alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সংস্কৃতি

মাছুম বিল্লাহ

: সোমবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২১
image

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোন একটি ঘটনা ঘটলেই কর্তৃপক্ষের সহজ সমাধান, হল খালি করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা। এই পুরোনো ওষুধ কতদিন চলবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ১৯ মাস বন্ধ থাকার পর খুলে দেয়ার পর ১২ সেপ্টেম্বর স্কুলগুলো খুলে দেয়া হলো কিন্তু বিশ^বিদ্যালয় খুলে দেয়ার পর মাত্র দুই সপ্তাহ ক্লাস হয়েছে এই কুয়েটে। তারপর সেখানে দুই ছাত্রের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, তাতেও এক সপ্তাহ ক্লাস বন্ধ থাকে। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই বিশ^বিদ্যালয়ের ৩৮ বছর বয়স্ক তরুণ ও মেধাবী শিক্ষক ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেনের করুণ, মর্মান্তিক ও রহস্যজনক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গত ৩ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। ওই বিশ^বিদ্যালয়ের চার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮০০ মেয়ে শিক্ষার্থী। হঠাৎ করে হল বন্ধ হলে এবং বিকেল ৪টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দিলে মেয়েরা কোথায় যাবে এ বিষয়টি আজও পর্যন্ত বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় এলো না।

এই হঠাৎ করে বন্ধ হওয়ার কালচার শুরু হয়েছে সেই এরশাদ আমল থেকে। আমাদের বিশ^বিদ্যালয়ের পুরোটা সময়ই কেটেছে এরশাদ আন্দোলন ও এরশাদ ভ্যাকেশনে। একবার এমন হয়েছিল কর্তৃপক্ষ বিকেল ৫টার মধ্যে যখন হল ছাড়তে বলল তখন কোথায় যাব? এদিক পুলিশের গাড়ি মহা উৎসাহে চারদিক ঘিরে ফেলেছে, লাঠিসোটা আর বন্দি করার সব সরঞ্জাম নিয়ে হাজির। কোনদিকে যাওয়ার কোন পথ নেই। বহু কষ্টে বেরিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের পোস্ট অফিসের পিওনের ছোট কক্ষে সারারাত কাটালাম, সারারাত দেখলাম পুলিশের গাড়ির টহল, মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধাবস্থা! পরদিন সকালে অতি সন্তর্পণে রাস্তায় এসে কোন রকমে এটি গাড়িতে চেপে বসলাম বরিশাল যাওয়ার জন্য কারণ পথে পথে পুলিশের তল্লাশি, ছাত্র পেলেই আর কথা নেই। পুলিশের সেকি উৎসাহ আর বীরত্ব! এর আগে কয়েকবার এ রকম হওয়ায় ঢাকা চলে আসতাম। ভাবছিলাম নারী শিক্ষার্থী যাদের বাড়ি অনেক দূরে এবং ঢাকায় যাদের সে রকম আত্মীয়-স্বজন নেই তাদের এই পরিস্থিতিতে কি অবস্থা হয়? তবে, জাহাঙ্গীরনগর যারা পড়েন তাদের হয়তো কোন না কোনভাবে ঢাকায় থাকার একটা ব্যবস্থা হয় কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর থেকে ওই সময়ে ঢাকা যাওয়াটাও খুব নিরাপদ নয়। কিন্তু খুলনা, পটুয়াখালী, দিনাজপুর কিংবা সিলেট এসব জায়গার উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হঠাৎ বন্ধ হওয়া আর হঠাৎ হল ছেড়ে দেয়ার ঘটনা নারী শিক্ষার্থীদের মহা বিপদে ফেলে দেয়। কাজেই কর্তৃপক্ষের বিষয়টি সুবিবেচনায় নিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা- উন্মুক্ত জীবনের ছোঁয়ায় আর রাজনীতির ছত্রছায়ায় কি সব কাণ্ড ঘটাতে পারে এবং ঘটাচ্ছে তা যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাদের সবই জানা। এসব শিক্ষার্থীরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে না, তোয়াক্কা করে না কাউকে। ক’দিন আগে আমরা দেখলাম সিলেট মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থীকে নিজ সংগঠনের হয়েও কীভাবে সহপাঠীদের কাছে মূল্য দিতে হয়েছে (মাথার খুলি সরিয়ে ফেলেছে)! তারপরেও আমরা এগুলোকে প্রশয় দিই। সেলিম হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন কারন শক্তিশালী সংগঠনের কিছু ছাত্র তার সঙ্গে চরম খারাপ আচরণ করেছে, যা শিক্ষক সহ্য করতে পারেননি। জানা যায় যে, বিশ^বিদ্যালয়ের লালন শাহ হলে ডাইনিং ম্যানেজার নির্বাচন নিয়ে কয়েকদিন ধরে ছাত্র নেতারা প্রভোস্ট ড. সেলিম হাসোনকে চাপ সৃষ্টি করছিলেন। ২৯ নভেম্বর দুপুরে নেতারা ওই শিক্ষকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং হুমকি দেন। তারই পরপরই তার মুত্যার ঘটনা ঘটে।

