হোসেন আবদুল মান্নান
দেশে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্টার নামে অসংখ্য স্বনামধন্য ও প্রাচীন স্কুলকে কলেজে রূপান্তর করা হয়েছে। এমন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। চারদিকে একাধিক অনুমোদিত কলেজ থাকা স্বত্বেও স্কুলকে কলেজ করার পেছনে কী উদ্দেশ্য ছিল তা বলা কঠিন। তবে সত্য যে, কতিপয় স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাইরে গিয়ে দেশের শতশত ঐতিহ্যবাহী স্কুলকে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় নাম দিয়ে চালু করা হয়েছে। এটি করা হয়েছে মূলত একই নামে, একই ক্যাম্পাসে এবং একই প্রশাসনিক ছাতার নিচে। এর জন্য মন্ত্রনালয়/বোর্ড থেকে যথারীতি অনুমতি পেয়ে যায়। পরবর্তীতে সাময়িকভাবে একটা টিনশেড ভবন করে নেয় এবং এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একই স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের বাধ্যগত ভর্তি করিয়ে উচ্চমাধ্যমিক কলেজের যাত্রা শুরু করে। পরে স্হানীয় রাজনীতির ঝান্ডাধারী প্রভাবশালী ব্যক্তিটি এর প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনিই ধীরে ধীরে অর্থের বিনিময়ে কয়েকজন অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে কিছু কামিয়ে নেন। এতে করেই তাদের প্রত্যাশিত কলেজ প্রতিষ্টার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায়।
এমন চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হওয়া অনেক প্রতিষ্টান সময়ের আবর্তে এখন প্রায় মুখথুবড়ে পড়ার মতন অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে দেশ ও জাতি একদিকে যেমন শতবর্ষী স্কুলের অতীতের গৌরবময় রেকর্ড হারাচ্ছে, একইসাথে একটা ভালো শিক্ষাবান্ধব কলেজের পরিবেশ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। আজকাল অনেক প্রবীণ শিক্ষক, গবেষক তথা শিক্ষাবিদ এমনটাই মনে করেন। এমনিতেই পেশাদার ভালো শিক্ষকের চরম সংকটের ভেতর দিয়ে চলেছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্হা। যোগ্যরা শিক্ষকতার পেশাকে এড়িয়ে চলছেন। সদ্যপ্রয়াত দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও আক্ষেপ করে বলেছিলেন, "দেশে শিক্ষক, গবেষক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক কেউ হতে চায় না। যেদিকে তাকাবেন সবাই প্রশাসক"। বলতে হবে, জাতি এখন পাকা ঘরে কাঁচা শিক্ষকের দুঃসময় অতিক্রম করে চলেছে।
দুই.
দেশে এত বিপুল সংখ্যক কলেজ হচ্ছে কেন? এগুলো কী কেবল ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বা শিক্ষার হার বৃদ্ধির জন্য?
সবক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়েছে রাজনৈতিক অবিমৃশ্যতায় বা উন্নাসিকতার হাত ধরে। আবার কিছু হয়েছে ব্যক্তিক ব্যবসায়িক মনস্তত্ত্ব থেকে। ধরা যাক, বাংলাদেশের একটা উপজেলার গড় আয়তন ২৫০ বর্গ কিঃ মিঃ। এবং জনসংখ্যার হার প্রতি উপজেলায় গড়ে ৩ লাখের কাছাকাছি। সেখানে গড়ে চার থেকে পাঁচটি কলেজ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত একটা ডিগ্রি কলেজ আছে। যা কয়েকবছর আগে এক আদেশে সরকারি বা জাতীয়করণ করা হয়ে গেছে। অবশিষ্টগুলি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ হিসেবে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রতিষ্টিত হয়ে চলমান আছে। যেগুলো একই কায়দায় এমপিও ভূক্ত হওয়ার আশীর্বাদ নিয়ে জীবন্মৃত হয়ে টিকে আছে। শিক্ষক কর্মচারী বেতন পাচ্ছে। ছাত্র ছাত্রীর আসা না আসা তখন কোনো সমস্যা নয়। তাছাড়া দেশের বর্তমান যোগাযোগ ব্যবস্হার উন্নয়নের আলোকে বলা যায়, যে কোনো একটা ইউনিয়ন থেকে উপজেলা সদরে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র আধা ঘণ্টা। এর বেশি হলে তা কদাচিৎ, কোথাও কোথাও। সর্বত্র নয়।
