alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

শ্লীলতা, অশ্লীলতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি

শেখর ভট্টাচার্য

: বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
image

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অনেক উল্লেখযোগ্য স্লোগান একদল রাজনৈতিক নেতার কয়েক ঘন্টার বক্তব্য থেকে শক্তিশালী বলে প্রমাণিত হয়েছে

রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রটি বিশাল তবে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের ভাষার মানের মধ্য দিয়ে রাজনীতি বা যে কোন রাজনৈতিক দলের সংস্কৃতি কিছুটা হলেও আঁচ করা সম্ভব হয়। মতামতের ভাষা আসলে কী? রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র থেকে শুরু করে নির্বাচনী ইস্তেহার পর্যন্ত মতামতের ভাষার বিস্তৃতি। তবে একটি দলের রাজনৈতিক ভাষার মান নাগরিকদের সামনে সব চেয়ে বেশি প্রকাশিত হয় দলটির সভায় ব্যবহৃত শব্দ, বাক্য, বিষয় উপস্থাপনার মাধ্যমে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পর্যবেক্ষকরা মনে করেন একটি রাজনৈতিক দলের স্লোগানের ভেতর দিয়ে সে দলের সমর্থক কিংবা সাধারণ, অসাধারণ মানুষেরা সব চেয়ে বেশি আন্দোলিত হয়ে থাকেন। স্লোগানের মানের কারনে সমর্থকেরা উচ্ছ্বসিত, উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অনেক উল্লেখযোগ্য স্লোগান একদল রাজনৈতিক নেতার কয়েক ঘন্টার বক্তব্য থেকে শক্তিশালী বলে প্রমাণিত হয়েছে। ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকের স্লোগান বিশ্লেষণ করলেই আমরা এই বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি গুলো পেয়ে যাবো।

রাজনীতির ভাষা রাজনৈতিক দলের আদর্শকে শানিত করে, চেতনাকে জনমনে প্রবাহিত করতে সহায়তা করে। সেই চেতনার অন্তর্নিহিত অর্থকে ধারণ করে সমর্থক এবং কখনো কখনো সমগ্র জাতি পরিশুদ্ধ হয়ে এগুতে থাকে। তবে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের ভাষা যখন কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল হয়ে উঠে তখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে জাতীয় সংস্কৃতিও মান হারিয়ে জাতিকে দিশেহারা করে তুলে। জাতি যতো বিভক্ত হয় ততোই হিংসা, প্রতিহিংসা, বিভেদ বাড়তে থাকতে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির উচ্চমান জাতীয় সংহতিকে সংহত করতে সহায়তা করে। বাংলাদেশের প্রতিটি গৌরবোজ্জ্বল আন্দোলনে আমরা দেখেছি স্লোগান কিংবা দেয়াল লিখনের মান জাতিকে লক্ষ্য অর্জনের দিকে ব্যাপক ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। আমারা যারা ষাটের দশকে জন্ম নিয়েছি কিংবা তারও পূর্বে, খিস্তি, খেঁউড় , অশালীন শব্দ, বাক্যকে রাজনৈতিক স্লোগান বা ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখিনি। সম্প্রতি আমাদের জাতীয় রুচির মানের এই অধপতনে সুশীল সমাজের সদস্য কিংবা রাজনৈতিক নেতবৃন্দের মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য শঙ্কা প্রকাশ হতে দেখা যাচ্ছে না।“সে এক অপার বিস্ময়”!

