মতিউর রহমান
বাংলাদেশে মাদকাসক্তি আজ আর কোনো গোপন বা প্রান্তিক সমস্যা নয়; বরং এটি একটি গভীর, বহুমাত্রিক সামাজিক মহামারীতে রূপ নিয়েছে, যা দেশের নৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ, এমনকি সমাজের উচ্চস্তরেও মাদকের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার প্রমাণ করে যে, এই সংকটটি কেবল পুলিশি দমন বা প্রচারণার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য নয়। এর মূল প্রোথিত রয়েছে সমাজের কাঠামোগত অসাম্য, সাংস্কৃতিক ভাঙন এবং এক তীব্র নৈতিক শূন্যতার গভীরে।
বাংলাদেশের মাদকবিরোধী নীতি দীর্ঘদিন ধরেই শাস্তিনির্ভর, যা সমস্যার মূল কারণকে উপেক্ষা করে। পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো অপ্রতুল, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দুর্বল, আর সামাজিক সহানুভূতি প্রায় অনুপস্থিত
বাংলাদেশের দ্রুত এবং প্রায়শই অপরিকল্পিত আধুনিকায়ন-বিশেষত গ্রামীণ জীবন থেকে দ্রুত নগরমুখী হওয়া, ব্যাপক শিল্পায়ন, ডিজিটাল অর্থনীতির উত্থান এবং ভোগবাদী সংস্কৃতির তীব্র বিস্তার-একদিকে যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি সৃষ্টি করেছে এক গভীর মানসিক ও নৈতিক শূন্যতা। সমাজবিজ্ঞানের জনক এমিল দুরখেইম যাকে ‘অ্যানোমি’ বা নৈতিক নৈরাজ্য বলে চিহ্নিত করেছিলেন, সেই অবস্থাই আজ বাংলাদেশের বাস্তবতায় দৃশ্যমান। একসময় পারিবারিক ঐক্য, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও চিরায়ত সামাজিক সংহতির যে সুসংহত কাঠামো মানুষকে মানসিক স্থিতিশীলতা প্রদান করত, তা আজ দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়েছে।
মানুষ যখন সমাজের ঐতিহ্যগত নৈতিক নিয়ন্ত্রণ বা সুস্পষ্ট আদর্শ হারিয়ে ফেলে, যখন পুরনো নিয়ম ভেঙে যায় কিন্তু নতুন কোনো শক্তিশালী নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয় না, তখন সেই শূন্যতা পূরণ করার জন্য তারা মাদকের মতো বিকল্প, ক্ষণস্থায়ী এবং বিধ্বংসী আশ্রয় খোঁজে। ফলে, মাদকাসক্তিকে কেবল আনন্দের উপকরণ বা ব্যক্তিগত দুর্বলতা হিসেবে দেখলে ভুল হবে; এটি হলো মানসিক বিচ্ছিন্নতা, দিক-নির্দেশনাহীনতা এবং গভীর নৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে পালানোর একটি প্রতিক্রিয়া। এটি এক প্রকার সামাজিক অসুস্থতার লক্ষণ, যেখানে সমাজ নিজেই তার সদস্যদের নৈতিকভাবে ধরে রাখতে বা তাদের জীবনের একটি অর্থ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। অ্যানোমিই জন্ম দেয় সেই লাগামহীন আকাক্সক্ষার, যা পূরণের ব্যর্থতা মানুষকে মাদকের দিকে ঠেলে দেয়।
রবার্ট কে. মেরটনের ‘স্ট্রেইন থিয়োরি’ মাদকাসক্তিকে কাঠামোগত অসাম্যের সরাসরি ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করে। মেরটনের মতে, যেকোনো সমাজে সফলতার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য-যেমন: সম্পদ, সম্মান বা ক্ষমতা-সবাইকে শেখানো হয় এবং এর প্রতি উৎসাহিত করা হয়, কিন্তু সেই সফলতা অর্জনের বৈধ পথ বা সুযোগ সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত নয়। বাংলাদেশের সমাজে ধনী-দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, মেধার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের অভাব, এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধার চরম অসমতা তরুণদের মধ্যে এক তীব্র হতাশা ও চাপ তৈরি করেছে।
