alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সাফল্য কি মিলল

রেজাউল করিম খোকন

: রোববার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২১

বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন বাংলাদেশকে তুলে ধরার উদ্দেশ্য ‘বাংলাদেশ ডিসকভার লিমিটলেস অপারচুনিটিজ’ শীর্ষক একটি ট্যাগলাইনসহ শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সামিট ২০২১-এ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, ভারত, সৌদি আরব, তুরস্ক, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৬ হাজারের বেশি প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। দুই দিনের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে সব মিলিয়ে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ৪২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। শীর্ষ সম্মেলনে ১৪টি পৃথক সেশন ছিল, যার মধ্যে ১১টি নীল অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা এবং ওষুধ, পরিবহন এবং লজিস্টিকস, পুঁজিবাজার, শক্তি এবং জ্বালানি, আর্থিক পরিষেবা, কৃষি ব্যবসা, চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য, পোশাক, বৈদ্যুতিক এবং ইলেক্ট্রনিক্স উৎপাদনে সম্পৃক্ত।

আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য তার সরকারের দেয়া সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা লুফে নিতে বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে একটি বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে আমরা অবকাঠামো উন্নয়নসহ সমস্ত নীতি সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিনিয়োগের জন্য আমরা সম্ভাবনাময় ১১টি খাত চিহ্নিত করেছি। এ সব হচ্ছে, অবকাঠামো, পুঁজিবাজার ও ফাইন্যান্সিয়াল সেবা, তথ্য-প্রযুক্তি, ইলেক্ট্রনিক্স উৎপাদন, চামড়া, স্বয়ংক্রিয় ও হালকা প্রকৌশল, কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ, পাট-বস্ত্র, এবং ব্লু-ইকোনমি। এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীগণ বাংলাদেশে এসব খাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

বিশ্বে বাংলাদেশি পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টি হবে এবং বাংলাদেশ কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হবে। ২০০৮ সাল থেকে পরপর তিন দফা নির্বাচনে জয়লাভের ফলে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দক্ষ-পরিশ্রমী জনসম্পদ সৃষ্টি, আকর্ষণীয় প্রণোদনার মাধ্যমে উদার বিনিয়োগ-নীতি এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশাল বাজারের মধ্যবর্তী ভৌগলিক অবস্থানের জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব দিন-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি আস্থার ফলে ৬০ শতাংশের বেশি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আসছে পুনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্ববাসী নতুন বাংলাদেশকে জানতে পেরেছে। বিনিয়োগের বিপুল সাড়া পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রায় ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। সৌদি কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন বড় ধরনের বিনিয়োগ করবে। তারা ইউরিয়া সার, চিনি ও বেফারেজ শিল্পে এবং বড় আকারের সিমেন্ট কারখানা স্থাপনে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এছাড়া আইয়াজ ও ইউনাইটেড গ্রুপ যৌথভাবে ১৫০ মিলিয়ন ডলার, কর্ণফুলি ড্রাই ডক ১১৮ মিলিয়ন ও বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ২০৪১ সালের বাংলাদেশের জন্য প্রণীত প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় লজিস্টিকস খাতকে একটি প্রাধিকারমূলক খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দুটি কর্মকৌশলের ওপর ভিত্তি করে ২০২৩ সালের মধ্যে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো-অধিকতর সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ ও বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি এবং রপ্তানি বহুমুখীকরণ। এ দুটি কৌশল সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন একটি গতিশীল লজিস্টিক খাত। লজিস্টিক খাতের উন্নয়নে অধিকতর বেসরকারি বিনিয়োগ আনয়নে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। লজিস্টিকস খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা অপরিসীম। ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পরিবহন ও অবকাঠামো খাতে প্রায় ২৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। এবং এ খাতসমূহের প্রদত্ত সেবার জন্য বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে। ব্যবসার আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে এ বাজারও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির মূল্য বর্তমানের ৩৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার হতে অচিরেই বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৫ সালে প্রায় ৫৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। এছাড়া আমদানি পণ্যের মূল্যও বর্তমানের ৫১ বিলিয়ন ডলার হতে বৃদ্ধি পেয়ে ৮৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধির সঙ্গে পণ্যাগার, সংরক্ষণাগার, কোল্ড চেইন ব্যবসা, সড়ক, নৌ, সমুদ্র এবং বিমানপথে পণ্য পরিবহন, নৌ, বিমান ও স্থলবন্দরের কার্যক্রম আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। ২০২২ সালের মধ্যে এ ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হবে প্রায় ৬৪ শতাংশ। এ কারণে এফ শ্রেণীর বিমান, যেমন এ-৩৮০, বি ৭৪৭-৮এফ ইত্যাদির অবতরণ ও উড্ডয়ন সহজতর করার জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিদেশি বিনিয়োগের বিপক্ষে সরকার কোন নীতি গ্রহণ করবে না বলে জানিয়েছেন তারা। যদিও এবারের সম্মেলনে বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পাওয়ার চেয়ে বাংলাদেশের বিনিয়োগের সম্ভাব্য খাতগুলোকে তুলে ধরাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ যে বিনিয়োগের আদর্শ লক্ষ্যবস্তু, বিষয়টি পরিষ্কার করা গেছে। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ট্যাক্স হলিডে, রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধাসহ অন্যান্য আকর্ষণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা গেছে। বাংলাদেশের অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। এবারের বিনিয়োগ সম্মেলন বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে দেশের শীর্ষ ১১টি কৌশলগত খাত নিয়ে সম্মেলনের কারিগরি আলোচনাগুলোতে সংশ্লিষ্ট খাতের সম্ভাবনার দিকগুলো ফুটে উঠেছে।

