alt

উপ-সম্পাদকীয়

জেলখানার চিঠি - পিতা-পুত্রের কথোপকথন

ওবায়দুল হাসান

: শুক্রবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২১
image

বাবা শেখ লুৎফর রহমানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু

একটা সময় ছিল যখন স্বজন প্রিয়জনের চিঠির অপেক্ষায় দিন কাটত। উন্মুখ হয়ে রইতাম কখন ডাক পিয়ন বাসার দরজায় এসে সজোড়ে বলে উঠবে-’চিঠি চিঠি’। আজ আর সেই দিন নেই। অথচ ভালবাসা, প্রেরণা, আদর, শুভ ভাবনা এসবের মোড়কে জড়ানো একটা চিঠি ছিল বন্ধনের অবিচ্ছেদ্য মাধ্যম। সেই চিত্র আজ নেই। প্রযুক্তির ধারাবাহিক দূরন্ত প্রমত্ত বিকাশে আজ সেই চিঠি লেখার প্রচলন বলতে গেলে তিরোহিত। ডাকবাক্সগুলো শূন্য, হাহাকারে আক্রান্ত, রাস্তার পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে বা বড় কোন গাছের কাণ্ডের সঙ্গে অতি অবহেলায় ঝুলছে।

আজ দু’টি চিঠি নিয়েই কিছু কথা বলব। আমার সহজ ভাবনার কথা। একটি চিঠি জেলখানা থেকে লেখা। অপরটি বাড়ী থেকে জেলখানায় এক কারাবন্দির নিকট লেখা। না, এটা নাজিম হিকমতের সেই বিখ্যাত কবিতাও নয় বা সে সম্পর্কিত কোন লেখাও নয়। বাস্তবে পিতা ও পুত্রের লেখা দু’টি চিঠিই আজকের উপজীব্য। একটি চিঠি ছেলে লিখেছিলেন বাবার কাছে। এর চার বছর পরে ছেলেকে শান্তনা দিয়ে বাবার লেখা আরেকটি চিঠি। উল্লে¬খ্য, চিঠি দু’টি কিন্তু একটি অপরটির প্রতিউত্তরও নয়।

শুরুতেই বলেছি আজকাল চিঠি লেখার চর্চা ও প্রচলন প্রায় উঠেই গেছে। ছাত্র জীবনে দেখেছি প্রত্যেক ছাত্রই বাড়িতে চিঠি লিখত হোস্টেলের খরচ এর টাকার জন্য। তখন এটিই ছিল যোগাযোগের মূল মাধ্যম। মুঠোফোন বা ক্ষুদে বার্তার প্রচলন তো আর তখন ছিলনা। টাকার জন্য চিঠি লিখতে হলে বাবার কাছে আর কোন আবদারের জন্য হলে চিঠি যেতো মায়ের কাছে। মায়েদেরকে দেওয়া চিঠি অনেক সময় গিয়ে পড়তো বাবার হাতেই। কারণ মায়ের নাম লিখে বা শুধু ‘মা’ বা ‘আম্মা’ লিখে প্রযত্নে লিখতে হতো বাবার নাম। এলাকার পোস্ট অফিসগুলো তো আর মায়েদের নাম জানতোনা তাই পত্র প্রাপ্তির এই ব্যবস্থা।

বিদেশ থেকে সাধারণত চিঠি আসতো নীল এনভেলপে। এনভেলপের গায়ে লেখা থাকতো Per Avion। এ শব্দটি একটি ফ্রেঞ্চ শব্দ যার ইংরেজি অর্থ হলো By Air. আগেকার দিনে যে পিতামাতার সন্তান বিদেশে থাকতেন সেই সন্তানের চিঠি পাওয়ার জন্য পিতা মাতার যে কি ব্যকুলতা ও অধীর অপেক্ষা থাকতো তা ভাষায় প্রকাশ করা বেশ কঠিন। আজকাল দীর্ঘদিন সন্তানকে না দেখার সেই ব্যাকুলতা নেই বললেই চলে। উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। Viber, Facebook বা WhatsApp এর মাধ্যমে সন্তানের সঙ্গে কথা বলার সময় ছবির মাধ্যমে সাক্ষাৎ মিলে। দূরে থাকা সন্তানকে ধরতে ছুঁতে না পেলেও ছবির মাধ্যমে দেখেও মন অনেকটাই শান্ত হয় বৈকি। প্রযুক্তির কল্যানে এটিও এক প্রাপ্তি বটে। তবে ব্যতিক্রম হলো যারা কারান্তরালে থাকে তাদের সঙ্গে যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায়ও দেখা সাক্ষাৎ হয় না। সেই ব্যবস্থা নেই। আর আগের দিনে তো এসব চিন্তাই করা যেতনা।

ভারতবর্ষের বহু নেতা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে জেলে কাটিয়েছেন অনেক বছর। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বেশ অনেকদিন কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। জেলখানা থেকে তাঁর লেখা অনেক চিঠি পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। তাঁর চিঠিতে তখনকার সমাজচিত্র, জেলাখানার অভ্যন্তরের অবস্থা ও আন্দোলন সংগ্রামের জন্য কিভাবে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন তার চিত্র পাওয়া যায়। তাঁর লেখা চিঠিগুলোর প্রাপকদের মধ্যে সম্ভবত তার বড় ভাই শরৎ চন্দ্র বসু, বার-এট-ল এর নাম এক নম্বরে থাকবে। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু চিঠি লিখেছেন জেলখানা থেকে তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। সেগুলোতে প্রকৃতি, মানব ইতিহাস, পৃথিবীর আদিকাল সম্পর্কিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে । ব্রিটিশ স্টেটসম্যান চেস্টারফিল্ড তাঁর পুত্রের কাছে অনেকগুলো উপদেশমূলক পত্র লিখেছেন। সেগুলো বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এসব পড়লে সমাজ জীবনে চলতে ফিরতে কি গ্রহনীয় আর কি বর্জনীয়, তার একটা দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়। এসব চিঠি কেবল নিতান্ত চিঠি ছিলনা। শুভ ভাবনা, দর্শন ও চেতনার চাদরে আবৃত ছিল এসব চিঠি।