স্লোগান কিংবা বক্তব্য প্রকাশের অশ্লীলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সাহসী বক্তব্য প্রকাশ না করার অর্থ কী আমাদের সমাজ অশ্লীলতাকে এখন ধারণ করছে কিংবা এই অশ্লীলতা আমাদের প্রত্যাহিক জীবনের স্বাভাবিক অংশে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি যখন অশ্লীল স্লোগাননির্ভর হয়ে পড়ে, তখন সেখানে আদর্শের স্থান দখল করে বিদ্বেষ, যুক্তির জায়গা নেয় গালিগালাজ, আর নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে কুরুচিকর বাক্যবিন্যাস। দলীয় কর্মীদের উন্মাদনা প্রশ্রয় পেলে এমন স্লোগান সামাজিক অনিয়ম ও সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়। সম্প্রতি ব্যবহৃত রাজনতিক বক্তব্য শুধুমাত্র আমাদের নিম্নস্তরের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই প্রকাশ করছেনা, জাতীয় মূল্যবোধের নিম্নগামিতাকেও দৃশ্যমান করে তুলছে। এই নিম্নগামীতাকে যদি আমরা রুখতে না পারি তাহলে এক সময় রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিপূর্ণ শিষ্টাচার বহির্ভুত হয়ে যাবে। প্রগতিকামী, সুষ্টু সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা দুরূহ হয়ে যেতে পারে।বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে সম্প্রতি এমন এক ধারা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান, যা শুধু রাজনীতির শালীনতা ও সৌজন্য হারানোর ইঙ্গিতই নয়, বরং সামাজিক অবক্ষয়েরও অন্যতম প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মিছিল, সমাবেশ কিংবা অনলাইন প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে অশ্লীল, ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগানের প্রবাহ। ভাষার এ ধরনের অবক্ষয় কেবল একটি দলের বা ব্যক্তির দায় নয়Ñএটি একটি জাতিগত ব্যর্থতা, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনার ভিতকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিশেষ করে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের ভাষা কেনো ক্রমাগত নিম্নগামী হচ্ছে। রাজনীতির লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য যখন শুধু ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরা কিংবা ক্ষমতা কেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়ায় তখন হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা, বল প্রয়োগ হয়ে ওঠে ক্ষমতারোহনের হাতিয়ার। রাজনৈতিক সংগ্রামে যখন হিংসা বিদ্বেষ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে তখন সৌজন্য, শিষ্টাচার দুরীভূত হতে থাকে। মানুষ যখন প্রবল হিংসার আগুনে প্রজ্বলিত হতে থাকে তখন শব্দ প্রয়োগের শালীনতা হারিয়ে ফেলে। দিনের শেষে আমরা যে একটি জাতির অংশ, এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে সামাজিক, রাজনৈতিক সংহতি প্রয়োজন হয় সে কথাটি বিস্মৃত হলে জাতি হিসেবে আমরা দুর্বল হয়ে যাবো।

জাতি হিসেবে আমরা সব চেয়ে আবেগ প্রবণ ছিলাম বায়ান্নতে ভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনে। বায়ান্নতে সূচিত ভাষা আন্দোলনকে অনেকেই আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সূচনা হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। আশ্চর্যের বিষয় মুক্তিযুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশে অশ্লীল, অশালীন স্লোগান শুনা যায়নি। বরঞ্চ সে সময়ে স্লোগান ছিলো অনেকটা কবিতা ধর্মী। বাংলাদেশের ভূগোল যে ছিলো নদী বেষ্টিত একটি নির্দিষ্ট স্থান সে কথাটি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য উনসত্তরে কী অসাধারণ শ্লোগান উঠেছিলো মিছিল মিছিলে। “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা, মেঘœা যমুনা”। দেয়ালে দেয়ালে লেখা দেখেছি, “বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ সুতীক্ষè করো চিত্ত, বাংলার মাটি দূর্জয় ঘাটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত”।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে অনেক উচ্চস্বরের স্লোগান শুনেছি। স্বর উচ্চ তবে অশ্লীল স্লোগান শুনেছি বলে মনে পড়েনা। সর্বোচ্চ স্বরে কাব্যিক স্লোগান ছিলো কবি রফিক আজাদের কবিতার পঙক্তি। সময়ের সাথে প্রাসঙ্গিক একটি কবিতার পংক্তিকে আমাদের অশালীন মনে হয়নি মোটেই। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় কবি রফিক আজাদ লিখেন : ‘ভাত দে হারামজাদা/তা না হলে মানচিত্র খাব।’ উচ্চ কন্ঠ আর অশ্লীলতা কিন্তু সমান্তরাল নয়।

