মর্তুজা হাসান সৈকত
এমভি অভিযান-১০ নামের লঞ্চে অগ্নিকা- নৌ-দুর্ঘটনায় নতুন এক ভয়ঙ্কর মাত্রা সংযোজন করেছে। দেশে আমরা এত দিন লঞ্চ ডুবে মানুষের মৃত্যু দেখলেও এই প্রথম পানিতে ভেসে থাকা লঞ্চে দগ্ধ হয়ে মৃত্যু দেখলাম এই লঞ্চটির বদৌলতে। বলা হয়ে থাকে, আমাদের নৌ, সড়ক ও রেলপথে যত দুর্ঘটনা ঘটে সবই মূলত অবহেলার জন্য। এই লঞ্চটির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। আগুন লাগার পর তা নেভানোর ন্যূনতম চেষ্টা যেমন তারা করেনি তেমনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও লঞ্চটিতে ছিল না।
সম্প্রতি এই লঞ্চটিতে সমুদ্রগামী জাহাজের দুটি রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিন লাগানো হয়েছিল। যে ইঞ্জিনগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোন অনুমতি নেয়া হয়নি। তাছাড়া, যাত্রার আগে খালি অবস্থায় ট্রায়ালের কথা থাকলেও সেটা দেয়া হয়েছে ধারণক্ষমতার চাইতে কয়েকগুণ বেশি যাত্রী নিয়ে পুরো গতিতে ইঞ্জিন দুটো একসঙ্গে চালিয়ে। আর এতেই ইঞ্জিনের অতিরিক্ত তাপে আগুন ধরতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
তদুপরি আগুন লাগার পর ইঞ্জিন রুমে মজুত থাকা কেরোসিন, দাহ্য পদার্থ লুব্রিকেট ও হাইড্রোলিক অয়েলের কারণে দ্রুত তা পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে যায়। কারণ, দাহ্য পদার্থ লঞ্চের ইঞ্জিন রুমে মজুত থাকলে যেমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখতে হয়, ওই লঞ্চে তা ছিল না। অন্যদিকে লঞ্চের এক কেবিন বয় জানিয়েছেন যে, ইঞ্জিন রুমের পাশে খাবারের হোটেলের জন্য ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া কাগজে-কলমে লঞ্চটি যে মাস্টারের (চালক) চালানোর কথা ছিল, তিনি চালাচ্ছিলেন না বলেও জানা গেছে। মানে যত রকম অব্যবস্থাপনা আছে তার সবই ছিল লঞ্চটিতে।
এই দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে আরও দেখিয়ে গেছে যে- বাংলাদেশের বিভিন্ন নৌযানে যেসব অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকে সেগুলোর প্রায় সবই মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা অকার্যকর। অভিযান-১০ লঞ্চটিতে ২১টি অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র থাকার পরও একটিও কোন কাজে আসেনি। এর কারণ হচ্ছে, লঞ্চ প্রথমবার নদীতে ভাসানোর সময় সেই যে সেগুলো সেট করা হয় তারপর সেগুলোর কি অবস্থা, সচল আছে কিনা-তা আর কখনো চেক করা হয় না।
আরেকটি কথা হলো, যারা আগুন নেভাবেন কিংবা ইন্সট্রুমেন্টগুলো ব্যবহার করবেন তাদেরও তো সেগুলো ব্যবহারের প্রশিক্ষণ লাগবে। তাছাড়া প্রশিক্ষণ শুধু লঞ্চচালক বা কর্মচারীদের নয়, প্রশিক্ষণ যাত্রীদেরও দরকার। লঞ্চে থাকা টেলিভিশনে ভিডিওর মাধ্যমে যাত্রা শুরুর পূর্বে নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের বুঝিয়ে দেয়া উচিত। অথচ এসব কিছু আমাদের এখানে কখনই করা হয় না।
তবে দায় শুধু লঞ্চ মালিক কিংবা কর্মচারীদের উপরে চাপালেই হবে না, দায় আছে সরকারেরও। অধিক মুনাফা লাভের আশায় লঞ্চ মালিকরা রোটেশন কৌশল করে প্রয়োজনের তুলনায় কম-সংখ্যাক লঞ্চ চালালেও কিংবা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকলেও সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে কখনও নজরদারি করা হয় না। এই যেমন এখন নৌপরিবহন অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিভিন্ন লঞ্চকে জরিমানা করছে এগুলো যদি সবসময় চলমান থাকতো তাহলে অভিযান-১০ লঞ্চটি যেসব ত্রুটি নিয়ে চলছিল সেগুলো হয়তো আগেই দৃষ্টিগোচর হতো। আর তাতে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি সম্ভবত এড়ানো যেত।
প্রতিটি দুর্ঘটনার পেছনেই রয়েছে মূলত অসতর্কতা কিংবা দায়িত্বে অবহেলা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে আর কতদিন? অভিযান-১০ লঞ্চটিতে যে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলো তা কোনভাবেই সাধারণ কোন দুর্ঘটনা নয়। নরওয়েজিয়ান সমাজবিজ্ঞানী জোহান গ্যালটাঙ এর কাঠামোগত সহিংসতার তত্ত্ব মানলে এটা স্পষ্টতই একটি কাঠামোগত হত্যা।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
মর্তুজা হাসান সৈকত