তাহলে এমন বাস্তবতায়, প্রতিষ্টিত স্কুলগুলোকে কলেজে পরিবর্তন করার হেতু কী? গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে এসব পুরানো স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের কেউ কেউ বড় মন্ত্রী, এমপি, আমলা, শিল্পপতি হিসেবে আভির্ভূত হয়েছেন। তখনই গ্রামীণ জনপদের প্রবীণ শ্রেণির গ্রহণযোগ্য মানুষকে সম্পৃক্ত করে এক শ্রেণির সুবিধালোভী,
রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা কাঙালরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করে ঐসব মানুষের দ্বারস্থ হয়ে যায়। চাটুকারিতা মোসাহেবি, তৈলমর্দন শুরু করে দেয়। তখন তার কাছে এদের অসংখ্য দাবিদাওয়ার মধ্যে অন্যতম প্রধান চাওয়া থাকে, ‘আপনার সেই স্কুলটিকে স্কুল এন্ড কলেজে পরিণত করে দিতে হবে’। এমন প্রস্তাবে তিনিও যারপরনাই আনন্দিত হন। মনের মধ্যে একটা মহৎ সামাজিক কাজের বাসনা জাগ্রত হয়ে ওঠে। যাক এবার জন্মস্থানের শিকড়ের জন্য কিছু একটা করে যেতে হবে। যা একদিন অবর্তমানে অর্থাৎ না থাকায়ও হয়তো কথা বলে যাবে। তিনি তখন যেকোনো কিছুর বিনিময়ে তার সেই শৈশবের প্রতিষ্টানকে উচ্চতর পর্যায়ে উপনীত করে দিয়ে যান। এক্ষেত্রে মন্ত্রনালয় বা সংশ্লিষ্ট বোর্ডও তাদের বিদ্যমান নীতিমালার ওপরও কাঁচি চালাতে কুন্ঠাবোধ করে না। কারণ, চাপ অনেক উপর থেকে অনবরত নিম্নগামী হচ্ছে। বলাবাহুল্য, মফস্বলে একটা কলেজ থেকে আরেকটার দূরত্ব নূন্যতম ৮ কি. মি. হতে হবে। তা মোটেও অনুসরণ করা হচ্ছে না। চাপে সবকিছু শিথিল করা হচ্ছে।
সুতরাং বলা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এভাবেই দেশের সেরা স্কুলগুলোর সবুজ প্রাঙ্গনেই কলেজের নামে সমাধি রচিত হয়েছে। একইসঙ্গে যিনি একজন প্রসিদ্ধ হেডমাস্টার হিসেবে যুগের পর যুগ সেবা দিয়ে এলাকায় খ্যাতিমান হয়েছিলেন; তিনি এখন প্রিন্সিপাল নামের বিশাল অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন। এতে করে কখনো কখনো তিনি নিজেও বিব্রতবোধ করেন।
তিন.
একটা পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি ও অনার্স কলেজের সংখ্যা ৩৩৬২ টি। দেশে মোট স্কুল এন্ড কলেজের সংখ্যা ১৫১৪ টি। এতে সংযুক্ত শিক্ষকের সংখ্যাও হাজার হাজার। উল্লেখ্য, শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য বা শিক্ষকের সংখ্যাই ১৫,০০০ হাজারের অধিক। এর মানে বিপুল সংখ্যক জনবল স্কুল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত আছেন। যার ব্যয়ভার সরকারই বহন করে চলেছে।
তবে স্কুলগুলোকে কলেজ করার নেতিবাচক দিকসমূহের মধ্যে অন্যতম হল, ছাত্র ছাত্রীর সংকট। চলতি শিক্ষা বর্ষে এসএসসি পরীক্ষায় পাশের হার খুব কম হওয়ায়, শতাধিক স্কুল এন্ড কলেজ এবং উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ ভর্তির জন্য এবার একজন ছাত্রও পায়নি। এটা কী ভাবা যায়? এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সর্বত্র কলেজের ছড়াছড়ি।
শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় কলেজের নাম না থাকা এবং অনুকূল যোগাযোগ মাধ্যম থাকায় ছাত্ররা জেলাশহরে পাড়ি দিচ্ছে। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্টান অর্থাৎ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়কে সহজলভ্য করে আনাচকানাচে গড়ে তোলার কুফল হিসাবেও তা দেখা যায়। উচ্চ শিক্ষা হাতের নাগালের মধ্যে চলে গেলে এর মানদ- ধরে রাখা কখনও সম্ভব হয় না। এটা পৃথিবীর কোথাও না। উচ্চশিক্ষা সবসময় শ্রম ও কষ্টের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রায় ৬০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা যায়।
এগুলোর ক্যাম্পাস, ভিসি, শিক্ষক, পাঠদান পদ্ধতি, ছাত্র ছাত্রীর উপস্থিতি, সনদপত্র বাণিজ্য সবকিছু নিয়েই আলোচনা সমালোচনা চলমান থাকে।
চার.