যারা মনে করছেন উচ্চারিত অশালীন স্লোগান, রাজনৈতিক বক্তব্য সময়ের ক্ষোভকে প্রকাশ করছে এবং এরকম প্রকাশিত হওয়া খুব স্বাভাবিক, তারা সময়কে পড়তে হয়তো কিছুটা হলেও ভুল করছেন। সুশীল সমাজ, জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব সময়কে পড়তে ভুল করলে এর দায়ভার কিন্তু সময়ের অভিভাবক হিসেবে নাগরিক সমাজ এবং রাজনৈতিক নেতাদের নিতে হবে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং সামাজিক সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্য। সামাজিক সংস্কৃতি যেমন রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিও একইভাবে সামাজিক সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। সমাজ থেকে উঠে আসা মানুষেরাই তো রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। সামজিক সংস্কৃতি যখন কলুষিত হয়ে পড়ে তখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিষ্কলুষ থাকতে পারেনা। একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করা উচিৎ এই সমাজ তথা দেশকে বাঁচাতে হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানকে রক্ষা করার দিকে নজর দিতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেহেতু আমাদের মতো দেশে প্রবল প্রভাব বিস্তারকারী আবাহ তৈরি করে তাই এর মানের উঠানামার সাথে সামাজিক সংস্কৃতির মানও ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হতে থাকে। উন্নত দেশে সামাজিক সংস্কৃতি রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে যা আমাদের দেশে সম্পূর্ণ বিপরীত।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৃশ্যমান অবনতিকে যারা দ্রোহের স্বভাবিক প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করবেন তারা জাতীয় সংস্কৃতির সার্বিক পতনকে তরান্বিত করার দায় এড়িয়ে যেতে পারবেন না।মনে রাখতে হবে রাজনীতিতে খিস্তি খেঁউড়ের সংস্কৃতিকে স্বাগতম জানালে এক সময় পুরো সমাজ অভব্য, সৌজন্যহীন হয়ে পড়বে।সমাজের ভেতরে ক্ষয় সৃষ্টি হলে একদিন ভেঙ্গে পড়বে শত বছরের ক্রমবিকাশমান গৌরবোজ্জ্বল জাতীয় সংস্কৃতি।

বাংলাদেশের অনেক সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ‘সমাজ শিশু-কিশোর তৈরি করে না, খিস্তি খেঁউড়ও তাদের দ্বারা সৃষ্ট নয়। এ’কারণে আমাদের কিশোরদের ক্ষোভ প্রকাশে যেসব শব্দ, বাক্য ব্যবহার করা হচ্ছে সে গুলো তাদের সৃষ্ট নয়! খিস্তি খেঁউড় সমাজ সৃষ্ট! আমাদের সমাজে নিপীড়নকারীদের আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে এবং সমাজে প্রচলিত শব্দকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে খিস্তি খেঁউড়ের প্রয়োগ শুরু হয়েছে। আজকাল যে কোন রাজনৈতিক মত প্রকাশে অভব্য, উচ্চারণ অযোগ্য শব্দ ব্যবহার করাকে অস্বাভাবিক বলে মনে করা হচ্ছেনা। অনেকেই মনে করেন নিপীড়িতরা অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেন প্রতীকী অর্থে।

যেভাবেই বিশ্লেষণ করা হোক না কেনো, আমরা যে অনাগত সময়ের জন্য সমাজ ও রাজনীতির ক্ষেত্রকে ভাগাড়ে পরিণত করছি সে কথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।রাজনৈতিক , সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন গুলো যদি এই বিপর্যয় রোধে (অনেকে হয়তো বিপর্যয় বলতে কুন্ঠা বোধ করবেন) এগিয়ে না আসেন তাহলে জাতীয় উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর বিষাক্ত প্রভাব আমাদেরকে হয়তো সীমাহীন সময় পর্যন্ত বহন করতে হবে। শুভ চিন্তার নাগরিকেরা কী বিষয়টিকে গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করে দেখছেন! এ বিষয়ে দ্রুত পথনকশা তৈরি না করলে বিপর্যয় রোধ কঠিন হয়ে যেতে পারে।

[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

পোশাক শিল্প : অগ্রগতি ও শ্রমিকের অধিকার

গণভোটের রাজনৈতিক গুরুত্ব

বামঘরানার বাটখারা...