এরই মধ্যে তুরস্কের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে দুটি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি এবং চীনের সঙ্গে তিনটি বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে। বিদ্যুৎ, প্রকৌশল, ওষুধ, আইসিটি, হাসপাতাল, পোশাক খাতসহ কয়েকটি খাতে বিনিয়োগের বিষয়ে এসব চুক্তি হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের জন্য ব্যাপক সাড়া মিলছে। সম্মেলন থেকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে বিদেশিরা দেশে বিনিয়োগে আগ্রহ জানিয়েছে। এছাড়া, দেশের বিদ্যুৎ খাতকে এগিয়ে নিতে সরকার চলতি বছরেই চীনের সঙ্গে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৩০ কোটি ডলারের চুক্তি করছে। পাশাপাশি গ্রিন এবং ক্লিন এনার্জি খাতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে সরকার। দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে ইতোমধ্যে নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিদেশিরা কিছু নীতি সহায়তার কথা বলেছে, সেগুলোতে সংস্কার করা হবে। যে অনুকূল পরিবেশ পেলে তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন, সেসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অনলাইন ওয়ান স্টপ সার্ভিস পোর্টালের মাধ্যমে বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের ১১টি সংস্থার ৪১টি সেবা প্রদান করে আসছে। বিনিয়োগ সেবার মান উন্নত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। আশা করা যায়, এ বছরের মধ্যেই ৩৫ সংস্থার মাধ্যমে ১৫৪টি বিনিয়োগ সেবা দিতে সক্ষম হবে তারা, যা আমাদের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস (ব্যবসা সহজ করা) সূচকে দুই অঙ্কের ঘরে উন্নত হওয়ার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

বিনিয়োগ সেবার মান উন্নত করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, অধিক বিনিয়োগ মানে অধিক কর্মসংস্থান এবং উন্নয়নের পথে আরও এগিয়ে যাওয়া। অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিপুল আয়োজন নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিয়ত বিনিয়োগের জন্য সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এ তালিকায় সিঙ্গাপুর ও দুবাই রয়েছে এমনকি আমেরিকা থেকেও বিনিয়োগের জন্য যোগাযোগ করছে। বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া অবস্থান। আমাদের ইমেজ সংকট রয়েছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ভ্যালু অনেক কম। এটাকে সামগ্রিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। ইনভেস্টররা বাংলাদেশের কথা শুনলে মনে করে এই দেশ অনেক গরিব কিংবা দুর্যোগকবলিত দেশ। এই অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ করতে হবে। প্রয়োজনে গ্লোবাল পিআর এজেন্সি নিয়োগ করে বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করতে হবে। আমরা গরিব দেশ নই, উন্নয়নশীল ও বিনিয়োগবান্ধব-এটা সবাইকে বোঝাতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সাফল্য কি মিলল