গ্রামীণ জনপদে বিদ্যমান সরকার অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে। এগুলোকে টিকিয়ে রাথতে হলে একসময় হয়তো আত্মীয়করণ প্রক্রিয়ায় যেতে হতে পারে। যেমন, খুব কাছাকাছিতে প্রতিষ্টিত ছোট কলেজকে বড় বা ছাত্রবহুল কলেজের সঙ্গে মার্জ করে দিতে হতে পারে। এমপিও ভূক্ত শিক্ষকদের অন্যত্র বদলির মাধ্যমে সমন্বয় করা হতে পারে। মানসম্মত ভালো শিক্ষালয় ছাত্রদের কাছে সবসময়ই আরাধ্য।
তা দূরে হোক বা কাছে তা বিবেচ্য নয়।
জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একবার বলেছিলেন, ‘শিক্ষিত আর অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে ব্যবধান ৬ মাইল’। এর ব্যাখা দিতে গিয়ে এই কিংবদন্তি নাকি বলেছিলেন, ‘বৃটিশ শাসন আমলে পূর্ববঙ্গে একটা স্কুল থেকে আরেকটার দূরত্ব গড়ে ৬ মাইল ছিল। পায়ে হেঁটে কষ্ট করে যারা গেছে তারা শিক্ষিত হয়েছে, আর যারা যায়নি তারা অশিক্ষিত রয়ে গেছে’।
কাজেই ভালো স্কুলগুলোকে আর যেন কোনো ক্রমেই কলেজ না করা হয়। অবস্থাদৃষ্ঠে মনে হয়, এগুলো কলেজ তো নয়, বরঞ্চ দেশের প্রত্যন্ত জনপদের নামজাদা স্কুলগুলোকে ধ্বংস করার এক পরোক্ষ পরিকল্পনা। দেশের উচ্চশিক্ষা হোক অধিক শ্রমসাধ্য, কর্মসাধ্য এবং কষ্টার্জিত।
[লেখক: গল্পকার, সাবেক সচিব]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
হোসেন আবদুল মান্নান
বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
দেশে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্টার নামে অসংখ্য স্বনামধন্য ও প্রাচীন স্কুলকে কলেজে রূপান্তর করা হয়েছে। এমন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। চারদিকে একাধিক অনুমোদিত কলেজ থাকা স্বত্বেও স্কুলকে কলেজ করার পেছনে কী উদ্দেশ্য ছিল তা বলা কঠিন। তবে সত্য যে, কতিপয় স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাইরে গিয়ে দেশের শতশত ঐতিহ্যবাহী স্কুলকে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় নাম দিয়ে চালু করা হয়েছে। এটি করা হয়েছে মূলত একই নামে, একই ক্যাম্পাসে এবং একই প্রশাসনিক ছাতার নিচে। এর জন্য মন্ত্রনালয়/বোর্ড থেকে যথারীতি অনুমতি পেয়ে যায়। পরবর্তীতে সাময়িকভাবে একটা টিনশেড ভবন করে নেয় এবং এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একই স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের বাধ্যগত ভর্তি করিয়ে উচ্চমাধ্যমিক কলেজের যাত্রা শুরু করে। পরে স্হানীয় রাজনীতির ঝান্ডাধারী প্রভাবশালী ব্যক্তিটি এর প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনিই ধীরে ধীরে অর্থের বিনিময়ে কয়েকজন অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে কিছু কামিয়ে নেন। এতে করেই তাদের প্রত্যাশিত কলেজ প্রতিষ্টার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায়।
এমন চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হওয়া অনেক প্রতিষ্টান সময়ের আবর্তে এখন প্রায় মুখথুবড়ে পড়ার মতন অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে দেশ ও জাতি একদিকে যেমন শতবর্ষী স্কুলের অতীতের গৌরবময় রেকর্ড হারাচ্ছে, একইসাথে একটা ভালো শিক্ষাবান্ধব কলেজের পরিবেশ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। আজকাল অনেক প্রবীণ শিক্ষক, গবেষক তথা শিক্ষাবিদ এমনটাই মনে করেন। এমনিতেই পেশাদার ভালো শিক্ষকের চরম সংকটের ভেতর দিয়ে চলেছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্হা। যোগ্যরা শিক্ষকতার পেশাকে এড়িয়ে চলছেন। সদ্যপ্রয়াত দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও আক্ষেপ করে বলেছিলেন, "দেশে শিক্ষক, গবেষক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক কেউ হতে চায় না। যেদিকে তাকাবেন সবাই প্রশাসক"। বলতে হবে, জাতি এখন পাকা ঘরে কাঁচা শিক্ষকের দুঃসময় অতিক্রম করে চলেছে।
দুই.
