alt

উপ-সম্পাদকীয়

অনলাইন জন্মনিবন্ধনে সমস্যা

নিশাত ছিদ্দিকা

: বুধবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২১

সম্প্রতি নিবন্ধন সেবা সহজ করতে অনলাইনে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করে সরকার। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পদক্ষেপ হিসেবে ২০১০ সাল থেকে অনলাইন জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়। সারাদেশে সরাসরি জন্মনিবন্ধনের পাশাপাশি অনলাইনেও নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে। অথচ সেখানেই বেড়েছে জটিলতা। ডিজিটাল জন্ম ও মৃত্যুসনদ নিতে পদে পদে ‘ডিজিটাল বিড়ম্বনায়’ পড়ছেন সেবাগ্রহীতারা। অনলাইন জন্মনিবন্ধন হয়ে উঠেছে অসহায়, খেটে খাওয়া কিংবা শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত সব শ্রেণীর মানুষের ভোগান্তির এক নতুন নাম। ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা কিংবা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ জনগণ।

জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমে একটি শিশু প্রথম নাগরিকত্ব লাভ করে। জন্মসনদ অত্যাবশ্যকীয় করার লক্ষ্যে সরকার নতুন করে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ২০০৪ প্রণয়ন করে। জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, শিশু অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে আইনটি ৩ জুলাই ২০০৬ থেকে কার্যকর করা হয়েছে। জন্মনিবন্ধন আইনে বলা হয়েছে, বয়স, জাতি-গোষ্ঠী, ধর্ম-কিংবা জাতীয়তা সব নির্বিশেষে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেকটি মানুষের জন্য জন্মনিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষে জন্মনিবন্ধন কর্তৃপক্ষ নিবন্ধনকারীকে একটি সার্টিফিকেট দেবেন।

এ বছরের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে স্কুলে ভর্তি, এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন, পাসপোর্টের জন্য আবেদনসহ আরও কিছু ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু উপজেলার জনসাধারণ বলছেন, অনলাইনে আবেদন করার প্রক্রিয়ায় সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

২০০১ সালের পর যাদের জন্ম, তাদের জন্মনিবন্ধনের জন্য বাবা-মায়ের জন্মসনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করায় সন্তানের জন্মসনদ নিতে গিয়েও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে অভিভাবকদের। একই সঙ্গে কারও মৃত্যুসনদ নিতে হলে প্রয়োজন হচ্ছে ডিজিটাল জন্মসনদের। সব মিলিয়ে চরম জটিলতায় পড়ছেন সেবাগ্রহীতারা।

ইউনিয়ন থেকে উপজেলায় আসা একজন বলেন, তার ঠিকানা যাচাই-সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হওয়ায় তিন-চার মাস ঘুরেও বাচ্চার সনদ নিতে পারছেন না, যা কি-না তার মতো দিনমজুরের জন্য খুবই কষ্টকর। তিনি বলেন, তার স্থায়ী ঠিকানা বলে কিছু নেই। তাই নিবন্ধন ফর্মে বর্তমান ঠিকানার জায়গায় বিদ্যুৎ বিলের কপি দিয়েছেন প্রমাণ হিসেবে। কিন্তু বিদ্যুৎ বিলে অন্যের নাম থাকায় ইউনিয়ন পরিষদ কর্মকর্তারা তার আবেদন গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘কর্মকর্তারা বলছেন বিদ্যুৎ বিলে আমার নাম না থাকলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু আমার নিজের বাড়ি নেই অন্যের জায়গাতে থাকি, বিলে আমার নাম কীভাবে থাকবে? তারা আমার আবেদনপত্র গ্রহণও করছে না, সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যাবে তাও বলছে না। এখন পর্যন্ত জানি না সনদ কীভাবে পাব।’

