শেখর ভট্টাচার্য
কোন বিশেষ একটি কবিতার বর্ষপূর্তি পালনের মতো অনন্য ঘটনা বাংলা সাহিত্যে বিরল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি মাত্র কবিতা নব্বই বছরপূর্তি উদযাপন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। কবিতাটি হলো, কাজী নজরুল ইসলাম রচিত “বিদ্রোহী”। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ৯০ বছরপূর্তি উদ্যাপন করা হয় ২০১১ সালে। একটি কথা সবাই স্বীকার করবেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিদ্রোহীর মতো প্রভাব সৃষ্টিকারী কবিতা খোঁজে পাওয়া দুষ্কর। কথাটির অর্থ এই নয় যে ‘বিদ্রোহী’র থেকে ভালো কবিতা কিংবা সমতুল্য কবিতা বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়নি।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির মাধ্যমে শিল্পিত উচ্চস্বরে একটি ইশতেহার নিয়ে আসেন কবি নজরুল। হাজার বছর ধরে চলে আসা বৈষম্য, নিপীড়ন, বিভেদ এবং অত্যাচারের কথা কবিতাটিতে প্রথাবিরোধী স্বরে উচ্চারিত হয়েছে। কবিতাটির কাব্য কলা নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন, কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর এবং এখনও যা মৃদু সুরে বহমান। কবিতার উপস্থাপনের অভিনবত্ব অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে গিয়ে অন্য কোন ধারায় কবিতা লেখা যায়, সে ধারণা অনেকের কাছে ছিলো কল্পনাতীত। সে কারণে কবিতাটি প্রকাশের পর, বাংলা কাব্য সাহিত্যের অঙ্গনে প্রচলিত কাব্যধারার বিরুদ্ধে যাওয়ার অভিযোগ তোলে, কাব্য কলা বিবেচনায় দুর্বল কবিতা হিসাবে বিবেচনা করে সমকালীন কবি সাহিত্যিকেরা ঈর্ষা প্রসূত সমালোচনার বান বইয়ে দিতে নিরলস ছিলেন। সমালোচনাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে সৌজন্যের ন্যূনতম সীমা অতিক্রম করে যেতে দেখা যায়। কবিতাটির “আবির্ভাব” হয়েছিল যেভাবে কালবোশেখীর ঝড়ের মতো, প্রকাশের পরে কবিতাটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো, ঝড় থেমে যাওয়ার পর শান্ত, স্নিগ্ধ প্রকৃতিকে ভালোবাসার মতো অপার।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর, ক্রিসমাসের রাত। কলকাতার ৩/৪সি, তালতলা লেনের একটি বাড়িতে বসে কাঠ পেন্সিলে এই কালজয়ী কবিতা লিখতে শুরু করেন সদ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত বাইশ বছরের যুবক কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি শুক্রবার সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় প্রথম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ছাপা হয়। পত্রিকাটির চাহিদা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, সেই সপ্তাহে পত্রিকাটি দুইবার মুদ্রণ করতে হয়েছিল। ১৯২২ সালের ডিসেম্বর কিংবা কবিতার প্রকাশের তারিখ ৬ জানুয়ারই ১৯২২ কে ধরে হিসাব করলে বিদ্রোহী কবিতাটি শত বছর পূর্ণ করেছে ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি। কী এক অপার বিস্ময়। শত বছর পরেও কবিতাটি জন্ম কালের শিহরণ ও আবেগ নিয়ে এখনও মানুষের মনে সাড়া জাগাতে সক্ষম। কবিতাটির প্রাসঙ্গিকতা শত বছর পরেও অপরিবর্তিত আছে।
বিদ্রোহী কবিতাটির প্রভাব কেন এত ব্যাপক ছিল? রবীন্দ্রবলয়ের ভেতরে অবস্থান করে নতুন ভাব, কবিতায় নতুন স্বর ব্যবহার করে বাংলা সাহিত্যের আকাশে “বিদ্রোহী” এক অনন্য সুন্দর রঙধনু হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। নজরুল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের মতে ‘আধুনিক বাংলা কবিতার যে জন্ম হলো, রবীন্দ্র ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে তাতে আরও সময় লেগে যেতো। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে আধুনিক বাংলা কবিতার সূচনা হলো। “তিনি বলছেন, বিদ্রোহী কবিতাটি বাংলা সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে, বিভিন্ন আন্দোলনে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছে। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে শিল্পিতভাবে সবচেয়ে উচ্চৈঃস্বরে লেখা কবিতাটির নাম “বিদ্রোহী”। এককভাবে একটি মাত্র কবিতা একটি ভাষায় লিখিত কবিতার গতি প্রকৃতিকে কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো আমাদের জাতীয় কবি রচিত “বিদ্রোহী”।
কীভাবে লেখা হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির সৃষ্টি ইতিহাস আমরা জানতে পারি নজরুলের সঙ্গে একই কক্ষে বসবাসকারী নজরুলের বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমদের কাছ থেকে। তিনি ছিলেন কবির ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন।, উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মুজফ্?ফর আহ্?মদ। কালজয়ী এই কবিতাটির জন্ম কথা কমরেড মোজাফফর তার ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ বইয়ে চমৎকার ভাবে উপস্থাপনা করেছেন। এই স্মতিকথার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, কবিতাটি লেখা হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো একদিন। তখন তারা একসঙ্গে থাকতেন কলকাতার ৩/৪সি, তালতলা লেনের একটি বাড়িতে। নজরুল কবিতাটি লিখেছিলেন কাঠপেন্সিল দিয়ে।
কেননা সে সময় এখনকার মতো বলপেন কিংবা ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারবার কলম ডুবিয়ে লিখতে গেলে চিন্তার সঙ্গে তাল রাখতে পারতে পারবেন না- এ রকমও হয়তো ভেবেছিলেন তিনি। সৃষ্টির ধারাকে আনন্দময়, বাধাহীন করার জন্যই কাঠপেন্সিলের ব্যবহার করেছিলেন কবি। বাইশ বছর বয়সের এক যুদ্ধ ফেরত সৈনিক, যে অভূতপূর্ব রচনা বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিলেন’ তা ভাবলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায়না। সুন্দর ও সত্যের অলৌকিক জগতে ধ্যানমগ্ন হয়ে একজন ঋষির অমূল্য অমিয় বাণী ধারণ করার মতো মনে হয় এই কবিতাটি লেখার প্রক্রিয়াকে। কমরেড মুজফ্?ফর লিখেছেন, “সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে আমি তা জানিনে। রাত ১০টার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।”
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন ৬০ পেরিয়েছে। আর নজরুলের বয়স কেবল ২২। ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হওয়ার পর নজরুল ইসলাম জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে পড়ে শুনিয়েছিলেন কবিকে। মুজফফর আহমদ জানিয়েছেন, ‘কবিতাটি কবি রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনানোর পরে তিনি নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন।’ ‘বিজলী’র পর এ কবিতা ‘মোস্?লেম ভারত’, ‘প্রবাসী’, ‘সাধনা’, ‘ধূমকেতু’, ‘দৈনিক বসুমতী’ ইত্যাদি পত্রিকায়ও ছাপা হয়। একই কবিতা বা লেখা প্রায় একই সময়ে এতটি পত্রিকায় ছাপা হওয়ার ঘটনাও বাংলা সাহিত্যে এটিই প্রথম।
কবিতাটি প্রকাশের পর যেন একটি যুদ্ধ বোমা বিস্ফোরণ হলো। ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো, বাঙালি প্রধান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কবি-সাহিত্যিক ও ‘ধর্মপ্রাণ’ মানুষদের একটি অংশ ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় প্রকাশিত নজরুলের ধর্মানুভূতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন’-এই লাইন নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি মহলে প্রবল উত্তেজনা দেখা গেল। আবার ‘খোদার আসন “আরশ” ছেদিয়া/উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর!’