উপরে যাদের চিঠির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের সবার তুলনায় আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় পিছিয়ে থাকা একজন মানুষ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কালের পরিক্রমা ও বিবর্তনে সংগ্রাম, আন্দোলন, ত্যাগ, তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে এই মানুষটিই একদিন হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। তিনি স্থান করে নেন আপামর জনতার মণিকোঠায়। দেশের সীমানা পেরিয়ে সমগ্র বিশ্ববাসীর নিকট হয়ে উঠেন একজন অবিসংবাদিত নেতা আর প্রতিষ্ঠিত হন বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে। নির্মোহ, নিরহংকারী, নিস্কলুষ চরিত্রের সাদা মনের বিরোচিত এই মানুষটি তাঁর জীবনের প্রায় এক চতুর্থাংশ সময় কাটিয়েছিলেন কারান্তরালে। সেই কারানিবাস থেকে পিতা শেখ লুৎফর রহমানকে লেখা তাঁর একটি চিঠি আজ আমি এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এই চিঠির মর্মার্থ থেকে তাঁর সম্পর্কে তখনকার সময়ের রাজনৈতিক অবস্থা ও তাঁর প্রতি সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ সম্পর্কে জানা যায়। জানা যায় প্রিয় স্বজনদের প্রতি তাঁর ভালবাসা ও উদ্বিগ্নতার কথা।

১৯৫৮ সালের ১২ নভেম্বর ঢাকা জেল থেকে রাজনৈতিক বন্দী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাবাকে লিখেছেন-

আব্বা,

আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম গ্রহণ করবেন ও মাকে দিবেন। মা এবার খুব কষ্ট পেয়েছিল কারণ এবার তাঁর সামনেই আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল। দোয়া করবেন মিথ্যা মামলায় আমার কিছুই করতে পারবেনা। আমাকে ডাকাতি মামলার আসামীও একবার করেছিল। আল্লাহ আছে, সত্যের জয় হবেই। আপনি জানেন আমার কিছুই নাই। দয়া করে ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখবেন। বাড়ি যেতে বলে দিতাম। কিন্তু ওদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে।

আমাকে আবার রাজবন্দী করেছে, দরকার ছিল না। কারণ রাজনীতি আর নাই, এবং রাজনীতি আর করবো না। সরকার অনুমতি দিলেও আর করবনা।

যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে আমি ঘুষ খেতে পারি সে দেশে কোন কাজই করা উচিত না। এদেশে ত্যাগ ও সাধনার কোন দামই নাই। যদি কোনদিন জেল হতে বের হতে পারি তবে কোন কিছু একটা করে ছেলেমেয়ে ও আপনাদের নিয়ে ভালভাবে সংসার করব। নিজেও কষ্ট করেছি আপনাদেরও দিয়েছি। বাড়ির সকলকে আমার ছালাম দিবেন, দোয়া করতে বলবেন। আপনার ও মায়ের শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন। চিন্তা করে মন খারাপ করবেন না। মাকে কাঁদতে নিষেধ করবেন। আমি ভাল আছি।

আপনার স্নেহের

মুজিব

NB: গোপালগঞ্জের বাসাটী ভাড়া দিয়া দিবেন, বাসার আর দরকার হবে না।

মুজিব।

(সূত্রঃ বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র পৃষ্ঠাঃ ৯৭)

এটি সহজ সত্য কথায় লেখা একজন রাজবন্দীর একটি অসাধারণ চিঠি, যার মধ্যে ফুটে উঠেছে মহান সৃষ্টিকর্তার উপর অগাধ আস্থা। সেই সাথে চিত্রিত হয়েছে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অত্যাচার অনাচার ও বৈষম্যের ধরণ। একজন সাবেক মন্ত্রীর আর্থিক অবস্থা, অবুঝ মানুষের ভ্রান্ত চিন্তার কারণে মন খারাপ করার কথাও সামনে এসেছে এই চিঠিতে।

অকপট বচনে লেখা এই চিঠির শুরুতেই পিতা মাতাকে সালাম জানিয়ে বন্দী মুজিব মায়ের কষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন এই বলে যে, ‘মা এবার খুব কষ্ট পেয়েছিল কারণ তাঁর সামনেই আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল’। তার পরই আবার তিনি তাঁর দৃঢ়তা প্রকাশ করে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁর গভীর আস্থা প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন --‘দোয়া করবেন মিথ্যা মামলায় আমার কিছুই করতে পারবেনা। আমাকে ডাকাতি মামলার আসামীও একবার করেছিল। আল্লাহ আছে, সত্যের জয় হবেই’।

১৯৫৪ ও ১৯৫৬ সালে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন এটা সর্বজনবিদিত। ‘১৯৫৮ সালে বন্দী দশায় থেকে শেখ মুজিব বাবাকে লিখেছেন -- ‘আপনি জানেন আমার কিছুই নাই। দয়া করে ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখবেন। বাড়ী যেতে বলে দিতাম। কিন্তু ওদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে’। ১৯৫৮ সালে শেখ মুজিব চার সন্তানের জনক, সাবেক মন্ত্রী, তথাপিও আর্থিক অনটন তাঁকে পিছু ছাড়েনি। সন্তানদের প্রতি উদ্বিগ্নতা সত্বেও একজন সৎ রাজনীতিবিদের প্রতিচ্ছবি শেখ মুজিব। চিঠিতে লেখা তাঁর এই কথাটিতে সেটিই মূর্ত হয়েছে। পিতার আর্থিক সামর্থ্য ছিল। তাই পিতার কাছেই চাওয়া। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্যই শুধু তাদের ঢাকায় থাকা।

মন্ত্রীর বাসভবন থেকে ’৫৮ এর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি বের হয়ে যেতে হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের। নিকট আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব ছাড়া তেমন কেউ তখন খোঁজ নেয়নি তাদের। শেখ মুজিবের পিতা জনাব শেখ লুৎফর রহমান বউমা ও নাতি নাতনীদের খোঁজ নিতেন, প্রয়োজনীয় খরচাদি পাঠাতেন। এখনও অনেক সাবেক মন্ত্রী আছেন। অনেকে ভবিষ্যতে ‘সাবেক’ হবেন। তাঁদেরকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব ’৫৮ সালে বন্দী দশার একজন সাবেক মন্ত্রীর তাঁর বাবাকে লেখা এই চিঠিটি পড়তে। চিঠিতে প্রতিফলিত সত্যগুলো অনুধাবন করতে। তখনকার সামরিক যাঁতাকলে নিষ্পেসিত রাজনীতির প্রতি ইঙ্গিত করে কিছু হতাশা ব্যক্ত করে শেখ মুজিব বাবাকে লিখেছেন -- ‘আমাকে আবার রাজবন্দী করেছে, দরকার ছিল না। কারণ রাজনীতি আর নাই, এবং রাজনীতি আর করবো না। সরকার অনুমতি দিলেও আর করব না। যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে আমি ঘুষ খেতে পারি সে দেশে কোন কাজই করা উচিত না। এদেশে ত্যাগ ও সাধনার কোন দামই নাই।’

