alt

উপ-সম্পাদকীয়

পাঠ্যপুস্তক এবং আমাদের গোঁড়ামি

মিথুশিলাক মুরমু

: সোমবার, ২৯ নভেম্বর ২০২১

গত রোজায় একটি সংবাদ আমাদের চমকে দিয়েছে। খবরটি ছিল এমন- ‘সৌদির স্কুলে পড়ানো হবে রামায়ণ-মহাভারত’। সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উদ্যোগে দেশটির সমস্ত বিদ্যালয়ে পড়ানো হবে রামায়ন-মহাভারত। এছাড়াও বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে নিজ দেশের নতুন প্রজন্মকে যুগোপযোগী গড়ে তুলতেই এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ। পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যোগব্যায়াম ও আয়ুর্বেদ বিষয়টিও।

ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সৌদি যুবরাজের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সৌদি আরবের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এ পরিকল্পনার কেতাবি নাম ‘ভিশন ২০৩০’। ভিশন ২০৩০ তে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, এ পরিকল্পনার হাত ধরে সৌদি আরবের শিক্ষাব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন হতে পারে। মহাভারত সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীন ভারতের দুটি প্রধান মহাকাব্যের অন্যতম, অপরটি রামায়ণ। মহাভারতের মূল উপজীব্য বিষয় হলো কৌরব ও পা-বদের গৃহবিবাদ এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলি। তবে এই আখ্যানভাগের বাইরেও দর্শন ও ভক্তির অধিকাংশ উপাদানই এই মহাকাব্যে সংযোজিত হয়েছে।

সৌদির এক টুইটার ব্যবহারকারী বিষয়টি নিয়ে টুইট করেছেন। নউফ আর মারওয়াই নামে সম্প্রতি নিজের ছেলের স্কুলের সিলেবাসের একটি স্ক্রিনশট পোস্ট করেছেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘সৌদি আরবের স্কুলের সোশ্যাল স্টাডিজের সিলেবাসে এ বিষয়গুলো যুক্ত করা হয়েছে। সৌদি আরবে এই নতুন ভিশন ২০৩০ একটি সমন্বয়পূর্ণ, মুক্তচিন্তাধারা ও ধৈর্যশীল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে।’ তেল নির্ভর সৌদি আরব তেল রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত অর্থের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে চেয়েছে। শিক্ষাসহ নানা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে তাই তেলের ওপর দেশের অর্থনীতির নির্ভরতা কমাতে চেয়েছে সৌদি সরকার।

সৌদি আরবের পর অভিন্ন পাঠ্যক্রম চালু করছে পাকিস্তান। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ’-এর নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল-দেশটিতে অভিন্ন পাঠ্যক্রম চালু করা। সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিগত আগস্ট থেকেই প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু হবে এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর জন্য আগামী বছর এবং নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য এমন পাঠ্যক্রম চালু হবে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে।

পাকিস্তান জাতীয় পাঠ্যক্রম পরিষদের (এনসিসি) রফিক তাহির ভাষ্যমতে, ‘প্রথমে সিন্ধু প্রবেশ এই পাঠ্যক্রম নিয়ে কিছুটা আপত্তি জানালেও পরে তারাও রাজি হয়েছে। তবে তারা মৌলিক বইগুলোর বাইরে নিজেদের মতো করে কিছুটা অতিরিক্ত বই রাখছে। এটা (সিন্ধুর সিন্ধান্ত) সঠিক ও ভালো দিক। অন্য প্রদেশগুলোও চাইলে তা করতে পারবে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে এনসিসি সম্মতি জানিয়েছে।’ সেখানে রয়েছে- ইংলিশ মিডিয়াম, ইসলামিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমসমূহ। বিশ্লেষকরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, যদি সত্যকারে একক পাঠ্যক্রম দেশব্যাপী চালুতে সফলতা আসে, তাহলে তা হবে পাকিস্তানের জন্য একটি বিপ্লব, যা দেশকে ভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাবে। তবে সময়ই বলে দেবে, এর ফল কী হতে যাচ্ছে।

