সজীব ওয়াফি
রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির অন্যতম নিয়ামক তরুণ প্রজন্ম। সারা পৃথিবীজুড়ে শিল্প, সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, সমাজ এবং রাজনীতিতে তরুণেরা অগ্রগামী। তরুণদের ওপরে নির্ভর করে সভ্যতার ভিত্তি রচনা হয়। এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও তরুণদের ভূমিকা অনন্য। করোনায় বাংলাদেশে তরুণেরা প্রচন্ড রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের বড় একটা অংশ যারা বেকারত্বের গ্লানি বহন করেছেন, তারা নানা দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়েছেন। চাকরির বয়সের ক্ষতিগ্রস্ত সময়ের সমন্বয় নিয়ে এতদিন ধরে তাদের প্রবল ক্ষোভ ছিল। ক্ষোভ ছিল একেই দিনে একাধিক চাকরির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে। নতুন করে যুক্ত হয়েছে প্রশ্নফাঁস বিতর্ক।
কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পরলে গত বছরের মার্চ মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের পাশাপাশি চাকরির সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ছিল না কোন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। এ কারণে সব প্রার্থীই বয়সজনিত টানাপড়েনে পড়েছেন। ব্যাকডেটে সার্কুলারের কথা বলা হলেও কয়েকটা সার্কুলার ব্যতীত বাস্তবে কিছুই হয়নি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী করোনা আক্রান্তের পূর্বে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৬ লাখ। যার ভেতরে শিক্ষিত বেকারত্বের সংখ্যা ছিল ১০ লাখের ওপরে। মহামারি বাস্তবতায় টিকে থাকতে অনেক প্রতিষ্ঠানে হয়েছে কর্মী ছাঁটাই। আবার দুই বছরে নতুন করে দুই-তিনটি ব্যাচও যুক্ত হয়েছে চাকরি পরীক্ষার দৌড়ে। বেড়েছে নতুন বেকারত্বের সংখ্যা। শিক্ষিত বেকারত্বের সংখ্যা যে দিনে দিনে বেড়েছে এ জন্য বেশি পড়াশোনা করার দরকার নেই, বরং সর্বশেষ অনুষ্ঠিত তিনটি বিসিএস পরীক্ষার প্রার্থী সংখ্যার দিকে তাকালেই অনুমেয়।
করোনায় হা-হুতাশ করা এ রকম একটি সময়ে ব্যাংকে চাকরি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের মতো ঘটনা ঘটছে। গণমাধ্যমে উঠে এসেছে জীবন বীমা করপোরেশনের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেই নির্দিষ্ট প্রার্থীদের জন্য উত্তরের ব্যবস্থা করা ছিল। ব্যাংকের প্রশ্নফাঁস বিষয়ে শিক্ষার্থীরা যখন অভিযোগ করে, কোন তদন্ত না করেই প্রথম ধাপেই গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। অথচ গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের আগের নিয়োগেও জালিয়াতি হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের বর্তমান প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ সত্য। গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে ধরা পরে দুর্নীতিবাজির এই মচ্ছব ২০১৪ সাল থেকে চলেছে এবং এর সঙ্গে দেশের নামকরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন কোন শিক্ষক জড়িত আছেন। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ তুলেছেন কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর এবং পরিসংখ্যান ব্যুরোতে নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে। অভিযোগের তীর ছুটেছে সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে। পূর্ববর্তী বছরগুলোতেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগসহ খাদ্য অধিদপ্তর, ব্যাংক, বীমা এবং বিভিন্ন অধিদপ্তরগুলোর নিয়োগে কখনোই বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না।
করোনা মহামারী পরবর্তী বিগত কয়েক মাস ধরে একেই দিনে একাধিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোন কোন দিন ২০-২৫টি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এমনকি ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষার দিনে একাধিক পরীক্ষার আয়োজন অযৌক্তিক। কারো সঙ্গে কারো একেবারেই সমন্বয় নেই। অন্যদিকে পরিবহন ধর্মঘটের ভেতরেও পরীক্ষা স্থগিত না করাটা নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের একগুঁয়েমি চরিত্র। কেননা অধিকাংশ প্রার্থীকে তাদের জেলা শহর অথবা গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। আবেদনের বিপরীতে প্রার্থীকে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জমা দিতে হয় এবং তিনি আইনগতভাবে পরীক্ষায় অংশ নেয়ার অধিকার রাখেন। সুতরাং কোন নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান একেই দিনে একাধিক পরীক্ষার আয়োজন করা এবং পরিবহন ধর্মঘটের দিনে পরীক্ষার আয়োজন করা প্রার্থীর সঙ্গে অন্যায় আচরণ।