দেশে এত বিপুল সংখ্যক কলেজ হচ্ছে কেন? এগুলো কী কেবল ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বা শিক্ষার হার বৃদ্ধির জন্য?
সবক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়েছে রাজনৈতিক অবিমৃশ্যতায় বা উন্নাসিকতার হাত ধরে। আবার কিছু হয়েছে ব্যক্তিক ব্যবসায়িক মনস্তত্ত্ব থেকে। ধরা যাক, বাংলাদেশের একটা উপজেলার গড় আয়তন ২৫০ বর্গ কিঃ মিঃ। এবং জনসংখ্যার হার প্রতি উপজেলায় গড়ে ৩ লাখের কাছাকাছি। সেখানে গড়ে চার থেকে পাঁচটি কলেজ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত একটা ডিগ্রি কলেজ আছে। যা কয়েকবছর আগে এক আদেশে সরকারি বা জাতীয়করণ করা হয়ে গেছে। অবশিষ্টগুলি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ হিসেবে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রতিষ্টিত হয়ে চলমান আছে। যেগুলো একই কায়দায় এমপিও ভূক্ত হওয়ার আশীর্বাদ নিয়ে জীবন্মৃত হয়ে টিকে আছে। শিক্ষক কর্মচারী বেতন পাচ্ছে। ছাত্র ছাত্রীর আসা না আসা তখন কোনো সমস্যা নয়। তাছাড়া দেশের বর্তমান যোগাযোগ ব্যবস্হার উন্নয়নের আলোকে বলা যায়, যে কোনো একটা ইউনিয়ন থেকে উপজেলা সদরে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র আধা ঘণ্টা। এর বেশি হলে তা কদাচিৎ, কোথাও কোথাও। সর্বত্র নয়।
তাহলে এমন বাস্তবতায়, প্রতিষ্টিত স্কুলগুলোকে কলেজে পরিবর্তন করার হেতু কী? গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে এসব পুরানো স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের কেউ কেউ বড় মন্ত্রী, এমপি, আমলা, শিল্পপতি হিসেবে আভির্ভূত হয়েছেন। তখনই গ্রামীণ জনপদের প্রবীণ শ্রেণির গ্রহণযোগ্য মানুষকে সম্পৃক্ত করে এক শ্রেণির সুবিধালোভী,
রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা কাঙালরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করে ঐসব মানুষের দ্বারস্থ হয়ে যায়। চাটুকারিতা মোসাহেবি, তৈলমর্দন শুরু করে দেয়। তখন তার কাছে এদের অসংখ্য দাবিদাওয়ার মধ্যে অন্যতম প্রধান চাওয়া থাকে, ‘আপনার সেই স্কুলটিকে স্কুল এন্ড কলেজে পরিণত করে দিতে হবে’। এমন প্রস্তাবে তিনিও যারপরনাই আনন্দিত হন। মনের মধ্যে একটা মহৎ সামাজিক কাজের বাসনা জাগ্রত হয়ে ওঠে। যাক এবার জন্মস্থানের শিকড়ের জন্য কিছু একটা করে যেতে হবে। যা একদিন অবর্তমানে অর্থাৎ না থাকায়ও হয়তো কথা বলে যাবে। তিনি তখন যেকোনো কিছুর বিনিময়ে তার সেই শৈশবের প্রতিষ্টানকে উচ্চতর পর্যায়ে উপনীত করে দিয়ে যান। এক্ষেত্রে মন্ত্রনালয় বা সংশ্লিষ্ট বোর্ডও তাদের বিদ্যমান নীতিমালার ওপরও কাঁচি চালাতে কুন্ঠাবোধ করে না। কারণ, চাপ অনেক উপর থেকে অনবরত নিম্নগামী হচ্ছে। বলাবাহুল্য, মফস্বলে একটা কলেজ থেকে আরেকটার দূরত্ব নূন্যতম ৮ কি. মি. হতে হবে। তা মোটেও অনুসরণ করা হচ্ছে না। চাপে সবকিছু শিথিল করা হচ্ছে।
সুতরাং বলা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এভাবেই দেশের সেরা স্কুলগুলোর সবুজ প্রাঙ্গনেই কলেজের নামে সমাধি রচিত হয়েছে। একইসঙ্গে যিনি একজন প্রসিদ্ধ হেডমাস্টার হিসেবে যুগের পর যুগ সেবা দিয়ে এলাকায় খ্যাতিমান হয়েছিলেন; তিনি এখন প্রিন্সিপাল নামের বিশাল অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন। এতে করে কখনো কখনো তিনি নিজেও বিব্রতবোধ করেন।
তিন.