সুলতানাবাদ নামের এক ইউনিয়নের বাসিন্দা বলেন, বর্তমান নিয়মানুযায়ী, ২০০১ সালের পর যাদের জন্ম তাদের জন্মনিবন্ধন করতে বাবা-মা’র জন্মনিবন্ধন কপি প্রয়োজন। কাজেই সন্তানদের জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করতে তার নিবন্ধন ইংরেজি করে নিতে বলেছে কিন্তু আজ দুই মাস হলো এখনও পাইনি আর কবে পাব তাও জানি না। তিনি আরও বলেন, গত দুই মাসে ৪-৫ বার ইউনিয়ন পরিষদে ও একবার উপজেলাতেও গিয়েছি কিন্তু কোন সমাধান পাইনি। এ বলে তার কথা ও বলে তার কথা।

উপজেলায় আরেক জন বলেন, ‘আমার দুই সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ করানো ছিল, কিন্তু সেখানে তাদের মায়ের নামে ভুল ছিল। পরে সেটি সংশোধন করি এবং গত বছরের সেপ্টেম্বরে আমার কাছে আমার দুই সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদের প্রিন্ট করা কপি হস্তান্তর করা হয়, যেটিতে সনদের দায়িত্বে থাকা আঞ্চলিক কর্মকর্তা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকের স্বাক্ষরও ছিল। কিন্তু কিছুদিন আগে সন্তানদের পাসপোর্ট করাতে গিয়ে ওই ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন সনদের নম্বর দেয়ার পর দেখি ওই নম্বর গ্রহণ করছে না। পরে জন্মনিবন্ধন অফিসে যোগাযোগ করলে তারা জানায় যে, আমার সন্তানদের ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন করাই হয়নি। অর্থাৎ ডেটাবেসে তাদের জন্মনিবন্ধনের তথ্য নেই, যদিও আমার কাছে সনদের প্রিন্ট করা কপি রয়েছে। সমস্যার সমাধান সম্পর্কে জানতে চাইলে বলা হয় সংশোধনের জন্য আবেদন করতে। অর্থাৎ সংশোধনের জন্য প্রক্রিয়াটা আবার নতুন করে শুরু করার উপদেশ দেয়া হয় আমাকে।’

চট্টগ্রামের বাসিন্দা, প্রবাসী আহমেদ সেলিম দূতাবাস থেকে জন্মনিবন্ধন করানোর ফলে তার সন্তানদের জন্মনিবন্ধনে পিতার নামের বাংলা না আসাতে বিড়ম্বনায় পড়েছেন। তার স্ত্রী দিলুআরা বেগম এই সমস্যার সমাধানের জন্য কখনো ইউএনও, কখনো চেয়ারম্যান কখনো ডিসির কার্যালয়ে গিয়েও একেকজনের একেক অভিমতে বিভ্রান্ত হয়েছে। পায়নি কোনো সঠিক সমাধান।

এদিকে, মৃত্যুসনদ নিতেও ভোগান্তিতে পড়েছেন অনেকে। তাদেরই একজন জয়নুল আবেদিন। মৃত বাবার মৃত্যু নিবন্ধন সনদ নিতে এসে জটিলতায় পড়েছেন তিনি। বাবার জন্মসনদ ডিজিটাল না হওয়ায় মৃত্যুসনদের আবেদন নিচ্ছেন না কর্মকর্তারা। সমস্যা সমাধানে জোন অফিসে এসেছেন জয়নুল। তবে জোন অফিস থেকে তাকে জানিয়ে দেয়া হয়, ডিজিটাল জন্মসনদ ছাড়া মৃত্যু নিবন্ধন সনদ দেয়া হবে না। ফলে বাবার রেখে যাওয়া জমি ও সম্পদ নিয়ে জটিলতায় পড়েছেন তিনি। জয়নুল আবেদিন বলেন, ১৫ দিন আগে বাবা মারা গেছেন। তার মৃত্যু নিবন্ধনের আবেদন করলেও সেটি নিচ্ছেন না কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন নম্বর ছাড়া মৃত্যু নিবন্ধন আবেদন করাই যাবে না। এখন জন্মনিবন্ধন কীভাবে করাবো বুঝতে পারছি না। পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। উপজেলা কর্মকর্তাগণ কোন কথা বলতে রাজি হয়নি, যদিও তারা বুঝিয়েছেন প্রাথমিক সব কাজ ইউনিয়ন পরিষদের, তাদের কাজ জরুরি প্রয়োজনে সংশোধন করা।

ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে আরও অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, সরকার নির্ধারিত ফি থেকে অধিক পরিমাণে অর্থ আদায় করছে তাদের কাছ থেকে। অনেকেই বলছেন কার্যালয়গুলোতে উপস্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নাগরিকদের স্পষ্ট কোন নির্দেশনা দিচ্ছেন না। সনদ সংশোধনের ক্ষেত্রেও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগছে বলে দাবি সনদ নিতে আসা অনেকের। একজন বলেন ‘আমি বেশ কয়েকবার আমার ইউনিয়ন পরিষদে গিয়েছি। সেখানকার অধিকাংশই আবেদনকারীদের সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। অনেক সময় কোন তথ্য জানতে চাইলেও স্পষ্টভাবে উত্তর দেয় না।’ বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায় সব ইউনিয়নেই কম-বেশি একই অবস্থা।

ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ বলেন, পুরোনো পাঁচ অঞ্চলের সঙ্গে নতুন আরও পাঁচটি অঞ্চল করা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন স্ট্যাবলিশমেন্ট স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, রাজস্ব সব অফিস হবে। তিনি বলেন, জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের ফরম্যাট সফটওয়্যারের মাধ্যমে হয়, সেটা জন্মনিবন্ধন অধিদপ্তর থেকে করা হয়। এখানে আমাদের কর্মকর্তাদের তেমন কিছুই করার নেই। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দিলে সেখান থেকে (অনলাইনে) নিবন্ধন সনদ ডাউনলোড করা যায়। সেটা আমরা সেবা নিতে আসা লোকদের হাতে পৌঁছে দেই। তবে অনেক সময় সার্ভার ডাউন থাকে, স্লো কাজ করে। আবার অনেক সময় বন্ধও থাকে। এসব সমস্যায় আমাদের কিছু করার নেই।

তিনি আরও বলেন, ‘জনগণ ভোগান্তির শিকার হয়, তা আমরা জানি। কিছু সিস্টেম আছে যেগুলো জটিল। সফটওয়্যারে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন নম্বর না দিলে সন্তানের জন্মনিবন্ধনের পরবর্তী পেজ আসে না। এ ধরনের কিছু জটিলতা থাকে, এটা অনেকটাই ডিজিটাল জটিলতা।’ আবেদনকারীরা সঠিক ডকুমেন্ট দিতে পারেন না জানিয়ে সিটি করপোরেশনের এ কর্মকর্তা বলেন, জন্ম তারিখটার জন্য অবশ্যই বৈধ ডকুমেন্ট থাকা দরকার। সেটা এনআইডি হতে পারে, শিক্ষাগত সনদের কপি হতে পারে কিংবা টিকা কার্ড হলেও চলবে। মানুষ সেগুলো দিতে পারেন না। কিছুদিন আগে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন দিবস পালন হলো, সেখানেও এ কথাগুলো উঠে এসেছে। এ সেবা প্রক্রিয়া কীভাবে জনবান্ধব ও ভোগান্তিমুক্ত করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের রেজিস্টার জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যে ফরম দেয়া হয়, সেখানে তো সব লেখা থাকে। কোন কোন কাগজপত্র ও কত টাকা ফিস জমা দিতে হবে, তাও সেখানে থাকে। সঠিকভাবে সাবমিট করলে ভোগান্তির কোন অবকাশ নেই।’ তিনি বলেন, তবুও যদি কোন ভোগান্তির বিষয় সামনে আসে, তার কোন নমুনা আমাদের জানালে খতিয়ে দেখব। কেউ মারা গেলে তার মৃত্যুনিবন্ধন সনদের জন্য আগে জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন হয়। সেটা কারও না থাকলে তার পক্ষে পরিবারের যে কেউ জন্ম গ্রহণসংক্রান্ত তথ্যসহ জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারেন। কোন অঞ্চলের অফিস কোথায়, সেটা ওয়েবসাইটে বলা আছে। নির্ধারিত টেলিফোন নম্বরে কল দিয়েও তথ্য জানা যাবে।

সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অনলাইন জন্মনিবন্ধনে সমস্যা

নিশাত ছিদ্দিকা

বুধবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২১

সম্প্রতি নিবন্ধন সেবা সহজ করতে অনলাইনে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করে সরকার। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পদক্ষেপ হিসেবে ২০১০ সাল থেকে অনলাইন জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়। সারাদেশে সরাসরি জন্মনিবন্ধনের পাশাপাশি অনলাইনেও নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে। অথচ সেখানেই বেড়েছে জটিলতা। ডিজিটাল জন্ম ও মৃত্যুসনদ নিতে পদে পদে ‘ডিজিটাল বিড়ম্বনায়’ পড়ছেন সেবাগ্রহীতারা। অনলাইন জন্মনিবন্ধন হয়ে উঠেছে অসহায়, খেটে খাওয়া কিংবা শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত সব শ্রেণীর মানুষের ভোগান্তির এক নতুন নাম। ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা কিংবা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ জনগণ।

জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমে একটি শিশু প্রথম নাগরিকত্ব লাভ করে। জন্মসনদ অত্যাবশ্যকীয় করার লক্ষ্যে সরকার নতুন করে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ২০০৪ প্রণয়ন করে। জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, শিশু অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে আইনটি ৩ জুলাই ২০০৬ থেকে কার্যকর করা হয়েছে। জন্মনিবন্ধন আইনে বলা হয়েছে, বয়স, জাতি-গোষ্ঠী, ধর্ম-কিংবা জাতীয়তা সব নির্বিশেষে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেকটি মানুষের জন্য জন্মনিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষে জন্মনিবন্ধন কর্তৃপক্ষ নিবন্ধনকারীকে একটি সার্টিফিকেট দেবেন।

এ বছরের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে স্কুলে ভর্তি, এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন, পাসপোর্টের জন্য আবেদনসহ আরও কিছু ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু উপজেলার জনসাধারণ বলছেন, অনলাইনে আবেদন করার প্রক্রিয়ায় সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

২০০১ সালের পর যাদের জন্ম, তাদের জন্মনিবন্ধনের জন্য বাবা-মায়ের জন্মসনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করায় সন্তানের জন্মসনদ নিতে গিয়েও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে অভিভাবকদের। একই সঙ্গে কারও মৃত্যুসনদ নিতে হলে প্রয়োজন হচ্ছে ডিজিটাল জন্মসনদের। সব মিলিয়ে চরম জটিলতায় পড়ছেন সেবাগ্রহীতারা।

ইউনিয়ন থেকে উপজেলায় আসা একজন বলেন, তার ঠিকানা যাচাই-সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হওয়ায় তিন-চার মাস ঘুরেও বাচ্চার সনদ নিতে পারছেন না, যা কি-না তার মতো দিনমজুরের জন্য খুবই কষ্টকর। তিনি বলেন, তার স্থায়ী ঠিকানা বলে কিছু নেই। তাই নিবন্ধন ফর্মে বর্তমান ঠিকানার জায়গায় বিদ্যুৎ বিলের কপি দিয়েছেন প্রমাণ হিসেবে। কিন্তু বিদ্যুৎ বিলে অন্যের নাম থাকায় ইউনিয়ন পরিষদ কর্মকর্তারা তার আবেদন গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘কর্মকর্তারা বলছেন বিদ্যুৎ বিলে আমার নাম না থাকলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু আমার নিজের বাড়ি নেই অন্যের জায়গাতে থাকি, বিলে আমার নাম কীভাবে থাকবে? তারা আমার আবেদনপত্র গ্রহণও করছে না, সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যাবে তাও বলছে না। এখন পর্যন্ত জানি না সনদ কীভাবে পাব।’

