alt

উপ-সম্পাদকীয়

গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে নারীর অংশগ্রহণ

রেজাউল করিম খোকন

: রোববার, ১৬ জানুয়ারী ২০২২
image

বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান ৫৩ শতাংশ হলেও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। গ্রামাঞ্চলের নারীরা প্রতিদিন গৃহস্থালি যাবতীয় কাজকর্মের পাশাপাশি সক্রিয়ভাবে পারিবারিক দায়িত্ব হিসেবে কৃষিকাজে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে আসছেন সবসময়। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের কারণে অতীতের মতো কৃষির দাপট নেই, কিন্তু তারপরও গ্রামীণ অর্থনীতি এখনও কৃষি নির্ভর। কৃষি কাজে পুরুষের চেয়ে গ্রামীণ নারীর অবদান তুলনামূলকভাবে বেশি। কিন্তু এরপরও নারীদের কৃষক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন কোন স্বীকৃতি নেই। কৃষিতে নারীর অবদানকে অবৈতনিক পারিবারিক শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে সাধারণত। যদিও নারীরা খামার ও পরিবারের উৎপাদন কাজের জন্য দ্বিমুখী চাপ সহ্য করেন।

গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে প্রায় দেড় কোটি বাড়তি শ্রমশক্তি নতুন যোগ হয়েছে। যার অর্ধেকেই নারী শ্রমিক। গ্রামীণ অর্থনীতিতে শ্রমশক্তি হিসেবে নিয়োজিত নারীরা মূলত কৃষিকাজ গবাদিপশু পালন, হাঁসমুরগি পালন, মৎস্য চাষ, শাকসবজি-ফলমূল উৎপাদন ইত্যাদি কৃষিসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত। গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করে রাখা নারীদের অবদানের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন করা হয় না আলাদাভাবে। রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার অংশ হিসেবে কৃষককার্ড বিতরণ করা হলেও নারী কৃষকরা সেখানে অবহেলিত এবং বঞ্চিত রয়ে গেছেন বারবার। নারী কৃষি শ্রমিকদের প্রতি মজুরি বৈষম্য আজও অব্যাহত রয়েছে। যদিও নারী শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশই কৃষি উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত বিভিন্ন কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সবচেয়ে বড় কথা, ভূমি মালিকানায়ও নারীর সমঅধিকার নেই। বাজারে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রেও পদে পদে তাদের নানা বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়।

প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কৃষিতে নারীর অবদানকে অবহেলা করার সাধারণ প্রবণতা থেকেই কৃষিতে নারীর অবদান স্বীকৃতি লাভ করছে না। আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে নব্বইয়ের দশক ও তার পরে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা কমে এলেও কৃষি খাতে নারীর এ অবদানের কারণে সাবির্কভাবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে নারীর অবস্থান আজও শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।

করোনাভাইরাসের ঢেউয়ে গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। গত বছরের সাধারণ ছুটির সময়ে গ্রামীণ কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া যেমন বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি উৎপাদিত পণ্য বিক্রিও করা যায়নি। ফলে টাকার প্রবাহ কমে গেছে। করোনার প্রভাব মোকাবিলায় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও গ্রামীণ অপ্রাতিষ্ঠানিক কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলো চলতি মূলধনের জোগান পায়নি। কিছু প্রতিষ্ঠান পেলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এছাড়া গ্রামীণ হাট-বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান পায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের কৃষি খাত। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। কৃষি উন্নয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

তাই খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, দারিদ্র্যবিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কৃষি উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান বিবেচনায় কৃষি খাতে স্বল্প সুদে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করে কৃষকদেরকে স্বাভাবিক উৎপাদনশীল কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনাসহ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অগ্রাধিকার খাত হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়নকে টেকসই করার ব্যাপারে এখন বেশ মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ রোধে লকডাউনের সময় গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে ছোট ছোট বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণের প্রবাহ বাড়ানো হয়েছে। এ খাতে চলতি মূলধনের জোগান দিতে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর অব্যবহৃত অর্থ দ্রুত বিনিয়োগ করার জন্য তদারকি বাড়ানো হয়েছে। গ্রামে ঋণের জোগান বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর আলোকে গ্রামবান্ধব ছোট ছোট বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। চলতি অর্থবছরে গ্রামে বিনিয়োগ করার জন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মিলে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে।

গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে কৃষিকাজে নিয়োজিত বিশাল সংখ্যার নারীদের কাজের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের অবদানকে পৃথকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। স্রেফ পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি একজন নারী কৃষিকাজে তার মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে পরিবার তথা সামগ্রিক গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন। এর বিনিময়ে তার উপযুক্ত আর্থিক মূল্য প্রদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং শক্তিশালী করার কোন উদ্যোগ নেই। যার মাধ্যমে নারী তার আর্থিক সক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে উদ্বুদ্ধ হবেন স্বাভাবিকভাবেই।

আর্থিক সেবা কার্যক্রমগুলোতে বর্তমানে গ্রামীণ নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়ভাবে অনেক কম বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটাকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। শুধু কৃষি খাতে নয়, গ্রামীণ নারীরা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় (এসএমই) ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারেন। যদিও গ্রামাঞ্চলে কিছু সংখ্যক নারী নিজের আগ্রহে ও প্রচেষ্টায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি নানা ধরনের ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে আশাব্যঞ্জক সাফল্য অর্জন করেছেন। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ২৫ শতাংশ অবদান রাখার পরও এসএমই ব্যবসায় নারী উদ্যোক্তারা মূল ধারায় আসতে পারছেন না আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে। এ নিয়ে বার বার বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। সবাই নারীর ক্ষমতায়নে তাদের আর্থিক কর্মকান্ড এবং ব্যবসা পরিচালনার পথ সুগম করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন।

কিন্তু আজও শহুরে অনেক নারী উদ্যোক্তাই ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় ঋণ যথাসময়ে না পাওয়ার কারণে তাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের ব্যবসা উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে পারছেন না। এ জন্য বহু প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের মাধমে গ্রাম ও উপশহরের লক্ষ লক্ষ নারীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের পথ তৈরির নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও গ্রামের অধিকাংশ নারীই তেমন সুযোগ লাভ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছেন এখনও। বাংলাদেশের অর্থনীতি গত ৫০ বছরে আজকের যে সমৃদ্ধ পর্যায়ে পৌঁছেছে তার পেছনে পোশাক শিল্পখাতে নিয়োজিত বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমশক্তির অবদানের কথা বার বার আলোচিত হচ্ছে বটে।

তবে পোশাক শিল্প ছাড়াও কৃষি কিংবা সেবা খাত, বিশেষ করে খামারবহির্ভূত কৃষি কিংবা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশে গ্রামীণ নারীদের শক্তিশালী ভূমিকা পালনের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার সময় এসেছে। তাদের কাজকে গুরুত্বহীন ভাবা কিংবা আর্থিক মূল্য প্রদানে অনীহা ক্রমেই গ্রামীণ নারীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। নানা ধরনের গৃহস্থালি কাজ ও প্রজনন-সংক্রান্ত দায়িত্বের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামীণ নারী আনুষ্ঠানিক বাজারকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে বড় ধরনের বাধা হিসেবে কাজ করছে। যদি তারা বাজারকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পান, তাহলে এর মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে আরো শক্তিশালী অবদান রাখতে পারবেন, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও নারী উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াতে নানামুখী প্রকল্প, উদ্যোগ গ্রহণ করছে। বিশেষ করে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা এবং শিল্প উদ্যোগগুলোতে নারীদের প্রচন্ড আগ্রহ থাকলেও নানা জটিলতা ও সামাজিক, আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতার কারণে এসএমই ঋণ গ্রহণ করতে না পারায় এ ক্ষেত্রে সংকট কাটছে না। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীরা কৃষির পাশাপাশি তাদের সক্ষমতার প্রকাশ ঘটাতে পারেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় অংশ গ্রহণের মাধ্যমে। শুধু উৎপাদন কাজে শ্রম দেয়া এবং অকাতরে অবদান রাখার পরও আর্থিক কর্মকান্ডে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়ার ব্যাপারটি এভাবে চলতে থাকলে প্রকারন্তরে নারীরা তাদের মেধা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়তে পারেন, যা গ্রামীণ নারীদের ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যেমন সুফল বয়ে আনবে না, তেমনিভাবে টেকসই গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ার প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হবে বার বার।