চিঠিতে তিনি মাকে কাঁদতে নিষেধ করেছেন। লিখেছেন ‘আমি ভাল আছি’। একথাগুলোর মধ্যে একটু হতাশা দেখা গেলেও চিঠির শেষের কথা ‘আল্লাহ আছে, সত্যের জয় হবেই’ -- এই কথাগুলো একসঙ্গে মিলিয়ে পড়লে এটি স্পষ্টই বোঝা যায় প্রতিরোধের গণগনে আগুনে বন্দী মুজিবের মন সদাই জ্বলছিল। সেই সাথে ছিল প্রিয়জনদের জন্য আকুলতা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের উপর ছিল তাঁর অকৃত্রিম বিশ্বাস। যা শুধু একজন ইমানদারেরই থাকে।

‘৫৮ সালে বন্দী হয়ে ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬২, ১৯৬৪ এবং ১৯৬৬ সালে তিনি বারবার কারারুদ্ধ হয়েছেন। বাবার নিকট লেখা চিঠিতে ক্ষোভে অভিমানে লিখেছিলেন তিনি আর রাজনীতি করবেন না। কিন্তু এটি কি সম্ভব ছিল বাংলার মানুষের আপামর নেতা শেখ মুজিব এর পক্ষে। ছিলনা, আর তাইতো তিনি ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবী পেশ করে পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য স্বায়ত্বশাসন দাবী করেন। আর এই অপরাধে আবারো তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। তাঁর ঠিকানা হলো কারান্তরালে। এরই মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে। মানুষেরও ধৈর্য্যরে সীমা থাকে। আর সেই সীমা যখন ভেঙ্গে পড়ে তখন মানুষ ফুঁসে উঠে। সাড়া বাংলার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে, আওয়াজ উঠল -- ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’। ‘জেলের তালা ভাঙ্গবো মুজিব ভাইকে আনবো’।

১৯৬৯ এর ২২ ফেব্র“য়ারি সবার প্রিয় মুজিব ভাই মুক্ত মানুষ হিসেবে আবার তাঁর প্রিয় দেশবাসির কাছে ফিরে আসেন। ২৩ ফেব্র“য়ারি ১৯৬৯ মুজিব ভাইকে সর্ব্বদলীয় ছাত্র সংগাম পরিষদ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। তখন থেকে তিনি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা সকলের বন্ধু, ‘বঙ্গবন্ধু’।

শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হওয়া পর্যন্ত বাংলার এই অবিসংবাদিত নেতাকে বহুবার জেলে যেতে হয়েছে। বাবার নিকট বা রাজনৈতিক অনেক নেতা-কর্মীর নিকট তিনি জেলখানা থেকে চিঠি লিখেছেন। তাঁর কাছেও অনেকে চিঠি পাঠিয়েছেন সে সময়। এরকম একটি চিঠি হলো বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাবার লেখা ৩১.৩.১৯৬২ তারিখের একটি চিঠি। তিনি লিখেছেন-

Tungipara

৩১.৩.৬২

বাবা খোকা

শুরুতেই দোয়া জানিবা। তোমার ২৯/৪/৬২ তারিখের (তারিখটি সম্ভবত ভুল ছাপা হয়) চিঠি একমাস পরে পাইলাম। ‘ঢাকা হইতে ছোট্ট বউ চিঠি লিখিয়াছিল যে, তুমি শীঘ্রই মুক্তি পাইবে এবং কয়েকদিন পরেই সকলকে লইয়া আমাদের দেখিতে আসিবে’। কিন্তু‘ আজ ২০/২৫ দিন হইয়াছে আর কোনও সংবাদ পাইতেছি না। “খোদা তায়ালা বলিয়াছেন তাহার বান্দাকে যে নির্য্যাতন করিবে আমি তাহাকে নির্য্যাতন করিব।” ইহা পূর্ব্বাপর ঘটনা হইতে সকলেই জানিতেছে এবং দুনিয়ার ইতিহাসও তাহা স্বাক্ষ্য দিতেছে। বেশি দিন হয় নাই তুমি নিজে ও দেখিতে পাইয়াছ। তোমাকে আটক করিয়া রাখার অর্থ হইতেছে আমাদের মতন বৃদ্ধ পিতা মাতার, নাবালক ছেলে-মেয়েদের এবং স্ত্রীর উপর নানারূপ অত্যাচার করা। আমরা উপায়হীন, সহ্য করিতে বাধ্য কিন্তু খোদাতায়ালা নিশ্চয়ই সহ্য করিবেন না। চিন্তা করিবা না সব কিছু খোদাতায়ালার উপর নির্ভর। তিনি যাহা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন। সত্যের জয় হবেই। নানারূপ মিথ্যা মোকদ্দমা চাপাইয়া তাহাতে কোনও ফল না পাইয়া তোমার সততার ছাফাই পাইয়াছে তাহা সত্ত্বেও তুমি কিছু না করিলে তোমাকে কেন যে আটকাইয়া রাখিতে হইবে তাহাই বুঝিতে পারিতেছি না। শুনিয়াছিলাম তোমাকেই সর্ব্বাগ্রে মুক্তি দিবে কিন্তু এখনও তাহার কোনও সম্ভাবনা দেখিতেছি না। দেশবাসী প্রায় সকলেই সরকার গোচরে সকল প্রকার রাজবন্দীদের এবং ছাত্রদের মুক্তির প্রার্থনা দিয়াছে। মনে হয় শীঘ্রই তোমাদের মুক্তি দিবে...। ঢাকার সকলে ভাল আছে। মীরার মার হাঁফানী উঠিয়াছিল, সেটা গোপালগঞ্জে শুনিলাম যে একটু ভাল হইয়াছে। আমরা বাড়ীর সকলেই ভাল আছি। তোমার মেজো বুজির শরীর খুবই খারাপ। সব সময় দোয়া করিতেছি এবং খোদার দরগায় প্রার্থনা যে তিনি তোমাদের মঙ্গল করুক। ৮০ বৎসর বয়সের বৃদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে এমন লেখা খুব কঠিন। তাই খুব ধীরে লিখিতে হয় এবং লিখিতে একটু দেরি হয়।

তোমার

আব্বা

Sheikh Mujibur Rahman

Security Prisoner

Central Jail

Dacca.

