সৌরভ জাকারিয়া
(শেষাংশ)
ঢাকার সাত কলেজ ও অন্যান্য সরকারি কলেজে পিএইচডি শিক্ষকের স্বল্পতার নেপথ্যে
সাত কলেজসহ সারাদেশের সরকারি কলেজের শিক্ষকগণ বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য। এ ক্যাডারে নিয়োগ, পদোন্নতি কিংবা পদায়নের কোনো ক্ষেত্রেই পিএইচডি, উচ্চতর ডিগ্রি বা প্রকাশনার শর্ত বা সুবিধা কোনটিই নেই। সরকারি কলেজের শিক্ষকদের চাকরিতে পিএইচডি ৩-৪ টি ইনক্রিমেন্ট সুবিধার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতিতে পিএইচডি-প্রকাশনা পূর্বশর্ত না হলেও অগ্রাধিকার বা সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এজন্যই মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ পিএইচডি ডিগ্রি নেয়ার দিকে অধিক মনোযোগী। সরকারি কলেজের শিক্ষকদের পিএইচডি অর্জনের পথেও রয়েছে নানাবিধ বাধা। পিএইচডিতে ভর্তির জন্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নেয়ার দীর্ঘ ও আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, বৃত্তিবিহীন পড়াশোনায় শিক্ষাছুটিতে বেতন অর্ধেক হয়ে যাওয়া এবং স্কলারশিপ পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহয়তা ট্রস্ট, স্ট্রেন্দিং প্রকল্প, ইউজিসি বা কমনওয়েলথ স্কলারশিপের বেশিরভাগই শিক্ষাবহির্ভূত সার্ভিস ক্যাডার বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দখলে চলে যায়, ফলে সরকারি কলেজের শিক্ষকরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। অথচ উচ্চশিক্ষা স্তরের প্রায় ৬০% শিক্ষার্থীর শিক্ষাগত ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত এই সরকারি কলেজের শিক্ষকদের হাতে।
সরকারি কলেজগুলোর পিএইচডিধারী শিক্ষক পদায়নের ক্ষেত্রে কোনো সুষ্ঠু বদলী নীতিমালা নেই এবং পিএইচডি অর্জনকে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। ফলে নতুনভাবে পিএইচডি অর্জনকারী শিক্ষকগণ প্রায়শই প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজে পদায়ন পান, যেখানে অনার্স-মাস্টার্স পর্যায় নেই। সেখান থেকে ঢাকার সাত কলেজ বা অনার্স-মাস্টার্স স্তরের কলেজে বদলী হতে দীর্ঘ সময় লাগে, এবং এই সময়ের মারপ্যাঁচে শিক্ষকের উৎসাহ ও জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ কমে যেতে পারে। সার্বিকভাবে, সরকারি কলেজে পিএইচডি শিক্ষকের স্বল্পতা মূলত নীতিগত, প্রক্রিয়াগত ও আর্থিক বাধার সমন্বিত ফলাফল। এই সমস্যার সমাধান ছাড়া দেশের সরকারি কলেজে পিএইচডিধারী শিক্ষক স্বল্পতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অনুচিত।
ঢাকার সরকারি কলেজে মানসম্মত শিক্ষা: শুধু পিএইচডি যথেষ্ট কি?
