মিহির কুমার রায়
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পথপরিক্রমায় অর্জিত অভিজ্ঞতা দিয়ে পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলেন যে, শুধু কৃষিই হবে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক। তিনি কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে স্বনির্ভর কৃষি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, কৃষকের জন্য সুদমুক্ত ঋণের প্রবর্তন, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ২২ লাখ কৃষককে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ, ১৯৭২ সালে কৃষকদের মাঝে ১৬১২৫ মেট্রিক টন উফশী ধান বীজ, ৪৪ হাজার মেট্রিক টন পাটবীজ, ১০৩৭ মেট্রিক টন গম বীজ, ১ লাখ হালচাষের বলদ গরু, ৫০ হাজার গাভী এবং ৩০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ, ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে খাসজমি বিতরণ, ধান, পাট, আখ প্রভৃতি ফসলের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, কৃষকদের মাঝে ৪০ হাজার সেচপাম্প বিতরণ, ২৯০০ গভীর নলকূপ ও ৩ হাজার অগভীর নলকূপ স্থাপন, নদীখনন, বাঁধ নির্মাণ, কৃষিবিদদের ক্লাস ওয়ান মর্যাদা দান ইত্যাদি। তিনি ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটে (এডিপি) ১০১ কোটি টাকা কৃষি উন্নয়নের জন্য দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি কৃষি গবেষণার ওপর জোর দিয়ে নার্স সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যার আওতায় ছিল সাতটি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং এ গুলোর সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদকে (বার্ক)। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে বর্তমান সরকার কৃষি খাতে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার কারণেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে কৃষিতে নিজের অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
স্বাধীনতাত্তোর বালাদেশের পাঁচ দশকের পথ পরিক্রমায় আওয়ামী লীগ মাত্র ২১ বছরের কিছু বেশি সময়ে ক্ষমতায় আসীন রয়েছেন এবং বর্তমান সরকার তার পর্যায়ক্রমে ১৩ বছর ক্ষমতায় আসীন বিধায় কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পকিল্পনা গ্রহণ করেন যার মধ্যে রয়েছে এসডিজি ২০৩০, রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ এর আলোকে জাতীয় কৃষিনীতি, ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, ডেল্টাপ্ল্যান : ২১০০ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা।
করোনাকালীন বিশ্বে যখন সব দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, অনেক দেশে যখন চলছে খাদ্যাভাব, তখন বাংলাদেশ তার অর্থনীতিকে সচল রেখেছে কৃষিকে ঘিরেই। বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমি কমে যাওয়া সত্ত্বেও ১৬ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের সুকঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে যেমন বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে তৃতীয়, শাকসবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ‘সোনালি আঁশ’ পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে অষ্টম, ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয়, মাংস উৎপাদনে চতুর্থ, ইলিশ উৎপাদনে ১ম স্থানে, আলু উৎপাদনে ৭ম স্থানে রয়েছে, যা কৃষি ক্ষেত্রে সাফল্যেরই প্রমাণের জন্য প্রযুক্তি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে যেমন ব্রি ১০৬টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, দেশে এখন পর্যন্ত ১৮টি ফসলের ১১২টি জাত আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ১১৫টি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে বেসরকারি বীজ কোম্পানি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ফসলের ৩০৬টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে, কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে ৩৬৩টি সহ বর্তমানে ২১১টি ফসল নিয়ে গবেষণা করছে।