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (চঝঈ) চাকরি প্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাই-বাছাই এবং পরিচালনায় তাদের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তাদের ভর্তি পরীক্ষাতে সামান্য কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে যথেষ্ট পারদর্শী। এমনকি সর্বশেষ ২০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একত্রিত হয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছে। এতে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষার সময়ে সারাদেশে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়নি, অন্যদিকে অপরিচিত জায়গায় থাকতে নানাবিধ চিন্তা এবং অতিরিক্ত অর্থ খরচের হাত থেকে পরিবারের মুক্তি মিললো। সর্বোপরি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সফলতা অর্জন করল কোন বিতর্ক ছাড়াই।
গণমাধ্যম উঠে এসেছে একটি চক্রই আট বছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে এসেছে। ফাঁস হওয়া সেই সব প্রশ্নপত্রে চাকরি পেয়েছেন অসংখ্য ব্যক্তি। বঞ্চিত হয়েছেন মেধাবীরা। অথচ দীর্ঘ আট বছর ধরে প্রশ্নফাঁস নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এতদিন কোন টেরই পেলেন না! রাষ্ট্রীয় এই ব্যর্থতা কি তরুণদের কাছে রাষ্ট্রের সব অর্জনকে সামান্য হলেও মলিন করবে না! অপরপক্ষে অভিযোগের তীর ছুটেছে কিছু কিছু পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বরত শিক্ষক নির্দিষ্ট পরীক্ষার্থীকে সহায়তা করার। সাম্প্রতিক সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের পরীক্ষার পরে যখন শিক্ষার্থীরা প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ তুললেন; কোন তদন্ত ছাড়াই বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা গুজব বলে প্রশ্নফাঁস উড়িয়ে দিলেন কেন?
করোনা মহামারী আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করে বেসরকারি কয়েকটা ব্যাংক ইতোমধ্যে কম্পিউটার বা মোবাইলের মাধ্যমে সৃজনশীল উপায়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার সক্ষমতা প্রমাণিত। সৃজনশীল উপায়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ায় অসদুপায় অবলম্বনের কোন সুযোগ সেখানে ছিল না। চাকরি পরীক্ষার প্রশ্ন কঠিন হলে ছাত্ররা হতাশ হয়ে হল থেকে বের হয়। আবার বেশি সহজ হলে যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সুতরাং সব ধরনের পরীক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা মাথায় রেখে, আদর্শ মানদন্ড বজায় রেখে পিএসসির ন্যায় শতভাগ স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্নপত্র প্রস্তুত আকাক্সিক্ষত।
পৃথিবী চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দারপ্রান্তের মুখোমুখি। বাংলাদেশ সেই পরিবর্তনে অংশীদার হতে চাইলে পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রযুক্তিকে শতভাগ কাজে লাগানোর কোন বিকল্প নেই। সঙ্গে সঙ্গে পিএসসিকে সরকারি সব শ্রেণীর চাকরি পরীক্ষায় প্রার্থীর যোগ্যতা যাচাই-বাছাই এবং পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে। এক্ষেত্রে পিএসসির অতিরিক্ত চাপ হয়ে থাকলে সাংবিধানিক ধারা অনুসরণ করে একাধিক কমিশন গঠন সময়ের প্রয়োজন। স্বাধীন শক্তিশালী কমিশন গঠন করে সরকারি-বেসরকারি সব চাকরির নিয়োগে শৃঙ্খলা আনয়ন এখন জরুরি। রোধ হবে বিচ্ছিন্ন নিয়োগ দিয়ে তরুণদের থেকে অযাচিত আয়ের কৌশল। এছাড়া সমন্বয়হীনতা, প্রশ্নফাঁস এবং অব্যবস্থাপনা এড়ানোর সুযোগ বলতে গেলে অনুপস্থিত। বাস্তবায়ন করতে হবে প্যানেল নিয়োগ ব্যবস্থা। প্রতি সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের ঢাকায় টেনে নেয়ার অর্থ নেই। বরঞ্চ সমন্বিত নিয়োগ ব্যবস্থা করে বিভাগীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরে পরীক্ষার আয়োজন করতে পারলেই শুধু বেকারদের পরিত্রাণ। এতে রাষ্ট্রীয় বিকেন্দ্রীকরণ যেমন সম্ভব হবে; তেমনি হবে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ স্লোগান বাস্তবায়নের জ্বলন্ত উদাহরণ।
বিএনপি সরকারের আমলে পাবলিক পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দাগ মুছতে বাংলাদেশের বহু সময় লেগেছে। যারা ইতোমধ্যে জালিয়াতি করে চাকরিতে প্রবেশ করেছে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের কঠোর শাস্তি এবং চাকরি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসে জিরো টলারেন্স দেখানো এখন তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা। শিক্ষা পদ্ধতি ও যোগ্যতা যাচাই পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন সবার কাক্সিক্ষত। নতুবা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে মেধাবীরা ছিঁটকে পড়বে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
সজীব ওয়াফি