ছাত্ররা এটি করেছে কারণ তারা জানে তারা একটি অনায়াসে করতে পারে, কেউ তাদের কিছু বলতে পারবে না। তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষক কিংবা কর্তৃপক্ষের কিছু করার সাহস নেই। তারা কিছু করলেও তাদের কিছু হবে না। উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এগুলো কি চলতেই থাকবে? কুয়েটে চার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮০০ শিক্ষার্থী নারী, ভাবতেই কত ভালো লাগে। আমার দেশে তৈরি হচ্ছে এতগুলো উচ্চশিক্ষিত নারী, এত তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থী। তারা দেশকে পাল্টে দিতে পারেন। কিন্তু যখন এসব ঘটনা দেখি তখন আশা জাগানোর জায়গাগুলো মেঘের অন্ধকারে ঢেকে যায়। সামান্য স্বার্থে এরা কীভাবে নিজেদের জীবন ও পুরো শিক্ষাকে কলুষিত করছে। এতসব মেধাবী শিক্ষার্থীরা যদি সুন্দর ক্যাম্পাসে বসে নিজ শিক্ষকের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করতে পারে তাহলে তারা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে জাতি কি দিবে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জনগণ যে ট্যাক্স প্রদান করছে তার বিনিময়ে তারা এসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে। সেই সত্যকে অনুধাবন করার শিক্ষা যদি তারা এখান থেকে না পায় তাহলে বলতে হয় জাতি অমানিশার অন্ধকারে ঢেকে যাবে।

