alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বাংলার সংস্কৃতি : উৎস, বিবর্তন ও বর্তমান সমাজ-মনন

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫

সংস্কৃতি মানব সভ্যতার মর্মবস্তুর প্রতিফলন। এটি মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস, আচরণ, রুচি, মূল্যবোধ ও জীবনযাপনের ধারাকে প্রতিফলিত করে। প্রতিটি সমাজের রয়েছে নিজস্ব জীবনধারা ও আচার-বিশ্বাস, যা তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভিত্তি। বাংলার সংস্কৃতি সেই অর্থে একটি অনন্য উদাহরণÑএটি যেমন আদি সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করে, তেমনি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহিরাগত প্রভাব, সংঘাত ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে এক স্বতন্ত্র জাতিসত্তা।

‘সংস্কৃতি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে, যার অর্থ ‘সংস্কৃত হওয়া’ বা ‘চর্চার মাধ্যমে পরিশীলিত হওয়া’। ইংরেজি শব্দ কালচার থেকে এর আধুনিক অর্থের প্রচলন হয়। ড. স্যামুয়েল পুফেনডর্ফের মতে, সংস্কৃতি হলো মানুষের বর্বরতা কাটিয়ে সভ্য জীবনে প্রবেশের প্রক্রিয়া। নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেইলর ১৮৭১ সালে বলেন, সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত সমস্ত আচরণ, জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি ও প্রথার সমষ্টিই সংস্কৃতি।

ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা হেলেন স্পেনসার-ওটেইয়ের মতে, সংস্কৃতি হলো একদল মানুষের ভাগাভাগি করা কিছু মৌলিক অনুমান, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, নীতিমালা ও আচরণের সমষ্টি, যা তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও জীবনযাপনের ধরনকে প্রভাবিত করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একে আরও মানবিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেনÑ“সংস্কৃতি মানে মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া।” তাঁর মতে, সংস্কৃতি কেবল রীতি-নীতি নয়, এটি মানুষকে নৈতিক ও নান্দনিকভাবে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়।

বাংলার আদি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল আর্য আগমনের আগেই। অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও তিব্বত-চীন গোষ্ঠীর মানুষ এ অঞ্চলে বসবাস করত। তারা প্রকৃতি-পূজক ছিলÑগাছপালা, নদ-নদী, সূর্য, চাঁদ ও বৃষ্টি ছিল তাদের ধর্মীয় উপাসনার কেন্দ্র। সমাজ ছিল মূলত কৃষিনির্ভর ও গোষ্ঠীগত। তারা গান, নৃত্য ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করত।

এই অনার্য সংস্কৃতির মধ্যে ছিল উৎসব ও আচার যেমনÑভ্রাতৃদ্বিতীয়া (ভাইফোঁটা), নবান্ন, অষ্টমী স্নান, রথযাত্রা, হোলি ও গঙ্গাস্নান। গ্রামীণ হাট ও মেলাও তখনকার সামাজিক জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। বয়ন, মৃৎশিল্প, পোড়ামাটির ভাস্কর্য, টেরাকোটা নির্মাণÑএসব ছিল তাদের শিল্পকলা ও কারুশিল্পের পরিচায়ক।

আর্যদের আগমনের পর বাংলার সংস্কৃতিতে ঘটে এক নতুন পরিবর্তন। ব্রাহ্মণ্যধর্ম, বেদ, আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। তবে এই সংঘাত পরিণত হয় এক সমন্বিত সংস্কৃতিতেÑযেখানে অনার্যদের প্রকৃতিপূজা ও লোকবিশ্বাস মিশে যায় আর্য ধর্মীয় আচারে। এই যুগে জন্ম নেয় বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি, যা একদিকে ধর্মীয়, অন্যদিকে জীবনঘনিষ্ঠ।

লোকসংস্কৃতি পরবর্তীতে বাঙালির মূল সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। আহমদ শরীফ যথার্থই বলেছেন, “বাঙালির ইতিহাস আসলে লোকজ জীবনধারার ইতিহাস।”