বলা যায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে এটি আরও এক ধাপ অগ্রগতি। সেক্ষেত্রে শুধু নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করলেই চলবে না, বরং প্রচলিত ধারার আবহমান কৃষিব্যবস্থার উন্নয়নও একান্তভাবে কাম্য ও কাক্সিক্ষত। বর্তমানে শহর-নগর-বন্দরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামের উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। রাজধানীসহ প্রায় সর্বত্র সুউচ্চ দালানকোঠা ও মার্কেট নির্মাণ করতে গিয়ে অত্যধিক চাপ পড়ছে কৃষিজমিতে। সরকার সমস্যাটি সম্পর্কে সম্যক সচেতন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন, গ্রামকে শহরায়ন করা হবে, গ্রামের নিসর্গ-প্রকৃতি ও সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন রেখেই। শহরের সব নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া হবে গ্রামেও।
তাই বলে শুধু উন্নয়নের নামে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে যে, কৃষি অদ্যাবধি বাংলাদেশের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির প্রাণশক্তি। তবে বর্তমানে কৃষিকাজে উৎসাহী তথা কৃষিশ্রমিক পাওয়া রীতিমতো দুর্লভ হয়ে উঠেছে। গত দুই বছর ধরে হাওরাঞ্চলে বোরোর বাম্পার ফলন হওয়ায় ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও একজন শ্রমিকের মজুরি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। অন্যদিকে বর্তমানে বাজারে এক মণ ধানের দাম বড়জোর ৪৫০-৫০০ টাকা। ইতোমধ্যে ধানের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। প্রচলিত কৃষিব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণ শুরু হলে ধানবীজ, চারা রোপণসহ সার ও কীটনাশক ছিটানো, নিড়ানি, সর্বোপরি ধান কাটা, মাড়াইসহ শুকানো এমনকি সরাসরি সাইলোতে পাঠানো সবই করা সহজে সম্ভব আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। কৃষিতে প্রতি বছর কমবেশি ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে। এর মধ্যে ৬-৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকে বিবিধ প্রণোদনা খাতে। এখন থেকে বাকি ৩ হাজার টাকা ব্যয় করা হবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কাজে। তবে উল্লেখ করা আবশ্যক, এই কাজটি শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই।
তবে এর সার্বিক সুফল পেতে হলে টুকরো টুকরো জমির একত্রীকরণ অত্যাবশ্যক। সমবায় প্রথা এক্ষেত্রে সুফলদায়ক হতে পারে। এর পাশাপাশি উৎপাদিত ফসলের আধুনিক বিপণন ব্যবস্থাও জরুরি। গত কয়েক বছরে দেশে বিপ্লব ঘটে গেছে কৃষিতে, ডিজিটাল কৃষিসহ হাইব্রিড পদ্ধতি চালুর ফলে একেবারে বীজতলা থেকে শুরু করে সার, সেচ, কীটনাশক, আবহাওয়া, জলবায়ু, ফসল উৎপাদন, বাজার পরিস্থিতিসহ অন্যবিধ সমস্যা নিয়ে খোলামেলা মতবিনিময়, পরামর্শ ও প্রতিকারের সুযোগ পাওয়া যায় তাৎক্ষণিকভাবে। এর অনিবার্য ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষি ব্যবস্থাপনায়, সুফল পাচ্ছে কৃষক, সর্বোপরি বাড়ছে ফসল উৎপাদন। তার মানে ডিজিটাল কৃষিব্যবস্থা দেশের কৃষিতে প্রায় বিপ্লব নিয়ে এসেছে। হাইব্রিড বীজ, জিএম বীজসহ আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ফসল, শাকসবজি, মৎস্য, পোলট্রি, ফলফলাদির উৎপাদন বাড়িয়েছে বহু গুণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি। প্রতি বছর উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য আধুনিক খাদ্যগুদামের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এর পাশাপাশি কৃষির যান্ত্রিকীকরণসহ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হলো সব মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা। এখন প্রশ্ন হলো, কোভিডের কারণে বিদেশ থেকে যে শ্রমিকরা দেশে ফিরে এসেছেন এবং এখনও বিদেশে যেতে পারেননি, শহর থেকে কাজ হারিয়ে যারা গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের কর্মসংস্থান কিংবা তাদের শ্রম বিনিয়োগ কীভাবে ঘটবে?