-চরণটিকে গর্হিত জ্ঞান করে ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের মাসখানেকের মধ্যে কবি গোলাম মোস্তফা সওগাত পত্রিকায় ‘নিয়ন্ত্রিত’ নামে একটি প্যারোডিতে বলেন, ‘ওগো “বীর”/সংযত কর, সংহত কর “উন্নত” তব শির।’ ইসলাম-দর্শন পত্রিকায় মুনশী রেয়াজুদ্দিন আহমদ লেখেন, ‘লোকটা মুসলমান না শয়তান’। পত্রিকাটির সম্পাদক আবদুল হাকিম তার প্যারোডি কবিতায় নজরুলকে বলেছেন, ‘বেল্লিক বেঈমান’, ‘নমরুদ’, ‘ফেরাউন’, ‘ভ্রাতৃদ্রোহী বিভীষণ’। সত্য ও সুন্দরের পুজারী কখনো সরল পথে সবার মনকে তুষ্ট করে এগিয়ে যেতে পারেন না। কবি নজরুল ইসলামও ছিলেন সত্য প্রকাশে অকপট। বাঙালি প্রধান দুটি সম্প্রদায়ের কবি সাহিত্যিকদের অনেকেই নজরুলের ধর্মবোধ, মানবতার জন্য প্রবল তৃষ্ণাকে উপলব্ধি করতে পারেননি, এ কারণেই তারা ক্রোধ প্রকাশে এত অস্থির হয়ে পড়েছিলেন।
বিদ্রোহী কবিতার “আমি” আসলে উৎপীড়িতের প্রতিনিধি। অসাম্য, অনায্য শাসন, সমাজের সব অসঙ্গতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, “বিদ্রোহ” ঘোষণাই আসলে কবিতাটির মর্মবাণী। কবিতাটিতে ভারতবর্ষের সমসাময়িক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে শক্তিশালী একটি অবস্থানের প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে। চির দুরন্ত, দুর্ধর্ষ, দুর্মর এই বিদ্রোহী সত্তা আপনাকে ছাড়া কাউকে কুর্নীশ করে না। মহাশক্তিশালীর এই সংহার মূর্তির মধ্যে কবি প্রেম ও করুণার এক অন্তঃলীলা প্রগ্রবণ বহমান রেখেছেন। কারণ বিদ্রোহ তো জাতের কল্যাণের জন্য দুঃখ মোচনের জন্য। এই জন্যই কবির এক হাতে বাঁশের বাঁশরী অন্য হাতে রণতুর্য।
“বিদ্রোহী” কবিতার শতবর্ষ পূর্তির পরেও আমরা দেখি শোষণ, অপশাসন, প্রান্তিক মানুষের ওপর নির্যাতন এবং নিষ্ঠুরতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। কবি নজরুল ছিলেন সাম্যের কবি। বহমান সময়ে বিশ্বজগতে এবং স্বদেশে অসাম্য, বৈষম্য এবং ভেদাভেদ সমাজকে বহুধা বিভক্ত করে ফেলেছে। “অত্যাচারীর খরগ কৃপান” নির্ভয়ে মানুষের মাথার উপর অবস্থান করে ভীতি সৃষ্টি করে যাচ্ছে। ধর্মের নামে অধর্ম, সাম্প্রদায়িকতার নোংরা ও সহিংস খেলা অবারিত ভাবে দেশে দেশে রাজনীতির ছায়ায় প্রবল দাপট দেখিয়ে চলছে। “বিদ্রোহী” কবিতাটি শুধু নব কাব্য ধারারই সূচনা করেনি, হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা বাঙালির জন্য কবিতাটি হলো জাগরণের স্মারক। নজরুল কবিতাটির মাধ্যমে একধরনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন যে প্রতিশ্রুতি বয়ে নিয়ে যাওয়ার দায় এখন আমাদের। দিনে দিনে আমাদের দায় ও ঋণ বেড়েই চলছে। এবার আমাদের জাগতে হবে। “বিদ্রোহী” কবিতাটি শতবর্ষ ধরে আমাদের এই আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
শেখর ভট্টাচার্য
বুধবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২২
কোন বিশেষ একটি কবিতার বর্ষপূর্তি পালনের মতো অনন্য ঘটনা বাংলা সাহিত্যে বিরল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি মাত্র কবিতা নব্বই বছরপূর্তি উদযাপন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। কবিতাটি হলো, কাজী নজরুল ইসলাম রচিত “বিদ্রোহী”। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ৯০ বছরপূর্তি উদ্যাপন করা হয় ২০১১ সালে। একটি কথা সবাই স্বীকার করবেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিদ্রোহীর মতো প্রভাব সৃষ্টিকারী কবিতা খোঁজে পাওয়া দুষ্কর। কথাটির অর্থ এই নয় যে ‘বিদ্রোহী’র থেকে ভালো কবিতা কিংবা সমতুল্য কবিতা বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়নি।