যখন বৈধ ও সামাজিকভাবে স্বীকৃত উপায়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয় না, তখন ব্যক্তি সেই চাপ মোকাবিলায় ভিন্ন পথ বেছে নেয়। মেরটনের তত্ত্বে, মাদকাসক্তি হলো ‘সরে যাওয়া’ এরই চরম প্রতিফলন, যেখানে ব্যক্তি সমাজের চাপানো সফলতার লক্ষ্য এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের বৈধ উপায় উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করে নিজের ভেতরে গুটিয়ে যায়। এটি এক প্রকার নীরব এবং অত্যন্ত ব্যক্তিগত প্রতিবাদ-একটি ব্যর্থ, অসাম্যপূর্ণ এবং স্বপ্নভঙ্গকারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একান্ত ব্যক্তিগত বিদ্রোহ। এটি প্রমাণ করে যে, মাদকাসক্তরা সমাজের বাইরের কেউ নয়, বরং তারাই সমাজের কাঠামোবদ্ধ চাপের সবচেয়ে বড় শিকার।
কার্ল মার্ক্সের ‘বিচ্ছিন্নতার ধারণা’ মাদক সমস্যার অর্থনৈতিক ও শ্রমভিত্তিক দিকটি ব্যাখ্যায় অপরিহার্য। শিল্পাঞ্চল, বিশেষ করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বা অন্য যেকোনো শ্রম-নিবিড় ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের জীবনে যে নিরন্তর শারীরিক ক্লান্তি, কাজের প্রতি কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকা, একঘেয়েমি এবং নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের ওপর কোনো মালিকানা না থাকার চাপ বিদ্যমান, তা মানুষকে তার নিজের শ্রম, তার নিজস্ব মানবিক সত্তা এবং বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই অর্থনৈতিক শোষণ ও মানসিক ক্লান্তি থেকে এক মুহূর্তের মুক্তি পেতে অনেকেই মাদকের আশ্রয় নেয়।
তাদের কাছে মাদক মানে একটি সাময়িক অবকাশ, এক টুকরো অবচেতন প্রতিবাদ। মার্ক্সের ভাষায়, তারা এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বন্দী, যা মানুষকে কেবল শ্রম দেওয়া একটি পণ্যতে রূপান্তরিত করে, আর আসক্তি হলো সেই অমানবিকতা এবং বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে এক ক্ষণস্থায়ী কিন্তু চূড়ান্তভাবে ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া। একইভাবে, উচ্চশিক্ষিত কিন্তু বেকার তরুণেরা যখন সমাজে নিজেদের যোগ্য স্থান খুঁজে পায় না, তখন সেই ব্যর্থতার বেদনা ও হতাশা তারা মাদক দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করে, যা অর্থনৈতিক কাঠামোর গভীর ত্রুটিকেই নির্দেশ করে।
মিশেল ফুকোর ক্ষমতা ও শাসনের বিশ্লেষণ আমাদের দেখায়, রাষ্ট্র কীভাবে মাদক সমস্যাকে ব্যবহার করে জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তথাকথিত “ড্রাগবিরোধী অভিযান” বা মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর দমন নীতিগুলো ফুকোর ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। ফুকোর দৃষ্টিতে, কঠোর আইন বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো কেবল অপরাধ দমন নয়, বরং রাষ্ট্রের এক প্রকার ‘শৃঙ্খলাবিধানকারী ক্ষমতা’, যা সমাজের প্রান্তিক বা বিচ্যুত মানুষদের ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের ক্ষমতার বৈধতা প্রতিষ্ঠা করে।