মধ্যযুগে বাংলার সংস্কৃতিতে ইসলামী প্রভাব প্রবল হয়ে ওঠে। মুসলিম শাসকগোষ্ঠী এখানে রাজনৈতিক স্থিতি প্রতিষ্ঠা করলে পারস্য-আরব-তুর্কি সভ্যতার প্রভাব আসে ভাষা, পোশাক, রন্ধনপ্রণালী ও সংগীতে। সুফি সাধক ও বৈষ্ণব সাধকদের মিলনে গড়ে ওঠে এক সহনশীল মানবতাবাদী সংস্কৃতি।

লালন, চ-ীদাস, শাহ আবদুল করিম প্রমুখ সাধকরা প্রেম, মানবতা ও সাম্যের বাণী ছড়িয়ে দেন। এই ধারাই পরে বাউল, মরমি গান ও কবিগানের মতো সংগীতরীতির জন্ম দেয়Ñযা আজও বাংলার প্রাণসংগীত।

অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে ইউরোপীয় প্রভাব ও শিক্ষা বিস্তারের ফলে শুরু হয় বঙ্গীয় নবজাগরণ। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরÑতাঁরা শুধু সাহিত্য বা সমাজসংস্কারক ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন সংস্কৃতির নবনির্মাতা।

রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃতিকে দেখেছেন মানুষ ও প্রকৃতির ঐক্যের মধ্যে, নজরুল ইসলাম একে দেখেছেন সংগ্রামী চেতনায়, আর লালন একে দেখেছেন মানবপ্রেমের সাধনায়। এই তিন ধারা মিলে তৈরি করে আধুনিক বাঙালিত্বের ভিত্তি।

বাংলাদেশের সংস্কৃতি মূলত বাঙালি সংস্কৃতির ধারাবাহিক রূপ, তবে এখানে রয়েছে নিজস্বতা ও বহুমাত্রিকতা। ভাষা, পোশাক, ভোজনরীতি, সংগীত, নৃত্য, উৎসবÑসবকিছুতেই প্রকাশ পায় বৈচিত্র্য ও ঐক্যের মেলবন্ধন।

ভাষা ও সাহিত্য: বাংলা ভাষা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মেরুদ-। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার অধিকার নয়, সংস্কৃতির আত্মরক্ষার লড়াই ছিল।

সঙ্গীত: বাউল, ভাটিয়ালি, মারফতি, নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক গানÑসবই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যের অংশ।

নৃত্য ও নাটক: মণিপুরী নৃত্য, যাত্রা, পালাগান, এবং সাম্প্রতিক সময়ে নাট্যমঞ্চের বিকাশ বাংলাদেশের শিল্পচেতনা বহন করে।

রন্ধনশৈলী: ভাত, মাছ, ভর্তা, পিঠাÑএসব খাবার কেবল খাদ্য নয়, সংস্কৃতির প্রতীক।

উৎসব: পহেলা বৈশাখ, নবান্ন, ঈদ, দুর্গাপূজা, বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিনÑসব ধর্মের উৎসব মিলেমিশে এক সম্প্রীতির স্রোত তৈরি করেছে।

বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের সংস্কৃতি নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। গণমাধ্যম ও প্রযুক্তির প্রভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটছে দ্রুত। তবে এও সত্য যে, এই প্রভাবের ভেতর দিয়েই গড়ে উঠছে এক নতুন সমন্বিত আধুনিকতা। চলচ্চিত্র, ডিজিটাল কনটেন্ট, ফোকফিউশন সঙ্গীতÑসবই এই পরিবর্তনের প্রতিফলন।

তবু বাঙালির মাটির গন্ধ, লোকসংগীত, পহেলা বৈশাখের মঙ্গলশোভাযাত্রা বা গ্রামীণ মেলাÑএসব আজও আমাদের পরিচয়ের শেকড়কে জিইয়ে রেখেছে।