মানসম্মত উচ্চশিক্ষা কেবল শিক্ষকের ডিগ্রির উপর নির্ভরশীল নয়; বরং এটি তিনটি মৌলিক স্তম্ভের সমন্বয়ে টিকে থাকে-জ্ঞানী, অনুপ্রেরণাদায়ক ও সক্রিয় শিক্ষক; উদ্দীপ্ত ও গঠনমূলক চিন্তাশীল শিক্ষার্থী; এবং আধুনিক ল্যাব, গ্রন্থাগার, গবেষণা বাজেট ও প্রশাসনিক সহায়তাবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান। সুতরাং ঢাকার সাত কলেজের সব শিক্ষক পিএইচডিধারী হলেও, যদি অবকাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা নিশ্চিত না হয়, তাহলে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বাস্তবতায়, সরকারি কলেজগুলোতে এই সুযোগ-সুবিধা সীমিত। এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও উচ্চশিক্ষার মানসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়নি। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত “স্কুলের যোগ্যতাই নেই, তবু ২০ বিশ্ববিদ্যালয়” শিরোনামের প্রতিবেদনও এই সমস্যার প্রমাণ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৫৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে; এর মধ্যে তিনটি এখনও কার্যক্রম শুরু করেনি। বাকি ৫৩টির মধ্যে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় ভাড়াবাড়ি বা অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং এগুলোর মধ্যে ২০টির একটি স্কুলের মত মৌলিক সুবিধাও নেই। যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই উচ্চশিক্ষার পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়নি, সেখানে সরকারি কলেজের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে একতরফা সমালোচনা যথার্থ নয়।
পিএইচডির সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক মরীচিকা
পিএইচডি ডিগ্রির উদ্দেশ্য নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা, বিদ্যমান জ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং মানব সভ্যতার জ্ঞানের ভাণ্ডারকে প্রসারিত করা। কিন্তু আধুনিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ডিগ্রির উদ্দেশ্য ও বাস্তবতা প্রায়ই একে অপরের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। বর্তমানে পিএইচডি ডিগ্রির প্রতি একদিকে যেমন একাডেমিক আকর্ষণ রয়েছে, অন্যদিকে সামাজিক ও পেশাগত কারণে এটি অনেক সময় “প্রতীকী মর্যাদা”র প্রতীক হয়ে উঠেছে। এজন্য দেশে পিএইচডিধারীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যুরো অফ স্ট্যাটিসটিক্স এর ২০২২ সালের এক রিপোর্ট বলছে, দেশে পিএইচডিধারীর সংখ্যা ৫১৭০৪ জন, এ সংখ্যা এতদিনে নিশ্চয়ই আরও অনেক বেড়েছে। দেশে পিএইচডিধারীর সংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে আশংকা করা যায় যে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মত এদেশেও পিএইচডি ডিগ্রির সংশ্লিষ্টতা বা প্রয়োজনীয়তা নেই এমনসব চাকরিতে যেমন, পুলিশ কনস্টেবল, অফিস সহায়ক, ক্লিনার পদে শয়ে শয়ে আবেদন পড়বে!
বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি সরকারি-বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের বাইরেও অন্যান্য নন-একাডেমিশিয়ানদের অনেকেই পিএইচডি ডিগ্রির প্রতি মোহগ্রস্ত হচ্ছেন। ইউজিসি’র ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে পিএইচডির সংখ্যা ৬৪০৭ জন। এ তথ্য থেকেই বুঝা যায়, শিক্ষকদের চেয়ে নন-একাডেমিশিয়ানদের পিএইচডির সংখ্যা অন্তত ৫ গুণ। পিএইচডিকে “চাকরি, পদোন্নতি বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদার জন্য আবশ্যক ডিগ্রি হিসেবে বিবেচনা করছেন, জ্ঞানের অন্বেষা হিসেবে নয়। সমাজে পিএইচডি আজ একধরনের সামাজিক মর্যাদার প্রতীক- নামের আগে “ড.” বসানো মানেই এক ধরনের সম্মান, প্রভাব ও স্বীকৃতি। এর ফলে অনেক সময় পিএইচডি অর্জন হয় প্রতিযোগিতার মানসিকতা থেকে, গবেষণার তাগিদ থেকে নয়। এই প্রবণতাকে বলা যায় “প্রতীকী মরীচিকা”- যেখানে বাস্তব জ্ঞান নয়, বরং পিএইচডি নামের প্রতীকই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ডিগ্রির মৌলিক দার্শনিক চেতনা- ‘জ্ঞানপ্রেম’ ক্রমশ ম্লান হয়ে পড়ছে।
এই প্রতীকী মর্যাদার প্রতিযোগিতার ফলশ্রুতিতে, অনেক পিএইচডি গবেষণা কেবল আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার জন্য করা হয়, যেখানে মৌলিক অবদান নেই, পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে, এমনকি কপিরাইট লঙ্ঘনও দেখা যায়। এজন্য দেশের প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রায়ই ভুয়া পিএইচডি, পিএইচডি থিসিসে নকল, পিএইচডি জালিয়াতির খবর আসে। ২০১৮ সালের এক সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে ভুয়া পিএইচডি’র সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৮ হাজার, এর মধ্যে আমেরিকা ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পাঁচ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন, যা সন্দেহাতীতভাবে ভুয়া হতে পারে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইনুন নিশাতের বরাতে একটি বক্তব্য ছড়িয়ে পড়েছে- “পিএইচডি ৬ ধরনের জালিয়াতি, তেজারতি, খয়রাতী, মারফতি, মেহনতি ও তেলেসমাতি। নেটিজেনরা ৭ নম্বরে আরেকটি জুড়ে দিয়েছেন- নীলক্ষেতী!
