এম এম তানজিমুল হক
ব্রিটিশ ভারতে কপিরাইট-সংক্রান্ত কোন নির্দিষ্ট আইন ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানে প্রথম ১৯৬২ সালে কপিরাইট আইন প্রণয়ন করা হয়। কপিরাইট কার্যালয়ের তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর প্রথম কপিরাইট আইন পাস করা হয় ১৯৭৪ সালে। পরবর্তীতে ২০০০ সালে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিভিন্ন বিধান-সংবলিত নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যা কপিরাইট আইন, ২০০০ নামে পরিচিত। এই আইনে বিভিন্ন বিধানের মধ্যে কপিরাইট এবং এ সম্পর্কিত অধিকার, ট্রিপ চুক্তির (The Agreement on Trade-Related Aspects of Intellectual Property Rights, 1994 - TRIPS) বিভিন্ন বিষয়বস্তু, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, ডাটাবেস, সিনেমা, অভিনেতাদের অধিকার, ফোনোগ্রামের অধিকার ইত্যাদি রয়েছে। ২০০৬ সালের উল্লিখিত আইনের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কপিরাইট বিধিমালা, ২০০৬ প্রণীত হয়েছে। তখন থেকে বাংলাদেশে উক্ত আইন ও বিধিমালা দ্বারাই কপিরাইটের বিষয়াবলির সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনা করা হয়ে আসছে।
সম্প্রতি ২৮ অক্টোবর ২০২১ সালে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে কপিরাইট আইন, ২০২১-এর খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়। নতুন এই আইনে কপিরাইট-সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে, পাশাপাশি অনেক নতুন বিষয়ের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
নতুন খসড়া আইন অনুযায়ী কোন কিছু প্রথম প্রকাশ হওয়ার পর ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট থাকবে। এক্ষেত্রে স্বত্বাধিকারী যদি মারাও যান, তাহলে প্রথম দিন থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত স্বত্বাধিকার পাবেন। কপিরাইট আইন, ২০০০-এ সমপরিমাণ মেয়াদের বিধান রয়েছে। নতুন খসড়া আইন অনুযায়ী, উল্লিখিত কপিরাইটের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে মেধাস্বত্ব থাকবে না। সবার জন্য তা উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
পূর্বের আইনটিতে আইনের বিধান বাস্তবায়নের জন্য টাস্কফোর্স এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনার কোন বিধান ছিল না। তবে কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য তিন ধরনের প্রতিকারের কথার উল্লেখ ছিল। কপিরাইট আইন, ২০০০-এর ধারা ৭৬ অনুযায়ী কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য দেওয়ানি প্রতিকার পেতে পারেন। কিছু শর্ত সাপেক্ষে, কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী নিষেধাজ্ঞা, ক্ষতিপূরণ, হিসাব এবং অন্যান্য সকল প্রতিকার এবং স্বত্ব লঙ্ঘনের দায়ে আইনের প্রদত্ত অন্যান্য প্রতিকার পেতে পারেন। আবার, আইনটিতে ফৌজদারি প্রতিকারেরও উল্লেখ ছিল। ধারা ৮২ অনুসারে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এ আইনে উল্লিখিত কোনো অধিকার লঙ্ঘন করলে বা করতে সহায়তা করলে কারাদন্ড ও অর্থদন্ড উভয়েই দন্ডিত হতে পারতেন। এ ছাড়াও আরও অনেক ধরনের ফৌজদারি প্রতিকারের উল্লেখ ছিল। কপিরাইট আইন, ২০০০-এ প্রশাসনিক প্রতিকারের কথা বলা রয়েছে। রেজিস্টার কপিরাইট লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে পারেন। ধারা ৯৯ অনুসারে কোন দেওয়ানি মামলার বিচার করা কালে রেজিস্টার ও বোর্ড বিশেষ কিছু বিষয়ে দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
খসড়া আইনটিতে লোকজ্ঞান ও লোকসংস্কৃতি রক্ষার জন্য এ-সংক্রান্ত একটি অধ্যায় এখানে যুক্ত করা হয়েছে। ২০০০ সালের কপিরাইট আইনে এ বিষয়ক কোনো অধ্যায় নেই।