এই প্রক্রিয়ায় মাদকাসক্ত ব্যক্তি ভুক্তভোগী না হয়েও দ্রুত অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হয়; যার প্রতি সহানুভূতির পরিবর্তে প্রয়োগ করা হয় কঠোর শাস্তি ও নজরদারি। রাষ্ট্র এইভাবে একদিকে নৈতিক শুদ্ধতার দাবি করে, অন্যদিকে দমন-পীড়ন ও শাস্তির মাধ্যমে সমাজে ভয় সৃষ্টি করে, যাতে তার শাসনব্যবস্থা অটুট থাকে এবং সমাজের মৌলিক কাঠামোগত সমস্যাগুলো-যেমন: বৈষম্য বা দুর্নীতি-আলোচনার বাইরে থেকে যায়। ক্ষমতা মাদকাসক্তির প্রকৃত কারণ নিয়ে আলোচনা না করে কেবল তার প্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়।
মাদকাসক্তির ক্ষেত্রে লিঙ্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাজতাত্ত্বিক মাত্রা যোগ করে। সমাজে এটিকে ঐতিহ্যগতভাবে পুরুষদের সমস্যা হিসেবে দেখা হলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শহুরে মধ্যবিত্ত নারীদের মধ্যে আসক্তি বৃদ্ধির হার উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। নারীরা এখানে দ্বিগুণভাবে নিপীড়িত-একদিকে মাদকাসক্তির জন্য তীব্র সামাজিক কলঙ্ক, অন্যদিকে পরিবার ও সমাজের পক্ষ থেকে নীরব দমন ও সহিংসতার শিকার। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো নারীর মানসিক যন্ত্রণা, পারিবারিক নির্যাতন, সামাজিক নিঃসঙ্গতা এবং দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে প্রায়শই অগ্রাহ্য করে। নারীর আসক্তি তাই একদিকে আত্মবিনাশের পথ, অন্যদিকে একটি অন্যায় ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের মানসিক প্রতিরোধের এক নীরব, অপ্রকাশিত রূপ। উপযুক্ত ও সংবেদনশীল পুনর্বাসন কেন্দ্রের অভাবে তাদের সমস্যা আরও গভীর হয়।
বিশ্ব-ব্যবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, বাংলাদেশের মাদক সমস্যা কেবল অভ্যন্তরীণ নয়, এটি একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অসমতার অংশ। বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বাংলাদেশ একটি আধা-প্রান্তিক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত, যা বৈধ ও অবৈধ উভয় বাজারেই বিশ্বশক্তির শোষণের শিকার। মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবার সহজ প্রবাহ, আন্তর্জাতিক পাচারকারী সিন্ডিকেটের ব্যাপক মুনাফা, এবং স্থানীয় প্রশাসনের দুর্নীতি-সবকিছুই বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত অমানবিক ও অন্যায্য কাঠামোর প্রতিফলন। মাদক ব্যবসা তাই শুধু স্থানীয় অপরাধ নয়, বরং এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্ধকার প্রতিরূপ, যেখানে দারিদ্র্য, সীমাহীন লোভ, এবং রাজনৈতিক দমন একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক মাদক পাচার রুটে অবস্থানের কারণে এই ব্যবসার শিকার, যা দেশের অভ্যন্তরীণ সংহতিকে ভেঙে দিচ্ছে।
তবে প্রতিটি আসক্ত ব্যক্তিকে কেবল ভুক্তভোগী বা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা ভুল। প্রতীকী পারস্পরিক ক্রিয়াবাদের আলোকে দেখা যায়, অনেক তরুণের কাছে মাদক গ্রহণ এক ধরনের সামাজিক আচরণ, যা বন্ধুত্ব, বিদ্রোহ বা আত্মপ্রকাশের প্রতীক হিসেবে কাজ করে। ঢাকা শহরের কিছু রেঁস্তোরা বা হোটেল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বা নির্দিষ্ট যুবকেন্দ্রিক সাবকালচারে (উপ-সংস্কৃতি) মাদক গ্রহণ একটি সামাজিক বন্ধনের আচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে মাদক কেবল নেশা নয়, বরং এটি একটি প্রতীকী ঘোষণা-’আমরা প্রচলিত সমাজের ভণ্ডামি মানি না’, ‘আমরা আমাদের নিজস্ব ঐক্য গড়ে তুলছি’। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মাদকাসক্তি বোঝার জন্য কেবল অপরাধের পরিসংখ্যান নয়, মানুষের অভিজ্ঞতা, অর্থবোধ ও সাংস্কৃতিক পটভূমি বুঝতে হবে, যেখানে তারা মাদক গ্রহণের মাধ্যমে এক ধরনের ভুল সামাজিকীকরণ ও পরিচয় খুঁজে নেয়।