অনেক অবাক করা বিষয়ের মধ্যে আর একটি অবাক করা বিষয় লক্ষ্য করি। টেলিভিশন তো দেখা হয় না, যদি হঠাৎ কখনও সুইচ টিপ দেই দেখি সংসদে কত ধরনের কথা হয়। কিন্তু শিক্ষার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কত যে দৈন্যদশা এ নিয়ে খুব একটা আলোচনা থাকে না। পত্রিকায় দেখলাম শিক্ষক সেলিমের মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনের জন তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল কিন্তু কমিটির দুজন তদন্তকাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এখানেই তো অনেক রহস্য। হতে পারে উক্ত দুই শিক্ষক যে কালারের, মৃত্যুবরণকারী শিক্ষক সেই কালারের নন। অথবা, তারা জানেন তারা যে রিপোর্ট দিবেন সেটি তারা যেভাবে চাবেন সেভাবে দিতে পারবেন না। অথবা হতে পারে কোন অজানা ইঙ্গিত তাদের তদন্তকাজ করতে না করেছে। এভাবেই আমরা সত্যকে চাপা দিতে থাকি। চাপা দিতে দিতে পরিস্থিতি এমন হয়েছে। এরই মধ্যে দেখলাম ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি ছাত্র সংগঠনের দুই পক্ষের সংঘর্ষে।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকের প্রতি সম্মান ও আবেগে কিছুদিন ক্লাস বর্জন করবেন, মানববন্ধন করবেন তারপর প্রকৃতির নিয়মেই ধীরে ধীরে মানুষ ভুলে যাবে। গুরুত্ব পাবে দেশের অথবা বিশ^বিদ্যালয়ের অন্য কোন একটা ঘটনা, যা এ ঘটনাকে তুচ্ছ করে ফেলবে কিংবা সবার দৃষ্টি অন্যদিকে নিবন্ধ করবে। এসব ঘটনার যারা হোতা কিংবা নিয়ন্ত্রক তারা এগুলো জানে কীভাবে পরিস্থিতি ম্যানেজ করতে হয়। তরুণ শিক্ষার্থীরা কোন অজানা ইঙ্গিতে বা নির্দেশে শুধু রক্ত গরম করা বক্তব্য দিবে, প্রতিপক্ষকে হামলা করবে, হলের দখল নেবে। কিন্তু এগুলো সমাজকে যে কিছুই দেয় না বরং গোটা সমাজে বিস্তার করে অশান্তির কালো ছায়া। ছাত্র জীবনে যেসব বন্ধুদের দেখেছি হকিস্টিক নিয়ে মারামারি করতে আর পিস্তল হাতে নিয়ে সহপাঠীদের তাড়া করতে তাদেরই দেখছি চাকরির জন্য একই কাতারে এসে প্রতিযোগিতায় নামতে। কেউ হয়তো অন্য পথে হেঁটে সামান্য কিছু পেয়েছে কিন্তু সবাই তো না।

আর একটি দুঃখজনক ও উদ্বেগের বিষয় হলো, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তো এখন প্রকৃত অর্থে কোন অভিভাবক নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা প্রতিষ্ঠান সৎভাবে, সঠিকভাবে চালাতে আসেন না, তারা আসেন অন্য কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য। তাই তাদের কাছ থেকে কোন নিরপেক্ষ, সৎ ও সাহসী কোন পদক্ষেপ বা ভূমিকা কেউ আশা করতে পারেন না, এখন আর করেনও না কেউ। তাই এসব দুঃখজনক ঘটনার পরে তাদের বক্তব্য বা ভূমিকা সেটি নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামান না। কারণ সবাই জানে উনারা কিছুই করতে পারেন না। তবে, নিরীহ ছাত্রদের ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে আবার পিছপা হন না। আমাদের যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী তো ক’দিন আগে বলেছেনই যে, ‘বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসিরা ছাত্রদের কথায় ওঠেন আর বসেন।’ আমরা তো তা অহরহ দেখছি।

এখন বিশ^বিদ্যালয়গুলোর যে অবস্থা তাতে বর্তমান পদ্ধতির ভিসি বা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোর অধ্যক্ষ পদের পরিবর্তন প্রয়োজন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, তাদের দ্বারা বর্তমান পরিস্থিতির শিক্ষা ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করা সম্ভব নয় এবং হচ্ছেও না। এই পদগুলোকে সাংবিধানিক পদের মতো চিন্তা করা প্রয়োজন যাতে তারা নিজেদের মতো কাজ করতে পারেন, এবং ইচ্ছে করলেই কেউ তাদের অপসারণ করতে পারবেন না। প্রচলিত পদ্ধতিতে কোন শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন যদি গরম গরম দু-একটা মিছিল দেয়, চোখ রাঙা করে কথা বলে তাহলেই দেখা যায় এসব প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের গদি টলমলে হয়ে যায়। তাই তারা স্র্রোতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দেন। কিন্তু এর ভবিষ্যৎ কি? প্রকৃত উচ্চশিক্ষায় আমাদের শিক্ষার্থীরা কি শিক্ষিত হবেন না, আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীরা কি প্রকৃত উচ্চশিক্ষার পরিবেশ দেশে কখনই পাবেন না? এভাবেই পেশীশক্তির প্রদর্শনী চলতে থাকবে আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে?