নীলক্ষেতের কম্পিউটার দোকানগুলোতে নাকি অর্থের বিনিময়ে কপি-পেস্ট নির্ভর পিএইচডি থিসিস পাওয়া যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে অচিরেই কৃত্রিমতি, গুগলতি, চ্যাটগুরতি নামের নতুন নতুন বিশেষণাত্মক পিএইচডিও এই তালিকায় যোগ হবার আশংকা আছে। পিএইচডি নিঃসন্দেহে মানবজ্ঞান বিকাশের এক শিখরচূড়া, কিন্তু এটি কোনো অভিজাত প্রতীক বা চাকরির একমাত্র পাসপোর্ট নয়। উচ্চ শিক্ষার মান কেবল পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের উপস্থিতি দিয়ে নির্ধারিত হয় না; বরং তা নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক একাডেমিক পরিবেশ, গবেষণার সুযোগ, এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে মুক্ত চিন্তার আদান-প্রদানের ওপর। ঢাকার সাত কলেজ বা যেকোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন কেবল শিক্ষকদের ডিগ্রির ওপর না করে শিক্ষার সামগ্রিক মান, শিক্ষকের দক্ষতা-নৈতিকতা ও শিক্ষার্থীর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ওপর হওয়া উচিত। জ্ঞানচর্চা, গবেষণা ও মানবিকতার সমন্বয়েই উচ্চ শিক্ষা তার পূর্ণতা পায়। আজ প্রয়োজন এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তোলা, যেখানে পিএইচডি হবে গভীর গবেষণার ফলাফল, মর্যাদার উপকরণ নয়; যেখানে শিক্ষকতা হবে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ, কেবল ডিগ্রির প্রদর্শনী নয়। তখনই পিএইচডি সত্যিকারের উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবেÑপ্রতীকী মরীচিকা নয়, বরং জ্ঞানের এক আলোকস্তম্ভ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: শিক্ষক ও সদস্য, দি অ্যাডভাইজরস: থিংক ট্যাংক অব সিভিল এডুকেশন]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সৌরভ জাকারিয়া
রোববার, ০২ নভেম্বর ২০২৫
(শেষাংশ)
ঢাকার সাত কলেজ ও অন্যান্য সরকারি কলেজে পিএইচডি শিক্ষকের স্বল্পতার নেপথ্যে
সাত কলেজসহ সারাদেশের সরকারি কলেজের শিক্ষকগণ বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য। এ ক্যাডারে নিয়োগ, পদোন্নতি কিংবা পদায়নের কোনো ক্ষেত্রেই পিএইচডি, উচ্চতর ডিগ্রি বা প্রকাশনার শর্ত বা সুবিধা কোনটিই নেই। সরকারি কলেজের শিক্ষকদের চাকরিতে পিএইচডি ৩-৪ টি ইনক্রিমেন্ট সুবিধার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতিতে পিএইচডি-প্রকাশনা পূর্বশর্ত না হলেও অগ্রাধিকার বা সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এজন্যই মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ পিএইচডি ডিগ্রি নেয়ার দিকে অধিক মনোযোগী। সরকারি কলেজের শিক্ষকদের পিএইচডি অর্জনের পথেও রয়েছে নানাবিধ বাধা। পিএইচডিতে ভর্তির জন্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নেয়ার দীর্ঘ ও আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, বৃত্তিবিহীন পড়াশোনায় শিক্ষাছুটিতে বেতন অর্ধেক হয়ে যাওয়া এবং স্কলারশিপ পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহয়তা ট্রস্ট, স্ট্রেন্দিং প্রকল্প, ইউজিসি বা কমনওয়েলথ স্কলারশিপের বেশিরভাগই শিক্ষাবহির্ভূত সার্ভিস ক্যাডার বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দখলে চলে যায়, ফলে সরকারি কলেজের শিক্ষকরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। অথচ উচ্চশিক্ষা স্তরের প্রায় ৬০% শিক্ষার্থীর শিক্ষাগত ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত এই সরকারি কলেজের শিক্ষকদের হাতে।
সরকারি কলেজগুলোর পিএইচডিধারী শিক্ষক পদায়নের ক্ষেত্রে কোনো সুষ্ঠু বদলী নীতিমালা নেই এবং পিএইচডি অর্জনকে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। ফলে নতুনভাবে পিএইচডি অর্জনকারী শিক্ষকগণ প্রায়শই প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজে পদায়ন পান, যেখানে অনার্স-মাস্টার্স পর্যায় নেই। সেখান থেকে ঢাকার সাত কলেজ বা অনার্স-মাস্টার্স স্তরের কলেজে বদলী হতে দীর্ঘ সময় লাগে, এবং এই সময়ের মারপ্যাঁচে শিক্ষকের উৎসাহ ও জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ কমে যেতে পারে। সার্বিকভাবে, সরকারি কলেজে পিএইচডি শিক্ষকের স্বল্পতা মূলত নীতিগত, প্রক্রিয়াগত ও আর্থিক বাধার সমন্বিত ফলাফল। এই সমস্যার সমাধান ছাড়া দেশের সরকারি কলেজে পিএইচডিধারী শিক্ষক স্বল্পতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অনুচিত।
ঢাকার সরকারি কলেজে মানসম্মত শিক্ষা: শুধু পিএইচডি যথেষ্ট কি?
