আরিফুল ইসলাম রাফি
বাংলাদেশ আজ এমন এক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে ন্যায়বিচার, মানবিকতা আর দায়িত্ববোধের সীমারেখা যেন ক্রমশ মুছে যাচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর দৃশ্যপট পাল্টেছে, কিন্তু মানসিক কাঠামো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। এই দেশের পুলিশ বাহিনী, যারা এক সময় ক্ষমতাসীনদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত হাতিয়ার ছিল, তারা আজ জনগণের ক্রোধের মুখোমুখি। অন্যদিকে, সমাজের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য দাবিতে রাজপথে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন।
এই দুই বিপরীতচিত্র; পুলিশ পালাচ্ছে, শিক্ষক পেটানো হচ্ছে- আসলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোর গভীর সংকটের প্রতীক। এটি কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়; এটি একটি নৈতিক, মানসিক ও ঐতিহাসিক পতনের গল্প।
বাংলাদেশের পুলিশ কখনোই কেবল আইন রক্ষার বাহিনী হয়ে উঠতে পারেনি। বরং তারা হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার একচেটিয়া প্রতীক। রাজনৈতিক আনুগত্য, দুর্নীতি, দমননীতি, এবং ক্ষমতাবানদের স্বার্থরক্ষাই বহুদিন ধরে পুলিশের পরিচিত চেহারা।
জুলাই অভ্যুত্থানের আগে পর্যন্ত এই বাহিনী ছিল অদম্য। বিরোধী মত দমন, গুম-খুন, এবং ভুয়া মামলার মাধ্যমে তারা হয়ে উঠেছিল ভয়ের আরেক নাম। সাধারণ মানুষ থানায় গেলে ন্যায় নয়, ভয় নিয়েই যেত। থানার দরজা ছিল নির্যাতনের প্রতীক, নিরাপত্তার নয়।
কিন্তু অভ্যুত্থানের পর যখন ক্ষমতার ভারসাম্য বদলালো, তখনই দেখা গেল পুলিশও কতটা একা। জনতা যাদের হাতের লাঠির আঘাতে কষ্ট পেয়েছিল, তারাই এখন সেই লাঠির মালিকদের পিছু নিচ্ছে। বহু স্থানে দেখা গেছে, পুলিশের ভয়ে মানুষ নয়, মানুষকে দেখে পুলিশ পালাচ্ছে। এমন দৃশ্য হয়তো রাজনৈতিক পালাবদলের চেয়ে অনেক বেশি প্রতীকী; এটি নৈতিক প্রতিশোধের দৃশ্য, দীর্ঘ অন্যায়ের জবাব হিসেবে এক সামাজিক বিচার।
জনগণের এই ক্ষোভ প্রতিহিংসা নয়; এটি প্রতিকারহীনতার প্রতিক্রিয়া। বছরের পর বছর কেউ শুনেছে না তাদের আর্তনাদ, কেউ দেয়নি ন্যায্য বিচার। থানার দালান তাদের জন্য ছিল অবিচারের দুর্গ। যখন রাষ্ট্র তার নাগরিককে বারবার অপমান করে, তখন এক সময় নাগরিকও রাষ্ট্রকে অপমানিত করতে শেখে।
অভ্যুত্থানের পর থানা পোড়ানো, পুলিশের ইউনিফর্ম ফেলে পালানোর দৃশ্য থেকে কেবলই মনে হয়েছিল, এটি ‘ন্যায়বিচারের প্রতীকী পুনর্দখল’। নাগরিকরা বোঝাতে চায় রাষ্ট্রের মালিক আসলে তারাই, যারা এতদিন নিপীড়িত ছিলো।
অন্যদিকে, শিক্ষকরা যে আন্দোলনে নেমেছেন তা কেবল অর্থনৈতিক নয় আত্মমর্যাদারও লড়াই। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দশকের পর দশক ধরে সরকারের অবহেলার শিকার। তাদের বেতন কাঠামো এমন যে, এক শিক্ষক পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দাবি ছিলো সম্মানজনক জীবনযাপনের সুযোগ। অথচ সরকারের প্রতিক্রিয়া যেখানে অমানবিক। রাজপথে ন্যায্য দাবিতে দাঁড়ানো শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ওপর পুলিশের হামলা, কাঁদুনে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, জলকামান নিক্ষেপ আমাদের সমাজের নৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করে।