অভিন্ন পাঠ্যক্রম বলতে যেটি বোঝা যায়, সমস্ত মাধ্যমই পাকিস্তানের জাতীয় পাঠ্যক্রম পরিষদের (এনসিসি)-র প্রণীত পাঠ্যক্রম অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা প্রদান করবেন। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে নিজেরা দু’একটি সংযোজন করতে সক্ষম হবেন। এতে করে সুদূর অতীতে নতুন প্রজন্মদের মধ্যে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, ধর্মান্ধহীনতা এবং জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বারোপিত হবে। মূলতঃ বিভেদের জায়গাগুলো সংকীর্ণ ও সংকুচিত হয়ে পড়বে।

আমরা ধর্মকে জাতীয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে এবং বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান নিশ্চিত করতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছি

আমার বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে উল্টো চিত্র আমাদের ভাবিত করে তোলে। ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তিরা অমুক কবি, সাহিত্যিক কিংবা লেখককে ধর্মের পরিচয়ে পরিচিত করে তুলেছেন; ফলস্বরূপ পাঠ্যপুস্তক থেকে তাদের লেখাগুলোকে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে। ধর্মের পরিচয়ে ধর্মকে অবলম্বন করে পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হওয়া দেশ ও জাতির জন্য নিঃসন্দেহে অশনি সংকেত! ‘হেফাজতে বাংলাদেশ’ কর্তৃক ঘোষিত ১৩ দফার ৫ নং বলা হয়েছে, ‘ইসলামবিরোধী নারী নীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতালমূলক করা।’ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’-এর ১২ দফার ৯-এ বলা হয়েছে, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইসলামি শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত কামিল-ফাজিল পাস শিক্ষক নিয়োগ এবং পাঠ্যপুস্তকে মৌলিক আকিদা ও বিধিবিধানের বিকৃত বন্ধ করা।’

আমরা ধর্মকে জাতীয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে এবং বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান নিশ্চিত করতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছি। বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মদের একটি বিশেষ ধর্মের আবরণ দিয়ে ঢেকে দিলে, তাদের অবারিত আকাশের পথকে রুদ্ধ দেয়ার মতো হচ্ছে কি না-ভেবে দেখা দরকার! ইতোমধ্যেই পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার তাগিদ দিয়েছেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা দেশ সম্পর্কে, দেশের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে, প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে, গোটা বিশ^ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবে এটি তো প্রত্যাশিত। এছাড়াও বৈশি^ক জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি ও মানবাধিকার সম্পর্কে অবদান রাখার লক্ষ্যে এ বিষয়গুলোকেও অগ্রাধিকারভাবে এড়িয়া যাওয়া নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার মতো।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও মৌলানা আক্রাম খাঁ শিক্ষার মধ্য দিয়ে মৈত্রী সংস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। শিক্ষা বলতে এখানে দেশবন্ধু সংস্কৃতি বা কালচার-এর কথাই বলতে চেয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্রের সাক্ষ্য অনুযায়ী কারাগারে মৌলানা আক্রাম খাঁর সঙ্গে দেশবন্ধুর প্রায়ই আলোচনা হতো এবং তার ফলশ্রুতিতে মৌলানা সাহেব হিন্দু-মুসলমানের শিক্ষার মিলন বিষয়ে পুস্তক বা প্রবন্ধ রচনা করতে রাজি হন। ধর্মশিক্ষা থাকবে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায় কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে নয়। পাঠ্যপুস্তক হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতাযুক্ত এবং ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধযুক্ত। কেবল পড়া নয় হোক চেতনার জাগরণ। আর এই জাগরণ সৃষ্টিতে প্রয়োজন বই, বই আর বই। পাঠ্যপুস্তক হচ্ছে এটির প্রথম পদক্ষেপ।