মানসম্মত উচ্চশিক্ষা কেবল শিক্ষকের ডিগ্রির উপর নির্ভরশীল নয়; বরং এটি তিনটি মৌলিক স্তম্ভের সমন্বয়ে টিকে থাকে-জ্ঞানী, অনুপ্রেরণাদায়ক ও সক্রিয় শিক্ষক; উদ্দীপ্ত ও গঠনমূলক চিন্তাশীল শিক্ষার্থী; এবং আধুনিক ল্যাব, গ্রন্থাগার, গবেষণা বাজেট ও প্রশাসনিক সহায়তাবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান। সুতরাং ঢাকার সাত কলেজের সব শিক্ষক পিএইচডিধারী হলেও, যদি অবকাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা নিশ্চিত না হয়, তাহলে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বাস্তবতায়, সরকারি কলেজগুলোতে এই সুযোগ-সুবিধা সীমিত। এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও উচ্চশিক্ষার মানসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়নি। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত “স্কুলের যোগ্যতাই নেই, তবু ২০ বিশ্ববিদ্যালয়” শিরোনামের প্রতিবেদনও এই সমস্যার প্রমাণ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৫৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে; এর মধ্যে তিনটি এখনও কার্যক্রম শুরু করেনি। বাকি ৫৩টির মধ্যে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় ভাড়াবাড়ি বা অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং এগুলোর মধ্যে ২০টির একটি স্কুলের মত মৌলিক সুবিধাও নেই। যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই উচ্চশিক্ষার পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়নি, সেখানে সরকারি কলেজের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে একতরফা সমালোচনা যথার্থ নয়।
পিএইচডির সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক মরীচিকা
পিএইচডি ডিগ্রির উদ্দেশ্য নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা, বিদ্যমান জ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং মানব সভ্যতার জ্ঞানের ভাণ্ডারকে প্রসারিত করা। কিন্তু আধুনিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ডিগ্রির উদ্দেশ্য ও বাস্তবতা প্রায়ই একে অপরের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। বর্তমানে পিএইচডি ডিগ্রির প্রতি একদিকে যেমন একাডেমিক আকর্ষণ রয়েছে, অন্যদিকে সামাজিক ও পেশাগত কারণে এটি অনেক সময় “প্রতীকী মর্যাদা”র প্রতীক হয়ে উঠেছে। এজন্য দেশে পিএইচডিধারীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যুরো অফ স্ট্যাটিসটিক্স এর ২০২২ সালের এক রিপোর্ট বলছে, দেশে পিএইচডিধারীর সংখ্যা ৫১৭০৪ জন, এ সংখ্যা এতদিনে নিশ্চয়ই আরও অনেক বেড়েছে। দেশে পিএইচডিধারীর সংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে আশংকা করা যায় যে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মত এদেশেও পিএইচডি ডিগ্রির সংশ্লিষ্টতা বা প্রয়োজনীয়তা নেই এমনসব চাকরিতে যেমন, পুলিশ কনস্টেবল, অফিস সহায়ক, ক্লিনার পদে শয়ে শয়ে আবেদন পড়বে!
বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি সরকারি-বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের বাইরেও অন্যান্য নন-একাডেমিশিয়ানদের অনেকেই পিএইচডি ডিগ্রির প্রতি মোহগ্রস্ত হচ্ছেন। ইউজিসি’র ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে পিএইচডির সংখ্যা ৬৪০৭ জন। এ তথ্য থেকেই বুঝা যায়, শিক্ষকদের চেয়ে নন-একাডেমিশিয়ানদের পিএইচডির সংখ্যা অন্তত ৫ গুণ। পিএইচডিকে “চাকরি, পদোন্নতি বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদার জন্য আবশ্যক ডিগ্রি হিসেবে বিবেচনা করছেন, জ্ঞানের অন্বেষা হিসেবে নয়। সমাজে পিএইচডি আজ একধরনের সামাজিক মর্যাদার প্রতীক- নামের আগে “ড.” বসানো মানেই এক ধরনের সম্মান, প্রভাব ও স্বীকৃতি। এর ফলে অনেক সময় পিএইচডি অর্জন হয় প্রতিযোগিতার মানসিকতা থেকে, গবেষণার তাগিদ থেকে নয়। এই প্রবণতাকে বলা যায় “প্রতীকী মরীচিকা”- যেখানে বাস্তব জ্ঞান নয়, বরং পিএইচডি নামের প্রতীকই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ডিগ্রির মৌলিক দার্শনিক চেতনা- ‘জ্ঞানপ্রেম’ ক্রমশ ম্লান হয়ে পড়ছে।
এই প্রতীকী মর্যাদার প্রতিযোগিতার ফলশ্রুতিতে, অনেক পিএইচডি গবেষণা কেবল আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার জন্য করা হয়, যেখানে মৌলিক অবদান নেই, পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে, এমনকি কপিরাইট লঙ্ঘনও দেখা যায়। এজন্য দেশের প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রায়ই ভুয়া পিএইচডি, পিএইচডি থিসিসে নকল, পিএইচডি জালিয়াতির খবর আসে। ২০১৮ সালের এক সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে ভুয়া পিএইচডি’র সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৮ হাজার, এর মধ্যে আমেরিকা ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পাঁচ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন, যা সন্দেহাতীতভাবে ভুয়া হতে পারে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইনুন নিশাতের বরাতে একটি বক্তব্য ছড়িয়ে পড়েছে- “পিএইচডি ৬ ধরনের জালিয়াতি, তেজারতি, খয়রাতী, মারফতি, মেহনতি ও তেলেসমাতি। নেটিজেনরা ৭ নম্বরে আরেকটি জুড়ে দিয়েছেন- নীলক্ষেতী!
নীলক্ষেতের কম্পিউটার দোকানগুলোতে নাকি অর্থের বিনিময়ে কপি-পেস্ট নির্ভর পিএইচডি থিসিস পাওয়া যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে অচিরেই কৃত্রিমতি, গুগলতি, চ্যাটগুরতি নামের নতুন নতুন বিশেষণাত্মক পিএইচডিও এই তালিকায় যোগ হবার আশংকা আছে। পিএইচডি নিঃসন্দেহে মানবজ্ঞান বিকাশের এক শিখরচূড়া, কিন্তু এটি কোনো অভিজাত প্রতীক বা চাকরির একমাত্র পাসপোর্ট নয়। উচ্চ শিক্ষার মান কেবল পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের উপস্থিতি দিয়ে নির্ধারিত হয় না; বরং তা নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক একাডেমিক পরিবেশ, গবেষণার সুযোগ, এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে মুক্ত চিন্তার আদান-প্রদানের ওপর। ঢাকার সাত কলেজ বা যেকোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন কেবল শিক্ষকদের ডিগ্রির ওপর না করে শিক্ষার সামগ্রিক মান, শিক্ষকের দক্ষতা-নৈতিকতা ও শিক্ষার্থীর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ওপর হওয়া উচিত। জ্ঞানচর্চা, গবেষণা ও মানবিকতার সমন্বয়েই উচ্চ শিক্ষা তার পূর্ণতা পায়। আজ প্রয়োজন এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তোলা, যেখানে পিএইচডি হবে গভীর গবেষণার ফলাফল, মর্যাদার উপকরণ নয়; যেখানে শিক্ষকতা হবে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ, কেবল ডিগ্রির প্রদর্শনী নয়। তখনই পিএইচডি সত্যিকারের উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবেÑপ্রতীকী মরীচিকা নয়, বরং জ্ঞানের এক আলোকস্তম্ভ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: শিক্ষক ও সদস্য, দি অ্যাডভাইজরস: থিংক ট্যাংক অব সিভিল এডুকেশন]