সুলতানাবাদ নামের এক ইউনিয়নের বাসিন্দা বলেন, বর্তমান নিয়মানুযায়ী, ২০০১ সালের পর যাদের জন্ম তাদের জন্মনিবন্ধন করতে বাবা-মা’র জন্মনিবন্ধন কপি প্রয়োজন। কাজেই সন্তানদের জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করতে তার নিবন্ধন ইংরেজি করে নিতে বলেছে কিন্তু আজ দুই মাস হলো এখনও পাইনি আর কবে পাব তাও জানি না। তিনি আরও বলেন, গত দুই মাসে ৪-৫ বার ইউনিয়ন পরিষদে ও একবার উপজেলাতেও গিয়েছি কিন্তু কোন সমাধান পাইনি। এ বলে তার কথা ও বলে তার কথা।

উপজেলায় আরেক জন বলেন, ‘আমার দুই সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ করানো ছিল, কিন্তু সেখানে তাদের মায়ের নামে ভুল ছিল। পরে সেটি সংশোধন করি এবং গত বছরের সেপ্টেম্বরে আমার কাছে আমার দুই সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদের প্রিন্ট করা কপি হস্তান্তর করা হয়, যেটিতে সনদের দায়িত্বে থাকা আঞ্চলিক কর্মকর্তা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকের স্বাক্ষরও ছিল। কিন্তু কিছুদিন আগে সন্তানদের পাসপোর্ট করাতে গিয়ে ওই ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন সনদের নম্বর দেয়ার পর দেখি ওই নম্বর গ্রহণ করছে না। পরে জন্মনিবন্ধন অফিসে যোগাযোগ করলে তারা জানায় যে, আমার সন্তানদের ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন করাই হয়নি। অর্থাৎ ডেটাবেসে তাদের জন্মনিবন্ধনের তথ্য নেই, যদিও আমার কাছে সনদের প্রিন্ট করা কপি রয়েছে। সমস্যার সমাধান সম্পর্কে জানতে চাইলে বলা হয় সংশোধনের জন্য আবেদন করতে। অর্থাৎ সংশোধনের জন্য প্রক্রিয়াটা আবার নতুন করে শুরু করার উপদেশ দেয়া হয় আমাকে।’

চট্টগ্রামের বাসিন্দা, প্রবাসী আহমেদ সেলিম দূতাবাস থেকে জন্মনিবন্ধন করানোর ফলে তার সন্তানদের জন্মনিবন্ধনে পিতার নামের বাংলা না আসাতে বিড়ম্বনায় পড়েছেন। তার স্ত্রী দিলুআরা বেগম এই সমস্যার সমাধানের জন্য কখনো ইউএনও, কখনো চেয়ারম্যান কখনো ডিসির কার্যালয়ে গিয়েও একেকজনের একেক অভিমতে বিভ্রান্ত হয়েছে। পায়নি কোনো সঠিক সমাধান।

এদিকে, মৃত্যুসনদ নিতেও ভোগান্তিতে পড়েছেন অনেকে। তাদেরই একজন জয়নুল আবেদিন। মৃত বাবার মৃত্যু নিবন্ধন সনদ নিতে এসে জটিলতায় পড়েছেন তিনি। বাবার জন্মসনদ ডিজিটাল না হওয়ায় মৃত্যুসনদের আবেদন নিচ্ছেন না কর্মকর্তারা। সমস্যা সমাধানে জোন অফিসে এসেছেন জয়নুল। তবে জোন অফিস থেকে তাকে জানিয়ে দেয়া হয়, ডিজিটাল জন্মসনদ ছাড়া মৃত্যু নিবন্ধন সনদ দেয়া হবে না। ফলে বাবার রেখে যাওয়া জমি ও সম্পদ নিয়ে জটিলতায় পড়েছেন তিনি। জয়নুল আবেদিন বলেন, ১৫ দিন আগে বাবা মারা গেছেন। তার মৃত্যু নিবন্ধনের আবেদন করলেও সেটি নিচ্ছেন না কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন নম্বর ছাড়া মৃত্যু নিবন্ধন আবেদন করাই যাবে না। এখন জন্মনিবন্ধন কীভাবে করাবো বুঝতে পারছি না। পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। উপজেলা কর্মকর্তাগণ কোন কথা বলতে রাজি হয়নি, যদিও তারা বুঝিয়েছেন প্রাথমিক সব কাজ ইউনিয়ন পরিষদের, তাদের কাজ জরুরি প্রয়োজনে সংশোধন করা।

ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে আরও অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, সরকার নির্ধারিত ফি থেকে অধিক পরিমাণে অর্থ আদায় করছে তাদের কাছ থেকে। অনেকেই বলছেন কার্যালয়গুলোতে উপস্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নাগরিকদের স্পষ্ট কোন নির্দেশনা দিচ্ছেন না। সনদ সংশোধনের ক্ষেত্রেও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগছে বলে দাবি সনদ নিতে আসা অনেকের। একজন বলেন ‘আমি বেশ কয়েকবার আমার ইউনিয়ন পরিষদে গিয়েছি। সেখানকার অধিকাংশই আবেদনকারীদের সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। অনেক সময় কোন তথ্য জানতে চাইলেও স্পষ্টভাবে উত্তর দেয় না।’ বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায় সব ইউনিয়নেই কম-বেশি একই অবস্থা।

ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ বলেন, পুরোনো পাঁচ অঞ্চলের সঙ্গে নতুন আরও পাঁচটি অঞ্চল করা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন স্ট্যাবলিশমেন্ট স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, রাজস্ব সব অফিস হবে। তিনি বলেন, জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের ফরম্যাট সফটওয়্যারের মাধ্যমে হয়, সেটা জন্মনিবন্ধন অধিদপ্তর থেকে করা হয়। এখানে আমাদের কর্মকর্তাদের তেমন কিছুই করার নেই। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দিলে সেখান থেকে (অনলাইনে) নিবন্ধন সনদ ডাউনলোড করা যায়। সেটা আমরা সেবা নিতে আসা লোকদের হাতে পৌঁছে দেই। তবে অনেক সময় সার্ভার ডাউন থাকে, স্লো কাজ করে। আবার অনেক সময় বন্ধও থাকে। এসব সমস্যায় আমাদের কিছু করার নেই।

তিনি আরও বলেন, ‘জনগণ ভোগান্তির শিকার হয়, তা আমরা জানি। কিছু সিস্টেম আছে যেগুলো জটিল। সফটওয়্যারে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন নম্বর না দিলে সন্তানের জন্মনিবন্ধনের পরবর্তী পেজ আসে না। এ ধরনের কিছু জটিলতা থাকে, এটা অনেকটাই ডিজিটাল জটিলতা।’ আবেদনকারীরা সঠিক ডকুমেন্ট দিতে পারেন না জানিয়ে সিটি করপোরেশনের এ কর্মকর্তা বলেন, জন্ম তারিখটার জন্য অবশ্যই বৈধ ডকুমেন্ট থাকা দরকার। সেটা এনআইডি হতে পারে, শিক্ষাগত সনদের কপি হতে পারে কিংবা টিকা কার্ড হলেও চলবে। মানুষ সেগুলো দিতে পারেন না। কিছুদিন আগে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন দিবস পালন হলো, সেখানেও এ কথাগুলো উঠে এসেছে। এ সেবা প্রক্রিয়া কীভাবে জনবান্ধব ও ভোগান্তিমুক্ত করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের রেজিস্টার জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যে ফরম দেয়া হয়, সেখানে তো সব লেখা থাকে। কোন কোন কাগজপত্র ও কত টাকা ফিস জমা দিতে হবে, তাও সেখানে থাকে। সঠিকভাবে সাবমিট করলে ভোগান্তির কোন অবকাশ নেই।’ তিনি বলেন, তবুও যদি কোন ভোগান্তির বিষয় সামনে আসে, তার কোন নমুনা আমাদের জানালে খতিয়ে দেখব। কেউ মারা গেলে তার মৃত্যুনিবন্ধন সনদের জন্য আগে জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন হয়। সেটা কারও না থাকলে তার পক্ষে পরিবারের যে কেউ জন্ম গ্রহণসংক্রান্ত তথ্যসহ জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারেন। কোন অঞ্চলের অফিস কোথায়, সেটা ওয়েবসাইটে বলা আছে। নির্ধারিত টেলিফোন নম্বরে কল দিয়েও তথ্য জানা যাবে।

সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

back to top