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির মাধ্যমে শিল্পিত উচ্চস্বরে একটি ইশতেহার নিয়ে আসেন কবি নজরুল। হাজার বছর ধরে চলে আসা বৈষম্য, নিপীড়ন, বিভেদ এবং অত্যাচারের কথা কবিতাটিতে প্রথাবিরোধী স্বরে উচ্চারিত হয়েছে। কবিতাটির কাব্য কলা নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন, কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর এবং এখনও যা মৃদু সুরে বহমান। কবিতার উপস্থাপনের অভিনবত্ব অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে গিয়ে অন্য কোন ধারায় কবিতা লেখা যায়, সে ধারণা অনেকের কাছে ছিলো কল্পনাতীত। সে কারণে কবিতাটি প্রকাশের পর, বাংলা কাব্য সাহিত্যের অঙ্গনে প্রচলিত কাব্যধারার বিরুদ্ধে যাওয়ার অভিযোগ তোলে, কাব্য কলা বিবেচনায় দুর্বল কবিতা হিসাবে বিবেচনা করে সমকালীন কবি সাহিত্যিকেরা ঈর্ষা প্রসূত সমালোচনার বান বইয়ে দিতে নিরলস ছিলেন। সমালোচনাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে সৌজন্যের ন্যূনতম সীমা অতিক্রম করে যেতে দেখা যায়। কবিতাটির “আবির্ভাব” হয়েছিল যেভাবে কালবোশেখীর ঝড়ের মতো, প্রকাশের পরে কবিতাটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো, ঝড় থেমে যাওয়ার পর শান্ত, স্নিগ্ধ প্রকৃতিকে ভালোবাসার মতো অপার।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর, ক্রিসমাসের রাত। কলকাতার ৩/৪সি, তালতলা লেনের একটি বাড়িতে বসে কাঠ পেন্সিলে এই কালজয়ী কবিতা লিখতে শুরু করেন সদ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত বাইশ বছরের যুবক কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি শুক্রবার সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় প্রথম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ছাপা হয়। পত্রিকাটির চাহিদা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, সেই সপ্তাহে পত্রিকাটি দুইবার মুদ্রণ করতে হয়েছিল। ১৯২২ সালের ডিসেম্বর কিংবা কবিতার প্রকাশের তারিখ ৬ জানুয়ারই ১৯২২ কে ধরে হিসাব করলে বিদ্রোহী কবিতাটি শত বছর পূর্ণ করেছে ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি। কী এক অপার বিস্ময়। শত বছর পরেও কবিতাটি জন্ম কালের শিহরণ ও আবেগ নিয়ে এখনও মানুষের মনে সাড়া জাগাতে সক্ষম। কবিতাটির প্রাসঙ্গিকতা শত বছর পরেও অপরিবর্তিত আছে।
বিদ্রোহী কবিতাটির প্রভাব কেন এত ব্যাপক ছিল? রবীন্দ্রবলয়ের ভেতরে অবস্থান করে নতুন ভাব, কবিতায় নতুন স্বর ব্যবহার করে বাংলা সাহিত্যের আকাশে “বিদ্রোহী” এক অনন্য সুন্দর রঙধনু হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। নজরুল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের মতে ‘আধুনিক বাংলা কবিতার যে জন্ম হলো, রবীন্দ্র ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে তাতে আরও সময় লেগে যেতো। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে আধুনিক বাংলা কবিতার সূচনা হলো। “তিনি বলছেন, বিদ্রোহী কবিতাটি বাংলা সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে, বিভিন্ন আন্দোলনে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছে। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে শিল্পিতভাবে সবচেয়ে উচ্চৈঃস্বরে লেখা কবিতাটির নাম “বিদ্রোহী”। এককভাবে একটি মাত্র কবিতা একটি ভাষায় লিখিত কবিতার গতি প্রকৃতিকে কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো আমাদের জাতীয় কবি রচিত “বিদ্রোহী”।