(সূত্রঃ বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র পৃষ্ঠাঃ ২১৭)

কারাগারে আটক পুত্র শেখ মুজিবকে লেখা এই চিঠির প্রথমাংশে পুত্রকে দেখার আশায় পথ পানে চেয়ে থাকা এক অশিতিপর বৃদ্ধের অনুচ্চারিত কান্নার কথাই ফুটে উঠেছে। কারাবন্দি পুত্রকে লিখা পত্রে পরের কথাগুলো থেকে বঙ্গবন্ধুর পিতার আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা ও আস্থার প্রকাশ ঘটেছে। বান্দার উপর যে অন্যায় জুলুম খোদা তায়ালা সহ্য করেন না এটাও স্বরণ করিয়ে দিয়েছেন বৃদ্ধ বাবা তার আদরের সন্তান খোকাকে।

পিতা ও পুত্রের চিঠি দু’টোর মধ্যে একটি বাক্যের ছিল সম উপস্থিতি। সেটি হলো ‘সত্যের জয় হবেই’। পিতা তার কারাবন্দি পুত্রকে লেখা চিঠিতে ও পিতাকে লেখা কারাবন্দি পুত্রের চিঠিতে এই তিনটি শব্দের অভিন্ন উচ্চকিত বাক্যটি নিঃসন্দেহে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁদের উভয়েরই গভীর আস্থার কথাটি উঠে এসেছে। সাধারণতঃ ধর্মপ্রাণ প্রত্যেকটি মানুষই যার যার ধর্ম বিশ্বাসে সৃষ্টিকর্তার উপর আস্থা রাখেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারে ধর্ম চর্চা তাঁদের পরিবারের একটি ঐতিহ্য। কিন্তু এই ধর্মপ্রাণ পরিবারটি একই সঙ্গে ছিল অসাম্প্রদায়িক। এই অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা বঙ্গবন্ধু নিজ জীবনে করেছেন এবং তিনি তাঁর সন্তানদেরকেও এই শিক্ষা দিয়েছেন। সম্ভবতঃ বঙ্গবন্ধু উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর পিতার কাছ থেকেই একজন অসাম্প্রদায়িক ধর্মপ্রাণ মানুষ হওয়ার শিক্ষাটি পেয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে লিখা চিঠির শেষাংশে তাঁর পিতা পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয় স্বজনের খবরাখবর জানিয়েছেন পুত্রকে। এটি থেকে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছের দূরের আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ খবর রাখতেন বা তাদের খবরাখবর জানতে চাইতেন। এটি ছিল তাঁর যাপিত ব্যক্তি জীবনের এক অনিবার্য ধরণ। আমরা যারা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি তারা সবাই আত্মীয় পরিজন বেষ্টিত অবস্থায় থাকতে পছন্দ করি। সকলকে নিয়েই শান্তি ও সুখের নীড় গড়তে চাই। বঙ্গবন্ধুর পিতার চিঠিটি পড়ে মনে হয় বঙ্গবন্ধু যেমন দেশবাসীর জন্য সাড়া জীবন চিন্তা করেছেন ঠিক তেমনি পরিবারের সদস্যদের প্রতিও ছিল তাঁর খেয়াল ও সদা উদ্বিগ্নতা। তিনি কখনও পরিবারের স্বজনদের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন না।

বঙ্গবন্ধুর পিতা তাঁর চিঠির শেষ লাইনে লিখেছেন-- ‘৮০ বৎসর বয়সের বৃদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে এমন লেখা খুব কঠিন। তাই খুব ধীরে লিখিতে হয় এবং লিখিতে একটু দেরি হয়’। হায়রে মমতাময় পিতা! কত কষ্টই না বুকে ধারণ করে এই চিঠিটা তিনি কারবন্দি পুত্রকে লিখেছিলেন। বঙ্গন্ধুর পিতা মাতা তাঁদের জীবনের দীর্ঘ সময় তাঁদের প্রিয় সন্তান খোকাকে কাছে পাননি। কারণ তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন মানুষের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে, আর এই অপরাধে তাঁকে বরণ করতে হয়েছে দীর্ঘ কারাবাস। সর্বশেষে ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ থেকে ৮ জানুয়ারী ১৯৭২ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। তাঁর ফিরে আসার অনিশ্চয়তা তখন যেমন সাড়া জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছিল ঠিক তেমনি পরিবারের সদস্য বিশেষ করে পিতা মাতা স্ত্রী সন্তানদেরকেও তখন দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে এক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। দীর্ঘ সাড়ে নয় মাস সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্নভাবে বঙ্গবন্ধুর পরিবার এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েছিল। অবশেষে ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ জাতির পিতা স্বদেশে ফিরে আসলেন। তাঁর প্রিয় দেশবাসির কাছে। প্রিয় স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশে। ফিরে আসলেন পিতা-মাতা ও স্ত্রী সন্তানদের কাছে।

সাড়া পৃথিবীর মানুষ অগাধ বিস্বয়ে তাকিয়ে দেখল মাত্র সাড়ে তিন বৎসরের মাথায় মুক্ত স্বাধীন বাংলার স্থপতি অবিসংবাদিত নেতাকে এ দেশেরই কিছু কুলাঙ্গার স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। ভাগ্যের জোড়ে দেশে না থাকার সুবাদে বেঁচে গেছেন জাতির পিতার দুই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। তাঁরা হয়েছেন পিতৃ-মাতৃহীন। বাঙালি জাতি হারিয়েছে তাদের নেতাকে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তাদের জাতির পিতাকে।

যে দু’টি চিঠি নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম সেই দু’টি চিঠিরই একটি অভিন্ন বাক্য “সত্যের জয় হবেই” । পিতা ও পুত্রের চিঠি দু’টিতে যে হৃদয় নিঃসৃত সত্য বচনগুলো মূর্ত হয়েছে সেগুলোর চর্চা ব্যক্তি সমাজ ও জাতীয় জীবনকে সমৃদ্ধ করবে। শেখাবে অনেক কিছু। চিঠি দু’টিতে ব্যক্ত পিতা ও পুত্রের ধারণা ও দর্শন আমরাও পোষন করি। বাঙালি জাতি জন্মজন্মান্তরে এই ধারণাই পোষন করবে। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখিয়ে গেছেন। সত্যকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে শিখিয়েছেন। কারণ সত্যের নেই কোন ক্ষয়, নেই কোন লয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর দুই কন্যার দীর্ঘায়ু কামনা করি।

[লেখক: বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, আপীল বিভাগ, ঢাকা।]

