাতির স্বার্থরক্ষা’ নামে বৈধতা দিয়েছেন। তাদের সমর্থকদের রাস্তায় সহিংস কার্যকলাপকে কর্তৃপক্ষ প্রায়ই উপেক্ষা করেছে বা প্রশ্রয় দিয়েছে। ফলাফল ছিল গণতন্ত্রের অবসান ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের উত্থান।
লাতিন আমেরিকায়ও সহিংসতার এই প্রবণতা বহুবার দেখা গেছে। ভেনেজুয়েলায় হুগো শাভেজ ও পরবর্তী সময়ের মাদুরো বিরোধীদের ‘রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী’ আখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক দমননীতি চালিয়েছেন। আবার আর্জেন্টিনায় সামরিক জান্তা কিংবা চিলিতে পিনোশের শাসনেও বিরোধীদের দমনে রাষ্ট্রীয় সহিংসতাকে বৈধ করা হয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সহিংসতা শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশল হয়নি, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্ককেও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ট্রাম্পের বর্তমান অবস্থান এই ঐতিহাসিক উদাহরণগুলোর সঙ্গে অস্বস্তিকর সাদৃশ্য বহন করে। বিরোধীদের ‘দেশীয় সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে ফেডারেল শক্তিকে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করার ইঙ্গিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শিষ্টাচার অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের দায়িত্ব হলো বিরোধী মতকে স্বীকৃতি দেওয়া, ভিন্নমতকে সুরক্ষা দেওয়া এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষ রাখা। অথচ ট্রাম্পের বক্তব্য ও কর্মকা-ে প্রতিনিয়ত যে বিভাজনমূলক সুর প্রতিফলিত হচ্ছে, তা শুধু মার্কিন ডেমোক্র্যাটদের জন্য হুমকি নয়; বরং বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও আইনের শাসনে আস্থাশীল সবার কাছেই এক গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে।
ট্রাম্পের রাজনৈতিক ইতিহাসে সহিংসতা ও বিভাজনমূলক আচরণ নতুন কোনো বিষয় নয়। ফিফথ অ্যাভিনিউয়ে প্রকাশ্যে কাউকে গুলি করার কল্পনা করা, সমর্থকদের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর হামলার আহ্বান, শার্লটসভিলে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে প্রশংসা, কিংবা ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে ফাঁসিতে ঝোলানোর হুমকিতেও নীরব থাকা—এসব ঘটনা এক গভীর নিদর্শন যে, সহিংসতা তার রাজনৈতিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এ ধরনের আচরণ শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য নয়; আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনৈতিক নীতিমালার দৃষ্টিকোণ থেকেও তা বিপজ্জনক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শীর্ষনেতার দায়িত্ব হলো বিরোধী মত ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের স্বীকৃতি দেওয়া, অথচ ট্রাম্পের কর্মকা-ে সেই সীমারেখা প্রায়শই অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে তার সমর্থকগোষ্ঠীকে ক্রমাগত ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ফক্স নিউজ থেকে শুরু করে টক—রেডিওর প্রচারকরা এটিকে পুনরায় পুনর্ব্যাখ্যা করছেন—সমর্থকদের রাগ স্বাভাবিক এবং ‘ন্যায্য প্রতিশোধের’ প্ররোচনা হিসেবে গৃহীত হওয়া উচিত। এভাবেই গড়ে উঠেছে এক ধরনের ‘অভিযোগ—শিল্প’, যেখানে ট্রাম্প নিজেকে অপরাধী নয়, বরং নিপীড়িত হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি উদ্বেগজনক, কারণ রাজনৈতিক সহিংসতার বৈধতা দেওয়ার এই কৌশল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও আইনের শাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
তবু মার্কিন সমাজের বৃহৎ অংশ এখনও রাজনৈতিক সহিংসতার বিপক্ষে অবস্থান করছে। সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফল দেখাচ্ছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ট্রাম্পের ওপর হামলার পরও সাধারণ জনগণের মধ্যে সহিংসতার প্রতি সমর্থন আরও কমেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়নি। তবে একাংশ রাজনীতিক ও সমর্থক ইচ্ছাকৃতভাবে সমাজকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে গণতান্ত্রিক মানদ- অনুসারে, এ ধরনের বিভাজনমূলক রাজনৈতিক কৌশল বিপজ্জনক নজির তৈরি করতে পারে, যা শুধু অভ্যন্তরীণ শান্তি নয়, বরং বৈশ্বিক কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্যও নেতিবাচক সংকেত বহন করে।