মঙ্গলবার, ১১ জানুয়ারী ২০২২
এমভি অভিযান-১০ নামের লঞ্চে অগ্নিকা- নৌ-দুর্ঘটনায় নতুন এক ভয়ঙ্কর মাত্রা সংযোজন করেছে। দেশে আমরা এত দিন লঞ্চ ডুবে মানুষের মৃত্যু দেখলেও এই প্রথম পানিতে ভেসে থাকা লঞ্চে দগ্ধ হয়ে মৃত্যু দেখলাম এই লঞ্চটির বদৌলতে। বলা হয়ে থাকে, আমাদের নৌ, সড়ক ও রেলপথে যত দুর্ঘটনা ঘটে সবই মূলত অবহেলার জন্য। এই লঞ্চটির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। আগুন লাগার পর তা নেভানোর ন্যূনতম চেষ্টা যেমন তারা করেনি তেমনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও লঞ্চটিতে ছিল না।
সম্প্রতি এই লঞ্চটিতে সমুদ্রগামী জাহাজের দুটি রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিন লাগানো হয়েছিল। যে ইঞ্জিনগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোন অনুমতি নেয়া হয়নি। তাছাড়া, যাত্রার আগে খালি অবস্থায় ট্রায়ালের কথা থাকলেও সেটা দেয়া হয়েছে ধারণক্ষমতার চাইতে কয়েকগুণ বেশি যাত্রী নিয়ে পুরো গতিতে ইঞ্জিন দুটো একসঙ্গে চালিয়ে। আর এতেই ইঞ্জিনের অতিরিক্ত তাপে আগুন ধরতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
তদুপরি আগুন লাগার পর ইঞ্জিন রুমে মজুত থাকা কেরোসিন, দাহ্য পদার্থ লুব্রিকেট ও হাইড্রোলিক অয়েলের কারণে দ্রুত তা পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে যায়। কারণ, দাহ্য পদার্থ লঞ্চের ইঞ্জিন রুমে মজুত থাকলে যেমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখতে হয়, ওই লঞ্চে তা ছিল না। অন্যদিকে লঞ্চের এক কেবিন বয় জানিয়েছেন যে, ইঞ্জিন রুমের পাশে খাবারের হোটেলের জন্য ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া কাগজে-কলমে লঞ্চটি যে মাস্টারের (চালক) চালানোর কথা ছিল, তিনি চালাচ্ছিলেন না বলেও জানা গেছে। মানে যত রকম অব্যবস্থাপনা আছে তার সবই ছিল লঞ্চটিতে।
এই দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে আরও দেখিয়ে গেছে যে- বাংলাদেশের বিভিন্ন নৌযানে যেসব অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকে সেগুলোর প্রায় সবই মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা অকার্যকর। অভিযান-১০ লঞ্চটিতে ২১টি অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র থাকার পরও একটিও কোন কাজে আসেনি। এর কারণ হচ্ছে, লঞ্চ প্রথমবার নদীতে ভাসানোর সময় সেই যে সেগুলো সেট করা হয় তারপর সেগুলোর কি অবস্থা, সচল আছে কিনা-তা আর কখনো চেক করা হয় না।
আরেকটি কথা হলো, যারা আগুন নেভাবেন কিংবা ইন্সট্রুমেন্টগুলো ব্যবহার করবেন তাদেরও তো সেগুলো ব্যবহারের প্রশিক্ষণ লাগবে। তাছাড়া প্রশিক্ষণ শুধু লঞ্চচালক বা কর্মচারীদের নয়, প্রশিক্ষণ যাত্রীদেরও দরকার। লঞ্চে থাকা টেলিভিশনে ভিডিওর মাধ্যমে যাত্রা শুরুর পূর্বে নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের বুঝিয়ে দেয়া উচিত। অথচ এসব কিছু আমাদের এখানে কখনই করা হয় না।
তবে দায় শুধু লঞ্চ মালিক কিংবা কর্মচারীদের উপরে চাপালেই হবে না, দায় আছে সরকারেরও। অধিক মুনাফা লাভের আশায় লঞ্চ মালিকরা রোটেশন কৌশল করে প্রয়োজনের তুলনায় কম-সংখ্যাক লঞ্চ চালালেও কিংবা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকলেও সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে কখনও নজরদারি করা হয় না। এই যেমন এখন নৌপরিবহন অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিভিন্ন লঞ্চকে জরিমানা করছে এগুলো যদি সবসময় চলমান থাকতো তাহলে অভিযান-১০ লঞ্চটি যেসব ত্রুটি নিয়ে চলছিল সেগুলো হয়তো আগেই দৃষ্টিগোচর হতো। আর তাতে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি সম্ভবত এড়ানো যেত।
প্রতিটি দুর্ঘটনার পেছনেই রয়েছে মূলত অসতর্কতা কিংবা দায়িত্বে অবহেলা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে আর কতদিন? অভিযান-১০ লঞ্চটিতে যে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলো তা কোনভাবেই সাধারণ কোন দুর্ঘটনা নয়। নরওয়েজিয়ান সমাজবিজ্ঞানী জোহান গ্যালটাঙ এর কাঠামোগত সহিংসতার তত্ত্ব মানলে এটা স্পষ্টতই একটি কাঠামোগত হত্যা।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]