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

অবহেলিত শিক্ষার দুর্দশা বাড়ছে

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

উপকূলের খাদ্যসংকট নিয়ে ভাবছেন কি নীতিনির্ধারকেরা?

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

শ্লীলতা, অশ্লীলতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি

শেখর ভট্টাচার্য

image

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অনেক উল্লেখযোগ্য স্লোগান একদল রাজনৈতিক নেতার কয়েক ঘন্টার বক্তব্য থেকে শক্তিশালী বলে প্রমাণিত হয়েছে

বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫

রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রটি বিশাল তবে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের ভাষার মানের মধ্য দিয়ে রাজনীতি বা যে কোন রাজনৈতিক দলের সংস্কৃতি কিছুটা হলেও আঁচ করা সম্ভব হয়। মতামতের ভাষা আসলে কী? রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র থেকে শুরু করে নির্বাচনী ইস্তেহার পর্যন্ত মতামতের ভাষার বিস্তৃতি। তবে একটি দলের রাজনৈতিক ভাষার মান নাগরিকদের সামনে সব চেয়ে বেশি প্রকাশিত হয় দলটির সভায় ব্যবহৃত শব্দ, বাক্য, বিষয় উপস্থাপনার মাধ্যমে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পর্যবেক্ষকরা মনে করেন একটি রাজনৈতিক দলের স্লোগানের ভেতর দিয়ে সে দলের সমর্থক কিংবা সাধারণ, অসাধারণ মানুষেরা সব চেয়ে বেশি আন্দোলিত হয়ে থাকেন। স্লোগানের মানের কারনে সমর্থকেরা উচ্ছ্বসিত, উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অনেক উল্লেখযোগ্য স্লোগান একদল রাজনৈতিক নেতার কয়েক ঘন্টার বক্তব্য থেকে শক্তিশালী বলে প্রমাণিত হয়েছে। ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকের স্লোগান বিশ্লেষণ করলেই আমরা এই বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি গুলো পেয়ে যাবো।

রাজনীতির ভাষা রাজনৈতিক দলের আদর্শকে শানিত করে, চেতনাকে জনমনে প্রবাহিত করতে সহায়তা করে। সেই চেতনার অন্তর্নিহিত অর্থকে ধারণ করে সমর্থক এবং কখনো কখনো সমগ্র জাতি পরিশুদ্ধ হয়ে এগুতে থাকে। তবে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের ভাষা যখন কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল হয়ে উঠে তখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে জাতীয় সংস্কৃতিও মান হারিয়ে জাতিকে দিশেহারা করে তুলে। জাতি যতো বিভক্ত হয় ততোই হিংসা, প্রতিহিংসা, বিভেদ বাড়তে থাকতে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির উচ্চমান জাতীয় সংহতিকে সংহত করতে সহায়তা করে। বাংলাদেশের প্রতিটি গৌরবোজ্জ্বল আন্দোলনে আমরা দেখেছি স্লোগান কিংবা দেয়াল লিখনের মান জাতিকে লক্ষ্য অর্জনের দিকে ব্যাপক ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। আমারা যারা ষাটের দশকে জন্ম নিয়েছি কিংবা তারও পূর্বে, খিস্তি, খেঁউড় , অশালীন শব্দ, বাক্যকে রাজনৈতিক স্লোগান বা ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখিনি। সম্প্রতি আমাদের জাতীয় রুচির মানের এই অধপতনে সুশীল সমাজের সদস্য কিংবা রাজনৈতিক নেতবৃন্দের মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য শঙ্কা প্রকাশ হতে দেখা যাচ্ছে না।“সে এক অপার বিস্ময়”!