বর্তমানে লোকসংস্কৃতি কেবল গ্রামে সীমাবদ্ধ নয়; এটি নগরজীবনেরও অনুপ্রেরণা। বাউলগান এখন শহরের মঞ্চে, নবান্ন উৎসব বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর মেলা এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও।

লেখক আবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, “বাঙালি সংস্কৃতির কেন্দ্রে রয়েছে বৈচিত্র্েযর ঐক্য।” এই ঐক্যই আমাদের জাতিসত্তার মূল শক্তি।

বাংলার সংস্কৃতিতে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। প্রাচীন যুগে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে শুরু করে আজকের নারী শিল্পী, সাহিত্যিক ও রাজনীতিকÑসব জায়গায়ই নারীরা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। বাংলা সাহিত্যে সুফিয়া কামাল, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নারীচিত্র, বা আজকের রুনা লায়লা–সাবিনা ইয়াসমিনের সংগীতÑসবই সাংস্কৃতিক বিকাশের সাক্ষ্য।

বাংলার নদ-নদী, বর্ষা, শস্যক্ষেতÑসবই আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কৃষিনির্ভর সমাজ থেকেই এসেছে নবান্ন, বর্ষা উৎসব, পিঠা-পায়েস, ধান কাটা গান। প্রকৃতি তাই শুধু পটভূমি নয়, আমাদের সাংস্কৃতিক সত্তার প্রাণ।

বর্তমান সময়ে ভোক্তাবাদ, কৃত্রিম বিনোদন, এবং বিদেশি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে দুর্বল করে তুলছে। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই লোকগান বা আদি আচার-অনুষ্ঠান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক শিক্ষার প্রসার, লোকসংস্কৃতির গবেষণা, এবং গণমাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতির ইতিবাচক প্রচার। জাতীয় শিক্ষানীতিতেও সংস্কৃতিচর্চাকে বাধ্যতামূলক করার দাবি উঠছে।

বাংলার সংস্কৃতি কোনো একদিনে গড়ে ওঠেনি। এটি সময়, ইতিহাস, জাতিগত মিশ্রণ, বিশ্বাস ও সংগ্রামের ফসল। এটি যেমন নদীর মতো বহমান, তেমনি গাছের মতো শিকড়বদ্ধ।

সংস্কৃতির পরিবর্তন সময়ের অনিবার্যতা, কিন্তু নিজস্ব শেকড় থেকে বিচ্যুতি মানেই আত্মপরিচয়ের ক্ষয়। তাই আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললেও আমাদের সংস্কৃতির মর্মমূলÑমানবতা, সম্প্রীতি, এবং প্রকৃতিপ্রেমÑঅক্ষুণœ রাখতে হবে।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেনÑ

“আমাদের সংস্কৃতি মানে আমাদের আত্মার প্রকাশ।”

বাংলার সংস্কৃতিও তাই আত্মারই প্রতিফলনÑযেখানে মাটি, মানুষ ও মন একাকার হয়ে আছে।

[লেখক: উন্নয়নকর্মী]

ভারত : এসআইআর এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন

মনে কী দ্বিধা নিয়ে...

নিরাপদ সড়ক ভাবনা

অপরিকল্পিত বাঁধ-শিল্পায়নে বিপর্যস্ত বরেন্দ্র কৃষি

ছবি

মামদানি দেখালেন নেতৃত্বের মূল পরিচয় কী

চেকের মামলায় বৈধ বিনিময়, লেনদেন, দেনা-পাওনা প্রমাণ ছাড়া আর জেল নয়

নবাগত শিক্ষকদের পেশাগত ভাবনা

মাদকাসক্তি: শুধু নিরাময় নয়, চাই সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার

আমেরিকার “নো কিংস” আন্দোলন

ঘি তো আমাদের লাগবেই, নো হাংকি পাংকি!

“মামদানি না জামদানি...”

ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষায় নীরব বিপ্লব

উপাত্ত সুরক্ষা আইন : গোপনীয়তা রক্ষা নাকি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ?

সমতা কি ন্যায্যতা নিশ্চিত করে?

ডেঙ্গু সংকট দূরদৃষ্টির ব্যর্থতা

ষাটের দশকে বামপন্থী ভাবনার উত্থান ও বিবর্তন

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে!

বায়ুর অপর নাম জীবন

ছবি

হাওরের জীবন ও সংস্কৃতি

বিখণ্ডিত আত্মপরিচয়: তরল সহানুভূতিতে নৈতিক মূলধনের সমাজতত্ত্ব

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

পোশাক শিল্প : অগ্রগতি ও শ্রমিকের অধিকার

গণভোটের রাজনৈতিক গুরুত্ব

বামঘরানার বাটখারা...

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বাংলার সংস্কৃতি : উৎস, বিবর্তন ও বর্তমান সমাজ-মনন

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫

সংস্কৃতি মানব সভ্যতার মর্মবস্তুর প্রতিফলন। এটি মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস, আচরণ, রুচি, মূল্যবোধ ও জীবনযাপনের ধারাকে প্রতিফলিত করে। প্রতিটি সমাজের রয়েছে নিজস্ব জীবনধারা ও আচার-বিশ্বাস, যা তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভিত্তি। বাংলার সংস্কৃতি সেই অর্থে একটি অনন্য উদাহরণÑএটি যেমন আদি সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করে, তেমনি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহিরাগত প্রভাব, সংঘাত ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে এক স্বতন্ত্র জাতিসত্তা।

‘সংস্কৃতি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে, যার অর্থ ‘সংস্কৃত হওয়া’ বা ‘চর্চার মাধ্যমে পরিশীলিত হওয়া’। ইংরেজি শব্দ কালচার থেকে এর আধুনিক অর্থের প্রচলন হয়। ড. স্যামুয়েল পুফেনডর্ফের মতে, সংস্কৃতি হলো মানুষের বর্বরতা কাটিয়ে সভ্য জীবনে প্রবেশের প্রক্রিয়া। নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেইলর ১৮৭১ সালে বলেন, সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত সমস্ত আচরণ, জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি ও প্রথার সমষ্টিই সংস্কৃতি।

ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা হেলেন স্পেনসার-ওটেইয়ের মতে, সংস্কৃতি হলো একদল মানুষের ভাগাভাগি করা কিছু মৌলিক অনুমান, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, নীতিমালা ও আচরণের সমষ্টি, যা তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও জীবনযাপনের ধরনকে প্রভাবিত করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একে আরও মানবিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেনÑ“সংস্কৃতি মানে মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া।” তাঁর মতে, সংস্কৃতি কেবল রীতি-নীতি নয়, এটি মানুষকে নৈতিক ও নান্দনিকভাবে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়।

বাংলার আদি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল আর্য আগমনের আগেই। অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও তিব্বত-চীন গোষ্ঠীর মানুষ এ অঞ্চলে বসবাস করত। তারা প্রকৃতি-পূজক ছিলÑগাছপালা, নদ-নদী, সূর্য, চাঁদ ও বৃষ্টি ছিল তাদের ধর্মীয় উপাসনার কেন্দ্র। সমাজ ছিল মূলত কৃষিনির্ভর ও গোষ্ঠীগত। তারা গান, নৃত্য ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করত।

এই অনার্য সংস্কৃতির মধ্যে ছিল উৎসব ও আচার যেমনÑভ্রাতৃদ্বিতীয়া (ভাইফোঁটা), নবান্ন, অষ্টমী স্নান, রথযাত্রা, হোলি ও গঙ্গাস্নান। গ্রামীণ হাট ও মেলাও তখনকার সামাজিক জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। বয়ন, মৃৎশিল্প, পোড়ামাটির ভাস্কর্য, টেরাকোটা নির্মাণÑএসব ছিল তাদের শিল্পকলা ও কারুশিল্পের পরিচায়ক।

