alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

নৃশংসতার ভিডিও, নীরব দর্শক আর হারিয়ে যাওয়া মানবতা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: রোববার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কুমিল্লার বুড়িচংয়ে সাকুরা স্টিল মিলে তামার তার চুরির অভিযোগে এক যুবককে ধরে দুটি জার্মান শেফার্ড কুকুর লেলিয়ে দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতিত যুবকের নাম শ্রী জয় চন্দ্র সরকার, সে ভাঙারি ব্যবসায়ী। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, দুটি শিকারি কুকুর যুবকটিকে কামড়াচ্ছে এবং কয়েকজন লোক লাঠি দিয়ে তাকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। কুকুরের কামড় ও লাঠির আঘাতে অসহায় যুবকটি যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। শুধু লিখব বলে অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে ভিডিওটি দেখেছি, যুবকটির চিৎকার যাতে কানে না আসে সেজন্য মোবাইলের সাউ- কিছুটা সময় বন্ধ করে রেখেছিলাম। কীভাবে একজন মানুষের উপর এমন অমানুষিক নির্যাতন করা সম্ভব হয়, যারা নির্যাতন করে তারা কি সত্যিই মানুষ! এদের মানসিক গঠন এত নিষ্ঠুরতায় আকীর্ণ কেন ? আশেপাশে এতগুলো মানুষ, কেউ কেন নির্যাতন রোধে এগিয়ে আসার সাহস করে না ?

বহু বছর আগে মতিঝিল বিমান অফিসের পাশে মোটরসাইকেলসহ কয়েকজন যুবককে উন্মত্ত জনতা পুড়িয়ে মেরেছিল। এই নৃশংস ঘটনা সর্বত্র আলোড়ন তুলেছিল। কারণ তখন এখনকার সময়ের মতো এত ঘন ঘন রোমহর্ষক ঘটনা ঘটত না।

ষাটের দশকে পাকিস্তান আমলে আমাদের ফেনী জেলার জিএমহাট এলাকায় এক হিন্দু মহাজনের বাড়িতে ডাকাতি করে চলে যাওয়ার সময় গ্রামবাসী তাড়া করে এক বিরাট ফসলের মাঠে দুই ডাকাতকে পিটিয়ে মেরে ফেলে, ডাকাতেরা গুলি ছুঁড়লেও মানুষ পিছু হটেনি। এই ঘটনার কয়েকদিন আগে আরেকটি হিন্দু বাড়িতে ডাকাতি হলে পুলিশ কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায়। পরপর দুইদিন ডাকাতি হওয়ায় মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেছিল। এলাকাবসীর ক্ষিপ্ত হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে নিরীহ গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করা। কিন্তু ডাকাত মেরে ফেলার পর শুধু ফেনী থেকে নয়, পুলিশের হেড কোয়ার্টার থেকেও দলে দলে পুলিশ আসতে থাকে, এলাকায় ভীতিজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়। ডাকাত হলেও তারা মানুষ, দুইজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা পাকিস্তান আমলেও স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়নি। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যানসহ গণ্যমান্য লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বহুবার। তখন ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল ছিল না বিধায় ডাকাত হত্যাকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

হুমায়ূন আহমেদের ‘নিমফুল’ নাটকটি বহু বছর আগে দেখেছি। ধৃত মনা ডাকাত বা অভিনেতা আসাদুজ্জমান নূরকে তার শিশু সন্তানসহ একটি গাছের সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে কয়েকবার মারা হয়। মোড়ল চৌধুরী সাহেবের বৈঠকখানায় প্রধান শিক্ষকের পরামর্শ মোতাবেক বাদ আছর খেজুর কাঁটা দিয়ে মনার চোখ তোলার সিদ্ধান্ত হয়। চোখ তোলার মনকাড়া দৃশ্য দেখার জন্য মাইকিং করার পাশাপাশি ভোজের আয়োজনও করা হয়। এত ভয় ও বিপদের মধ্যেও ডাকাত মনা ও তার শিশু সন্তানের ক্ষিধা লাগে, রান্না করার পোলাওর গন্ধ পায়। মোড়লের কিশোরী মেয়ে মদিনা ব্যতীত আর কারোরই ডাকাতের প্রতি দরদ নেই। কিশোরী মদিনা চোরের শিশু সন্তানটিকে পানি দিয়ে বাবার চৌধুরী সাহেবের হাতে চড় খেয়েছে। মাইকে চোখ তোলার খবর শুনে দেখার জন্য শিশুরাও ছুটে এসেছে। ডাকাত মনার চোখ তোলার জন্য সমাজের আবালবৃদ্ধবনিতার মধ্যে যে উৎসাহ-উদ্দীপনার আমেজ তৈরি হয় তা ক্ষমাহীন হিংস্রতা ছাড়া আর কিছুই নয়। নাটকের একটি সংলাপ হচ্ছে, ‘মাঝে মাঝে মানুষ আর মানুষ থাকে না, পিশাচ হয়ে যায়’।

ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী চোরের হাত কাটার আইন আছে। এই আইন প্রয়োগে হযরত ওমর (রা.) কিন্তু তার নিজস্ব বিচার-বিবেচনা আমলে নিয়েছিলেন। কেন চুরি করল, চুরি করার আগে চোরের খাবারের ব্যবস্থা রাষ্ট্রের তরফ থেকে করা হয়েছিল কিনা ইত্যাদি। দুর্ভিক্ষের সময় তিনি চোরের হাত কাটা বন্ধ রেখেছিলেন। নিশ্চয়ই খলিফা ওমর (রা.) বুঝতে পেরেছিলেন, উপবাসী লোকের পেটে খাবার না থাকলে ধর্মের নীতি কথায় মানুষ ঈমান রাখতে পারে না। পেটের দায়ে মানুষ ডাস্টবিন, নর্দমা থেকেও কুড়িয়ে খায়। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে এক যুবককে লাঠি দিয়ে যত্রতত্র নারীদের পেটাতে দেখা গেল, তার ভাষ্যমতে তারা ‘বেশ্যা’। তার কথিত ‘বেশ্যা’কে পিটানোর জন্য এই যুবক কক্সবাজারেও পৌঁছে যায়, এবং পুলিশের সামনে সে এক মেয়েকে পিটায়।এই যুবক ইরানের নৈতিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছিল। যারা রাস্তাঘাটে নৈতিক পুলিশ সাজে তারা কখনো একটি টাকাও ভিক্ষা দেয় না, ভিক্ষা চাইলে বলবে, ‘কাজ করতে পারিস না’। শামীম ওসমানও নারায়ণগঞ্জের টানবাজার থেকে পিটিয়ে যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করেছিল, কিন্তু তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার গরজ বোধ করেনি। গৃহহীন মা যখন তার সন্তানের খাবার জোগাড় করতে পারে না, না খেয়ে বিনা ওষুধে আস্তে আস্তে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয় তখন সেই মা তার দেহ বিক্রির সময় নৈতিক পুলিশের লাঠিকে ভয় করে না।

একবার একটা স্লোগান ওঠেছিল, অস্ত্র ঠেকিয়ে টাকা ছিনতাই করলে যদি সন্ত্রাসী হয়, তাহলে ফাইল ঠেকিয়ে ঘুষ খাওয়াও সন্ত্রাস। অর্থের বিনিময়ে দেহ বিক্রি করলে যদি বেশ্যা হয়, অর্থের বিনিময়ে যে নৈতিকতা বেচে সেও বেশ্যা। নৈতিকতা বিক্রি হয় অর্থ নিয়ে ফাইল সই করলে, চাকরি দিলে, নমিনেশন বিক্রি করলে, দলের পদ বেচলে, মিথ্যা লেখার কলম চালনায়। চোর ধরার আগ্রহ থাকলে শ্বেতপত্রে উল্লেখিত ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচারকারী চোরদের ধরা হোক, ভাঙারি ব্যবসায়ী তামার তার চোরকে নয়। ইংরেজেরা ভারতবর্ষ থেকে সব চুরি করে ইংল্যা-ে নিয়ে গেল, পূর্ব পাকিস্তানকে লুণ্ঠন করে পশ্চিম পাকিস্তানে তিন তিনটি রাজধানী তৈরি করা হলো। অবৈধ অর্থ পাচার করে মালয়েশীয়াকে ‘সেকে- হোম’ এবং কানাডাকে ‘বেগমপাড়া’ করল- অথচ বিগত তের মাসে একজন চোরও ধরা হলো না, একটি টাকাও ফেরত আনা সম্ভব হলো না। কোটি কোটি টাকা চুরির খবর এখনো শোনা যায়। এত বড় একটি গণঅভ্যুত্থানের পরও চুরি হলে অতীতের চুরি অটোমেটিক্যালি জায়েজ হয়ে যায়।

মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় রচনা পর্যায়ে ‘চোরের আত্মকাহিনী’ মুখস্ত করেছিলাম। সেখানেও দলবেঁধে লোকজন চোরকে পিটিয়েছে। এক পথচারী বাবা তার কাঁধের শিশু সন্তানকে ভীড় ঠেলে রক্তাক্ত চোর দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাপজান, চোর দেখেছ’? শিশুটি উত্তর দিল, ‘বাবা, চোর কই, ও তো মানুষ’। এত পিটুনি, কিল, গুতা খাওয়ার পরও চোর কান্না করেনি, কিন্তু শিশুটির কথা কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। গণঅভ্যুত্থানের শুরু থেকে অদ্যাবধি মানুষ মারার রোমহর্ষক ঘটনার নানাবিধ ভিডিও দেখে দেখে মনে হয়েছে, মানুষ মারার মধ্যে একটা আনন্দ আছে, এই আনন্দ স্বজাতি মারার আনন্দ। সম্প্রতি নদী থেকে প্রায়ই লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের নদীগুলো যেন লাশের ভাসমান কবরস্থান। নদীতে লাশ ফেলা হলে প্রমাণ লোপাট করা সহজ। নির্বিঘেœ এই জঘন্য অপরাধ অনবচ্ছিন্ন রাখা সম্ভব হলে গুম আর ক্রস ফায়ারিংয়ের ঝুঁকি নিতে হবে না।

মানুষের ভিতর প্রতিকারহীন ধ্বংসাত্মাক প্রবণতা রয়েছে। তাই জিওগ্রাফি চ্যানেলে আজকাল শিশুরাও বাঘের হরিণ শিকার দেখে আনন্দ পায়, আনন্দ পায় বাঘ আর কুমিরের লড়াই দেখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের সৈন্যরা যেভাবে মানুষ খুন করেছে, পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরাও ঠিক একই পদ্ধতিতে মানুষ হত্যা করেছে। এখন ইসরায়েলের সৈন্যরা আরো নিষ্ঠুরতার সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। মানুষের হাতে মানুষ মরছে মালয়েশীয়ার বনজঙ্গলে, লিবিয়ার দুর্গম এলাকায়, কলম্বিয়ার ড্রাগ কার্টেলের নির্মম প্রতিহিংসায়। মানুষ মানুষকে নিপীড়ন করে আনন্দ পায় বলেই রেসলিং জনপ্রিয় খেলা। রোমান সম্রাটসহ হাজার হাজার দর্শককে আনন্দ দিতেই খোলা মাঠে বা খাঁচার ভিতর আয়োজন করা হতো মানুষে মানুষে দ্বন্দ্বযুদ্ধ, মানুষ আর হিংস্র পশুর লড়াই। এই লড়াই চলত মৃত্যু পর্যন্ত।লক্ষ লক্ষ বছর পার করে মানুষ অনেক ক্ষেত্রে সভ্য হলেও মানুষ হত্যার আদিম স্বভাব পরিত্যাগ করেনি। করেনি বলেই স্টিল মিলে তার চুরির অপরাধে এক যুবককে বেদম পিটুনির পাশাপাশি জার্মান শেফার্ড কুকুর লেলিয়ে দিতে পেরেছে।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]

ডেঙ্গু সংকট দূরদৃষ্টির ব্যর্থতা

ষাটের দশকে বামপন্থী ভাবনার উত্থান ও বিবর্তন

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে!