পরিসংখ্যান তথা বিচারে আজও নারীকে পুরুষের তুলনায় বেশি পরিশ্রম করতে হয়। নারীর কর্মের, অবদানের কোনো অর্থনৈতিক মূল্য বিচার করা হয় না। তাকে সব সময় পুরুষের ওপর নির্ভরশীল করে রাখার অসুস্থ মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়। অথচ অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ নারীর ওপর নির্ভরশীল-তার স্বীকৃতি মেলে না। ব্যাপারটি স্বীকার করতে চায় না প্রায় সবাই। ধর্মীয় অনুশাসনগুলো প্রয়োগ ভেদে পুরুষরা নিজেদের সুবিধার জন্য নিজেদের মতো করে বলেন। মূলত এখনও নারীর নিজের কোন পরিচয় নেই। যে কোন বাবার মেয়ে, কোন ভাইয়ের বোন, কোন স্বামীর স্ত্রী কিংবা কোনো ছেলে বা মেয়ের মা-এটাই বিবেচিত হয়। আজও নারীকে পুরুষের চেয়ে ছোট কিংবা নিকৃষ্ট মনে করা হয়। যে বিয়েকে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর একমাত্র নিয়তি বলে গণ্য করা হয়, সেই বিয়ের মাধ্যমে নারীর বন্দি জীবন কিংবা নির্যাতনের দুয়ার উন্মুক্ত হয়।

নারীর কোয়ান্টিটি টাইম অনেক আছে, কিন্তু কোয়ালিটি টাইম একটুও নেই। মনের মধ্যে জমে থাকা সব দুর্বলতা, হীনমন্যতা ঝেড়ে ফেলতে হবে। জীবন তো একটাই। এক জীবনের হাসি কান্না দুঃখ সবার একই। অথচ নারী এখনও মর্যাদায় খাটো এই সমাজে। নানা বাধা বিপত্তির পরেও গত দুই দশকে মানবিক খাতে নারীর ঈর্ষণীয় অগ্রগতি হলেও ক্ষমতায়নের জায়গাটি এখনও দুর্বল। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পরিবার থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দুর্বল, নারী ব্যাপকভাবে নির্যাতনের শিকার, সম্পদের ওপর তাদের অধিকার নেই বললেই চলে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে নারীর যে অগ্রগতি হয়েছে তাতে করে আমরা স্বস্তি পেতে পারি বটে কিন্তু অত্যাচার নির্যাতন খুব একটা কমেনি, সমাজের ভেতরেই সংকট রয়ে গেছে। নারী ব্যাপক পরিসরে সক্ষমতা অর্জন করেছে, কিন্তু ক্ষমতায়ন সে তুলনায় কম বলা যায়।

নারীকে আরও বেশি ক্ষমতায়িত করতে হলে রাজনীতিতে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নারীকে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। ক্ষমতায়নের জন্য রাষ্ট্র যদি একটি কাঠামো দাঁড় করায়, তাহলেই শুধু নারীদের যে উন্নয়ন তা টেকসই হতে পারে। নারীর ক্ষমতায়নে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয় না নারী এমন কাজ করে পুরুষের তিনগুণ। অর্থনৈতিক মজুরিবিহীন এসব কাজের কোনো মূল্যায়ন হয় না। পরিবার গঠনে নারীর ভূমিকা মুখ্য হলেও পরিবারে তার অবদানের কোন স্বীকৃতি নেই। নারীর অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দরকার। নারী নিজের প্রয়োজনে শ্রমবাজারে যুক্ত হয়েছে, কেউ তার আসার পথ তৈরি করে দেয়নি। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে এখন যে নারীরা আছেন, তারা নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কাজ করছেন।

কিন্তু নারী উন্নয়ন যদি পদ্ধতি ধরে না এগোয়, তাহলে তা টেকসই হবে না। আমাদের নারী হিমালয়ের চূড়ায় উঠেছে, সেনাবাহিনীতে কাজ করছে, কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষের যে মনোভাব তা এখনও অনেক নিচে পড়ে আছে। এভাবে নারী নির্যাতন এখনও অনেকের চোখে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এখন পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা নারীকে আরও বেশি পণ্যে পরিণত করেছে। আসলে নারীকে পুরুষের সমমর্যাদা দেয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পুরুষের মানসিক বৈকল্য দূর করা। এটা সবচেয়ে জরুরি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধিকার পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার এক ধরনের অদম্য মনোভাব। এ জন্য নারীদের দীর্ঘ লড়াই করতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে নারীর অংশগ্রহণ