সাম্প্রতিক কপিরাইট মামলা
তুমুল জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ ‘মাসুদ রানা’-এর লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন সুপরিচিত। কিন্তু এ সিরিজের অধিকাংশ বইয়ের লেখক হিসেবে দাবি করে কপিরাইট আইনে মামলা করেন শেখ আবদুল হাকিম। দীর্ঘ প্রায় এক বছরের আইনি লড়াই শেষে এ বছর জুন মাসে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস শেখ আবদুল হাকিমের পক্ষে মামলার রায় প্রদান করে। রায়ে সেবা প্রকাশনীর পাঠকপ্রিয় স্পাই থ্রিলার ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে মালিকানা স্বত্ব শেখ আবদুল হাকিমকে দেয়া হয়। কপিরাইট অফিসের রায় চ্যালেঞ্জ করে লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কপিরাইট অফিসের দেয়া সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে হাইকোর্ট।
বাংলাদেশে কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব আইনের তোয়াক্কা না করেই গীতিকার এবং সুরকারদের বঞ্চিত করে গান বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে দুজন সুপরিচিত শিল্পীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত আদালতে গড়ানোর পর একজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। আসিফ আকবর এবং শফিক তুহিন দুজনেই বাংলা গানের জনপ্রিয় শিল্পী। শিল্পী শফিক তুহিনের দায়ের করা অভিযোগে আসিফ আকবর গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
বাংলাদেশের দুটি জনপ্রিয় ব্যান্ড নগরবাউল এবং মাইলসের প্রধান শিল্পীরা ১০ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে গিয়ে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। মাইলস ব্যান্ডের প্রধান হামিন আহমেদ বলেন, ২০০৭ সাল থেকে মোবাইল অপারেটর বাংলালিংক দেশের ব্যান্ডগুলোর গান, তাদের (শিল্পী ও ব্যান্ডদল) অনুমতি ছাড়াই গ্রাহকদের রিং টোন, কলার রিং ব্যাক টোন, ওয়েলকাম টিউন এবং ফুল-ট্র্যাক ব্রডকাস্ট এবং ডাউনলোডের পূর্ণ সুবিধা দিচ্ছে। উভয় মামলাই কপিরাইট আইন, ২০০০-এর ধারা ৭১, ৮২ এবং ৯১-এর অধীনে দায়ের করা হয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শমন জারি করে প্রতিষ্ঠানটিকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আদালতে হাজির হয়ে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন।
বর্তমান সময়ের সমস্যাবলি
বিভিন্ন প্রকাশনার অননুমোদিত ব্যবহার উচিত নয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইন প্রবর্তন করা হয়েছিল ‘পাইরেসি’ নামের অপরাধ ঠেকানোর জন্য। ইন্টারনেটে পাইরেসির মাধ্যমে উৎপন্ন প্রচুর বই, চলচ্চিত্র ও গান মেলে। কারণ, প্রযুক্তি পাইরেসিকে সহজসাধ্য করেছে।
প্রচলিত আইনে রয়্যালটি পরিশোধের বিধান থাকা সত্ত্বেও সারা দিন টিভি চ্যানেল ও এফএম রেডিওতে রয়্যালটি না দিয়ে গায়কের নাম উল্লেখ না করে গায়কদের গান প্রচার করা হচ্ছে। মোবাইল ফোন অপারেটররা কোনো রয়্যালটি না দিয়ে গায়কদের বিখ্যাত গান রিং টোন ও ওয়েলকাম টিউন হিসেবে ব্যবহার করছে।
কপিরাইট অফিসটি কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ রেজিস্টার দ্বারা পরিচালিত হয়। এমনকি এর কোনো স্থায়ী অফিস বা জায়গা নেই। এত সীমিতসংখ্যক জনবল নিয়ে সব এলাকায় কাজ করা ওই অফিসের জন্য সমস্যা।
কপিরাইট আইনের অধীনে অপরাধগুলো উপযুক্ত আদালত দ্বারা শাস্তিযোগ্য। বাংলাদেশে, আদালতগুলো বিশাল মামলা-মোকদ্দমায় ভারাক্রান্ত এবং অনেক কারণেই প্রচলিত আদালতে মামলা নিষ্পত্তি প্রায়ই সময়সাপেক্ষ।