একটা রাষ্ট্র তখনই ব্যর্থ হয়, যখন জ্ঞানী মানুষগুলো তার রাজপথে রক্তাক্ত হয়, আর ক্ষমতাধররা চেয়ারে নিশ্চিন্তে বসে থাকে। শিক্ষকের প্রতি সম্মান হারিয়ে গেলে সমাজের চরিত্র ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে। কারণ শিক্ষক কেবল পাঠদাতা নন; তিনি জাতির বিবেক, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নির্মাতা।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্র আজ উল্টোপথে চলছে। রাষ্ট্রের সেবকরা হয়ে উঠেছে প্রভু, আর নাগরিকরা পরিণত হয়েছে শাসিত প্রজায়। পুলিশ, আমলাতন্ত্র কিংবা রাজনৈতিক নেতৃত্ব; সবাই যেন রাষ্ট্র নয়, ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত। যেখানে পুলিশের দায়িত্ব জনগণকে রক্ষা করা, সেখানে তারা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দলের রক্ষক। আর শিক্ষকরা, যারা জাতির আলোকবর্তিকা হওয়ার কথা, তারা সরকারি অবহেলায় পরিণত হয়েছেন প্রান্তিক শ্রেণির কর্মী।
এই বিকৃত ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার আর আইন একই সঙ্গে অপমানিত হয়। রাষ্ট্র তখন তার নাগরিককে ভয় পায়, নাগরিকও রাষ্ট্রকে ঘৃণা করে। এই পারস্পরিক অবিশ্বাসই আমাদের পতনের মূল কারণ।
বাংলাদেশে ক্ষমতা মানেই স্বেচ্ছাচারিতা, এ যেন অব্যর্থ নিয়মে পরিণত হয়েছে। যে-ই ক্ষমতায় আসুক, তারা একই ধাঁচে চলে: বিরোধী দমন, রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে ভয় দেখানো, প্রশাসনকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার। এই সংস্কৃতি এমনভাবে সমাজে গেঁথে গেছে যে, রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানই আর নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। ফলে পুলিশ, আমলাতন্ত্র, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রাজনৈতিক আনুগত্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, শিক্ষক সমাজের বঞ্চনা রাষ্ট্রের আরেক চেহারা প্রকাশ করে, শিক্ষা এখন আর রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার নয়। উন্নয়নের বুলি যতই বাজুক, মানবসম্পদে বিনিয়োগের অভাবই আমাদের প্রকৃত অন্ধকার।
এই সংকটের মূল কারণ হলো জবাবদিহির অনুপস্থিতি। যারা অন্যায় করে, তারা জানে শাস্তি হবে না। ফলে রাষ্ট্রে অন্যায় এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। পুলিশের অন্যায় কিংবা প্রশাসনিক দুর্নীতি, সব কিছুরই শেষমেশ দায়হীন সমাপ্তি ঘটে।
একইভাবে, শিক্ষক আন্দোলনে হামলা চালানো কর্মকর্তারাও জানেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। এই অব্যাহতি-সংস্কৃতিই আজ রাষ্ট্রকে নৈতিকভাবে পঙ্গু করে তুলেছে। যে সমাজে অন্যায়কে অন্যায় বলা যায় না, সেখানে ন্যায়বিচার কেবল বইয়ের বিষয়বস্তু হয়ে থাকে, বাস্তবতার নয়।
এখন প্রশ্ন ওঠে, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কোথায়? প্রথমত, পুলিশি ব্যবস্থার পূর্ণ সংস্কার ছাড়া কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। পুলিশকে হতে হবে জনগণের রক্ষক, কোনো সরকারের নয়। নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষা খাতকে জাতীয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষকের মর্যাদা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করতে হবে। তাদের বেতন, পদোন্নতি, ও নিরাপত্তা সহ সব কিছুতে বৈষম্য দূর করা না গেলে শিক্ষার মান টিকবে না। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রকে তার নাগরিকদের বিশ্বাস ফিরিয়ে দিতে হবে। জনগণকে যদি মনে হয় রাষ্ট্র তাদের নয়, তবে সেটি আর রাষ্ট্র থাকে না; হয়ে ওঠে দখলকৃত কাঠামো।
আজকের বাংলাদেশ এক প্রতীকী মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে শিক্ষক রাজপথে, পুলিশ পালিয়ে বেড়ায়। স্বেচ্ছাচারিতার এই রাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। যদি আমরা সত্যিই পরিবর্তন চাই, তবে শুরু করতে হবে জবাবদিহি থেকে। পুলিশ হোক বা রাজনীতিক, সবাইকে আইনের অধীনে আনতে হবে। যে রাষ্ট্রে শিক্ষক নিরাপদ নন, পুলিশ জবাবদিহিহীন, আর জনগণ অবিশ্বাসে ভোগে; সেই রাষ্ট্র টিকলেও সভ্যতা টিকে না। এবার দেখার বিষয় আমরা কোন পথ বেছে নিই; স্বেচ্ছাচারিতার অন্ধকার, না কি ন্যায়ের আলোর পথে নতুন সূচনা?