স্লোগান কিংবা বক্তব্য প্রকাশের অশ্লীলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সাহসী বক্তব্য প্রকাশ না করার অর্থ কী আমাদের সমাজ অশ্লীলতাকে এখন ধারণ করছে কিংবা এই অশ্লীলতা আমাদের প্রত্যাহিক জীবনের স্বাভাবিক অংশে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি যখন অশ্লীল স্লোগাননির্ভর হয়ে পড়ে, তখন সেখানে আদর্শের স্থান দখল করে বিদ্বেষ, যুক্তির জায়গা নেয় গালিগালাজ, আর নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে কুরুচিকর বাক্যবিন্যাস। দলীয় কর্মীদের উন্মাদনা প্রশ্রয় পেলে এমন স্লোগান সামাজিক অনিয়ম ও সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়। সম্প্রতি ব্যবহৃত রাজনতিক বক্তব্য শুধুমাত্র আমাদের নিম্নস্তরের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই প্রকাশ করছেনা, জাতীয় মূল্যবোধের নিম্নগামিতাকেও দৃশ্যমান করে তুলছে। এই নিম্নগামীতাকে যদি আমরা রুখতে না পারি তাহলে এক সময় রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিপূর্ণ শিষ্টাচার বহির্ভুত হয়ে যাবে। প্রগতিকামী, সুষ্টু সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা দুরূহ হয়ে যেতে পারে।বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে সম্প্রতি এমন এক ধারা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান, যা শুধু রাজনীতির শালীনতা ও সৌজন্য হারানোর ইঙ্গিতই নয়, বরং সামাজিক অবক্ষয়েরও অন্যতম প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মিছিল, সমাবেশ কিংবা অনলাইন প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে অশ্লীল, ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগানের প্রবাহ। ভাষার এ ধরনের অবক্ষয় কেবল একটি দলের বা ব্যক্তির দায় নয়Ñএটি একটি জাতিগত ব্যর্থতা, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনার ভিতকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিশেষ করে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের ভাষা কেনো ক্রমাগত নিম্নগামী হচ্ছে। রাজনীতির লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য যখন শুধু ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরা কিংবা ক্ষমতা কেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়ায় তখন হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা, বল প্রয়োগ হয়ে ওঠে ক্ষমতারোহনের হাতিয়ার। রাজনৈতিক সংগ্রামে যখন হিংসা বিদ্বেষ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে তখন সৌজন্য, শিষ্টাচার দুরীভূত হতে থাকে। মানুষ যখন প্রবল হিংসার আগুনে প্রজ্বলিত হতে থাকে তখন শব্দ প্রয়োগের শালীনতা হারিয়ে ফেলে। দিনের শেষে আমরা যে একটি জাতির অংশ, এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে সামাজিক, রাজনৈতিক সংহতি প্রয়োজন হয় সে কথাটি বিস্মৃত হলে জাতি হিসেবে আমরা দুর্বল হয়ে যাবো।

জাতি হিসেবে আমরা সব চেয়ে আবেগ প্রবণ ছিলাম বায়ান্নতে ভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনে। বায়ান্নতে সূচিত ভাষা আন্দোলনকে অনেকেই আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সূচনা হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। আশ্চর্যের বিষয় মুক্তিযুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশে অশ্লীল, অশালীন স্লোগান শুনা যায়নি। বরঞ্চ সে সময়ে স্লোগান ছিলো অনেকটা কবিতা ধর্মী। বাংলাদেশের ভূগোল যে ছিলো নদী বেষ্টিত একটি নির্দিষ্ট স্থান সে কথাটি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য উনসত্তরে কী অসাধারণ শ্লোগান উঠেছিলো মিছিল মিছিলে। “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা, মেঘœা যমুনা”। দেয়ালে দেয়ালে লেখা দেখেছি, “বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ সুতীক্ষè করো চিত্ত, বাংলার মাটি দূর্জয় ঘাটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত”।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে অনেক উচ্চস্বরের স্লোগান শুনেছি। স্বর উচ্চ তবে অশ্লীল স্লোগান শুনেছি বলে মনে পড়েনা। সর্বোচ্চ স্বরে কাব্যিক স্লোগান ছিলো কবি রফিক আজাদের কবিতার পঙক্তি। সময়ের সাথে প্রাসঙ্গিক একটি কবিতার পংক্তিকে আমাদের অশালীন মনে হয়নি মোটেই। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় কবি রফিক আজাদ লিখেন : ‘ভাত দে হারামজাদা/তা না হলে মানচিত্র খাব।’ উচ্চ কন্ঠ আর অশ্লীলতা কিন্তু সমান্তরাল নয়।