যদিও বাংলাদেশে কপিরাইট সুরক্ষার জন্য আমাদের শক্তিশালী আইনি কাঠামো রয়েছে, কপিরাইট সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতনতার অভাবের কারণে অনেক লেখক কর্মসংস্থানের অধীনে কাজ করা কপিরাইটের প্রথম মালিকানা হারান।
যদিও কপিরাইট অফিস আধুনিক অ্যাপ্লিকেশন পদ্ধতি চালু করেছে, কপিরাইট অফিস এবং কপিরাইট করার পদ্ধতিগুলো সম্পূর্ণভাবে আধুনিকায়ন করা উচিত যাতে কপিরাইট অফিস সঠিকভাবে তার কার্য সম্পাদন করতে পারে। কপিরাইটের সঙ্গে জড়িত সব বিভাগকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে প্রশিক্ষণের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। পেটেন্ট বিভাগ, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক এবং কপিরাইট অফিসগুলো সরকারের অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিভাগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ করা উচিত। কম্পিউটার ও ইন্টারনেটে অননুমোদিত ব্যবহার রোধ করার লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
কপিরাইটের নতুন খসড়া আইনে পূর্বের অনেক সমস্যাবলির কথা মাথায় রেখে অনেক বিধান সংযোজন করা হয়েছে। পাশাপাশি, কিছু নতুন বিষয় কপিরাইটের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে যার দরুন কপিরাইট আইনের সুরক্ষার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান সময়ে কপিরাইট আইনের অন্যতম সমস্যা হলো আইনের যথেষ্ট প্রয়োগের অভাব। খসড়া আইনটিতে আইনের বিধান বাস্তবায়নের জন্য টাস্কফোর্স এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার কথা বলা রয়েছে। আশা করা যায়, আইনটি পাস হলে কপিরাইট-সম্পর্কিত সমস্যা নিরসনে আইনটি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
[লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়]
সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
এম এম তানজিমুল হক
রোববার, ১৬ জানুয়ারী ২০২২
ব্রিটিশ ভারতে কপিরাইট-সংক্রান্ত কোন নির্দিষ্ট আইন ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানে প্রথম ১৯৬২ সালে কপিরাইট আইন প্রণয়ন করা হয়। কপিরাইট কার্যালয়ের তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর প্রথম কপিরাইট আইন পাস করা হয় ১৯৭৪ সালে। পরবর্তীতে ২০০০ সালে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিভিন্ন বিধান-সংবলিত নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যা কপিরাইট আইন, ২০০০ নামে পরিচিত। এই আইনে বিভিন্ন বিধানের মধ্যে কপিরাইট এবং এ সম্পর্কিত অধিকার, ট্রিপ চুক্তির (The Agreement on Trade-Related Aspects of Intellectual Property Rights, 1994 - TRIPS) বিভিন্ন বিষয়বস্তু, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, ডাটাবেস, সিনেমা, অভিনেতাদের অধিকার, ফোনোগ্রামের অধিকার ইত্যাদি রয়েছে। ২০০৬ সালের উল্লিখিত আইনের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কপিরাইট বিধিমালা, ২০০৬ প্রণীত হয়েছে। তখন থেকে বাংলাদেশে উক্ত আইন ও বিধিমালা দ্বারাই কপিরাইটের বিষয়াবলির সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনা করা হয়ে আসছে।
সম্প্রতি ২৮ অক্টোবর ২০২১ সালে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে কপিরাইট আইন, ২০২১-এর খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়। নতুন এই আইনে কপিরাইট-সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে, পাশাপাশি অনেক নতুন বিষয়ের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