[লেখক : ব্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সংস্কৃতি

মাছুম বিল্লাহ

image

সোমবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২১

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোন একটি ঘটনা ঘটলেই কর্তৃপক্ষের সহজ সমাধান, হল খালি করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা। এই পুরোনো ওষুধ কতদিন চলবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ১৯ মাস বন্ধ থাকার পর খুলে দেয়ার পর ১২ সেপ্টেম্বর স্কুলগুলো খুলে দেয়া হলো কিন্তু বিশ^বিদ্যালয় খুলে দেয়ার পর মাত্র দুই সপ্তাহ ক্লাস হয়েছে এই কুয়েটে। তারপর সেখানে দুই ছাত্রের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, তাতেও এক সপ্তাহ ক্লাস বন্ধ থাকে। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই বিশ^বিদ্যালয়ের ৩৮ বছর বয়স্ক তরুণ ও মেধাবী শিক্ষক ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেনের করুণ, মর্মান্তিক ও রহস্যজনক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গত ৩ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। ওই বিশ^বিদ্যালয়ের চার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮০০ মেয়ে শিক্ষার্থী। হঠাৎ করে হল বন্ধ হলে এবং বিকেল ৪টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দিলে মেয়েরা কোথায় যাবে এ বিষয়টি আজও পর্যন্ত বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় এলো না।

এই হঠাৎ করে বন্ধ হওয়ার কালচার শুরু হয়েছে সেই এরশাদ আমল থেকে। আমাদের বিশ^বিদ্যালয়ের পুরোটা সময়ই কেটেছে এরশাদ আন্দোলন ও এরশাদ ভ্যাকেশনে। একবার এমন হয়েছিল কর্তৃপক্ষ বিকেল ৫টার মধ্যে যখন হল ছাড়তে বলল তখন কোথায় যাব? এদিক পুলিশের গাড়ি মহা উৎসাহে চারদিক ঘিরে ফেলেছে, লাঠিসোটা আর বন্দি করার সব সরঞ্জাম নিয়ে হাজির। কোনদিকে যাওয়ার কোন পথ নেই। বহু কষ্টে বেরিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের পোস্ট অফিসের পিওনের ছোট কক্ষে সারারাত কাটালাম, সারারাত দেখলাম পুলিশের গাড়ির টহল, মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধাবস্থা! পরদিন সকালে অতি সন্তর্পণে রাস্তায় এসে কোন রকমে এটি গাড়িতে চেপে বসলাম বরিশাল যাওয়ার জন্য কারণ পথে পথে পুলিশের তল্লাশি, ছাত্র পেলেই আর কথা নেই। পুলিশের সেকি উৎসাহ আর বীরত্ব! এর আগে কয়েকবার এ রকম হওয়ায় ঢাকা চলে আসতাম। ভাবছিলাম নারী শিক্ষার্থী যাদের বাড়ি অনেক দূরে এবং ঢাকায় যাদের সে রকম আত্মীয়-স্বজন নেই তাদের এই পরিস্থিতিতে কি অবস্থা হয়? তবে, জাহাঙ্গীরনগর যারা পড়েন তাদের হয়তো কোন না কোনভাবে ঢাকায় থাকার একটা ব্যবস্থা হয় কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর থেকে ওই সময়ে ঢাকা যাওয়াটাও খুব নিরাপদ নয়। কিন্তু খুলনা, পটুয়াখালী, দিনাজপুর কিংবা সিলেট এসব জায়গার উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হঠাৎ বন্ধ হওয়া আর হঠাৎ হল ছেড়ে দেয়ার ঘটনা নারী শিক্ষার্থীদের মহা বিপদে ফেলে দেয়। কাজেই কর্তৃপক্ষের বিষয়টি সুবিবেচনায় নিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা- উন্মুক্ত জীবনের ছোঁয়ায় আর রাজনীতির ছত্রছায়ায় কি সব কাণ্ড ঘটাতে পারে এবং ঘটাচ্ছে তা যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাদের সবই জানা। এসব শিক্ষার্থীরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে না, তোয়াক্কা করে না কাউকে। ক’দিন আগে আমরা দেখলাম সিলেট মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থীকে নিজ সংগঠনের হয়েও কীভাবে সহপাঠীদের কাছে মূল্য দিতে হয়েছে (মাথার খুলি সরিয়ে ফেলেছে)! তারপরেও আমরা এগুলোকে প্রশয় দিই। সেলিম হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন কারন শক্তিশালী সংগঠনের কিছু ছাত্র তার সঙ্গে চরম খারাপ আচরণ করেছে, যা শিক্ষক সহ্য করতে পারেননি। জানা যায় যে, বিশ^বিদ্যালয়ের লালন শাহ হলে ডাইনিং ম্যানেজার নির্বাচন নিয়ে কয়েকদিন ধরে ছাত্র নেতারা প্রভোস্ট ড. সেলিম হাসোনকে চাপ সৃষ্টি করছিলেন। ২৯ নভেম্বর দুপুরে নেতারা ওই শিক্ষকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং হুমকি দেন। তারই পরপরই তার মুত্যার ঘটনা ঘটে।