রেজাউল করিম খোকন

রোববার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২১

বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন বাংলাদেশকে তুলে ধরার উদ্দেশ্য ‘বাংলাদেশ ডিসকভার লিমিটলেস অপারচুনিটিজ’ শীর্ষক একটি ট্যাগলাইনসহ শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সামিট ২০২১-এ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, ভারত, সৌদি আরব, তুরস্ক, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৬ হাজারের বেশি প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। দুই দিনের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে সব মিলিয়ে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ৪২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। শীর্ষ সম্মেলনে ১৪টি পৃথক সেশন ছিল, যার মধ্যে ১১টি নীল অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা এবং ওষুধ, পরিবহন এবং লজিস্টিকস, পুঁজিবাজার, শক্তি এবং জ্বালানি, আর্থিক পরিষেবা, কৃষি ব্যবসা, চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য, পোশাক, বৈদ্যুতিক এবং ইলেক্ট্রনিক্স উৎপাদনে সম্পৃক্ত।

আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য তার সরকারের দেয়া সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা লুফে নিতে বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে একটি বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে আমরা অবকাঠামো উন্নয়নসহ সমস্ত নীতি সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিনিয়োগের জন্য আমরা সম্ভাবনাময় ১১টি খাত চিহ্নিত করেছি। এ সব হচ্ছে, অবকাঠামো, পুঁজিবাজার ও ফাইন্যান্সিয়াল সেবা, তথ্য-প্রযুক্তি, ইলেক্ট্রনিক্স উৎপাদন, চামড়া, স্বয়ংক্রিয় ও হালকা প্রকৌশল, কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ, পাট-বস্ত্র, এবং ব্লু-ইকোনমি। এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীগণ বাংলাদেশে এসব খাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

বিশ্বে বাংলাদেশি পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টি হবে এবং বাংলাদেশ কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হবে। ২০০৮ সাল থেকে পরপর তিন দফা নির্বাচনে জয়লাভের ফলে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দক্ষ-পরিশ্রমী জনসম্পদ সৃষ্টি, আকর্ষণীয় প্রণোদনার মাধ্যমে উদার বিনিয়োগ-নীতি এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশাল বাজারের মধ্যবর্তী ভৌগলিক অবস্থানের জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব দিন-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি আস্থার ফলে ৬০ শতাংশের বেশি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আসছে পুনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্ববাসী নতুন বাংলাদেশকে জানতে পেরেছে। বিনিয়োগের বিপুল সাড়া পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রায় ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। সৌদি কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন বড় ধরনের বিনিয়োগ করবে। তারা ইউরিয়া সার, চিনি ও বেফারেজ শিল্পে এবং বড় আকারের সিমেন্ট কারখানা স্থাপনে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এছাড়া আইয়াজ ও ইউনাইটেড গ্রুপ যৌথভাবে ১৫০ মিলিয়ন ডলার, কর্ণফুলি ড্রাই ডক ১১৮ মিলিয়ন ও বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ২০৪১ সালের বাংলাদেশের জন্য প্রণীত প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় লজিস্টিকস খাতকে একটি প্রাধিকারমূলক খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দুটি কর্মকৌশলের ওপর ভিত্তি করে ২০২৩ সালের মধ্যে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো-অধিকতর সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ ও বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি এবং রপ্তানি বহুমুখীকরণ। এ দুটি কৌশল সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন একটি গতিশীল লজিস্টিক খাত। লজিস্টিক খাতের উন্নয়নে অধিকতর বেসরকারি বিনিয়োগ আনয়নে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। লজিস্টিকস খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা অপরিসীম। ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পরিবহন ও অবকাঠামো খাতে প্রায় ২৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। এবং এ খাতসমূহের প্রদত্ত সেবার জন্য বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে। ব্যবসার আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে এ বাজারও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির মূল্য বর্তমানের ৩৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার হতে অচিরেই বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৫ সালে প্রায় ৫৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। এছাড়া আমদানি পণ্যের মূল্যও বর্তমানের ৫১ বিলিয়ন ডলার হতে বৃদ্ধি পেয়ে ৮৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধির সঙ্গে পণ্যাগার, সংরক্ষণাগার, কোল্ড চেইন ব্যবসা, সড়ক, নৌ, সমুদ্র এবং বিমানপথে পণ্য পরিবহন, নৌ, বিমান ও স্থলবন্দরের কার্যক্রম আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। ২০২২ সালের মধ্যে এ ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হবে প্রায় ৬৪ শতাংশ। এ কারণে এফ শ্রেণীর বিমান, যেমন এ-৩৮০, বি ৭৪৭-৮এফ ইত্যাদির অবতরণ ও উড্ডয়ন সহজতর করার জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিদেশি বিনিয়োগের বিপক্ষে সরকার কোন নীতি গ্রহণ করবে না বলে জানিয়েছেন তারা। যদিও এবারের সম্মেলনে বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পাওয়ার চেয়ে বাংলাদেশের বিনিয়োগের সম্ভাব্য খাতগুলোকে তুলে ধরাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ যে বিনিয়োগের আদর্শ লক্ষ্যবস্তু, বিষয়টি পরিষ্কার করা গেছে। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ট্যাক্স হলিডে, রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধাসহ অন্যান্য আকর্ষণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা গেছে। বাংলাদেশের অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। এবারের বিনিয়োগ সম্মেলন বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে দেশের শীর্ষ ১১টি কৌশলগত খাত নিয়ে সম্মেলনের কারিগরি আলোচনাগুলোতে সংশ্লিষ্ট খাতের সম্ভাবনার দিকগুলো ফুটে উঠেছে।