বাংলাদেশের মাদকবিরোধী নীতি দীর্ঘদিন ধরেই শাস্তিনির্ভর, যা সমস্যার মূল কারণকে উপেক্ষা করে। পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো অপ্রতুল, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দুর্বল, আর সামাজিক সহানুভূতি প্রায় অনুপস্থিত। দুরখেইমের মতে, এটি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা-সমাজ যখন নিজের বিচ্যুত বা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নৈতিকভাবে পুনর্গঠনে ব্যর্থ হয়, তখন তার নৈতিক সংহতি দুর্বল হয়ে পড়ে। হাওয়ার্ড বেকার তার ‘লেবেলিং থিয়োরি’তে দেখিয়েছেন যে, সমাজের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াই অনেক সময় একজন মানুষকে স্থায়ীভাবে ‘অপরাধী’ বা ‘বিচ্যুত’ করে তোলে। এই লেবেল তাদের সুস্থ জীবনে পুনরুদ্ধারের পথ বন্ধ করে দেয়।
মাদক সমস্যা মোকাবিলায় তাই সবচেয়ে আগে দরকার সামাজিক মনোভাবে পরিবর্তন-অপরাধ নয়, এটিকে একটি কাঠামোগত ও সামাজিক রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। সমাধান অবশ্যই সমাজতাত্ত্বিক হতে হবে: অপরাধীদের শাস্তি নয়, বরং তাদের চিকিৎসার মাধ্যমে সমাজে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা; বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং তাদের সঙ্গে পুনঃসংহতি স্থাপন করা। সমাজের নৈতিক ভিত্তি পুনর্গঠন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং তরুণদের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করাই হতে পারে এই শূন্যতা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ।
বাংলাদেশের মাদক সমস্যাকে সমাজতাত্ত্বিকভাবে বোঝা মানে কেবল অপরাধের পরিসংখ্যান নয়, বরং সামগ্রিক সামাজিক সংহতির সংকটকে উপলব্ধি করা। সমাজে যখন ন্যায়বিচার, আস্থা ও সমবেদনা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, যখন ব্যক্তির সামাজিকীকরণের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন মানুষ বাস্তবতা থেকে পালানোর পথ খোঁজে। মাদক সেই পলায়নের প্রতীক।
মাদকাসক্তি আসলে বাংলাদেশের আধুনিকতার অন্তর্গত এক আয়না-যেখানে প্রতিফলিত হয় উন্নয়নের আলোয় ঢাকা পড়া বঞ্চনা, নৈতিকতা হারানো রাজনীতি, এবং একাকী মানুষের তীব্র আর্তনাদ। দুরখেইম থেকে ফুকো, মার্ক্স থেকে মেরটন-সব তত্ত্ব এক জায়গায় মিলিত হয়ে আমাদের একটিই বার্তা দেয়: আসক্তি কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, এটি এক বিভ্রান্ত ও বিভক্ত সমাজের গভীরতম সামাজিক লক্ষণ। এই শূন্যতার পিছু ছুটতে ছুটতে বাংলাদেশ যদি সত্যিই মুক্তি খুঁজে পেতে চায়, তবে তাকে প্রথমে নিজের সমাজদেহকে আরোগ্য করতে হবে-বিশ্বাস, সহানুভূতি, ন্যায়বিচার ও নৈতিক সংহতির পুনর্গঠনই হতে পারে মাদকমুক্ত ভবিষ্যতের একমাত্র পথ।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতিউর রহমান
শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশে মাদকাসক্তি আজ আর কোনো গোপন বা প্রান্তিক সমস্যা নয়; বরং এটি একটি গভীর, বহুমাত্রিক সামাজিক মহামারীতে রূপ নিয়েছে, যা দেশের নৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ, এমনকি সমাজের উচ্চস্তরেও মাদকের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার প্রমাণ করে যে, এই সংকটটি কেবল পুলিশি দমন বা প্রচারণার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য নয়। এর মূল প্রোথিত রয়েছে সমাজের কাঠামোগত অসাম্য, সাংস্কৃতিক ভাঙন এবং এক তীব্র নৈতিক শূন্যতার গভীরে।
বাংলাদেশের মাদকবিরোধী নীতি দীর্ঘদিন ধরেই শাস্তিনির্ভর, যা সমস্যার মূল কারণকে উপেক্ষা করে। পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো অপ্রতুল, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দুর্বল, আর সামাজিক সহানুভূতি প্রায় অনুপস্থিত
বাংলাদেশের দ্রুত এবং প্রায়শই অপরিকল্পিত আধুনিকায়ন-বিশেষত গ্রামীণ জীবন থেকে দ্রুত নগরমুখী হওয়া, ব্যাপক শিল্পায়ন, ডিজিটাল অর্থনীতির উত্থান এবং ভোগবাদী সংস্কৃতির তীব্র বিস্তার-একদিকে যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি সৃষ্টি করেছে এক গভীর মানসিক ও নৈতিক শূন্যতা। সমাজবিজ্ঞানের জনক এমিল দুরখেইম যাকে ‘অ্যানোমি’ বা নৈতিক নৈরাজ্য বলে চিহ্নিত করেছিলেন, সেই অবস্থাই আজ বাংলাদেশের বাস্তবতায় দৃশ্যমান। একসময় পারিবারিক ঐক্য, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও চিরায়ত সামাজিক সংহতির যে সুসংহত কাঠামো মানুষকে মানসিক স্থিতিশীলতা প্রদান করত, তা আজ দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়েছে।
মানুষ যখন সমাজের ঐতিহ্যগত নৈতিক নিয়ন্ত্রণ বা সুস্পষ্ট আদর্শ হারিয়ে ফেলে, যখন পুরনো নিয়ম ভেঙে যায় কিন্তু নতুন কোনো শক্তিশালী নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয় না, তখন সেই শূন্যতা পূরণ করার জন্য তারা মাদকের মতো বিকল্প, ক্ষণস্থায়ী এবং বিধ্বংসী আশ্রয় খোঁজে। ফলে, মাদকাসক্তিকে কেবল আনন্দের উপকরণ বা ব্যক্তিগত দুর্বলতা হিসেবে দেখলে ভুল হবে; এটি হলো মানসিক বিচ্ছিন্নতা, দিক-নির্দেশনাহীনতা এবং গভীর নৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে পালানোর একটি প্রতিক্রিয়া। এটি এক প্রকার সামাজিক অসুস্থতার লক্ষণ, যেখানে সমাজ নিজেই তার সদস্যদের নৈতিকভাবে ধরে রাখতে বা তাদের জীবনের একটি অর্থ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। অ্যানোমিই জন্ম দেয় সেই লাগামহীন আকাক্সক্ষার, যা পূরণের ব্যর্থতা মানুষকে মাদকের দিকে ঠেলে দেয়।
রবার্ট কে. মেরটনের ‘স্ট্রেইন থিয়োরি’ মাদকাসক্তিকে কাঠামোগত অসাম্যের সরাসরি ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করে। মেরটনের মতে, যেকোনো সমাজে সফলতার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য-যেমন: সম্পদ, সম্মান বা ক্ষমতা-সবাইকে শেখানো হয় এবং এর প্রতি উৎসাহিত করা হয়, কিন্তু সেই সফলতা অর্জনের বৈধ পথ বা সুযোগ সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত নয়। বাংলাদেশের সমাজে ধনী-দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, মেধার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের অভাব, এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধার চরম অসমতা তরুণদের মধ্যে এক তীব্র হতাশা ও চাপ তৈরি করেছে।