ছাত্ররা এটি করেছে কারণ তারা জানে তারা একটি অনায়াসে করতে পারে, কেউ তাদের কিছু বলতে পারবে না। তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষক কিংবা কর্তৃপক্ষের কিছু করার সাহস নেই। তারা কিছু করলেও তাদের কিছু হবে না। উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এগুলো কি চলতেই থাকবে? কুয়েটে চার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮০০ শিক্ষার্থী নারী, ভাবতেই কত ভালো লাগে। আমার দেশে তৈরি হচ্ছে এতগুলো উচ্চশিক্ষিত নারী, এত তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থী। তারা দেশকে পাল্টে দিতে পারেন। কিন্তু যখন এসব ঘটনা দেখি তখন আশা জাগানোর জায়গাগুলো মেঘের অন্ধকারে ঢেকে যায়। সামান্য স্বার্থে এরা কীভাবে নিজেদের জীবন ও পুরো শিক্ষাকে কলুষিত করছে। এতসব মেধাবী শিক্ষার্থীরা যদি সুন্দর ক্যাম্পাসে বসে নিজ শিক্ষকের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করতে পারে তাহলে তারা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে জাতি কি দিবে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জনগণ যে ট্যাক্স প্রদান করছে তার বিনিময়ে তারা এসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে। সেই সত্যকে অনুধাবন করার শিক্ষা যদি তারা এখান থেকে না পায় তাহলে বলতে হয় জাতি অমানিশার অন্ধকারে ঢেকে যাবে।