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জেলখানার চিঠি - পিতা-পুত্রের কথোপকথন

ওবায়দুল হাসান

image

বাবা শেখ লুৎফর রহমানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু

শুক্রবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২১

একটা সময় ছিল যখন স্বজন প্রিয়জনের চিঠির অপেক্ষায় দিন কাটত। উন্মুখ হয়ে রইতাম কখন ডাক পিয়ন বাসার দরজায় এসে সজোড়ে বলে উঠবে-’চিঠি চিঠি’। আজ আর সেই দিন নেই। অথচ ভালবাসা, প্রেরণা, আদর, শুভ ভাবনা এসবের মোড়কে জড়ানো একটা চিঠি ছিল বন্ধনের অবিচ্ছেদ্য মাধ্যম। সেই চিত্র আজ নেই। প্রযুক্তির ধারাবাহিক দূরন্ত প্রমত্ত বিকাশে আজ সেই চিঠি লেখার প্রচলন বলতে গেলে তিরোহিত। ডাকবাক্সগুলো শূন্য, হাহাকারে আক্রান্ত, রাস্তার পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে বা বড় কোন গাছের কাণ্ডের সঙ্গে অতি অবহেলায় ঝুলছে।

আজ দু’টি চিঠি নিয়েই কিছু কথা বলব। আমার সহজ ভাবনার কথা। একটি চিঠি জেলখানা থেকে লেখা। অপরটি বাড়ী থেকে জেলখানায় এক কারাবন্দির নিকট লেখা। না, এটা নাজিম হিকমতের সেই বিখ্যাত কবিতাও নয় বা সে সম্পর্কিত কোন লেখাও নয়। বাস্তবে পিতা ও পুত্রের লেখা দু’টি চিঠিই আজকের উপজীব্য। একটি চিঠি ছেলে লিখেছিলেন বাবার কাছে। এর চার বছর পরে ছেলেকে শান্তনা দিয়ে বাবার লেখা আরেকটি চিঠি। উল্লে¬খ্য, চিঠি দু’টি কিন্তু একটি অপরটির প্রতিউত্তরও নয়।

শুরুতেই বলেছি আজকাল চিঠি লেখার চর্চা ও প্রচলন প্রায় উঠেই গেছে। ছাত্র জীবনে দেখেছি প্রত্যেক ছাত্রই বাড়িতে চিঠি লিখত হোস্টেলের খরচ এর টাকার জন্য। তখন এটিই ছিল যোগাযোগের মূল মাধ্যম। মুঠোফোন বা ক্ষুদে বার্তার প্রচলন তো আর তখন ছিলনা। টাকার জন্য চিঠি লিখতে হলে বাবার কাছে আর কোন আবদারের জন্য হলে চিঠি যেতো মায়ের কাছে। মায়েদেরকে দেওয়া চিঠি অনেক সময় গিয়ে পড়তো বাবার হাতেই। কারণ মায়ের নাম লিখে বা শুধু ‘মা’ বা ‘আম্মা’ লিখে প্রযত্নে লিখতে হতো বাবার নাম। এলাকার পোস্ট অফিসগুলো তো আর মায়েদের নাম জানতোনা তাই পত্র প্রাপ্তির এই ব্যবস্থা।

বিদেশ থেকে সাধারণত চিঠি আসতো নীল এনভেলপে। এনভেলপের গায়ে লেখা থাকতো Per Avion। এ শব্দটি একটি ফ্রেঞ্চ শব্দ যার ইংরেজি অর্থ হলো By Air. আগেকার দিনে যে পিতামাতার সন্তান বিদেশে থাকতেন সেই সন্তানের চিঠি পাওয়ার জন্য পিতা মাতার যে কি ব্যকুলতা ও অধীর অপেক্ষা থাকতো তা ভাষায় প্রকাশ করা বেশ কঠিন। আজকাল দীর্ঘদিন সন্তানকে না দেখার সেই ব্যাকুলতা নেই বললেই চলে। উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। Viber, Facebook বা WhatsApp এর মাধ্যমে সন্তানের সঙ্গে কথা বলার সময় ছবির মাধ্যমে সাক্ষাৎ মিলে। দূরে থাকা সন্তানকে ধরতে ছুঁতে না পেলেও ছবির মাধ্যমে দেখেও মন অনেকটাই শান্ত হয় বৈকি। প্রযুক্তির কল্যানে এটিও এক প্রাপ্তি বটে। তবে ব্যতিক্রম হলো যারা কারান্তরালে থাকে তাদের সঙ্গে যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায়ও দেখা সাক্ষাৎ হয় না। সেই ব্যবস্থা নেই। আর আগের দিনে তো এসব চিন্তাই করা যেতনা।

ভারতবর্ষের বহু নেতা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে জেলে কাটিয়েছেন অনেক বছর। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বেশ অনেকদিন কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। জেলখানা থেকে তাঁর লেখা অনেক চিঠি পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। তাঁর চিঠিতে তখনকার সমাজচিত্র, জেলাখানার অভ্যন্তরের অবস্থা ও আন্দোলন সংগ্রামের জন্য কিভাবে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন তার চিত্র পাওয়া যায়। তাঁর লেখা চিঠিগুলোর প্রাপকদের মধ্যে সম্ভবত তার বড় ভাই শরৎ চন্দ্র বসু, বার-এট-ল এর নাম এক নম্বরে থাকবে। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু চিঠি লিখেছেন জেলখানা থেকে তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। সেগুলোতে প্রকৃতি, মানব ইতিহাস, পৃথিবীর আদিকাল সম্পর্কিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে । ব্রিটিশ স্টেটসম্যান চেস্টারফিল্ড তাঁর পুত্রের কাছে অনেকগুলো উপদেশমূলক পত্র লিখেছেন। সেগুলো বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এসব পড়লে সমাজ জীবনে চলতে ফিরতে কি গ্রহনীয় আর কি বর্জনীয়, তার একটা দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়। এসব চিঠি কেবল নিতান্ত চিঠি ছিলনা। শুভ ভাবনা, দর্শন ও চেতনার চাদরে আবৃত ছিল এসব চিঠি।

