আকতার হোসাইন
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন পে-স্কেল প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু সেই কমিশন পে-স্কেলের ওপর মনোযোগ না দিয়ে বরং প্রস্তাব দিয়েছে-‘সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আলাদা একটি ব্যাংক গঠন করা হোক।’ এ প্রস্তাবকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন জল্পনা-কল্পনা।
ছোট্ট এই দেশে এমনিতেই ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। এর মধ্যে অধিকাংশ ব্যাংকই তারল্য সংকটে পড়ে হিমশিম খাচ্ছে। হাতে গোনা কয়েকটি ব্যাংক ভালো অবস্থানে থাকলেও বেশিরভাগ ব্যাংকের অবস্থা নাজুক ও ভঙ্গুর। মানুষের ব্যাংকের প্রতি আস্থা ক্রমান্বয়ে তলানিতে ঠেকেছে। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংক প্রস্তাবনা কতটা যৌক্তিক-সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
বিগত সরকারের সময় থেকেই সরকারি চাকরিজীবীদের দাবি ছিল নতুন পে-স্কেল বা বেতন কাঠামো সংস্কার করা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই দাবিকে ঘিরে আন্দোলনের জোয়ার ওঠে। সেই প্রেক্ষাপটে সরকার ২০২৫ সালের ২৭ জুলাই মোট ২২ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করে, যাদের কাজÑবর্তমান বাজারব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে একটি নতুন বেতন কাঠামো প্রস্তাব করা।
কিন্তু এই কমিশন বেতন কাঠামোর বদলে কীভাবে সরকারি কর্মচারীদের জন্য আলাদা ব্যাংক গঠন করা যায়, সে বিষয়েই মনোযোগ দিচ্ছে-এমন সমালোচনা উঠেছে। কমিশনের কিছু প্রভাবশালী সদস্য যুক্তি দিচ্ছেন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আনসার-ভিডিপির নিজস্ব ব্যাংক আছে; তাহলে ২০ লাখ সরকারি কর্মচারীর জন্যও একটি ব্যাংক গঠন করা যেতেই পারে। তাদের দাবি-সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে।
তবে তারা হয়তো বুঝতে পারছেন না, একটি ব্যাংক গঠনের জন্য দরকার মিশ্র আমানত-অর্থাৎ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়। সরকারি কর্মচারীদের বেতনের পুরো অর্থ এই চাহিদা মেটাতে পারবে না। বরং এই এক লাখ কোটি টাকা কেবল লেনদেনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। বিশেষ বাহিনীর ব্যাংকগুলো টিকে আছে বিশেষ বরাদ্দ ও তহবিলের ওপর; সরকারি কর্মচারীদের ব্যাংকের ক্ষেত্রে সে সুবিধা থাকবে কি? যদি না থাকে, তাহলে নতুন ব্যাংক গঠনের অর্থ কী?
আরেকটি যুক্তি হলো-সরকারি কর্মচারীরা ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে বেতন পান। বদলির সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিবর্তন করতে হয়, ফলে বেতন পেতে দেরি হয়। তাদের মতে, আলাদা ব্যাংক থাকলে এসব ঝামেলা কমবে এবং স্বল্পসুদে ঋণ পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থাকতেও নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন কী? আসলে প্রয়োজন সুশাসনের, নতুন প্রতিষ্ঠানের নয়।
শহরের অলিগলিতে ব্যাংক শাখা গজিয়েছে, কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংকিং সুবিধা এখনো সীমিত। এত ব্যাংক থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ ব্যাংকিং সেবায় আস্থা পাচ্ছে না-এটাই বাস্তবতা।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় বেতন কমিশনও ‘সমৃদ্ধির সোপান ব্যাংক’ নামে একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়সংলগ্ন সরকারি জমি বিক্রি করে ৪০০ কোটি টাকা মূলধনে ব্যাংক গঠনের পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
বিশ্বের আর কোনো দেশে কি সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আলাদা ব্যাংক আছে? বাংলাদেশ এখন এমন এক উদাহরণ তৈরি করতে যাচ্ছে, যেখানে ব্যাংক খাতই সবচেয়ে দুর্বল ও আস্থা সংকটে নিমজ্জিত। রাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রাণশক্তি এই ব্যাংক খাত, আর সেই খাতই এখন অস্তিত্ব সংকটে।