রেজাউল করিম খোকন

image

রোববার, ১৬ জানুয়ারী ২০২২

বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান ৫৩ শতাংশ হলেও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। গ্রামাঞ্চলের নারীরা প্রতিদিন গৃহস্থালি যাবতীয় কাজকর্মের পাশাপাশি সক্রিয়ভাবে পারিবারিক দায়িত্ব হিসেবে কৃষিকাজে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে আসছেন সবসময়। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের কারণে অতীতের মতো কৃষির দাপট নেই, কিন্তু তারপরও গ্রামীণ অর্থনীতি এখনও কৃষি নির্ভর। কৃষি কাজে পুরুষের চেয়ে গ্রামীণ নারীর অবদান তুলনামূলকভাবে বেশি। কিন্তু এরপরও নারীদের কৃষক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন কোন স্বীকৃতি নেই। কৃষিতে নারীর অবদানকে অবৈতনিক পারিবারিক শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে সাধারণত। যদিও নারীরা খামার ও পরিবারের উৎপাদন কাজের জন্য দ্বিমুখী চাপ সহ্য করেন।

গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে প্রায় দেড় কোটি বাড়তি শ্রমশক্তি নতুন যোগ হয়েছে। যার অর্ধেকেই নারী শ্রমিক। গ্রামীণ অর্থনীতিতে শ্রমশক্তি হিসেবে নিয়োজিত নারীরা মূলত কৃষিকাজ গবাদিপশু পালন, হাঁসমুরগি পালন, মৎস্য চাষ, শাকসবজি-ফলমূল উৎপাদন ইত্যাদি কৃষিসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত। গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করে রাখা নারীদের অবদানের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন করা হয় না আলাদাভাবে। রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার অংশ হিসেবে কৃষককার্ড বিতরণ করা হলেও নারী কৃষকরা সেখানে অবহেলিত এবং বঞ্চিত রয়ে গেছেন বারবার। নারী কৃষি শ্রমিকদের প্রতি মজুরি বৈষম্য আজও অব্যাহত রয়েছে। যদিও নারী শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশই কৃষি উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত বিভিন্ন কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সবচেয়ে বড় কথা, ভূমি মালিকানায়ও নারীর সমঅধিকার নেই। বাজারে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রেও পদে পদে তাদের নানা বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়।

প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কৃষিতে নারীর অবদানকে অবহেলা করার সাধারণ প্রবণতা থেকেই কৃষিতে নারীর অবদান স্বীকৃতি লাভ করছে না। আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে নব্বইয়ের দশক ও তার পরে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা কমে এলেও কৃষি খাতে নারীর এ অবদানের কারণে সাবির্কভাবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে নারীর অবস্থান আজও শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।

করোনাভাইরাসের ঢেউয়ে গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। গত বছরের সাধারণ ছুটির সময়ে গ্রামীণ কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া যেমন বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি উৎপাদিত পণ্য বিক্রিও করা যায়নি। ফলে টাকার প্রবাহ কমে গেছে। করোনার প্রভাব মোকাবিলায় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও গ্রামীণ অপ্রাতিষ্ঠানিক কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলো চলতি মূলধনের জোগান পায়নি। কিছু প্রতিষ্ঠান পেলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এছাড়া গ্রামীণ হাট-বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান পায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের কৃষি খাত। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। কৃষি উন্নয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

তাই খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, দারিদ্র্যবিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কৃষি উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান বিবেচনায় কৃষি খাতে স্বল্প সুদে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করে কৃষকদেরকে স্বাভাবিক উৎপাদনশীল কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনাসহ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অগ্রাধিকার খাত হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়নকে টেকসই করার ব্যাপারে এখন বেশ মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ রোধে লকডাউনের সময় গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে ছোট ছোট বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণের প্রবাহ বাড়ানো হয়েছে। এ খাতে চলতি মূলধনের জোগান দিতে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর অব্যবহৃত অর্থ দ্রুত বিনিয়োগ করার জন্য তদারকি বাড়ানো হয়েছে। গ্রামে ঋণের জোগান বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর আলোকে গ্রামবান্ধব ছোট ছোট বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। চলতি অর্থবছরে গ্রামে বিনিয়োগ করার জন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মিলে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে।

গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে কৃষিকাজে নিয়োজিত বিশাল সংখ্যার নারীদের কাজের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের অবদানকে পৃথকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। স্রেফ পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি একজন নারী কৃষিকাজে তার মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে পরিবার তথা সামগ্রিক গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন। এর বিনিময়ে তার উপযুক্ত আর্থিক মূল্য প্রদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং শক্তিশালী করার কোন উদ্যোগ নেই। যার মাধ্যমে নারী তার আর্থিক সক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে উদ্বুদ্ধ হবেন স্বাভাবিকভাবেই।

আর্থিক সেবা কার্যক্রমগুলোতে বর্তমানে গ্রামীণ নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়ভাবে অনেক কম বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটাকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। শুধু কৃষি খাতে নয়, গ্রামীণ নারীরা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় (এসএমই) ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারেন। যদিও গ্রামাঞ্চলে কিছু সংখ্যক নারী নিজের আগ্রহে ও প্রচেষ্টায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি নানা ধরনের ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে আশাব্যঞ্জক সাফল্য অর্জন করেছেন। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ২৫ শতাংশ অবদান রাখার পরও এসএমই ব্যবসায় নারী উদ্যোক্তারা মূল ধারায় আসতে পারছেন না আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে। এ নিয়ে বার বার বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। সবাই নারীর ক্ষমতায়নে তাদের আর্থিক কর্মকান্ড এবং ব্যবসা পরিচালনার পথ সুগম করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন।

কিন্তু আজও শহুরে অনেক নারী উদ্যোক্তাই ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় ঋণ যথাসময়ে না পাওয়ার কারণে তাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের ব্যবসা উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে পারছেন না। এ জন্য বহু প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের মাধমে গ্রাম ও উপশহরের লক্ষ লক্ষ নারীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের পথ তৈরির নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও গ্রামের অধিকাংশ নারীই তেমন সুযোগ লাভ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছেন এখনও। বাংলাদেশের অর্থনীতি গত ৫০ বছরে আজকের যে সমৃদ্ধ পর্যায়ে পৌঁছেছে তার পেছনে পোশাক শিল্পখাতে নিয়োজিত বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমশক্তির অবদানের কথা বার বার আলোচিত হচ্ছে বটে।

তবে পোশাক শিল্প ছাড়াও কৃষি কিংবা সেবা খাত, বিশেষ করে খামারবহির্ভূত কৃষি কিংবা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশে গ্রামীণ নারীদের শক্তিশালী ভূমিকা পালনের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার সময় এসেছে। তাদের কাজকে গুরুত্বহীন ভাবা কিংবা আর্থিক মূল্য প্রদানে অনীহা ক্রমেই গ্রামীণ নারীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। নানা ধরনের গৃহস্থালি কাজ ও প্রজনন-সংক্রান্ত দায়িত্বের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামীণ নারী আনুষ্ঠানিক বাজারকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে বড় ধরনের বাধা হিসেবে কাজ করছে। যদি তারা বাজারকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পান, তাহলে এর মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে আরো শক্তিশালী অবদান রাখতে পারবেন, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও নারী উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াতে নানামুখী প্রকল্প, উদ্যোগ গ্রহণ করছে। বিশেষ করে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা এবং শিল্প উদ্যোগগুলোতে নারীদের প্রচন্ড আগ্রহ থাকলেও নানা জটিলতা ও সামাজিক, আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতার কারণে এসএমই ঋণ গ্রহণ করতে না পারায় এ ক্ষেত্রে সংকট কাটছে না। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীরা কৃষির পাশাপাশি তাদের সক্ষমতার প্রকাশ ঘটাতে পারেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় অংশ গ্রহণের মাধ্যমে। শুধু উৎপাদন কাজে শ্রম দেয়া এবং অকাতরে অবদান রাখার পরও আর্থিক কর্মকান্ডে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়ার ব্যাপারটি এভাবে চলতে থাকলে প্রকারন্তরে নারীরা তাদের মেধা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়তে পারেন, যা গ্রামীণ নারীদের ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যেমন সুফল বয়ে আনবে না, তেমনিভাবে টেকসই গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ার প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হবে বার বার।