এরই মধ্যে তুরস্কের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে দুটি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি এবং চীনের সঙ্গে তিনটি বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে। বিদ্যুৎ, প্রকৌশল, ওষুধ, আইসিটি, হাসপাতাল, পোশাক খাতসহ কয়েকটি খাতে বিনিয়োগের বিষয়ে এসব চুক্তি হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের জন্য ব্যাপক সাড়া মিলছে। সম্মেলন থেকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে বিদেশিরা দেশে বিনিয়োগে আগ্রহ জানিয়েছে। এছাড়া, দেশের বিদ্যুৎ খাতকে এগিয়ে নিতে সরকার চলতি বছরেই চীনের সঙ্গে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৩০ কোটি ডলারের চুক্তি করছে। পাশাপাশি গ্রিন এবং ক্লিন এনার্জি খাতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে সরকার। দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে ইতোমধ্যে নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিদেশিরা কিছু নীতি সহায়তার কথা বলেছে, সেগুলোতে সংস্কার করা হবে। যে অনুকূল পরিবেশ পেলে তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন, সেসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অনলাইন ওয়ান স্টপ সার্ভিস পোর্টালের মাধ্যমে বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের ১১টি সংস্থার ৪১টি সেবা প্রদান করে আসছে। বিনিয়োগ সেবার মান উন্নত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। আশা করা যায়, এ বছরের মধ্যেই ৩৫ সংস্থার মাধ্যমে ১৫৪টি বিনিয়োগ সেবা দিতে সক্ষম হবে তারা, যা আমাদের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস (ব্যবসা সহজ করা) সূচকে দুই অঙ্কের ঘরে উন্নত হওয়ার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

বিনিয়োগ সেবার মান উন্নত করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, অধিক বিনিয়োগ মানে অধিক কর্মসংস্থান এবং উন্নয়নের পথে আরও এগিয়ে যাওয়া। অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিপুল আয়োজন নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিয়ত বিনিয়োগের জন্য সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এ তালিকায় সিঙ্গাপুর ও দুবাই রয়েছে এমনকি আমেরিকা থেকেও বিনিয়োগের জন্য যোগাযোগ করছে। বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া অবস্থান। আমাদের ইমেজ সংকট রয়েছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ভ্যালু অনেক কম। এটাকে সামগ্রিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। ইনভেস্টররা বাংলাদেশের কথা শুনলে মনে করে এই দেশ অনেক গরিব কিংবা দুর্যোগকবলিত দেশ। এই অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ করতে হবে। প্রয়োজনে গ্লোবাল পিআর এজেন্সি নিয়োগ করে বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করতে হবে। আমরা গরিব দেশ নই, উন্নয়নশীল ও বিনিয়োগবান্ধব-এটা সবাইকে বোঝাতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top