২০১৯ ও ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী-বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৩২৩ বিলিয়ন ডলার, ভারতের ২,৬৬০ বিলিয়ন, থাইল্যান্ডের ৫০০ বিলিয়ন এবং মালয়েশিয়ার ৩৩৭ বিলিয়ন ডলার। অথচ দেশগুলোর ব্যাংকের সংখ্যা যথাক্রমে বাংলাদেশে ৫২, ভারতে ৩৪, থাইল্যান্ডে ১৮ ও মালয়েশিয়ায় মাত্র ৮টি। বিশাল অর্থনীতির দেশ চীনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক মাত্র ১২টি। ফলে বাংলাদেশের ব্যাংকসংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেশি-এবং তার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট।
প্রশ্ন হলো-বিগত সরকারের দেখানো পথেই কি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও হাঁটছে? অনেকেই জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্যদের দক্ষতা ও দূরদর্শিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে, কমিশনের কাজ নতুন বেতন কাঠামো তৈরি করা, যাতে কর্মচারীদের জীবনমান উন্নত হয় এবং বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে। কিন্তু তারা যদি ব্যাংক গঠনের মতো অগ্রাধিকারের বাইরে চলে যান, তাহলে সেটি মূল দায়িত্ব থেকে বিচ্যুতি ছাড়া কিছুই নয়।
সরকারের উচিত হবে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা এবং প্রয়োজন হলে নতুনভাবে কমিশন গঠন করে একটি বাস্তবসম্মত, সুবিন্যস্ত ও মানবিক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা-যেখানে সবার আশার প্রতিফলন ঘটবে এবং অর্থনীতি টেকসই ভারসাম্য বজায় রাখবে। দেশের অর্থনীতির ক্ষতি না করে বরং স্থিতিশীলতা আনা-এটাই সবার কাম্য।
[লেখক : ব্যাংকার]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
আকতার হোসাইন
সোমবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৫
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন পে-স্কেল প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু সেই কমিশন পে-স্কেলের ওপর মনোযোগ না দিয়ে বরং প্রস্তাব দিয়েছে-‘সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আলাদা একটি ব্যাংক গঠন করা হোক।’ এ প্রস্তাবকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন জল্পনা-কল্পনা।
ছোট্ট এই দেশে এমনিতেই ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। এর মধ্যে অধিকাংশ ব্যাংকই তারল্য সংকটে পড়ে হিমশিম খাচ্ছে। হাতে গোনা কয়েকটি ব্যাংক ভালো অবস্থানে থাকলেও বেশিরভাগ ব্যাংকের অবস্থা নাজুক ও ভঙ্গুর। মানুষের ব্যাংকের প্রতি আস্থা ক্রমান্বয়ে তলানিতে ঠেকেছে। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংক প্রস্তাবনা কতটা যৌক্তিক-সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
বিগত সরকারের সময় থেকেই সরকারি চাকরিজীবীদের দাবি ছিল নতুন পে-স্কেল বা বেতন কাঠামো সংস্কার করা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই দাবিকে ঘিরে আন্দোলনের জোয়ার ওঠে। সেই প্রেক্ষাপটে সরকার ২০২৫ সালের ২৭ জুলাই মোট ২২ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করে, যাদের কাজÑবর্তমান বাজারব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে একটি নতুন বেতন কাঠামো প্রস্তাব করা।
কিন্তু এই কমিশন বেতন কাঠামোর বদলে কীভাবে সরকারি কর্মচারীদের জন্য আলাদা ব্যাংক গঠন করা যায়, সে বিষয়েই মনোযোগ দিচ্ছে-এমন সমালোচনা উঠেছে। কমিশনের কিছু প্রভাবশালী সদস্য যুক্তি দিচ্ছেন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আনসার-ভিডিপির নিজস্ব ব্যাংক আছে; তাহলে ২০ লাখ সরকারি কর্মচারীর জন্যও একটি ব্যাংক গঠন করা যেতেই পারে। তাদের দাবি-সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে।
তবে তারা হয়তো বুঝতে পারছেন না, একটি ব্যাংক গঠনের জন্য দরকার মিশ্র আমানত-অর্থাৎ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়। সরকারি কর্মচারীদের বেতনের পুরো অর্থ এই চাহিদা মেটাতে পারবে না। বরং এই এক লাখ কোটি টাকা কেবল লেনদেনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। বিশেষ বাহিনীর ব্যাংকগুলো টিকে আছে বিশেষ বরাদ্দ ও তহবিলের ওপর; সরকারি কর্মচারীদের ব্যাংকের ক্ষেত্রে সে সুবিধা থাকবে কি? যদি না থাকে, তাহলে নতুন ব্যাংক গঠনের অর্থ কী?