পরিসংখ্যান তথা বিচারে আজও নারীকে পুরুষের তুলনায় বেশি পরিশ্রম করতে হয়। নারীর কর্মের, অবদানের কোনো অর্থনৈতিক মূল্য বিচার করা হয় না। তাকে সব সময় পুরুষের ওপর নির্ভরশীল করে রাখার অসুস্থ মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়। অথচ অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ নারীর ওপর নির্ভরশীল-তার স্বীকৃতি মেলে না। ব্যাপারটি স্বীকার করতে চায় না প্রায় সবাই। ধর্মীয় অনুশাসনগুলো প্রয়োগ ভেদে পুরুষরা নিজেদের সুবিধার জন্য নিজেদের মতো করে বলেন। মূলত এখনও নারীর নিজের কোন পরিচয় নেই। যে কোন বাবার মেয়ে, কোন ভাইয়ের বোন, কোন স্বামীর স্ত্রী কিংবা কোনো ছেলে বা মেয়ের মা-এটাই বিবেচিত হয়। আজও নারীকে পুরুষের চেয়ে ছোট কিংবা নিকৃষ্ট মনে করা হয়। যে বিয়েকে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর একমাত্র নিয়তি বলে গণ্য করা হয়, সেই বিয়ের মাধ্যমে নারীর বন্দি জীবন কিংবা নির্যাতনের দুয়ার উন্মুক্ত হয়।

নারীর কোয়ান্টিটি টাইম অনেক আছে, কিন্তু কোয়ালিটি টাইম একটুও নেই। মনের মধ্যে জমে থাকা সব দুর্বলতা, হীনমন্যতা ঝেড়ে ফেলতে হবে। জীবন তো একটাই। এক জীবনের হাসি কান্না দুঃখ সবার একই। অথচ নারী এখনও মর্যাদায় খাটো এই সমাজে। নানা বাধা বিপত্তির পরেও গত দুই দশকে মানবিক খাতে নারীর ঈর্ষণীয় অগ্রগতি হলেও ক্ষমতায়নের জায়গাটি এখনও দুর্বল। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পরিবার থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দুর্বল, নারী ব্যাপকভাবে নির্যাতনের শিকার, সম্পদের ওপর তাদের অধিকার নেই বললেই চলে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে নারীর যে অগ্রগতি হয়েছে তাতে করে আমরা স্বস্তি পেতে পারি বটে কিন্তু অত্যাচার নির্যাতন খুব একটা কমেনি, সমাজের ভেতরেই সংকট রয়ে গেছে। নারী ব্যাপক পরিসরে সক্ষমতা অর্জন করেছে, কিন্তু ক্ষমতায়ন সে তুলনায় কম বলা যায়।

নারীকে আরও বেশি ক্ষমতায়িত করতে হলে রাজনীতিতে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নারীকে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। ক্ষমতায়নের জন্য রাষ্ট্র যদি একটি কাঠামো দাঁড় করায়, তাহলেই শুধু নারীদের যে উন্নয়ন তা টেকসই হতে পারে। নারীর ক্ষমতায়নে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয় না নারী এমন কাজ করে পুরুষের তিনগুণ। অর্থনৈতিক মজুরিবিহীন এসব কাজের কোনো মূল্যায়ন হয় না। পরিবার গঠনে নারীর ভূমিকা মুখ্য হলেও পরিবারে তার অবদানের কোন স্বীকৃতি নেই। নারীর অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দরকার। নারী নিজের প্রয়োজনে শ্রমবাজারে যুক্ত হয়েছে, কেউ তার আসার পথ তৈরি করে দেয়নি। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে এখন যে নারীরা আছেন, তারা নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কাজ করছেন।

কিন্তু নারী উন্নয়ন যদি পদ্ধতি ধরে না এগোয়, তাহলে তা টেকসই হবে না। আমাদের নারী হিমালয়ের চূড়ায় উঠেছে, সেনাবাহিনীতে কাজ করছে, কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষের যে মনোভাব তা এখনও অনেক নিচে পড়ে আছে। এভাবে নারী নির্যাতন এখনও অনেকের চোখে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এখন পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা নারীকে আরও বেশি পণ্যে পরিণত করেছে। আসলে নারীকে পুরুষের সমমর্যাদা দেয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পুরুষের মানসিক বৈকল্য দূর করা। এটা সবচেয়ে জরুরি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধিকার পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার এক ধরনের অদম্য মনোভাব। এ জন্য নারীদের দীর্ঘ লড়াই করতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top