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
আরিফুল ইসলাম রাফি
বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
বাংলাদেশ আজ এমন এক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে ন্যায়বিচার, মানবিকতা আর দায়িত্ববোধের সীমারেখা যেন ক্রমশ মুছে যাচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর দৃশ্যপট পাল্টেছে, কিন্তু মানসিক কাঠামো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। এই দেশের পুলিশ বাহিনী, যারা এক সময় ক্ষমতাসীনদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত হাতিয়ার ছিল, তারা আজ জনগণের ক্রোধের মুখোমুখি। অন্যদিকে, সমাজের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য দাবিতে রাজপথে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন।
এই দুই বিপরীতচিত্র; পুলিশ পালাচ্ছে, শিক্ষক পেটানো হচ্ছে- আসলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোর গভীর সংকটের প্রতীক। এটি কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়; এটি একটি নৈতিক, মানসিক ও ঐতিহাসিক পতনের গল্প।
বাংলাদেশের পুলিশ কখনোই কেবল আইন রক্ষার বাহিনী হয়ে উঠতে পারেনি। বরং তারা হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার একচেটিয়া প্রতীক। রাজনৈতিক আনুগত্য, দুর্নীতি, দমননীতি, এবং ক্ষমতাবানদের স্বার্থরক্ষাই বহুদিন ধরে পুলিশের পরিচিত চেহারা।
জুলাই অভ্যুত্থানের আগে পর্যন্ত এই বাহিনী ছিল অদম্য। বিরোধী মত দমন, গুম-খুন, এবং ভুয়া মামলার মাধ্যমে তারা হয়ে উঠেছিল ভয়ের আরেক নাম। সাধারণ মানুষ থানায় গেলে ন্যায় নয়, ভয় নিয়েই যেত। থানার দরজা ছিল নির্যাতনের প্রতীক, নিরাপত্তার নয়।
কিন্তু অভ্যুত্থানের পর যখন ক্ষমতার ভারসাম্য বদলালো, তখনই দেখা গেল পুলিশও কতটা একা। জনতা যাদের হাতের লাঠির আঘাতে কষ্ট পেয়েছিল, তারাই এখন সেই লাঠির মালিকদের পিছু নিচ্ছে। বহু স্থানে দেখা গেছে, পুলিশের ভয়ে মানুষ নয়, মানুষকে দেখে পুলিশ পালাচ্ছে। এমন দৃশ্য হয়তো রাজনৈতিক পালাবদলের চেয়ে অনেক বেশি প্রতীকী; এটি নৈতিক প্রতিশোধের দৃশ্য, দীর্ঘ অন্যায়ের জবাব হিসেবে এক সামাজিক বিচার।
জনগণের এই ক্ষোভ প্রতিহিংসা নয়; এটি প্রতিকারহীনতার প্রতিক্রিয়া। বছরের পর বছর কেউ শুনেছে না তাদের আর্তনাদ, কেউ দেয়নি ন্যায্য বিচার। থানার দালান তাদের জন্য ছিল অবিচারের দুর্গ। যখন রাষ্ট্র তার নাগরিককে বারবার অপমান করে, তখন এক সময় নাগরিকও রাষ্ট্রকে অপমানিত করতে শেখে।
অভ্যুত্থানের পর থানা পোড়ানো, পুলিশের ইউনিফর্ম ফেলে পালানোর দৃশ্য থেকে কেবলই মনে হয়েছিল, এটি ‘ন্যায়বিচারের প্রতীকী পুনর্দখল’। নাগরিকরা বোঝাতে চায় রাষ্ট্রের মালিক আসলে তারাই, যারা এতদিন নিপীড়িত ছিলো।
অন্যদিকে, শিক্ষকরা যে আন্দোলনে নেমেছেন তা কেবল অর্থনৈতিক নয় আত্মমর্যাদারও লড়াই। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দশকের পর দশক ধরে সরকারের অবহেলার শিকার। তাদের বেতন কাঠামো এমন যে, এক শিক্ষক পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দাবি ছিলো সম্মানজনক জীবনযাপনের সুযোগ। অথচ সরকারের প্রতিক্রিয়া যেখানে অমানবিক। রাজপথে ন্যায্য দাবিতে দাঁড়ানো শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ওপর পুলিশের হামলা, কাঁদুনে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, জলকামান নিক্ষেপ আমাদের সমাজের নৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করে।