নতুন খসড়া আইন অনুযায়ী কোন কিছু প্রথম প্রকাশ হওয়ার পর ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট থাকবে। এক্ষেত্রে স্বত্বাধিকারী যদি মারাও যান, তাহলে প্রথম দিন থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত স্বত্বাধিকার পাবেন। কপিরাইট আইন, ২০০০-এ সমপরিমাণ মেয়াদের বিধান রয়েছে। নতুন খসড়া আইন অনুযায়ী, উল্লিখিত কপিরাইটের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে মেধাস্বত্ব থাকবে না। সবার জন্য তা উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
পূর্বের আইনটিতে আইনের বিধান বাস্তবায়নের জন্য টাস্কফোর্স এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনার কোন বিধান ছিল না। তবে কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য তিন ধরনের প্রতিকারের কথার উল্লেখ ছিল। কপিরাইট আইন, ২০০০-এর ধারা ৭৬ অনুযায়ী কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য দেওয়ানি প্রতিকার পেতে পারেন। কিছু শর্ত সাপেক্ষে, কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী নিষেধাজ্ঞা, ক্ষতিপূরণ, হিসাব এবং অন্যান্য সকল প্রতিকার এবং স্বত্ব লঙ্ঘনের দায়ে আইনের প্রদত্ত অন্যান্য প্রতিকার পেতে পারেন। আবার, আইনটিতে ফৌজদারি প্রতিকারেরও উল্লেখ ছিল। ধারা ৮২ অনুসারে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এ আইনে উল্লিখিত কোনো অধিকার লঙ্ঘন করলে বা করতে সহায়তা করলে কারাদন্ড ও অর্থদন্ড উভয়েই দন্ডিত হতে পারতেন। এ ছাড়াও আরও অনেক ধরনের ফৌজদারি প্রতিকারের উল্লেখ ছিল। কপিরাইট আইন, ২০০০-এ প্রশাসনিক প্রতিকারের কথা বলা রয়েছে। রেজিস্টার কপিরাইট লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে পারেন। ধারা ৯৯ অনুসারে কোন দেওয়ানি মামলার বিচার করা কালে রেজিস্টার ও বোর্ড বিশেষ কিছু বিষয়ে দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
খসড়া আইনটিতে লোকজ্ঞান ও লোকসংস্কৃতি রক্ষার জন্য এ-সংক্রান্ত একটি অধ্যায় এখানে যুক্ত করা হয়েছে। ২০০০ সালের কপিরাইট আইনে এ বিষয়ক কোনো অধ্যায় নেই।
সাম্প্রতিক কপিরাইট মামলা
তুমুল জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ ‘মাসুদ রানা’-এর লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন সুপরিচিত। কিন্তু এ সিরিজের অধিকাংশ বইয়ের লেখক হিসেবে দাবি করে কপিরাইট আইনে মামলা করেন শেখ আবদুল হাকিম। দীর্ঘ প্রায় এক বছরের আইনি লড়াই শেষে এ বছর জুন মাসে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস শেখ আবদুল হাকিমের পক্ষে মামলার রায় প্রদান করে। রায়ে সেবা প্রকাশনীর পাঠকপ্রিয় স্পাই থ্রিলার ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে মালিকানা স্বত্ব শেখ আবদুল হাকিমকে দেয়া হয়। কপিরাইট অফিসের রায় চ্যালেঞ্জ করে লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কপিরাইট অফিসের দেয়া সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে হাইকোর্ট।
বাংলাদেশে কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব আইনের তোয়াক্কা না করেই গীতিকার এবং সুরকারদের বঞ্চিত করে গান বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে দুজন সুপরিচিত শিল্পীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত আদালতে গড়ানোর পর একজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। আসিফ আকবর এবং শফিক তুহিন দুজনেই বাংলা গানের জনপ্রিয় শিল্পী। শিল্পী শফিক তুহিনের দায়ের করা অভিযোগে আসিফ আকবর গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