বায়ুর অপর নাম জীবন

ছবি

হাওরের জীবন ও সংস্কৃতি

বিখণ্ডিত আত্মপরিচয়: তরল সহানুভূতিতে নৈতিক মূলধনের সমাজতত্ত্ব

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

পোশাক শিল্প : অগ্রগতি ও শ্রমিকের অধিকার

গণভোটের রাজনৈতিক গুরুত্ব

বামঘরানার বাটখারা...

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

নৃশংসতার ভিডিও, নীরব দর্শক আর হারিয়ে যাওয়া মানবতা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

রোববার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কুমিল্লার বুড়িচংয়ে সাকুরা স্টিল মিলে তামার তার চুরির অভিযোগে এক যুবককে ধরে দুটি জার্মান শেফার্ড কুকুর লেলিয়ে দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতিত যুবকের নাম শ্রী জয় চন্দ্র সরকার, সে ভাঙারি ব্যবসায়ী। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, দুটি শিকারি কুকুর যুবকটিকে কামড়াচ্ছে এবং কয়েকজন লোক লাঠি দিয়ে তাকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। কুকুরের কামড় ও লাঠির আঘাতে অসহায় যুবকটি যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। শুধু লিখব বলে অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে ভিডিওটি দেখেছি, যুবকটির চিৎকার যাতে কানে না আসে সেজন্য মোবাইলের সাউ- কিছুটা সময় বন্ধ করে রেখেছিলাম। কীভাবে একজন মানুষের উপর এমন অমানুষিক নির্যাতন করা সম্ভব হয়, যারা নির্যাতন করে তারা কি সত্যিই মানুষ! এদের মানসিক গঠন এত নিষ্ঠুরতায় আকীর্ণ কেন ? আশেপাশে এতগুলো মানুষ, কেউ কেন নির্যাতন রোধে এগিয়ে আসার সাহস করে না ?

বহু বছর আগে মতিঝিল বিমান অফিসের পাশে মোটরসাইকেলসহ কয়েকজন যুবককে উন্মত্ত জনতা পুড়িয়ে মেরেছিল। এই নৃশংস ঘটনা সর্বত্র আলোড়ন তুলেছিল। কারণ তখন এখনকার সময়ের মতো এত ঘন ঘন রোমহর্ষক ঘটনা ঘটত না।

ষাটের দশকে পাকিস্তান আমলে আমাদের ফেনী জেলার জিএমহাট এলাকায় এক হিন্দু মহাজনের বাড়িতে ডাকাতি করে চলে যাওয়ার সময় গ্রামবাসী তাড়া করে এক বিরাট ফসলের মাঠে দুই ডাকাতকে পিটিয়ে মেরে ফেলে, ডাকাতেরা গুলি ছুঁড়লেও মানুষ পিছু হটেনি। এই ঘটনার কয়েকদিন আগে আরেকটি হিন্দু বাড়িতে ডাকাতি হলে পুলিশ কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায়। পরপর দুইদিন ডাকাতি হওয়ায় মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেছিল। এলাকাবসীর ক্ষিপ্ত হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে নিরীহ গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করা। কিন্তু ডাকাত মেরে ফেলার পর শুধু ফেনী থেকে নয়, পুলিশের হেড কোয়ার্টার থেকেও দলে দলে পুলিশ আসতে থাকে, এলাকায় ভীতিজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়। ডাকাত হলেও তারা মানুষ, দুইজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা পাকিস্তান আমলেও স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়নি। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যানসহ গণ্যমান্য লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বহুবার। তখন ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল ছিল না বিধায় ডাকাত হত্যাকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