[লেখক : অধ্যাপক, ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]
মিহির কুমার রায়
সোমবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২২
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পথপরিক্রমায় অর্জিত অভিজ্ঞতা দিয়ে পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলেন যে, শুধু কৃষিই হবে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক। তিনি কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে স্বনির্ভর কৃষি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, কৃষকের জন্য সুদমুক্ত ঋণের প্রবর্তন, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ২২ লাখ কৃষককে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ, ১৯৭২ সালে কৃষকদের মাঝে ১৬১২৫ মেট্রিক টন উফশী ধান বীজ, ৪৪ হাজার মেট্রিক টন পাটবীজ, ১০৩৭ মেট্রিক টন গম বীজ, ১ লাখ হালচাষের বলদ গরু, ৫০ হাজার গাভী এবং ৩০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ, ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে খাসজমি বিতরণ, ধান, পাট, আখ প্রভৃতি ফসলের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, কৃষকদের মাঝে ৪০ হাজার সেচপাম্প বিতরণ, ২৯০০ গভীর নলকূপ ও ৩ হাজার অগভীর নলকূপ স্থাপন, নদীখনন, বাঁধ নির্মাণ, কৃষিবিদদের ক্লাস ওয়ান মর্যাদা দান ইত্যাদি। তিনি ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটে (এডিপি) ১০১ কোটি টাকা কৃষি উন্নয়নের জন্য দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি কৃষি গবেষণার ওপর জোর দিয়ে নার্স সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যার আওতায় ছিল সাতটি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং এ গুলোর সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদকে (বার্ক)। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে বর্তমান সরকার কৃষি খাতে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার কারণেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে কৃষিতে নিজের অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
স্বাধীনতাত্তোর বালাদেশের পাঁচ দশকের পথ পরিক্রমায় আওয়ামী লীগ মাত্র ২১ বছরের কিছু বেশি সময়ে ক্ষমতায় আসীন রয়েছেন এবং বর্তমান সরকার তার পর্যায়ক্রমে ১৩ বছর ক্ষমতায় আসীন বিধায় কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পকিল্পনা গ্রহণ করেন যার মধ্যে রয়েছে এসডিজি ২০৩০, রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ এর আলোকে জাতীয় কৃষিনীতি, ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, ডেল্টাপ্ল্যান : ২১০০ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা।
করোনাকালীন বিশ্বে যখন সব দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, অনেক দেশে যখন চলছে খাদ্যাভাব, তখন বাংলাদেশ তার অর্থনীতিকে সচল রেখেছে কৃষিকে ঘিরেই। বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমি কমে যাওয়া সত্ত্বেও ১৬ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের সুকঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে যেমন বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে তৃতীয়, শাকসবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ‘সোনালি আঁশ’ পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে অষ্টম, ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয়, মাংস উৎপাদনে চতুর্থ, ইলিশ উৎপাদনে ১ম স্থানে, আলু উৎপাদনে ৭ম স্থানে রয়েছে, যা কৃষি ক্ষেত্রে সাফল্যেরই প্রমাণের জন্য প্রযুক্তি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে যেমন ব্রি ১০৬টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, দেশে এখন পর্যন্ত ১৮টি ফসলের ১১২টি জাত আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ১১৫টি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে বেসরকারি বীজ কোম্পানি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ফসলের ৩০৬টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে, কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে ৩৬৩টি সহ বর্তমানে ২১১টি ফসল নিয়ে গবেষণা করছে।