উপরে যাদের চিঠির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের সবার তুলনায় আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় পিছিয়ে থাকা একজন মানুষ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কালের পরিক্রমা ও বিবর্তনে সংগ্রাম, আন্দোলন, ত্যাগ, তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে এই মানুষটিই একদিন হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। তিনি স্থান করে নেন আপামর জনতার মণিকোঠায়। দেশের সীমানা পেরিয়ে সমগ্র বিশ্ববাসীর নিকট হয়ে উঠেন একজন অবিসংবাদিত নেতা আর প্রতিষ্ঠিত হন বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে। নির্মোহ, নিরহংকারী, নিস্কলুষ চরিত্রের সাদা মনের বিরোচিত এই মানুষটি তাঁর জীবনের প্রায় এক চতুর্থাংশ সময় কাটিয়েছিলেন কারান্তরালে। সেই কারানিবাস থেকে পিতা শেখ লুৎফর রহমানকে লেখা তাঁর একটি চিঠি আজ আমি এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এই চিঠির মর্মার্থ থেকে তাঁর সম্পর্কে তখনকার সময়ের রাজনৈতিক অবস্থা ও তাঁর প্রতি সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ সম্পর্কে জানা যায়। জানা যায় প্রিয় স্বজনদের প্রতি তাঁর ভালবাসা ও উদ্বিগ্নতার কথা।

১৯৫৮ সালের ১২ নভেম্বর ঢাকা জেল থেকে রাজনৈতিক বন্দী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাবাকে লিখেছেন-

আব্বা,

আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম গ্রহণ করবেন ও মাকে দিবেন। মা এবার খুব কষ্ট পেয়েছিল কারণ এবার তাঁর সামনেই আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল। দোয়া করবেন মিথ্যা মামলায় আমার কিছুই করতে পারবেনা। আমাকে ডাকাতি মামলার আসামীও একবার করেছিল। আল্লাহ আছে, সত্যের জয় হবেই। আপনি জানেন আমার কিছুই নাই। দয়া করে ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখবেন। বাড়ি যেতে বলে দিতাম। কিন্তু ওদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে।

আমাকে আবার রাজবন্দী করেছে, দরকার ছিল না। কারণ রাজনীতি আর নাই, এবং রাজনীতি আর করবো না। সরকার অনুমতি দিলেও আর করবনা।

যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে আমি ঘুষ খেতে পারি সে দেশে কোন কাজই করা উচিত না। এদেশে ত্যাগ ও সাধনার কোন দামই নাই। যদি কোনদিন জেল হতে বের হতে পারি তবে কোন কিছু একটা করে ছেলেমেয়ে ও আপনাদের নিয়ে ভালভাবে সংসার করব। নিজেও কষ্ট করেছি আপনাদেরও দিয়েছি। বাড়ির সকলকে আমার ছালাম দিবেন, দোয়া করতে বলবেন। আপনার ও মায়ের শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন। চিন্তা করে মন খারাপ করবেন না। মাকে কাঁদতে নিষেধ করবেন। আমি ভাল আছি।

আপনার স্নেহের

মুজিব

NB: গোপালগঞ্জের বাসাটী ভাড়া দিয়া দিবেন, বাসার আর দরকার হবে না।

মুজিব।

(সূত্রঃ বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র পৃষ্ঠাঃ ৯৭)

এটি সহজ সত্য কথায় লেখা একজন রাজবন্দীর একটি অসাধারণ চিঠি, যার মধ্যে ফুটে উঠেছে মহান সৃষ্টিকর্তার উপর অগাধ আস্থা। সেই সাথে চিত্রিত হয়েছে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অত্যাচার অনাচার ও বৈষম্যের ধরণ। একজন সাবেক মন্ত্রীর আর্থিক অবস্থা, অবুঝ মানুষের ভ্রান্ত চিন্তার কারণে মন খারাপ করার কথাও সামনে এসেছে এই চিঠিতে।

অকপট বচনে লেখা এই চিঠির শুরুতেই পিতা মাতাকে সালাম জানিয়ে বন্দী মুজিব মায়ের কষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন এই বলে যে, ‘মা এবার খুব কষ্ট পেয়েছিল কারণ তাঁর সামনেই আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল’। তার পরই আবার তিনি তাঁর দৃঢ়তা প্রকাশ করে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁর গভীর আস্থা প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন --‘দোয়া করবেন মিথ্যা মামলায় আমার কিছুই করতে পারবেনা। আমাকে ডাকাতি মামলার আসামীও একবার করেছিল। আল্লাহ আছে, সত্যের জয় হবেই’।

১৯৫৪ ও ১৯৫৬ সালে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন এটা সর্বজনবিদিত। ‘১৯৫৮ সালে বন্দী দশায় থেকে শেখ মুজিব বাবাকে লিখেছেন -- ‘আপনি জানেন আমার কিছুই নাই। দয়া করে ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখবেন। বাড়ী যেতে বলে দিতাম। কিন্তু ওদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে’। ১৯৫৮ সালে শেখ মুজিব চার সন্তানের জনক, সাবেক মন্ত্রী, তথাপিও আর্থিক অনটন তাঁকে পিছু ছাড়েনি। সন্তানদের প্রতি উদ্বিগ্নতা সত্বেও একজন সৎ রাজনীতিবিদের প্রতিচ্ছবি শেখ মুজিব। চিঠিতে লেখা তাঁর এই কথাটিতে সেটিই মূর্ত হয়েছে। পিতার আর্থিক সামর্থ্য ছিল। তাই পিতার কাছেই চাওয়া। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্যই শুধু তাদের ঢাকায় থাকা।

মন্ত্রীর বাসভবন থেকে ’৫৮ এর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি বের হয়ে যেতে হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের। নিকট আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব ছাড়া তেমন কেউ তখন খোঁজ নেয়নি তাদের। শেখ মুজিবের পিতা জনাব শেখ লুৎফর রহমান বউমা ও নাতি নাতনীদের খোঁজ নিতেন, প্রয়োজনীয় খরচাদি পাঠাতেন। এখনও অনেক সাবেক মন্ত্রী আছেন। অনেকে ভবিষ্যতে ‘সাবেক’ হবেন। তাঁদেরকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব ’৫৮ সালে বন্দী দশার একজন সাবেক মন্ত্রীর তাঁর বাবাকে লেখা এই চিঠিটি পড়তে। চিঠিতে প্রতিফলিত সত্যগুলো অনুধাবন করতে। তখনকার সামরিক যাঁতাকলে নিষ্পেসিত রাজনীতির প্রতি ইঙ্গিত করে কিছু হতাশা ব্যক্ত করে শেখ মুজিব বাবাকে লিখেছেন -- ‘আমাকে আবার রাজবন্দী করেছে, দরকার ছিল না। কারণ রাজনীতি আর নাই, এবং রাজনীতি আর করবো না। সরকার অনুমতি দিলেও আর করব না। যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে আমি ঘুষ খেতে পারি সে দেশে কোন কাজই করা উচিত না। এদেশে ত্যাগ ও সাধনার কোন দামই নাই।’