চার্লি কার্ক হত্যাকা-ের রাতের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট বার্তা দেয়—ট্রাম্প ঐক্যের পথ নয়, বিভাজনকেই রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। তার প্রশাসন এখন ‘মতবিরোধের স্বাদ’ নয়, বরং ‘নিষ্ঠুরতার স্বাদ’কে স্বীকৃতি দিচ্ছে। রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে, এটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এক গভীর সংকেত: যেখানে ভিন্নমতকে গ্রহণের পরিবর্তে শত্রুপক্ষকে দমন করা হচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিপীড়ক শক্তির কাছে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতি আমাদের মনে করায়—গণতন্ত্র কখনোই স্বতঃসিদ্ধ নয়। এর প্রতিরক্ষা করতে হয় সতর্ক নেতৃত্ব, সচেতন নাগরিক এবং আইনের শাসনের অটল ভিত্তি। যখন শক্তিশালী নেতারা সহিংসতাকে প্রলুব্ধি হিসেবে ব্যবহার করেন, তখন সমাজের মানসিক ভারসাম্যও স্থির থাকে না। ট্রাম্পের চলমান কৌশল এ ভাবেই বিভাজনকে স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য করে তুলছে, যা শুধুমাত্র বর্তমানকে নয়, ভবিষ্যতের রাজনৈতিক প্রজন্মকেও প্রভাবিত করতে পারে।
প্রশ্ন জাগে—আমেরিকা কি এই সহিংসতার রাজনীতি থেকে বের হতে পারবে, নাকি বিভাজন ও ভয়ভীতি চালিত পথেই এগোবে? উত্তরটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে নয়; নাগরিক সমাজের জাগরণ, স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের সতর্কতা, এবং আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মানদ-ের রক্ষা করাই নির্ধারণ করবে। চার্লি কার্কের জীবন ও মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে কখনো শান্তিপূর্ণ একক ঘটনার প্রতিও সমালোচনামূলক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন, কারণ রাজনৈতিক সহিংসতা কখনো এক ব্যক্তির সীমা ছাড়িয়ে সমাজকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
শেষ কথা, এই রাতের অন্ধকার আমাদের সতর্ক করে—বিভাজন যদি নীরবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে গণতন্ত্রের আলো নিভে যেতে সময় লাগবে না। তাই এখনই পদক্ষেপ নেওয়া অত্যাবশ্যক, নইলে সহিংসতার রাজনীতি শুধু নির্বাচনী কৌশল নয়, বরং সমগ্র সমাজের নৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিকেও গভীর ক্ষয় ঘটাবে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: আইনজীবী ও গবেষক]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
জাহাঙ্গীর আলম সরকার
রোববার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
মার্কিন রাজনীতি যেন আবারও অগ্নিপরীক্ষার মুখে দাঁড়িয়েছে। কট্টর ডানপন্থী নেতা চার্লি কার্কের হত্যাকা- সেই আগুনে নতুন স্ফুলিঙ্গ ছড়াল। ঘটনার তদন্ত এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে, খুনির উদ্দেশ্য অজানা, সত্য উন্মোচিত হয়নি—তবু রাজনৈতিক অঙ্গন ইতোমধ্যেই উত্তাল। এ উত্তালতা যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রে বিদ্যমান ভারসাম্যহীনতার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে।
ঠিক এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া যেন ঘটনার গুরুত্বকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনি তদন্তের ফলাফলের অপেক্ষা না করেই দ্রুত বামপন্থীদের দিকে আঙুল তুলেছেন, প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছেন। এটি নিছক আবেগতাড়িত প্রতিক্রিয়া নয়; বরং তার রাজনীতির এক দীর্ঘস্থায়ী ধারা—সহিংসতাকে বৈধ করে তোলা, বিভাজনকে জিইয়ে রাখা, এবং শত্রুভীতিকে রাজনৈতিক অস্ত্রে রূপান্তরিত করা।
চার্লি কার্কের রক্তে ভেজা এই ট্র্যাজেডি তাই শুধু একজন নেতার মৃত্যু নয়; এটি যেন মার্কিন রাজনীতির অন্তর্লীন সহিংস স্রোতকে নগ্নভাবে সামনে টেনে এনেছে। প্রশ্ন জাগে—এই স্রোতকে কি ট্রাম্প শুধু সহ্য করছেন, নাকি এটিকেই তিনি রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন?