যারা মনে করছেন উচ্চারিত অশালীন স্লোগান, রাজনৈতিক বক্তব্য সময়ের ক্ষোভকে প্রকাশ করছে এবং এরকম প্রকাশিত হওয়া খুব স্বাভাবিক, তারা সময়কে পড়তে হয়তো কিছুটা হলেও ভুল করছেন। সুশীল সমাজ, জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব সময়কে পড়তে ভুল করলে এর দায়ভার কিন্তু সময়ের অভিভাবক হিসেবে নাগরিক সমাজ এবং রাজনৈতিক নেতাদের নিতে হবে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং সামাজিক সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্য। সামাজিক সংস্কৃতি যেমন রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিও একইভাবে সামাজিক সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। সমাজ থেকে উঠে আসা মানুষেরাই তো রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। সামজিক সংস্কৃতি যখন কলুষিত হয়ে পড়ে তখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিষ্কলুষ থাকতে পারেনা। একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করা উচিৎ এই সমাজ তথা দেশকে বাঁচাতে হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানকে রক্ষা করার দিকে নজর দিতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেহেতু আমাদের মতো দেশে প্রবল প্রভাব বিস্তারকারী আবাহ তৈরি করে তাই এর মানের উঠানামার সাথে সামাজিক সংস্কৃতির মানও ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হতে থাকে। উন্নত দেশে সামাজিক সংস্কৃতি রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে যা আমাদের দেশে সম্পূর্ণ বিপরীত।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৃশ্যমান অবনতিকে যারা দ্রোহের স্বভাবিক প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করবেন তারা জাতীয় সংস্কৃতির সার্বিক পতনকে তরান্বিত করার দায় এড়িয়ে যেতে পারবেন না।মনে রাখতে হবে রাজনীতিতে খিস্তি খেঁউড়ের সংস্কৃতিকে স্বাগতম জানালে এক সময় পুরো সমাজ অভব্য, সৌজন্যহীন হয়ে পড়বে।সমাজের ভেতরে ক্ষয় সৃষ্টি হলে একদিন ভেঙ্গে পড়বে শত বছরের ক্রমবিকাশমান গৌরবোজ্জ্বল জাতীয় সংস্কৃতি।

বাংলাদেশের অনেক সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ‘সমাজ শিশু-কিশোর তৈরি করে না, খিস্তি খেঁউড়ও তাদের দ্বারা সৃষ্ট নয়। এ’কারণে আমাদের কিশোরদের ক্ষোভ প্রকাশে যেসব শব্দ, বাক্য ব্যবহার করা হচ্ছে সে গুলো তাদের সৃষ্ট নয়! খিস্তি খেঁউড় সমাজ সৃষ্ট! আমাদের সমাজে নিপীড়নকারীদের আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে এবং সমাজে প্রচলিত শব্দকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে খিস্তি খেঁউড়ের প্রয়োগ শুরু হয়েছে। আজকাল যে কোন রাজনৈতিক মত প্রকাশে অভব্য, উচ্চারণ অযোগ্য শব্দ ব্যবহার করাকে অস্বাভাবিক বলে মনে করা হচ্ছেনা। অনেকেই মনে করেন নিপীড়িতরা অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেন প্রতীকী অর্থে।

যেভাবেই বিশ্লেষণ করা হোক না কেনো, আমরা যে অনাগত সময়ের জন্য সমাজ ও রাজনীতির ক্ষেত্রকে ভাগাড়ে পরিণত করছি সে কথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।রাজনৈতিক , সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন গুলো যদি এই বিপর্যয় রোধে (অনেকে হয়তো বিপর্যয় বলতে কুন্ঠা বোধ করবেন) এগিয়ে না আসেন তাহলে জাতীয় উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর বিষাক্ত প্রভাব আমাদেরকে হয়তো সীমাহীন সময় পর্যন্ত বহন করতে হবে। শুভ চিন্তার নাগরিকেরা কী বিষয়টিকে গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করে দেখছেন! এ বিষয়ে দ্রুত পথনকশা তৈরি না করলে বিপর্যয় রোধ কঠিন হয়ে যেতে পারে।

[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top