চিঠিতে তিনি মাকে কাঁদতে নিষেধ করেছেন। লিখেছেন ‘আমি ভাল আছি’। একথাগুলোর মধ্যে একটু হতাশা দেখা গেলেও চিঠির শেষের কথা ‘আল্লাহ আছে, সত্যের জয় হবেই’ -- এই কথাগুলো একসঙ্গে মিলিয়ে পড়লে এটি স্পষ্টই বোঝা যায় প্রতিরোধের গণগনে আগুনে বন্দী মুজিবের মন সদাই জ্বলছিল। সেই সাথে ছিল প্রিয়জনদের জন্য আকুলতা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের উপর ছিল তাঁর অকৃত্রিম বিশ্বাস। যা শুধু একজন ইমানদারেরই থাকে।

‘৫৮ সালে বন্দী হয়ে ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬২, ১৯৬৪ এবং ১৯৬৬ সালে তিনি বারবার কারারুদ্ধ হয়েছেন। বাবার নিকট লেখা চিঠিতে ক্ষোভে অভিমানে লিখেছিলেন তিনি আর রাজনীতি করবেন না। কিন্তু এটি কি সম্ভব ছিল বাংলার মানুষের আপামর নেতা শেখ মুজিব এর পক্ষে। ছিলনা, আর তাইতো তিনি ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবী পেশ করে পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য স্বায়ত্বশাসন দাবী করেন। আর এই অপরাধে আবারো তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। তাঁর ঠিকানা হলো কারান্তরালে। এরই মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে। মানুষেরও ধৈর্য্যরে সীমা থাকে। আর সেই সীমা যখন ভেঙ্গে পড়ে তখন মানুষ ফুঁসে উঠে। সাড়া বাংলার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে, আওয়াজ উঠল -- ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’। ‘জেলের তালা ভাঙ্গবো মুজিব ভাইকে আনবো’।

১৯৬৯ এর ২২ ফেব্র“য়ারি সবার প্রিয় মুজিব ভাই মুক্ত মানুষ হিসেবে আবার তাঁর প্রিয় দেশবাসির কাছে ফিরে আসেন। ২৩ ফেব্র“য়ারি ১৯৬৯ মুজিব ভাইকে সর্ব্বদলীয় ছাত্র সংগাম পরিষদ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। তখন থেকে তিনি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা সকলের বন্ধু, ‘বঙ্গবন্ধু’।

শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হওয়া পর্যন্ত বাংলার এই অবিসংবাদিত নেতাকে বহুবার জেলে যেতে হয়েছে। বাবার নিকট বা রাজনৈতিক অনেক নেতা-কর্মীর নিকট তিনি জেলখানা থেকে চিঠি লিখেছেন। তাঁর কাছেও অনেকে চিঠি পাঠিয়েছেন সে সময়। এরকম একটি চিঠি হলো বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাবার লেখা ৩১.৩.১৯৬২ তারিখের একটি চিঠি। তিনি লিখেছেন-

Tungipara

৩১.৩.৬২

বাবা খোকা

শুরুতেই দোয়া জানিবা। তোমার ২৯/৪/৬২ তারিখের (তারিখটি সম্ভবত ভুল ছাপা হয়) চিঠি একমাস পরে পাইলাম। ‘ঢাকা হইতে ছোট্ট বউ চিঠি লিখিয়াছিল যে, তুমি শীঘ্রই মুক্তি পাইবে এবং কয়েকদিন পরেই সকলকে লইয়া আমাদের দেখিতে আসিবে’। কিন্তু‘ আজ ২০/২৫ দিন হইয়াছে আর কোনও সংবাদ পাইতেছি না। “খোদা তায়ালা বলিয়াছেন তাহার বান্দাকে যে নির্য্যাতন করিবে আমি তাহাকে নির্য্যাতন করিব।” ইহা পূর্ব্বাপর ঘটনা হইতে সকলেই জানিতেছে এবং দুনিয়ার ইতিহাসও তাহা স্বাক্ষ্য দিতেছে। বেশি দিন হয় নাই তুমি নিজে ও দেখিতে পাইয়াছ। তোমাকে আটক করিয়া রাখার অর্থ হইতেছে আমাদের মতন বৃদ্ধ পিতা মাতার, নাবালক ছেলে-মেয়েদের এবং স্ত্রীর উপর নানারূপ অত্যাচার করা। আমরা উপায়হীন, সহ্য করিতে বাধ্য কিন্তু খোদাতায়ালা নিশ্চয়ই সহ্য করিবেন না। চিন্তা করিবা না সব কিছু খোদাতায়ালার উপর নির্ভর। তিনি যাহা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন। সত্যের জয় হবেই। নানারূপ মিথ্যা মোকদ্দমা চাপাইয়া তাহাতে কোনও ফল না পাইয়া তোমার সততার ছাফাই পাইয়াছে তাহা সত্ত্বেও তুমি কিছু না করিলে তোমাকে কেন যে আটকাইয়া রাখিতে হইবে তাহাই বুঝিতে পারিতেছি না। শুনিয়াছিলাম তোমাকেই সর্ব্বাগ্রে মুক্তি দিবে কিন্তু এখনও তাহার কোনও সম্ভাবনা দেখিতেছি না। দেশবাসী প্রায় সকলেই সরকার গোচরে সকল প্রকার রাজবন্দীদের এবং ছাত্রদের মুক্তির প্রার্থনা দিয়াছে। মনে হয় শীঘ্রই তোমাদের মুক্তি দিবে...। ঢাকার সকলে ভাল আছে। মীরার মার হাঁফানী উঠিয়াছিল, সেটা গোপালগঞ্জে শুনিলাম যে একটু ভাল হইয়াছে। আমরা বাড়ীর সকলেই ভাল আছি। তোমার মেজো বুজির শরীর খুবই খারাপ। সব সময় দোয়া করিতেছি এবং খোদার দরগায় প্রার্থনা যে তিনি তোমাদের মঙ্গল করুক। ৮০ বৎসর বয়সের বৃদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে এমন লেখা খুব কঠিন। তাই খুব ধীরে লিখিতে হয় এবং লিখিতে একটু দেরি হয়।

তোমার

আব্বা

Sheikh Mujibur Rahman

Security Prisoner

Central Jail

Dacca.