আরেকটি যুক্তি হলো-সরকারি কর্মচারীরা ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে বেতন পান। বদলির সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিবর্তন করতে হয়, ফলে বেতন পেতে দেরি হয়। তাদের মতে, আলাদা ব্যাংক থাকলে এসব ঝামেলা কমবে এবং স্বল্পসুদে ঋণ পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থাকতেও নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন কী? আসলে প্রয়োজন সুশাসনের, নতুন প্রতিষ্ঠানের নয়।
শহরের অলিগলিতে ব্যাংক শাখা গজিয়েছে, কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংকিং সুবিধা এখনো সীমিত। এত ব্যাংক থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ ব্যাংকিং সেবায় আস্থা পাচ্ছে না-এটাই বাস্তবতা।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় বেতন কমিশনও ‘সমৃদ্ধির সোপান ব্যাংক’ নামে একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়সংলগ্ন সরকারি জমি বিক্রি করে ৪০০ কোটি টাকা মূলধনে ব্যাংক গঠনের পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
বিশ্বের আর কোনো দেশে কি সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আলাদা ব্যাংক আছে? বাংলাদেশ এখন এমন এক উদাহরণ তৈরি করতে যাচ্ছে, যেখানে ব্যাংক খাতই সবচেয়ে দুর্বল ও আস্থা সংকটে নিমজ্জিত। রাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রাণশক্তি এই ব্যাংক খাত, আর সেই খাতই এখন অস্তিত্ব সংকটে।
২০১৯ ও ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী-বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৩২৩ বিলিয়ন ডলার, ভারতের ২,৬৬০ বিলিয়ন, থাইল্যান্ডের ৫০০ বিলিয়ন এবং মালয়েশিয়ার ৩৩৭ বিলিয়ন ডলার। অথচ দেশগুলোর ব্যাংকের সংখ্যা যথাক্রমে বাংলাদেশে ৫২, ভারতে ৩৪, থাইল্যান্ডে ১৮ ও মালয়েশিয়ায় মাত্র ৮টি। বিশাল অর্থনীতির দেশ চীনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক মাত্র ১২টি। ফলে বাংলাদেশের ব্যাংকসংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেশি-এবং তার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট।
প্রশ্ন হলো-বিগত সরকারের দেখানো পথেই কি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও হাঁটছে? অনেকেই জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্যদের দক্ষতা ও দূরদর্শিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে, কমিশনের কাজ নতুন বেতন কাঠামো তৈরি করা, যাতে কর্মচারীদের জীবনমান উন্নত হয় এবং বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে। কিন্তু তারা যদি ব্যাংক গঠনের মতো অগ্রাধিকারের বাইরে চলে যান, তাহলে সেটি মূল দায়িত্ব থেকে বিচ্যুতি ছাড়া কিছুই নয়।
সরকারের উচিত হবে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা এবং প্রয়োজন হলে নতুনভাবে কমিশন গঠন করে একটি বাস্তবসম্মত, সুবিন্যস্ত ও মানবিক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা-যেখানে সবার আশার প্রতিফলন ঘটবে এবং অর্থনীতি টেকসই ভারসাম্য বজায় রাখবে। দেশের অর্থনীতির ক্ষতি না করে বরং স্থিতিশীলতা আনা-এটাই সবার কাম্য।
[লেখক : ব্যাংকার]