হুমায়ূন আহমেদের ‘নিমফুল’ নাটকটি বহু বছর আগে দেখেছি। ধৃত মনা ডাকাত বা অভিনেতা আসাদুজ্জমান নূরকে তার শিশু সন্তানসহ একটি গাছের সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে কয়েকবার মারা হয়। মোড়ল চৌধুরী সাহেবের বৈঠকখানায় প্রধান শিক্ষকের পরামর্শ মোতাবেক বাদ আছর খেজুর কাঁটা দিয়ে মনার চোখ তোলার সিদ্ধান্ত হয়। চোখ তোলার মনকাড়া দৃশ্য দেখার জন্য মাইকিং করার পাশাপাশি ভোজের আয়োজনও করা হয়। এত ভয় ও বিপদের মধ্যেও ডাকাত মনা ও তার শিশু সন্তানের ক্ষিধা লাগে, রান্না করার পোলাওর গন্ধ পায়। মোড়লের কিশোরী মেয়ে মদিনা ব্যতীত আর কারোরই ডাকাতের প্রতি দরদ নেই। কিশোরী মদিনা চোরের শিশু সন্তানটিকে পানি দিয়ে বাবার চৌধুরী সাহেবের হাতে চড় খেয়েছে। মাইকে চোখ তোলার খবর শুনে দেখার জন্য শিশুরাও ছুটে এসেছে। ডাকাত মনার চোখ তোলার জন্য সমাজের আবালবৃদ্ধবনিতার মধ্যে যে উৎসাহ-উদ্দীপনার আমেজ তৈরি হয় তা ক্ষমাহীন হিংস্রতা ছাড়া আর কিছুই নয়। নাটকের একটি সংলাপ হচ্ছে, ‘মাঝে মাঝে মানুষ আর মানুষ থাকে না, পিশাচ হয়ে যায়’।

ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী চোরের হাত কাটার আইন আছে। এই আইন প্রয়োগে হযরত ওমর (রা.) কিন্তু তার নিজস্ব বিচার-বিবেচনা আমলে নিয়েছিলেন। কেন চুরি করল, চুরি করার আগে চোরের খাবারের ব্যবস্থা রাষ্ট্রের তরফ থেকে করা হয়েছিল কিনা ইত্যাদি। দুর্ভিক্ষের সময় তিনি চোরের হাত কাটা বন্ধ রেখেছিলেন। নিশ্চয়ই খলিফা ওমর (রা.) বুঝতে পেরেছিলেন, উপবাসী লোকের পেটে খাবার না থাকলে ধর্মের নীতি কথায় মানুষ ঈমান রাখতে পারে না। পেটের দায়ে মানুষ ডাস্টবিন, নর্দমা থেকেও কুড়িয়ে খায়। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে এক যুবককে লাঠি দিয়ে যত্রতত্র নারীদের পেটাতে দেখা গেল, তার ভাষ্যমতে তারা ‘বেশ্যা’। তার কথিত ‘বেশ্যা’কে পিটানোর জন্য এই যুবক কক্সবাজারেও পৌঁছে যায়, এবং পুলিশের সামনে সে এক মেয়েকে পিটায়।এই যুবক ইরানের নৈতিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছিল। যারা রাস্তাঘাটে নৈতিক পুলিশ সাজে তারা কখনো একটি টাকাও ভিক্ষা দেয় না, ভিক্ষা চাইলে বলবে, ‘কাজ করতে পারিস না’। শামীম ওসমানও নারায়ণগঞ্জের টানবাজার থেকে পিটিয়ে যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করেছিল, কিন্তু তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার গরজ বোধ করেনি। গৃহহীন মা যখন তার সন্তানের খাবার জোগাড় করতে পারে না, না খেয়ে বিনা ওষুধে আস্তে আস্তে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয় তখন সেই মা তার দেহ বিক্রির সময় নৈতিক পুলিশের লাঠিকে ভয় করে না।

একবার একটা স্লোগান ওঠেছিল, অস্ত্র ঠেকিয়ে টাকা ছিনতাই করলে যদি সন্ত্রাসী হয়, তাহলে ফাইল ঠেকিয়ে ঘুষ খাওয়াও সন্ত্রাস। অর্থের বিনিময়ে দেহ বিক্রি করলে যদি বেশ্যা হয়, অর্থের বিনিময়ে যে নৈতিকতা বেচে সেও বেশ্যা। নৈতিকতা বিক্রি হয় অর্থ নিয়ে ফাইল সই করলে, চাকরি দিলে, নমিনেশন বিক্রি করলে, দলের পদ বেচলে, মিথ্যা লেখার কলম চালনায়। চোর ধরার আগ্রহ থাকলে শ্বেতপত্রে উল্লেখিত ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচারকারী চোরদের ধরা হোক, ভাঙারি ব্যবসায়ী তামার তার চোরকে নয়। ইংরেজেরা ভারতবর্ষ থেকে সব চুরি করে ইংল্যা-ে নিয়ে গেল, পূর্ব পাকিস্তানকে লুণ্ঠন করে পশ্চিম পাকিস্তানে তিন তিনটি রাজধানী তৈরি করা হলো। অবৈধ অর্থ পাচার করে মালয়েশীয়াকে ‘সেকে- হোম’ এবং কানাডাকে ‘বেগমপাড়া’ করল- অথচ বিগত তের মাসে একজন চোরও ধরা হলো না, একটি টাকাও ফেরত আনা সম্ভব হলো না। কোটি কোটি টাকা চুরির খবর এখনো শোনা যায়। এত বড় একটি গণঅভ্যুত্থানের পরও চুরি হলে অতীতের চুরি অটোমেটিক্যালি জায়েজ হয়ে যায়।

মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় রচনা পর্যায়ে ‘চোরের আত্মকাহিনী’ মুখস্ত করেছিলাম। সেখানেও দলবেঁধে লোকজন চোরকে পিটিয়েছে। এক পথচারী বাবা তার কাঁধের শিশু সন্তানকে ভীড় ঠেলে রক্তাক্ত চোর দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাপজান, চোর দেখেছ’? শিশুটি উত্তর দিল, ‘বাবা, চোর কই, ও তো মানুষ’। এত পিটুনি, কিল, গুতা খাওয়ার পরও চোর কান্না করেনি, কিন্তু শিশুটির কথা কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। গণঅভ্যুত্থানের শুরু থেকে অদ্যাবধি মানুষ মারার রোমহর্ষক ঘটনার নানাবিধ ভিডিও দেখে দেখে মনে হয়েছে, মানুষ মারার মধ্যে একটা আনন্দ আছে, এই আনন্দ স্বজাতি মারার আনন্দ। সম্প্রতি নদী থেকে প্রায়ই লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের নদীগুলো যেন লাশের ভাসমান কবরস্থান। নদীতে লাশ ফেলা হলে প্রমাণ লোপাট করা সহজ। নির্বিঘেœ এই জঘন্য অপরাধ অনবচ্ছিন্ন রাখা সম্ভব হলে গুম আর ক্রস ফায়ারিংয়ের ঝুঁকি নিতে হবে না।

মানুষের ভিতর প্রতিকারহীন ধ্বংসাত্মাক প্রবণতা রয়েছে। তাই জিওগ্রাফি চ্যানেলে আজকাল শিশুরাও বাঘের হরিণ শিকার দেখে আনন্দ পায়, আনন্দ পায় বাঘ আর কুমিরের লড়াই দেখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের সৈন্যরা যেভাবে মানুষ খুন করেছে, পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরাও ঠিক একই পদ্ধতিতে মানুষ হত্যা করেছে। এখন ইসরায়েলের সৈন্যরা আরো নিষ্ঠুরতার সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। মানুষের হাতে মানুষ মরছে মালয়েশীয়ার বনজঙ্গলে, লিবিয়ার দুর্গম এলাকায়, কলম্বিয়ার ড্রাগ কার্টেলের নির্মম প্রতিহিংসায়। মানুষ মানুষকে নিপীড়ন করে আনন্দ পায় বলেই রেসলিং জনপ্রিয় খেলা। রোমান সম্রাটসহ হাজার হাজার দর্শককে আনন্দ দিতেই খোলা মাঠে বা খাঁচার ভিতর আয়োজন করা হতো মানুষে মানুষে দ্বন্দ্বযুদ্ধ, মানুষ আর হিংস্র পশুর লড়াই। এই লড়াই চলত মৃত্যু পর্যন্ত।লক্ষ লক্ষ বছর পার করে মানুষ অনেক ক্ষেত্রে সভ্য হলেও মানুষ হত্যার আদিম স্বভাব পরিত্যাগ করেনি। করেনি বলেই স্টিল মিলে তার চুরির অপরাধে এক যুবককে বেদম পিটুনির পাশাপাশি জার্মান শেফার্ড কুকুর লেলিয়ে দিতে পেরেছে।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]

back to top