আর্যদের আগমনের পর বাংলার সংস্কৃতিতে ঘটে এক নতুন পরিবর্তন। ব্রাহ্মণ্যধর্ম, বেদ, আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। তবে এই সংঘাত পরিণত হয় এক সমন্বিত সংস্কৃতিতেÑযেখানে অনার্যদের প্রকৃতিপূজা ও লোকবিশ্বাস মিশে যায় আর্য ধর্মীয় আচারে। এই যুগে জন্ম নেয় বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি, যা একদিকে ধর্মীয়, অন্যদিকে জীবনঘনিষ্ঠ।

লোকসংস্কৃতি পরবর্তীতে বাঙালির মূল সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। আহমদ শরীফ যথার্থই বলেছেন, “বাঙালির ইতিহাস আসলে লোকজ জীবনধারার ইতিহাস।”

মধ্যযুগে বাংলার সংস্কৃতিতে ইসলামী প্রভাব প্রবল হয়ে ওঠে। মুসলিম শাসকগোষ্ঠী এখানে রাজনৈতিক স্থিতি প্রতিষ্ঠা করলে পারস্য-আরব-তুর্কি সভ্যতার প্রভাব আসে ভাষা, পোশাক, রন্ধনপ্রণালী ও সংগীতে। সুফি সাধক ও বৈষ্ণব সাধকদের মিলনে গড়ে ওঠে এক সহনশীল মানবতাবাদী সংস্কৃতি।

লালন, চ-ীদাস, শাহ আবদুল করিম প্রমুখ সাধকরা প্রেম, মানবতা ও সাম্যের বাণী ছড়িয়ে দেন। এই ধারাই পরে বাউল, মরমি গান ও কবিগানের মতো সংগীতরীতির জন্ম দেয়Ñযা আজও বাংলার প্রাণসংগীত।

অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে ইউরোপীয় প্রভাব ও শিক্ষা বিস্তারের ফলে শুরু হয় বঙ্গীয় নবজাগরণ। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরÑতাঁরা শুধু সাহিত্য বা সমাজসংস্কারক ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন সংস্কৃতির নবনির্মাতা।

রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃতিকে দেখেছেন মানুষ ও প্রকৃতির ঐক্যের মধ্যে, নজরুল ইসলাম একে দেখেছেন সংগ্রামী চেতনায়, আর লালন একে দেখেছেন মানবপ্রেমের সাধনায়। এই তিন ধারা মিলে তৈরি করে আধুনিক বাঙালিত্বের ভিত্তি।

বাংলাদেশের সংস্কৃতি মূলত বাঙালি সংস্কৃতির ধারাবাহিক রূপ, তবে এখানে রয়েছে নিজস্বতা ও বহুমাত্রিকতা। ভাষা, পোশাক, ভোজনরীতি, সংগীত, নৃত্য, উৎসবÑসবকিছুতেই প্রকাশ পায় বৈচিত্র্য ও ঐক্যের মেলবন্ধন।

ভাষা ও সাহিত্য: বাংলা ভাষা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মেরুদ-। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার অধিকার নয়, সংস্কৃতির আত্মরক্ষার লড়াই ছিল।

সঙ্গীত: বাউল, ভাটিয়ালি, মারফতি, নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক গানÑসবই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যের অংশ।

নৃত্য ও নাটক: মণিপুরী নৃত্য, যাত্রা, পালাগান, এবং সাম্প্রতিক সময়ে নাট্যমঞ্চের বিকাশ বাংলাদেশের শিল্পচেতনা বহন করে।

রন্ধনশৈলী: ভাত, মাছ, ভর্তা, পিঠাÑএসব খাবার কেবল খাদ্য নয়, সংস্কৃতির প্রতীক।

উৎসব: পহেলা বৈশাখ, নবান্ন, ঈদ, দুর্গাপূজা, বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিনÑসব ধর্মের উৎসব মিলেমিশে এক সম্প্রীতির স্রোত তৈরি করেছে।

বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের সংস্কৃতি নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। গণমাধ্যম ও প্রযুক্তির প্রভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটছে দ্রুত। তবে এও সত্য যে, এই প্রভাবের ভেতর দিয়েই গড়ে উঠছে এক নতুন সমন্বিত আধুনিকতা। চলচ্চিত্র, ডিজিটাল কনটেন্ট, ফোকফিউশন সঙ্গীতÑসবই এই পরিবর্তনের প্রতিফলন।

তবু বাঙালির মাটির গন্ধ, লোকসংগীত, পহেলা বৈশাখের মঙ্গলশোভাযাত্রা বা গ্রামীণ মেলাÑএসব আজও আমাদের পরিচয়ের শেকড়কে জিইয়ে রেখেছে।

বর্তমানে লোকসংস্কৃতি কেবল গ্রামে সীমাবদ্ধ নয়; এটি নগরজীবনেরও অনুপ্রেরণা। বাউলগান এখন শহরের মঞ্চে, নবান্ন উৎসব বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর মেলা এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও।

লেখক আবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, “বাঙালি সংস্কৃতির কেন্দ্রে রয়েছে বৈচিত্র্েযর ঐক্য।” এই ঐক্যই আমাদের জাতিসত্তার মূল শক্তি।

বাংলার সংস্কৃতিতে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। প্রাচীন যুগে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে শুরু করে আজকের নারী শিল্পী, সাহিত্যিক ও রাজনীতিকÑসব জায়গায়ই নারীরা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। বাংলা সাহিত্যে সুফিয়া কামাল, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নারীচিত্র, বা আজকের রুনা লায়লা–সাবিনা ইয়াসমিনের সংগীতÑসবই সাংস্কৃতিক বিকাশের সাক্ষ্য।

বাংলার নদ-নদী, বর্ষা, শস্যক্ষেতÑসবই আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কৃষিনির্ভর সমাজ থেকেই এসেছে নবান্ন, বর্ষা উৎসব, পিঠা-পায়েস, ধান কাটা গান। প্রকৃতি তাই শুধু পটভূমি নয়, আমাদের সাংস্কৃতিক সত্তার প্রাণ।

বর্তমান সময়ে ভোক্তাবাদ, কৃত্রিম বিনোদন, এবং বিদেশি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে দুর্বল করে তুলছে। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই লোকগান বা আদি আচার-অনুষ্ঠান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক শিক্ষার প্রসার, লোকসংস্কৃতির গবেষণা, এবং গণমাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতির ইতিবাচক প্রচার। জাতীয় শিক্ষানীতিতেও সংস্কৃতিচর্চাকে বাধ্যতামূলক করার দাবি উঠছে।

বাংলার সংস্কৃতি কোনো একদিনে গড়ে ওঠেনি। এটি সময়, ইতিহাস, জাতিগত মিশ্রণ, বিশ্বাস ও সংগ্রামের ফসল। এটি যেমন নদীর মতো বহমান, তেমনি গাছের মতো শিকড়বদ্ধ।

সংস্কৃতির পরিবর্তন সময়ের অনিবার্যতা, কিন্তু নিজস্ব শেকড় থেকে বিচ্যুতি মানেই আত্মপরিচয়ের ক্ষয়। তাই আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললেও আমাদের সংস্কৃতির মর্মমূলÑমানবতা, সম্প্রীতি, এবং প্রকৃতিপ্রেমÑঅক্ষুণœ রাখতে হবে।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেনÑ

“আমাদের সংস্কৃতি মানে আমাদের আত্মার প্রকাশ।”

বাংলার সংস্কৃতিও তাই আত্মারই প্রতিফলনÑযেখানে মাটি, মানুষ ও মন একাকার হয়ে আছে।

[লেখক: উন্নয়নকর্মী]

back to top