অনেক অবাক করা বিষয়ের মধ্যে আর একটি অবাক করা বিষয় লক্ষ্য করি। টেলিভিশন তো দেখা হয় না, যদি হঠাৎ কখনও সুইচ টিপ দেই দেখি সংসদে কত ধরনের কথা হয়। কিন্তু শিক্ষার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কত যে দৈন্যদশা এ নিয়ে খুব একটা আলোচনা থাকে না। পত্রিকায় দেখলাম শিক্ষক সেলিমের মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনের জন তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল কিন্তু কমিটির দুজন তদন্তকাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এখানেই তো অনেক রহস্য। হতে পারে উক্ত দুই শিক্ষক যে কালারের, মৃত্যুবরণকারী শিক্ষক সেই কালারের নন। অথবা, তারা জানেন তারা যে রিপোর্ট দিবেন সেটি তারা যেভাবে চাবেন সেভাবে দিতে পারবেন না। অথবা হতে পারে কোন অজানা ইঙ্গিত তাদের তদন্তকাজ করতে না করেছে। এভাবেই আমরা সত্যকে চাপা দিতে থাকি। চাপা দিতে দিতে পরিস্থিতি এমন হয়েছে। এরই মধ্যে দেখলাম ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি ছাত্র সংগঠনের দুই পক্ষের সংঘর্ষে।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকের প্রতি সম্মান ও আবেগে কিছুদিন ক্লাস বর্জন করবেন, মানববন্ধন করবেন তারপর প্রকৃতির নিয়মেই ধীরে ধীরে মানুষ ভুলে যাবে। গুরুত্ব পাবে দেশের অথবা বিশ^বিদ্যালয়ের অন্য কোন একটা ঘটনা, যা এ ঘটনাকে তুচ্ছ করে ফেলবে কিংবা সবার দৃষ্টি অন্যদিকে নিবন্ধ করবে। এসব ঘটনার যারা হোতা কিংবা নিয়ন্ত্রক তারা এগুলো জানে কীভাবে পরিস্থিতি ম্যানেজ করতে হয়। তরুণ শিক্ষার্থীরা কোন অজানা ইঙ্গিতে বা নির্দেশে শুধু রক্ত গরম করা বক্তব্য দিবে, প্রতিপক্ষকে হামলা করবে, হলের দখল নেবে। কিন্তু এগুলো সমাজকে যে কিছুই দেয় না বরং গোটা সমাজে বিস্তার করে অশান্তির কালো ছায়া। ছাত্র জীবনে যেসব বন্ধুদের দেখেছি হকিস্টিক নিয়ে মারামারি করতে আর পিস্তল হাতে নিয়ে সহপাঠীদের তাড়া করতে তাদেরই দেখছি চাকরির জন্য একই কাতারে এসে প্রতিযোগিতায় নামতে। কেউ হয়তো অন্য পথে হেঁটে সামান্য কিছু পেয়েছে কিন্তু সবাই তো না।

আর একটি দুঃখজনক ও উদ্বেগের বিষয় হলো, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তো এখন প্রকৃত অর্থে কোন অভিভাবক নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা প্রতিষ্ঠান সৎভাবে, সঠিকভাবে চালাতে আসেন না, তারা আসেন অন্য কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য। তাই তাদের কাছ থেকে কোন নিরপেক্ষ, সৎ ও সাহসী কোন পদক্ষেপ বা ভূমিকা কেউ আশা করতে পারেন না, এখন আর করেনও না কেউ। তাই এসব দুঃখজনক ঘটনার পরে তাদের বক্তব্য বা ভূমিকা সেটি নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামান না। কারণ সবাই জানে উনারা কিছুই করতে পারেন না। তবে, নিরীহ ছাত্রদের ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে আবার পিছপা হন না। আমাদের যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী তো ক’দিন আগে বলেছেনই যে, ‘বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসিরা ছাত্রদের কথায় ওঠেন আর বসেন।’ আমরা তো তা অহরহ দেখছি।

এখন বিশ^বিদ্যালয়গুলোর যে অবস্থা তাতে বর্তমান পদ্ধতির ভিসি বা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোর অধ্যক্ষ পদের পরিবর্তন প্রয়োজন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, তাদের দ্বারা বর্তমান পরিস্থিতির শিক্ষা ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করা সম্ভব নয় এবং হচ্ছেও না। এই পদগুলোকে সাংবিধানিক পদের মতো চিন্তা করা প্রয়োজন যাতে তারা নিজেদের মতো কাজ করতে পারেন, এবং ইচ্ছে করলেই কেউ তাদের অপসারণ করতে পারবেন না। প্রচলিত পদ্ধতিতে কোন শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন যদি গরম গরম দু-একটা মিছিল দেয়, চোখ রাঙা করে কথা বলে তাহলেই দেখা যায় এসব প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের গদি টলমলে হয়ে যায়। তাই তারা স্র্রোতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দেন। কিন্তু এর ভবিষ্যৎ কি? প্রকৃত উচ্চশিক্ষায় আমাদের শিক্ষার্থীরা কি শিক্ষিত হবেন না, আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীরা কি প্রকৃত উচ্চশিক্ষার পরিবেশ দেশে কখনই পাবেন না? এভাবেই পেশীশক্তির প্রদর্শনী চলতে থাকবে আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে?

[লেখক : ব্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত]

back to top