যখন বৈধ ও সামাজিকভাবে স্বীকৃত উপায়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয় না, তখন ব্যক্তি সেই চাপ মোকাবিলায় ভিন্ন পথ বেছে নেয়। মেরটনের তত্ত্বে, মাদকাসক্তি হলো ‘সরে যাওয়া’ এরই চরম প্রতিফলন, যেখানে ব্যক্তি সমাজের চাপানো সফলতার লক্ষ্য এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের বৈধ উপায় উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করে নিজের ভেতরে গুটিয়ে যায়। এটি এক প্রকার নীরব এবং অত্যন্ত ব্যক্তিগত প্রতিবাদ-একটি ব্যর্থ, অসাম্যপূর্ণ এবং স্বপ্নভঙ্গকারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একান্ত ব্যক্তিগত বিদ্রোহ। এটি প্রমাণ করে যে, মাদকাসক্তরা সমাজের বাইরের কেউ নয়, বরং তারাই সমাজের কাঠামোবদ্ধ চাপের সবচেয়ে বড় শিকার।
কার্ল মার্ক্সের ‘বিচ্ছিন্নতার ধারণা’ মাদক সমস্যার অর্থনৈতিক ও শ্রমভিত্তিক দিকটি ব্যাখ্যায় অপরিহার্য। শিল্পাঞ্চল, বিশেষ করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বা অন্য যেকোনো শ্রম-নিবিড় ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের জীবনে যে নিরন্তর শারীরিক ক্লান্তি, কাজের প্রতি কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকা, একঘেয়েমি এবং নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের ওপর কোনো মালিকানা না থাকার চাপ বিদ্যমান, তা মানুষকে তার নিজের শ্রম, তার নিজস্ব মানবিক সত্তা এবং বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই অর্থনৈতিক শোষণ ও মানসিক ক্লান্তি থেকে এক মুহূর্তের মুক্তি পেতে অনেকেই মাদকের আশ্রয় নেয়।
তাদের কাছে মাদক মানে একটি সাময়িক অবকাশ, এক টুকরো অবচেতন প্রতিবাদ। মার্ক্সের ভাষায়, তারা এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বন্দী, যা মানুষকে কেবল শ্রম দেওয়া একটি পণ্যতে রূপান্তরিত করে, আর আসক্তি হলো সেই অমানবিকতা এবং বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে এক ক্ষণস্থায়ী কিন্তু চূড়ান্তভাবে ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া। একইভাবে, উচ্চশিক্ষিত কিন্তু বেকার তরুণেরা যখন সমাজে নিজেদের যোগ্য স্থান খুঁজে পায় না, তখন সেই ব্যর্থতার বেদনা ও হতাশা তারা মাদক দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করে, যা অর্থনৈতিক কাঠামোর গভীর ত্রুটিকেই নির্দেশ করে।
মিশেল ফুকোর ক্ষমতা ও শাসনের বিশ্লেষণ আমাদের দেখায়, রাষ্ট্র কীভাবে মাদক সমস্যাকে ব্যবহার করে জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তথাকথিত “ড্রাগবিরোধী অভিযান” বা মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর দমন নীতিগুলো ফুকোর ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। ফুকোর দৃষ্টিতে, কঠোর আইন বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো কেবল অপরাধ দমন নয়, বরং রাষ্ট্রের এক প্রকার ‘শৃঙ্খলাবিধানকারী ক্ষমতা’, যা সমাজের প্রান্তিক বা বিচ্যুত মানুষদের ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের ক্ষমতার বৈধতা প্রতিষ্ঠা করে।