একটা রাষ্ট্র তখনই ব্যর্থ হয়, যখন জ্ঞানী মানুষগুলো তার রাজপথে রক্তাক্ত হয়, আর ক্ষমতাধররা চেয়ারে নিশ্চিন্তে বসে থাকে। শিক্ষকের প্রতি সম্মান হারিয়ে গেলে সমাজের চরিত্র ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে। কারণ শিক্ষক কেবল পাঠদাতা নন; তিনি জাতির বিবেক, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নির্মাতা।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্র আজ উল্টোপথে চলছে। রাষ্ট্রের সেবকরা হয়ে উঠেছে প্রভু, আর নাগরিকরা পরিণত হয়েছে শাসিত প্রজায়। পুলিশ, আমলাতন্ত্র কিংবা রাজনৈতিক নেতৃত্ব; সবাই যেন রাষ্ট্র নয়, ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত। যেখানে পুলিশের দায়িত্ব জনগণকে রক্ষা করা, সেখানে তারা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দলের রক্ষক। আর শিক্ষকরা, যারা জাতির আলোকবর্তিকা হওয়ার কথা, তারা সরকারি অবহেলায় পরিণত হয়েছেন প্রান্তিক শ্রেণির কর্মী।
এই বিকৃত ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার আর আইন একই সঙ্গে অপমানিত হয়। রাষ্ট্র তখন তার নাগরিককে ভয় পায়, নাগরিকও রাষ্ট্রকে ঘৃণা করে। এই পারস্পরিক অবিশ্বাসই আমাদের পতনের মূল কারণ।
বাংলাদেশে ক্ষমতা মানেই স্বেচ্ছাচারিতা, এ যেন অব্যর্থ নিয়মে পরিণত হয়েছে। যে-ই ক্ষমতায় আসুক, তারা একই ধাঁচে চলে: বিরোধী দমন, রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে ভয় দেখানো, প্রশাসনকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার। এই সংস্কৃতি এমনভাবে সমাজে গেঁথে গেছে যে, রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানই আর নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। ফলে পুলিশ, আমলাতন্ত্র, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রাজনৈতিক আনুগত্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, শিক্ষক সমাজের বঞ্চনা রাষ্ট্রের আরেক চেহারা প্রকাশ করে, শিক্ষা এখন আর রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার নয়। উন্নয়নের বুলি যতই বাজুক, মানবসম্পদে বিনিয়োগের অভাবই আমাদের প্রকৃত অন্ধকার।
এই সংকটের মূল কারণ হলো জবাবদিহির অনুপস্থিতি। যারা অন্যায় করে, তারা জানে শাস্তি হবে না। ফলে রাষ্ট্রে অন্যায় এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। পুলিশের অন্যায় কিংবা প্রশাসনিক দুর্নীতি, সব কিছুরই শেষমেশ দায়হীন সমাপ্তি ঘটে।
একইভাবে, শিক্ষক আন্দোলনে হামলা চালানো কর্মকর্তারাও জানেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। এই অব্যাহতি-সংস্কৃতিই আজ রাষ্ট্রকে নৈতিকভাবে পঙ্গু করে তুলেছে। যে সমাজে অন্যায়কে অন্যায় বলা যায় না, সেখানে ন্যায়বিচার কেবল বইয়ের বিষয়বস্তু হয়ে থাকে, বাস্তবতার নয়।
এখন প্রশ্ন ওঠে, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কোথায়? প্রথমত, পুলিশি ব্যবস্থার পূর্ণ সংস্কার ছাড়া কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। পুলিশকে হতে হবে জনগণের রক্ষক, কোনো সরকারের নয়। নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষা খাতকে জাতীয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষকের মর্যাদা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করতে হবে। তাদের বেতন, পদোন্নতি, ও নিরাপত্তা সহ সব কিছুতে বৈষম্য দূর করা না গেলে শিক্ষার মান টিকবে না। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রকে তার নাগরিকদের বিশ্বাস ফিরিয়ে দিতে হবে। জনগণকে যদি মনে হয় রাষ্ট্র তাদের নয়, তবে সেটি আর রাষ্ট্র থাকে না; হয়ে ওঠে দখলকৃত কাঠামো।
আজকের বাংলাদেশ এক প্রতীকী মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে শিক্ষক রাজপথে, পুলিশ পালিয়ে বেড়ায়। স্বেচ্ছাচারিতার এই রাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। যদি আমরা সত্যিই পরিবর্তন চাই, তবে শুরু করতে হবে জবাবদিহি থেকে। পুলিশ হোক বা রাজনীতিক, সবাইকে আইনের অধীনে আনতে হবে। যে রাষ্ট্রে শিক্ষক নিরাপদ নন, পুলিশ জবাবদিহিহীন, আর জনগণ অবিশ্বাসে ভোগে; সেই রাষ্ট্র টিকলেও সভ্যতা টিকে না। এবার দেখার বিষয় আমরা কোন পথ বেছে নিই; স্বেচ্ছাচারিতার অন্ধকার, না কি ন্যায়ের আলোর পথে নতুন সূচনা?
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]