রোববার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২১
রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির অন্যতম নিয়ামক তরুণ প্রজন্ম। সারা পৃথিবীজুড়ে শিল্প, সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, সমাজ এবং রাজনীতিতে তরুণেরা অগ্রগামী। তরুণদের ওপরে নির্ভর করে সভ্যতার ভিত্তি রচনা হয়। এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও তরুণদের ভূমিকা অনন্য। করোনায় বাংলাদেশে তরুণেরা প্রচন্ড রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের বড় একটা অংশ যারা বেকারত্বের গ্লানি বহন করেছেন, তারা নানা দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়েছেন। চাকরির বয়সের ক্ষতিগ্রস্ত সময়ের সমন্বয় নিয়ে এতদিন ধরে তাদের প্রবল ক্ষোভ ছিল। ক্ষোভ ছিল একেই দিনে একাধিক চাকরির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে। নতুন করে যুক্ত হয়েছে প্রশ্নফাঁস বিতর্ক।
কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পরলে গত বছরের মার্চ মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের পাশাপাশি চাকরির সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ছিল না কোন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। এ কারণে সব প্রার্থীই বয়সজনিত টানাপড়েনে পড়েছেন। ব্যাকডেটে সার্কুলারের কথা বলা হলেও কয়েকটা সার্কুলার ব্যতীত বাস্তবে কিছুই হয়নি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী করোনা আক্রান্তের পূর্বে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৬ লাখ। যার ভেতরে শিক্ষিত বেকারত্বের সংখ্যা ছিল ১০ লাখের ওপরে। মহামারি বাস্তবতায় টিকে থাকতে অনেক প্রতিষ্ঠানে হয়েছে কর্মী ছাঁটাই। আবার দুই বছরে নতুন করে দুই-তিনটি ব্যাচও যুক্ত হয়েছে চাকরি পরীক্ষার দৌড়ে। বেড়েছে নতুন বেকারত্বের সংখ্যা। শিক্ষিত বেকারত্বের সংখ্যা যে দিনে দিনে বেড়েছে এ জন্য বেশি পড়াশোনা করার দরকার নেই, বরং সর্বশেষ অনুষ্ঠিত তিনটি বিসিএস পরীক্ষার প্রার্থী সংখ্যার দিকে তাকালেই অনুমেয়।
করোনায় হা-হুতাশ করা এ রকম একটি সময়ে ব্যাংকে চাকরি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের মতো ঘটনা ঘটছে। গণমাধ্যমে উঠে এসেছে জীবন বীমা করপোরেশনের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেই নির্দিষ্ট প্রার্থীদের জন্য উত্তরের ব্যবস্থা করা ছিল। ব্যাংকের প্রশ্নফাঁস বিষয়ে শিক্ষার্থীরা যখন অভিযোগ করে, কোন তদন্ত না করেই প্রথম ধাপেই গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। অথচ গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের আগের নিয়োগেও জালিয়াতি হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের বর্তমান প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ সত্য। গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে ধরা পরে দুর্নীতিবাজির এই মচ্ছব ২০১৪ সাল থেকে চলেছে এবং এর সঙ্গে দেশের নামকরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন কোন শিক্ষক জড়িত আছেন। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ তুলেছেন কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর এবং পরিসংখ্যান ব্যুরোতে নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে। অভিযোগের তীর ছুটেছে সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে। পূর্ববর্তী বছরগুলোতেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগসহ খাদ্য অধিদপ্তর, ব্যাংক, বীমা এবং বিভিন্ন অধিদপ্তরগুলোর নিয়োগে কখনোই বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না।
করোনা মহামারী পরবর্তী বিগত কয়েক মাস ধরে একেই দিনে একাধিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোন কোন দিন ২০-২৫টি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এমনকি ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষার দিনে একাধিক পরীক্ষার আয়োজন অযৌক্তিক। কারো সঙ্গে কারো একেবারেই সমন্বয় নেই। অন্যদিকে পরিবহন ধর্মঘটের ভেতরেও পরীক্ষা স্থগিত না করাটা নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের একগুঁয়েমি চরিত্র। কেননা অধিকাংশ প্রার্থীকে তাদের জেলা শহর অথবা গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। আবেদনের বিপরীতে প্রার্থীকে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জমা দিতে হয় এবং তিনি আইনগতভাবে পরীক্ষায় অংশ নেয়ার অধিকার রাখেন। সুতরাং কোন নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান একেই দিনে একাধিক পরীক্ষার আয়োজন করা এবং পরিবহন ধর্মঘটের দিনে পরীক্ষার আয়োজন করা প্রার্থীর সঙ্গে অন্যায় আচরণ।