[লেখক : কলামিস্ট]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পাঠ্যপুস্তক এবং আমাদের গোঁড়ামি

মিথুশিলাক মুরমু

সোমবার, ২৯ নভেম্বর ২০২১

গত রোজায় একটি সংবাদ আমাদের চমকে দিয়েছে। খবরটি ছিল এমন- ‘সৌদির স্কুলে পড়ানো হবে রামায়ণ-মহাভারত’। সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উদ্যোগে দেশটির সমস্ত বিদ্যালয়ে পড়ানো হবে রামায়ন-মহাভারত। এছাড়াও বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে নিজ দেশের নতুন প্রজন্মকে যুগোপযোগী গড়ে তুলতেই এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ। পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যোগব্যায়াম ও আয়ুর্বেদ বিষয়টিও।

ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সৌদি যুবরাজের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সৌদি আরবের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এ পরিকল্পনার কেতাবি নাম ‘ভিশন ২০৩০’। ভিশন ২০৩০ তে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, এ পরিকল্পনার হাত ধরে সৌদি আরবের শিক্ষাব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন হতে পারে। মহাভারত সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীন ভারতের দুটি প্রধান মহাকাব্যের অন্যতম, অপরটি রামায়ণ। মহাভারতের মূল উপজীব্য বিষয় হলো কৌরব ও পা-বদের গৃহবিবাদ এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলি। তবে এই আখ্যানভাগের বাইরেও দর্শন ও ভক্তির অধিকাংশ উপাদানই এই মহাকাব্যে সংযোজিত হয়েছে।

সৌদির এক টুইটার ব্যবহারকারী বিষয়টি নিয়ে টুইট করেছেন। নউফ আর মারওয়াই নামে সম্প্রতি নিজের ছেলের স্কুলের সিলেবাসের একটি স্ক্রিনশট পোস্ট করেছেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘সৌদি আরবের স্কুলের সোশ্যাল স্টাডিজের সিলেবাসে এ বিষয়গুলো যুক্ত করা হয়েছে। সৌদি আরবে এই নতুন ভিশন ২০৩০ একটি সমন্বয়পূর্ণ, মুক্তচিন্তাধারা ও ধৈর্যশীল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে।’ তেল নির্ভর সৌদি আরব তেল রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত অর্থের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে চেয়েছে। শিক্ষাসহ নানা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে তাই তেলের ওপর দেশের অর্থনীতির নির্ভরতা কমাতে চেয়েছে সৌদি সরকার।

সৌদি আরবের পর অভিন্ন পাঠ্যক্রম চালু করছে পাকিস্তান। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ’-এর নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল-দেশটিতে অভিন্ন পাঠ্যক্রম চালু করা। সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিগত আগস্ট থেকেই প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু হবে এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর জন্য আগামী বছর এবং নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য এমন পাঠ্যক্রম চালু হবে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে।

পাকিস্তান জাতীয় পাঠ্যক্রম পরিষদের (এনসিসি) রফিক তাহির ভাষ্যমতে, ‘প্রথমে সিন্ধু প্রবেশ এই পাঠ্যক্রম নিয়ে কিছুটা আপত্তি জানালেও পরে তারাও রাজি হয়েছে। তবে তারা মৌলিক বইগুলোর বাইরে নিজেদের মতো করে কিছুটা অতিরিক্ত বই রাখছে। এটা (সিন্ধুর সিন্ধান্ত) সঠিক ও ভালো দিক। অন্য প্রদেশগুলোও চাইলে তা করতে পারবে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে এনসিসি সম্মতি জানিয়েছে।’ সেখানে রয়েছে- ইংলিশ মিডিয়াম, ইসলামিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমসমূহ। বিশ্লেষকরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, যদি সত্যকারে একক পাঠ্যক্রম দেশব্যাপী চালুতে সফলতা আসে, তাহলে তা হবে পাকিস্তানের জন্য একটি বিপ্লব, যা দেশকে ভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাবে। তবে সময়ই বলে দেবে, এর ফল কী হতে যাচ্ছে।