ট্রাম্পের রাজনৈতিক যাত্রায় সহিংসতাকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে বৈধতা দেওয়ার প্রবণতা একাধিকবার স্পষ্ট হয়েছে। প্রকাশ্যে তিনি বলেছেন, সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া যদি আক্রমণাত্মক হয়, সেটি ‘সহনীয়’ বা কখনো কখনো ‘ন্যায্য’। এর সবচেয়ে আলোচিত দৃষ্টান্ত ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি কংগ্রেস ভবনে হামলার ঘটনা। গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র কংগ্রেসে আক্রমণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়। পরবর্তী সময়ে দোষী সাব্যস্ত বহু সহিংস অংশগ্রহণকারীকে ট্রাম্প ক্ষমা করেছেন এবং তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক পরিসর এই ঘটনাকে বিদ্রোহ নয়, বরং দেশপ্রেমিকদের আত্মরক্ষার পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছে। যে ঘটনাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের চেষ্টা হিসেবে দেখা হয়, ট্রাম্প—শিবির সেখানে তৈরি করেছে ‘বৈধ প্রতিরোধের’ আখ্যান।
চার্লি কার্ক হত্যাকা-ের পর প্রতিক্রিয়ায়ও সেই প্রবণতার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। উদারপন্থী মহলে কিছু বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য দেখা গেলেও মূলধারার সমালোচকেরা স্পষ্টভাবে সহিংসতাকে নিন্দা করেছেন এবং কার্ককে একজন বিতর্কিত হলেও নীতিনিষ্ঠ প্রতিপক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অপরদিকে, ডানপন্থী শিবিরে প্রতিক্রিয়ার ধারা ছিল আরও আক্রমণাত্মক—প্রতিশোধ, দমননীতি, এমনকি সরাসরি ‘যুদ্ধের’ ডাক পর্যন্ত উঠেছে। কেউ কেউ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার বিতর্কিত অতীতকে তুলে ধরে এফবিআইয়ের সাবেক প্রধান জে. এডগার হুভারের বেআইনি কৌশল অনুসরণের কথা বলেছেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই এই হত্যাকা-কে ব্যবহার করছেন তার অপছন্দের নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলোর ওপর আক্রমণের অজুহাত হিসেবে, যা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সম্পর্ককে বিপজ্জনকভাবে অস্পষ্ট করে দিচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপট শুধু মার্কিন রাজনীতির সংকট নয়; এটি এক বিস্তৃত আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনীয়। ইতিহাসে দেখা গেছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন বিরোধী পক্ষকে শুধু প্রতিদ্বন্ধী নয়, বরং ‘রাষ্ট্রের শত্রু’ হিসেবে আখ্যা দেয়, তখন গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পড়তে দেরি হয় না। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় ইউরোপের ১৯৩০—এর দশক। জার্মানিতে হিটলার এবং ইতালিতে মুসোলিনি রাজনৈতিক সহিংসতাকে একদিকে উসকে দিয়েছেন, অন্যদিকে সেটিকে ‘জাতির স্বার্থরক্ষা’ নামে বৈধতা দিয়েছেন। তাদের সমর্থকদের রাস্তায় সহিংস কার্যকলাপকে কর্তৃপক্ষ প্রায়ই উপেক্ষা করেছে বা প্রশ্রয় দিয়েছে। ফলাফল ছিল গণতন্ত্রের অবসান ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের উত্থান।
লাতিন আমেরিকায়ও সহিংসতার এই প্রবণতা বহুবার দেখা গেছে। ভেনেজুয়েলায় হুগো শাভেজ ও পরবর্তী সময়ের মাদুরো বিরোধীদের ‘রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী’ আখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক দমননীতি চালিয়েছেন। আবার আর্জেন্টিনায় সামরিক জান্তা কিংবা চিলিতে পিনোশের শাসনেও বিরোধীদের দমনে রাষ্ট্রীয় সহিংসতাকে বৈধ করা হয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সহিংসতা শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশল হয়নি, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্ককেও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ট্রাম্পের বর্তমান অবস্থান এই ঐতিহাসিক উদাহরণগুলোর সঙ্গে অস্বস্তিকর সাদৃশ্য বহন করে। বিরোধীদের ‘দেশীয় সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে ফেডারেল শক্তিকে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করার ইঙ্গিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শিষ্টাচার অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের দায়িত্ব হলো বিরোধী মতকে স্বীকৃতি দেওয়া, ভিন্নমতকে সুরক্ষা দেওয়া এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষ রাখা। অথচ ট্রাম্পের বক্তব্য ও কর্মকা-ে প্রতিনিয়ত যে বিভাজনমূলক সুর প্রতিফলিত হচ্ছে, তা শুধু মার্কিন ডেমোক্র্যাটদের জন্য হুমকি নয়; বরং বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও আইনের শাসনে আস্থাশীল সবার কাছেই এক গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে।