এই প্রক্রিয়ায় মাদকাসক্ত ব্যক্তি ভুক্তভোগী না হয়েও দ্রুত অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হয়; যার প্রতি সহানুভূতির পরিবর্তে প্রয়োগ করা হয় কঠোর শাস্তি ও নজরদারি। রাষ্ট্র এইভাবে একদিকে নৈতিক শুদ্ধতার দাবি করে, অন্যদিকে দমন-পীড়ন ও শাস্তির মাধ্যমে সমাজে ভয় সৃষ্টি করে, যাতে তার শাসনব্যবস্থা অটুট থাকে এবং সমাজের মৌলিক কাঠামোগত সমস্যাগুলো-যেমন: বৈষম্য বা দুর্নীতি-আলোচনার বাইরে থেকে যায়। ক্ষমতা মাদকাসক্তির প্রকৃত কারণ নিয়ে আলোচনা না করে কেবল তার প্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়।
মাদকাসক্তির ক্ষেত্রে লিঙ্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাজতাত্ত্বিক মাত্রা যোগ করে। সমাজে এটিকে ঐতিহ্যগতভাবে পুরুষদের সমস্যা হিসেবে দেখা হলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শহুরে মধ্যবিত্ত নারীদের মধ্যে আসক্তি বৃদ্ধির হার উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। নারীরা এখানে দ্বিগুণভাবে নিপীড়িত-একদিকে মাদকাসক্তির জন্য তীব্র সামাজিক কলঙ্ক, অন্যদিকে পরিবার ও সমাজের পক্ষ থেকে নীরব দমন ও সহিংসতার শিকার। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো নারীর মানসিক যন্ত্রণা, পারিবারিক নির্যাতন, সামাজিক নিঃসঙ্গতা এবং দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে প্রায়শই অগ্রাহ্য করে। নারীর আসক্তি তাই একদিকে আত্মবিনাশের পথ, অন্যদিকে একটি অন্যায় ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের মানসিক প্রতিরোধের এক নীরব, অপ্রকাশিত রূপ। উপযুক্ত ও সংবেদনশীল পুনর্বাসন কেন্দ্রের অভাবে তাদের সমস্যা আরও গভীর হয়।
বিশ্ব-ব্যবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, বাংলাদেশের মাদক সমস্যা কেবল অভ্যন্তরীণ নয়, এটি একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অসমতার অংশ। বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বাংলাদেশ একটি আধা-প্রান্তিক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত, যা বৈধ ও অবৈধ উভয় বাজারেই বিশ্বশক্তির শোষণের শিকার। মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবার সহজ প্রবাহ, আন্তর্জাতিক পাচারকারী সিন্ডিকেটের ব্যাপক মুনাফা, এবং স্থানীয় প্রশাসনের দুর্নীতি-সবকিছুই বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত অমানবিক ও অন্যায্য কাঠামোর প্রতিফলন। মাদক ব্যবসা তাই শুধু স্থানীয় অপরাধ নয়, বরং এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্ধকার প্রতিরূপ, যেখানে দারিদ্র্য, সীমাহীন লোভ, এবং রাজনৈতিক দমন একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক মাদক পাচার রুটে অবস্থানের কারণে এই ব্যবসার শিকার, যা দেশের অভ্যন্তরীণ সংহতিকে ভেঙে দিচ্ছে।
তবে প্রতিটি আসক্ত ব্যক্তিকে কেবল ভুক্তভোগী বা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা ভুল। প্রতীকী পারস্পরিক ক্রিয়াবাদের আলোকে দেখা যায়, অনেক তরুণের কাছে মাদক গ্রহণ এক ধরনের সামাজিক আচরণ, যা বন্ধুত্ব, বিদ্রোহ বা আত্মপ্রকাশের প্রতীক হিসেবে কাজ করে। ঢাকা শহরের কিছু রেঁস্তোরা বা হোটেল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বা নির্দিষ্ট যুবকেন্দ্রিক সাবকালচারে (উপ-সংস্কৃতি) মাদক গ্রহণ একটি সামাজিক বন্ধনের আচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে মাদক কেবল নেশা নয়, বরং এটি একটি প্রতীকী ঘোষণা-’আমরা প্রচলিত সমাজের ভণ্ডামি মানি না’, ‘আমরা আমাদের নিজস্ব ঐক্য গড়ে তুলছি’। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মাদকাসক্তি বোঝার জন্য কেবল অপরাধের পরিসংখ্যান নয়, মানুষের অভিজ্ঞতা, অর্থবোধ ও সাংস্কৃতিক পটভূমি বুঝতে হবে, যেখানে তারা মাদক গ্রহণের মাধ্যমে এক ধরনের ভুল সামাজিকীকরণ ও পরিচয় খুঁজে নেয়।