অভিন্ন পাঠ্যক্রম বলতে যেটি বোঝা যায়, সমস্ত মাধ্যমই পাকিস্তানের জাতীয় পাঠ্যক্রম পরিষদের (এনসিসি)-র প্রণীত পাঠ্যক্রম অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা প্রদান করবেন। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে নিজেরা দু’একটি সংযোজন করতে সক্ষম হবেন। এতে করে সুদূর অতীতে নতুন প্রজন্মদের মধ্যে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, ধর্মান্ধহীনতা এবং জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বারোপিত হবে। মূলতঃ বিভেদের জায়গাগুলো সংকীর্ণ ও সংকুচিত হয়ে পড়বে।

আমরা ধর্মকে জাতীয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে এবং বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান নিশ্চিত করতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছি

আমার বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে উল্টো চিত্র আমাদের ভাবিত করে তোলে। ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তিরা অমুক কবি, সাহিত্যিক কিংবা লেখককে ধর্মের পরিচয়ে পরিচিত করে তুলেছেন; ফলস্বরূপ পাঠ্যপুস্তক থেকে তাদের লেখাগুলোকে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে। ধর্মের পরিচয়ে ধর্মকে অবলম্বন করে পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হওয়া দেশ ও জাতির জন্য নিঃসন্দেহে অশনি সংকেত! ‘হেফাজতে বাংলাদেশ’ কর্তৃক ঘোষিত ১৩ দফার ৫ নং বলা হয়েছে, ‘ইসলামবিরোধী নারী নীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতালমূলক করা।’ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’-এর ১২ দফার ৯-এ বলা হয়েছে, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইসলামি শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত কামিল-ফাজিল পাস শিক্ষক নিয়োগ এবং পাঠ্যপুস্তকে মৌলিক আকিদা ও বিধিবিধানের বিকৃত বন্ধ করা।’

আমরা ধর্মকে জাতীয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে এবং বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান নিশ্চিত করতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছি। বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মদের একটি বিশেষ ধর্মের আবরণ দিয়ে ঢেকে দিলে, তাদের অবারিত আকাশের পথকে রুদ্ধ দেয়ার মতো হচ্ছে কি না-ভেবে দেখা দরকার! ইতোমধ্যেই পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার তাগিদ দিয়েছেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা দেশ সম্পর্কে, দেশের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে, প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে, গোটা বিশ^ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবে এটি তো প্রত্যাশিত। এছাড়াও বৈশি^ক জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি ও মানবাধিকার সম্পর্কে অবদান রাখার লক্ষ্যে এ বিষয়গুলোকেও অগ্রাধিকারভাবে এড়িয়া যাওয়া নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার মতো।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও মৌলানা আক্রাম খাঁ শিক্ষার মধ্য দিয়ে মৈত্রী সংস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। শিক্ষা বলতে এখানে দেশবন্ধু সংস্কৃতি বা কালচার-এর কথাই বলতে চেয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্রের সাক্ষ্য অনুযায়ী কারাগারে মৌলানা আক্রাম খাঁর সঙ্গে দেশবন্ধুর প্রায়ই আলোচনা হতো এবং তার ফলশ্রুতিতে মৌলানা সাহেব হিন্দু-মুসলমানের শিক্ষার মিলন বিষয়ে পুস্তক বা প্রবন্ধ রচনা করতে রাজি হন। ধর্মশিক্ষা থাকবে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায় কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে নয়। পাঠ্যপুস্তক হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতাযুক্ত এবং ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধযুক্ত। কেবল পড়া নয় হোক চেতনার জাগরণ। আর এই জাগরণ সৃষ্টিতে প্রয়োজন বই, বই আর বই। পাঠ্যপুস্তক হচ্ছে এটির প্রথম পদক্ষেপ।

[লেখক : কলামিস্ট]

back to top