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (চঝঈ) চাকরি প্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাই-বাছাই এবং পরিচালনায় তাদের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তাদের ভর্তি পরীক্ষাতে সামান্য কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে যথেষ্ট পারদর্শী। এমনকি সর্বশেষ ২০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একত্রিত হয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছে। এতে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষার সময়ে সারাদেশে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়নি, অন্যদিকে অপরিচিত জায়গায় থাকতে নানাবিধ চিন্তা এবং অতিরিক্ত অর্থ খরচের হাত থেকে পরিবারের মুক্তি মিললো। সর্বোপরি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সফলতা অর্জন করল কোন বিতর্ক ছাড়াই।
গণমাধ্যম উঠে এসেছে একটি চক্রই আট বছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে এসেছে। ফাঁস হওয়া সেই সব প্রশ্নপত্রে চাকরি পেয়েছেন অসংখ্য ব্যক্তি। বঞ্চিত হয়েছেন মেধাবীরা। অথচ দীর্ঘ আট বছর ধরে প্রশ্নফাঁস নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এতদিন কোন টেরই পেলেন না! রাষ্ট্রীয় এই ব্যর্থতা কি তরুণদের কাছে রাষ্ট্রের সব অর্জনকে সামান্য হলেও মলিন করবে না! অপরপক্ষে অভিযোগের তীর ছুটেছে কিছু কিছু পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বরত শিক্ষক নির্দিষ্ট পরীক্ষার্থীকে সহায়তা করার। সাম্প্রতিক সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের পরীক্ষার পরে যখন শিক্ষার্থীরা প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ তুললেন; কোন তদন্ত ছাড়াই বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা গুজব বলে প্রশ্নফাঁস উড়িয়ে দিলেন কেন?
করোনা মহামারী আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করে বেসরকারি কয়েকটা ব্যাংক ইতোমধ্যে কম্পিউটার বা মোবাইলের মাধ্যমে সৃজনশীল উপায়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার সক্ষমতা প্রমাণিত। সৃজনশীল উপায়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ায় অসদুপায় অবলম্বনের কোন সুযোগ সেখানে ছিল না। চাকরি পরীক্ষার প্রশ্ন কঠিন হলে ছাত্ররা হতাশ হয়ে হল থেকে বের হয়। আবার বেশি সহজ হলে যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সুতরাং সব ধরনের পরীক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা মাথায় রেখে, আদর্শ মানদন্ড বজায় রেখে পিএসসির ন্যায় শতভাগ স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্নপত্র প্রস্তুত আকাক্সিক্ষত।
পৃথিবী চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দারপ্রান্তের মুখোমুখি। বাংলাদেশ সেই পরিবর্তনে অংশীদার হতে চাইলে পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রযুক্তিকে শতভাগ কাজে লাগানোর কোন বিকল্প নেই। সঙ্গে সঙ্গে পিএসসিকে সরকারি সব শ্রেণীর চাকরি পরীক্ষায় প্রার্থীর যোগ্যতা যাচাই-বাছাই এবং পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে। এক্ষেত্রে পিএসসির অতিরিক্ত চাপ হয়ে থাকলে সাংবিধানিক ধারা অনুসরণ করে একাধিক কমিশন গঠন সময়ের প্রয়োজন। স্বাধীন শক্তিশালী কমিশন গঠন করে সরকারি-বেসরকারি সব চাকরির নিয়োগে শৃঙ্খলা আনয়ন এখন জরুরি। রোধ হবে বিচ্ছিন্ন নিয়োগ দিয়ে তরুণদের থেকে অযাচিত আয়ের কৌশল। এছাড়া সমন্বয়হীনতা, প্রশ্নফাঁস এবং অব্যবস্থাপনা এড়ানোর সুযোগ বলতে গেলে অনুপস্থিত। বাস্তবায়ন করতে হবে প্যানেল নিয়োগ ব্যবস্থা। প্রতি সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের ঢাকায় টেনে নেয়ার অর্থ নেই। বরঞ্চ সমন্বিত নিয়োগ ব্যবস্থা করে বিভাগীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরে পরীক্ষার আয়োজন করতে পারলেই শুধু বেকারদের পরিত্রাণ। এতে রাষ্ট্রীয় বিকেন্দ্রীকরণ যেমন সম্ভব হবে; তেমনি হবে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ স্লোগান বাস্তবায়নের জ্বলন্ত উদাহরণ।
বিএনপি সরকারের আমলে পাবলিক পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দাগ মুছতে বাংলাদেশের বহু সময় লেগেছে। যারা ইতোমধ্যে জালিয়াতি করে চাকরিতে প্রবেশ করেছে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের কঠোর শাস্তি এবং চাকরি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসে জিরো টলারেন্স দেখানো এখন তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা। শিক্ষা পদ্ধতি ও যোগ্যতা যাচাই পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন সবার কাক্সিক্ষত। নতুবা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে মেধাবীরা ছিঁটকে পড়বে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]