ট্রাম্পের রাজনৈতিক ইতিহাসে সহিংসতা ও বিভাজনমূলক আচরণ নতুন কোনো বিষয় নয়। ফিফথ অ্যাভিনিউয়ে প্রকাশ্যে কাউকে গুলি করার কল্পনা করা, সমর্থকদের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর হামলার আহ্বান, শার্লটসভিলে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে প্রশংসা, কিংবা ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে ফাঁসিতে ঝোলানোর হুমকিতেও নীরব থাকা—এসব ঘটনা এক গভীর নিদর্শন যে, সহিংসতা তার রাজনৈতিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এ ধরনের আচরণ শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য নয়; আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনৈতিক নীতিমালার দৃষ্টিকোণ থেকেও তা বিপজ্জনক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শীর্ষনেতার দায়িত্ব হলো বিরোধী মত ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের স্বীকৃতি দেওয়া, অথচ ট্রাম্পের কর্মকা-ে সেই সীমারেখা প্রায়শই অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে তার সমর্থকগোষ্ঠীকে ক্রমাগত ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ফক্স নিউজ থেকে শুরু করে টক—রেডিওর প্রচারকরা এটিকে পুনরায় পুনর্ব্যাখ্যা করছেন—সমর্থকদের রাগ স্বাভাবিক এবং ‘ন্যায্য প্রতিশোধের’ প্ররোচনা হিসেবে গৃহীত হওয়া উচিত। এভাবেই গড়ে উঠেছে এক ধরনের ‘অভিযোগ—শিল্প’, যেখানে ট্রাম্প নিজেকে অপরাধী নয়, বরং নিপীড়িত হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি উদ্বেগজনক, কারণ রাজনৈতিক সহিংসতার বৈধতা দেওয়ার এই কৌশল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও আইনের শাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
তবু মার্কিন সমাজের বৃহৎ অংশ এখনও রাজনৈতিক সহিংসতার বিপক্ষে অবস্থান করছে। সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফল দেখাচ্ছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ট্রাম্পের ওপর হামলার পরও সাধারণ জনগণের মধ্যে সহিংসতার প্রতি সমর্থন আরও কমেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়নি। তবে একাংশ রাজনীতিক ও সমর্থক ইচ্ছাকৃতভাবে সমাজকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে গণতান্ত্রিক মানদ- অনুসারে, এ ধরনের বিভাজনমূলক রাজনৈতিক কৌশল বিপজ্জনক নজির তৈরি করতে পারে, যা শুধু অভ্যন্তরীণ শান্তি নয়, বরং বৈশ্বিক কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্যও নেতিবাচক সংকেত বহন করে।
চার্লি কার্ক হত্যাকা-ের রাতের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট বার্তা দেয়—ট্রাম্প ঐক্যের পথ নয়, বিভাজনকেই রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। তার প্রশাসন এখন ‘মতবিরোধের স্বাদ’ নয়, বরং ‘নিষ্ঠুরতার স্বাদ’কে স্বীকৃতি দিচ্ছে। রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে, এটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এক গভীর সংকেত: যেখানে ভিন্নমতকে গ্রহণের পরিবর্তে শত্রুপক্ষকে দমন করা হচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিপীড়ক শক্তির কাছে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতি আমাদের মনে করায়—গণতন্ত্র কখনোই স্বতঃসিদ্ধ নয়। এর প্রতিরক্ষা করতে হয় সতর্ক নেতৃত্ব, সচেতন নাগরিক এবং আইনের শাসনের অটল ভিত্তি। যখন শক্তিশালী নেতারা সহিংসতাকে প্রলুব্ধি হিসেবে ব্যবহার করেন, তখন সমাজের মানসিক ভারসাম্যও স্থির থাকে না। ট্রাম্পের চলমান কৌশল এ ভাবেই বিভাজনকে স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য করে তুলছে, যা শুধুমাত্র বর্তমানকে নয়, ভবিষ্যতের রাজনৈতিক প্রজন্মকেও প্রভাবিত করতে পারে।
প্রশ্ন জাগে—আমেরিকা কি এই সহিংসতার রাজনীতি থেকে বের হতে পারবে, নাকি বিভাজন ও ভয়ভীতি চালিত পথেই এগোবে? উত্তরটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে নয়; নাগরিক সমাজের জাগরণ, স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের সতর্কতা, এবং আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মানদ-ের রক্ষা করাই নির্ধারণ করবে। চার্লি কার্কের জীবন ও মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে কখনো শান্তিপূর্ণ একক ঘটনার প্রতিও সমালোচনামূলক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন, কারণ রাজনৈতিক সহিংসতা কখনো এক ব্যক্তির সীমা ছাড়িয়ে সমাজকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
শেষ কথা, এই রাতের অন্ধকার আমাদের সতর্ক করে—বিভাজন যদি নীরবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে গণতন্ত্রের আলো নিভে যেতে সময় লাগবে না। তাই এখনই পদক্ষেপ নেওয়া অত্যাবশ্যক, নইলে সহিংসতার রাজনীতি শুধু নির্বাচনী কৌশল নয়, বরং সমগ্র সমাজের নৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিকেও গভীর ক্ষয় ঘটাবে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: আইনজীবী ও গবেষক]