বলা যায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে এটি আরও এক ধাপ অগ্রগতি। সেক্ষেত্রে শুধু নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করলেই চলবে না, বরং প্রচলিত ধারার আবহমান কৃষিব্যবস্থার উন্নয়নও একান্তভাবে কাম্য ও কাক্সিক্ষত। বর্তমানে শহর-নগর-বন্দরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামের উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। রাজধানীসহ প্রায় সর্বত্র সুউচ্চ দালানকোঠা ও মার্কেট নির্মাণ করতে গিয়ে অত্যধিক চাপ পড়ছে কৃষিজমিতে। সরকার সমস্যাটি সম্পর্কে সম্যক সচেতন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন, গ্রামকে শহরায়ন করা হবে, গ্রামের নিসর্গ-প্রকৃতি ও সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন রেখেই। শহরের সব নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া হবে গ্রামেও।
তাই বলে শুধু উন্নয়নের নামে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে যে, কৃষি অদ্যাবধি বাংলাদেশের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির প্রাণশক্তি। তবে বর্তমানে কৃষিকাজে উৎসাহী তথা কৃষিশ্রমিক পাওয়া রীতিমতো দুর্লভ হয়ে উঠেছে। গত দুই বছর ধরে হাওরাঞ্চলে বোরোর বাম্পার ফলন হওয়ায় ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও একজন শ্রমিকের মজুরি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। অন্যদিকে বর্তমানে বাজারে এক মণ ধানের দাম বড়জোর ৪৫০-৫০০ টাকা। ইতোমধ্যে ধানের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। প্রচলিত কৃষিব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণ শুরু হলে ধানবীজ, চারা রোপণসহ সার ও কীটনাশক ছিটানো, নিড়ানি, সর্বোপরি ধান কাটা, মাড়াইসহ শুকানো এমনকি সরাসরি সাইলোতে পাঠানো সবই করা সহজে সম্ভব আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। কৃষিতে প্রতি বছর কমবেশি ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে। এর মধ্যে ৬-৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকে বিবিধ প্রণোদনা খাতে। এখন থেকে বাকি ৩ হাজার টাকা ব্যয় করা হবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কাজে। তবে উল্লেখ করা আবশ্যক, এই কাজটি শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই।
তবে এর সার্বিক সুফল পেতে হলে টুকরো টুকরো জমির একত্রীকরণ অত্যাবশ্যক। সমবায় প্রথা এক্ষেত্রে সুফলদায়ক হতে পারে। এর পাশাপাশি উৎপাদিত ফসলের আধুনিক বিপণন ব্যবস্থাও জরুরি। গত কয়েক বছরে দেশে বিপ্লব ঘটে গেছে কৃষিতে, ডিজিটাল কৃষিসহ হাইব্রিড পদ্ধতি চালুর ফলে একেবারে বীজতলা থেকে শুরু করে সার, সেচ, কীটনাশক, আবহাওয়া, জলবায়ু, ফসল উৎপাদন, বাজার পরিস্থিতিসহ অন্যবিধ সমস্যা নিয়ে খোলামেলা মতবিনিময়, পরামর্শ ও প্রতিকারের সুযোগ পাওয়া যায় তাৎক্ষণিকভাবে। এর অনিবার্য ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষি ব্যবস্থাপনায়, সুফল পাচ্ছে কৃষক, সর্বোপরি বাড়ছে ফসল উৎপাদন। তার মানে ডিজিটাল কৃষিব্যবস্থা দেশের কৃষিতে প্রায় বিপ্লব নিয়ে এসেছে। হাইব্রিড বীজ, জিএম বীজসহ আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ফসল, শাকসবজি, মৎস্য, পোলট্রি, ফলফলাদির উৎপাদন বাড়িয়েছে বহু গুণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি। প্রতি বছর উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য আধুনিক খাদ্যগুদামের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এর পাশাপাশি কৃষির যান্ত্রিকীকরণসহ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হলো সব মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা। এখন প্রশ্ন হলো, কোভিডের কারণে বিদেশ থেকে যে শ্রমিকরা দেশে ফিরে এসেছেন এবং এখনও বিদেশে যেতে পারেননি, শহর থেকে কাজ হারিয়ে যারা গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের কর্মসংস্থান কিংবা তাদের শ্রম বিনিয়োগ কীভাবে ঘটবে?
[লেখক : অধ্যাপক, ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]