একটা পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি ও অনার্স কলেজের সংখ্যা ৩৩৬২ টি। দেশে মোট স্কুল এন্ড কলেজের সংখ্যা ১৫১৪ টি। এতে সংযুক্ত শিক্ষকের সংখ্যাও হাজার হাজার। উল্লেখ্য, শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য বা শিক্ষকের সংখ্যাই ১৫,০০০ হাজারের অধিক। এর মানে বিপুল সংখ্যক জনবল স্কুল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত আছেন। যার ব্যয়ভার সরকারই বহন করে চলেছে।
তবে স্কুলগুলোকে কলেজ করার নেতিবাচক দিকসমূহের মধ্যে অন্যতম হল, ছাত্র ছাত্রীর সংকট। চলতি শিক্ষা বর্ষে এসএসসি পরীক্ষায় পাশের হার খুব কম হওয়ায়, শতাধিক স্কুল এন্ড কলেজ এবং উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ ভর্তির জন্য এবার একজন ছাত্রও পায়নি। এটা কী ভাবা যায়? এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সর্বত্র কলেজের ছড়াছড়ি।
শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় কলেজের নাম না থাকা এবং অনুকূল যোগাযোগ মাধ্যম থাকায় ছাত্ররা জেলাশহরে পাড়ি দিচ্ছে। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্টান অর্থাৎ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়কে সহজলভ্য করে আনাচকানাচে গড়ে তোলার কুফল হিসাবেও তা দেখা যায়। উচ্চ শিক্ষা হাতের নাগালের মধ্যে চলে গেলে এর মানদ- ধরে রাখা কখনও সম্ভব হয় না। এটা পৃথিবীর কোথাও না। উচ্চশিক্ষা সবসময় শ্রম ও কষ্টের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রায় ৬০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা যায়।
এগুলোর ক্যাম্পাস, ভিসি, শিক্ষক, পাঠদান পদ্ধতি, ছাত্র ছাত্রীর উপস্থিতি, সনদপত্র বাণিজ্য সবকিছু নিয়েই আলোচনা সমালোচনা চলমান থাকে।
চার.
গ্রামীণ জনপদে বিদ্যমান সরকার অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে। এগুলোকে টিকিয়ে রাথতে হলে একসময় হয়তো আত্মীয়করণ প্রক্রিয়ায় যেতে হতে পারে। যেমন, খুব কাছাকাছিতে প্রতিষ্টিত ছোট কলেজকে বড় বা ছাত্রবহুল কলেজের সঙ্গে মার্জ করে দিতে হতে পারে। এমপিও ভূক্ত শিক্ষকদের অন্যত্র বদলির মাধ্যমে সমন্বয় করা হতে পারে। মানসম্মত ভালো শিক্ষালয় ছাত্রদের কাছে সবসময়ই আরাধ্য।
তা দূরে হোক বা কাছে তা বিবেচ্য নয়।
জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একবার বলেছিলেন, ‘শিক্ষিত আর অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে ব্যবধান ৬ মাইল’। এর ব্যাখা দিতে গিয়ে এই কিংবদন্তি নাকি বলেছিলেন, ‘বৃটিশ শাসন আমলে পূর্ববঙ্গে একটা স্কুল থেকে আরেকটার দূরত্ব গড়ে ৬ মাইল ছিল। পায়ে হেঁটে কষ্ট করে যারা গেছে তারা শিক্ষিত হয়েছে, আর যারা যায়নি তারা অশিক্ষিত রয়ে গেছে’।
কাজেই ভালো স্কুলগুলোকে আর যেন কোনো ক্রমেই কলেজ না করা হয়। অবস্থাদৃষ্ঠে মনে হয়, এগুলো কলেজ তো নয়, বরঞ্চ দেশের প্রত্যন্ত জনপদের নামজাদা স্কুলগুলোকে ধ্বংস করার এক পরোক্ষ পরিকল্পনা। দেশের উচ্চশিক্ষা হোক অধিক শ্রমসাধ্য, কর্মসাধ্য এবং কষ্টার্জিত।
[লেখক: গল্পকার, সাবেক সচিব]