(সূত্রঃ বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র পৃষ্ঠাঃ ২১৭)

কারাগারে আটক পুত্র শেখ মুজিবকে লেখা এই চিঠির প্রথমাংশে পুত্রকে দেখার আশায় পথ পানে চেয়ে থাকা এক অশিতিপর বৃদ্ধের অনুচ্চারিত কান্নার কথাই ফুটে উঠেছে। কারাবন্দি পুত্রকে লিখা পত্রে পরের কথাগুলো থেকে বঙ্গবন্ধুর পিতার আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা ও আস্থার প্রকাশ ঘটেছে। বান্দার উপর যে অন্যায় জুলুম খোদা তায়ালা সহ্য করেন না এটাও স্বরণ করিয়ে দিয়েছেন বৃদ্ধ বাবা তার আদরের সন্তান খোকাকে।

পিতা ও পুত্রের চিঠি দু’টোর মধ্যে একটি বাক্যের ছিল সম উপস্থিতি। সেটি হলো ‘সত্যের জয় হবেই’। পিতা তার কারাবন্দি পুত্রকে লেখা চিঠিতে ও পিতাকে লেখা কারাবন্দি পুত্রের চিঠিতে এই তিনটি শব্দের অভিন্ন উচ্চকিত বাক্যটি নিঃসন্দেহে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁদের উভয়েরই গভীর আস্থার কথাটি উঠে এসেছে। সাধারণতঃ ধর্মপ্রাণ প্রত্যেকটি মানুষই যার যার ধর্ম বিশ্বাসে সৃষ্টিকর্তার উপর আস্থা রাখেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারে ধর্ম চর্চা তাঁদের পরিবারের একটি ঐতিহ্য। কিন্তু এই ধর্মপ্রাণ পরিবারটি একই সঙ্গে ছিল অসাম্প্রদায়িক। এই অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা বঙ্গবন্ধু নিজ জীবনে করেছেন এবং তিনি তাঁর সন্তানদেরকেও এই শিক্ষা দিয়েছেন। সম্ভবতঃ বঙ্গবন্ধু উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর পিতার কাছ থেকেই একজন অসাম্প্রদায়িক ধর্মপ্রাণ মানুষ হওয়ার শিক্ষাটি পেয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে লিখা চিঠির শেষাংশে তাঁর পিতা পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয় স্বজনের খবরাখবর জানিয়েছেন পুত্রকে। এটি থেকে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছের দূরের আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ খবর রাখতেন বা তাদের খবরাখবর জানতে চাইতেন। এটি ছিল তাঁর যাপিত ব্যক্তি জীবনের এক অনিবার্য ধরণ। আমরা যারা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি তারা সবাই আত্মীয় পরিজন বেষ্টিত অবস্থায় থাকতে পছন্দ করি। সকলকে নিয়েই শান্তি ও সুখের নীড় গড়তে চাই। বঙ্গবন্ধুর পিতার চিঠিটি পড়ে মনে হয় বঙ্গবন্ধু যেমন দেশবাসীর জন্য সাড়া জীবন চিন্তা করেছেন ঠিক তেমনি পরিবারের সদস্যদের প্রতিও ছিল তাঁর খেয়াল ও সদা উদ্বিগ্নতা। তিনি কখনও পরিবারের স্বজনদের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন না।

বঙ্গবন্ধুর পিতা তাঁর চিঠির শেষ লাইনে লিখেছেন-- ‘৮০ বৎসর বয়সের বৃদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে এমন লেখা খুব কঠিন। তাই খুব ধীরে লিখিতে হয় এবং লিখিতে একটু দেরি হয়’। হায়রে মমতাময় পিতা! কত কষ্টই না বুকে ধারণ করে এই চিঠিটা তিনি কারবন্দি পুত্রকে লিখেছিলেন। বঙ্গন্ধুর পিতা মাতা তাঁদের জীবনের দীর্ঘ সময় তাঁদের প্রিয় সন্তান খোকাকে কাছে পাননি। কারণ তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন মানুষের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে, আর এই অপরাধে তাঁকে বরণ করতে হয়েছে দীর্ঘ কারাবাস। সর্বশেষে ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ থেকে ৮ জানুয়ারী ১৯৭২ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। তাঁর ফিরে আসার অনিশ্চয়তা তখন যেমন সাড়া জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছিল ঠিক তেমনি পরিবারের সদস্য বিশেষ করে পিতা মাতা স্ত্রী সন্তানদেরকেও তখন দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে এক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। দীর্ঘ সাড়ে নয় মাস সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্নভাবে বঙ্গবন্ধুর পরিবার এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েছিল। অবশেষে ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ জাতির পিতা স্বদেশে ফিরে আসলেন। তাঁর প্রিয় দেশবাসির কাছে। প্রিয় স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশে। ফিরে আসলেন পিতা-মাতা ও স্ত্রী সন্তানদের কাছে।

সাড়া পৃথিবীর মানুষ অগাধ বিস্বয়ে তাকিয়ে দেখল মাত্র সাড়ে তিন বৎসরের মাথায় মুক্ত স্বাধীন বাংলার স্থপতি অবিসংবাদিত নেতাকে এ দেশেরই কিছু কুলাঙ্গার স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। ভাগ্যের জোড়ে দেশে না থাকার সুবাদে বেঁচে গেছেন জাতির পিতার দুই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। তাঁরা হয়েছেন পিতৃ-মাতৃহীন। বাঙালি জাতি হারিয়েছে তাদের নেতাকে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তাদের জাতির পিতাকে।

যে দু’টি চিঠি নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম সেই দু’টি চিঠিরই একটি অভিন্ন বাক্য “সত্যের জয় হবেই” । পিতা ও পুত্রের চিঠি দু’টিতে যে হৃদয় নিঃসৃত সত্য বচনগুলো মূর্ত হয়েছে সেগুলোর চর্চা ব্যক্তি সমাজ ও জাতীয় জীবনকে সমৃদ্ধ করবে। শেখাবে অনেক কিছু। চিঠি দু’টিতে ব্যক্ত পিতা ও পুত্রের ধারণা ও দর্শন আমরাও পোষন করি। বাঙালি জাতি জন্মজন্মান্তরে এই ধারণাই পোষন করবে। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখিয়ে গেছেন। সত্যকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে শিখিয়েছেন। কারণ সত্যের নেই কোন ক্ষয়, নেই কোন লয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর দুই কন্যার দীর্ঘায়ু কামনা করি।

[লেখক: বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, আপীল বিভাগ, ঢাকা।]

back to top