বাংলাদেশের মাদকবিরোধী নীতি দীর্ঘদিন ধরেই শাস্তিনির্ভর, যা সমস্যার মূল কারণকে উপেক্ষা করে। পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো অপ্রতুল, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দুর্বল, আর সামাজিক সহানুভূতি প্রায় অনুপস্থিত। দুরখেইমের মতে, এটি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা-সমাজ যখন নিজের বিচ্যুত বা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নৈতিকভাবে পুনর্গঠনে ব্যর্থ হয়, তখন তার নৈতিক সংহতি দুর্বল হয়ে পড়ে। হাওয়ার্ড বেকার তার ‘লেবেলিং থিয়োরি’তে দেখিয়েছেন যে, সমাজের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াই অনেক সময় একজন মানুষকে স্থায়ীভাবে ‘অপরাধী’ বা ‘বিচ্যুত’ করে তোলে। এই লেবেল তাদের সুস্থ জীবনে পুনরুদ্ধারের পথ বন্ধ করে দেয়।
মাদক সমস্যা মোকাবিলায় তাই সবচেয়ে আগে দরকার সামাজিক মনোভাবে পরিবর্তন-অপরাধ নয়, এটিকে একটি কাঠামোগত ও সামাজিক রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। সমাধান অবশ্যই সমাজতাত্ত্বিক হতে হবে: অপরাধীদের শাস্তি নয়, বরং তাদের চিকিৎসার মাধ্যমে সমাজে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা; বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং তাদের সঙ্গে পুনঃসংহতি স্থাপন করা। সমাজের নৈতিক ভিত্তি পুনর্গঠন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং তরুণদের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করাই হতে পারে এই শূন্যতা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ।
বাংলাদেশের মাদক সমস্যাকে সমাজতাত্ত্বিকভাবে বোঝা মানে কেবল অপরাধের পরিসংখ্যান নয়, বরং সামগ্রিক সামাজিক সংহতির সংকটকে উপলব্ধি করা। সমাজে যখন ন্যায়বিচার, আস্থা ও সমবেদনা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, যখন ব্যক্তির সামাজিকীকরণের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন মানুষ বাস্তবতা থেকে পালানোর পথ খোঁজে। মাদক সেই পলায়নের প্রতীক।
মাদকাসক্তি আসলে বাংলাদেশের আধুনিকতার অন্তর্গত এক আয়না-যেখানে প্রতিফলিত হয় উন্নয়নের আলোয় ঢাকা পড়া বঞ্চনা, নৈতিকতা হারানো রাজনীতি, এবং একাকী মানুষের তীব্র আর্তনাদ। দুরখেইম থেকে ফুকো, মার্ক্স থেকে মেরটন-সব তত্ত্ব এক জায়গায় মিলিত হয়ে আমাদের একটিই বার্তা দেয়: আসক্তি কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, এটি এক বিভ্রান্ত ও বিভক্ত সমাজের গভীরতম সামাজিক লক্ষণ। এই শূন্যতার পিছু ছুটতে ছুটতে বাংলাদেশ যদি সত্যিই মুক্তি খুঁজে পেতে চায়, তবে তাকে প্রথমে নিজের সমাজদেহকে আরোগ্য করতে হবে-বিশ্বাস, সহানুভূতি, ন্যায়বিচার ও নৈতিক সংহতির পুনর্গঠনই হতে পারে মাদকমুক্ত ভবিষ্যতের একমাত্র পথ।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]