বাংলাদেশের দুটি জনপ্রিয় ব্যান্ড নগরবাউল এবং মাইলসের প্রধান শিল্পীরা ১০ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে গিয়ে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। মাইলস ব্যান্ডের প্রধান হামিন আহমেদ বলেন, ২০০৭ সাল থেকে মোবাইল অপারেটর বাংলালিংক দেশের ব্যান্ডগুলোর গান, তাদের (শিল্পী ও ব্যান্ডদল) অনুমতি ছাড়াই গ্রাহকদের রিং টোন, কলার রিং ব্যাক টোন, ওয়েলকাম টিউন এবং ফুল-ট্র্যাক ব্রডকাস্ট এবং ডাউনলোডের পূর্ণ সুবিধা দিচ্ছে। উভয় মামলাই কপিরাইট আইন, ২০০০-এর ধারা ৭১, ৮২ এবং ৯১-এর অধীনে দায়ের করা হয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শমন জারি করে প্রতিষ্ঠানটিকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আদালতে হাজির হয়ে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন।
বর্তমান সময়ের সমস্যাবলি
বিভিন্ন প্রকাশনার অননুমোদিত ব্যবহার উচিত নয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইন প্রবর্তন করা হয়েছিল ‘পাইরেসি’ নামের অপরাধ ঠেকানোর জন্য। ইন্টারনেটে পাইরেসির মাধ্যমে উৎপন্ন প্রচুর বই, চলচ্চিত্র ও গান মেলে। কারণ, প্রযুক্তি পাইরেসিকে সহজসাধ্য করেছে।
প্রচলিত আইনে রয়্যালটি পরিশোধের বিধান থাকা সত্ত্বেও সারা দিন টিভি চ্যানেল ও এফএম রেডিওতে রয়্যালটি না দিয়ে গায়কের নাম উল্লেখ না করে গায়কদের গান প্রচার করা হচ্ছে। মোবাইল ফোন অপারেটররা কোনো রয়্যালটি না দিয়ে গায়কদের বিখ্যাত গান রিং টোন ও ওয়েলকাম টিউন হিসেবে ব্যবহার করছে।
কপিরাইট অফিসটি কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ রেজিস্টার দ্বারা পরিচালিত হয়। এমনকি এর কোনো স্থায়ী অফিস বা জায়গা নেই। এত সীমিতসংখ্যক জনবল নিয়ে সব এলাকায় কাজ করা ওই অফিসের জন্য সমস্যা।
কপিরাইট আইনের অধীনে অপরাধগুলো উপযুক্ত আদালত দ্বারা শাস্তিযোগ্য। বাংলাদেশে, আদালতগুলো বিশাল মামলা-মোকদ্দমায় ভারাক্রান্ত এবং অনেক কারণেই প্রচলিত আদালতে মামলা নিষ্পত্তি প্রায়ই সময়সাপেক্ষ।
যদিও বাংলাদেশে কপিরাইট সুরক্ষার জন্য আমাদের শক্তিশালী আইনি কাঠামো রয়েছে, কপিরাইট সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতনতার অভাবের কারণে অনেক লেখক কর্মসংস্থানের অধীনে কাজ করা কপিরাইটের প্রথম মালিকানা হারান।
যদিও কপিরাইট অফিস আধুনিক অ্যাপ্লিকেশন পদ্ধতি চালু করেছে, কপিরাইট অফিস এবং কপিরাইট করার পদ্ধতিগুলো সম্পূর্ণভাবে আধুনিকায়ন করা উচিত যাতে কপিরাইট অফিস সঠিকভাবে তার কার্য সম্পাদন করতে পারে। কপিরাইটের সঙ্গে জড়িত সব বিভাগকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে প্রশিক্ষণের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। পেটেন্ট বিভাগ, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক এবং কপিরাইট অফিসগুলো সরকারের অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিভাগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ করা উচিত। কম্পিউটার ও ইন্টারনেটে অননুমোদিত ব্যবহার রোধ করার লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
কপিরাইটের নতুন খসড়া আইনে পূর্বের অনেক সমস্যাবলির কথা মাথায় রেখে অনেক বিধান সংযোজন করা হয়েছে। পাশাপাশি, কিছু নতুন বিষয় কপিরাইটের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে যার দরুন কপিরাইট আইনের সুরক্ষার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান সময়ে কপিরাইট আইনের অন্যতম সমস্যা হলো আইনের যথেষ্ট প্রয়োগের অভাব। খসড়া আইনটিতে আইনের বিধান বাস্তবায়নের জন্য টাস্কফোর্স এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার কথা বলা রয়েছে। আশা করা যায়, আইনটি পাস হলে কপিরাইট-সম্পর্কিত সমস্যা নিরসনে আইনটি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
[লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়]
সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)