কীভাবে লেখা হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির সৃষ্টি ইতিহাস আমরা জানতে পারি নজরুলের সঙ্গে একই কক্ষে বসবাসকারী নজরুলের বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমদের কাছ থেকে। তিনি ছিলেন কবির ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন।, উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মুজফ্?ফর আহ্?মদ। কালজয়ী এই কবিতাটির জন্ম কথা কমরেড মোজাফফর তার ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ বইয়ে চমৎকার ভাবে উপস্থাপনা করেছেন। এই স্মতিকথার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, কবিতাটি লেখা হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো একদিন। তখন তারা একসঙ্গে থাকতেন কলকাতার ৩/৪সি, তালতলা লেনের একটি বাড়িতে। নজরুল কবিতাটি লিখেছিলেন কাঠপেন্সিল দিয়ে।
কেননা সে সময় এখনকার মতো বলপেন কিংবা ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারবার কলম ডুবিয়ে লিখতে গেলে চিন্তার সঙ্গে তাল রাখতে পারতে পারবেন না- এ রকমও হয়তো ভেবেছিলেন তিনি। সৃষ্টির ধারাকে আনন্দময়, বাধাহীন করার জন্যই কাঠপেন্সিলের ব্যবহার করেছিলেন কবি। বাইশ বছর বয়সের এক যুদ্ধ ফেরত সৈনিক, যে অভূতপূর্ব রচনা বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিলেন’ তা ভাবলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায়না। সুন্দর ও সত্যের অলৌকিক জগতে ধ্যানমগ্ন হয়ে একজন ঋষির অমূল্য অমিয় বাণী ধারণ করার মতো মনে হয় এই কবিতাটি লেখার প্রক্রিয়াকে। কমরেড মুজফ্?ফর লিখেছেন, “সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে আমি তা জানিনে। রাত ১০টার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।”
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন ৬০ পেরিয়েছে। আর নজরুলের বয়স কেবল ২২। ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হওয়ার পর নজরুল ইসলাম জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে পড়ে শুনিয়েছিলেন কবিকে। মুজফফর আহমদ জানিয়েছেন, ‘কবিতাটি কবি রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনানোর পরে তিনি নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন।’ ‘বিজলী’র পর এ কবিতা ‘মোস্?লেম ভারত’, ‘প্রবাসী’, ‘সাধনা’, ‘ধূমকেতু’, ‘দৈনিক বসুমতী’ ইত্যাদি পত্রিকায়ও ছাপা হয়। একই কবিতা বা লেখা প্রায় একই সময়ে এতটি পত্রিকায় ছাপা হওয়ার ঘটনাও বাংলা সাহিত্যে এটিই প্রথম।
কবিতাটি প্রকাশের পর যেন একটি যুদ্ধ বোমা বিস্ফোরণ হলো। ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো, বাঙালি প্রধান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কবি-সাহিত্যিক ও ‘ধর্মপ্রাণ’ মানুষদের একটি অংশ ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় প্রকাশিত নজরুলের ধর্মানুভূতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন’-এই লাইন নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি মহলে প্রবল উত্তেজনা দেখা গেল। আবার ‘খোদার আসন “আরশ” ছেদিয়া/উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর!’-চরণটিকে গর্হিত জ্ঞান করে ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের মাসখানেকের মধ্যে কবি গোলাম মোস্তফা সওগাত পত্রিকায় ‘নিয়ন্ত্রিত’ নামে একটি প্যারোডিতে বলেন, ‘ওগো “বীর”/সংযত কর, সংহত কর “উন্নত” তব শির।’ ইসলাম-দর্শন পত্রিকায় মুনশী রেয়াজুদ্দিন আহমদ লেখেন, ‘লোকটা মুসলমান না শয়তান’। পত্রিকাটির সম্পাদক আবদুল হাকিম তার প্যারোডি কবিতায় নজরুলকে বলেছেন, ‘বেল্লিক বেঈমান’, ‘নমরুদ’, ‘ফেরাউন’, ‘ভ্রাতৃদ্রোহী বিভীষণ’। সত্য ও সুন্দরের পুজারী কখনো সরল পথে সবার মনকে তুষ্ট করে এগিয়ে যেতে পারেন না। কবি নজরুল ইসলামও ছিলেন সত্য প্রকাশে অকপট। বাঙালি প্রধান দুটি সম্প্রদায়ের কবি সাহিত্যিকদের অনেকেই নজরুলের ধর্মবোধ, মানবতার জন্য প্রবল তৃষ্ণাকে উপলব্ধি করতে পারেননি, এ কারণেই তারা ক্রোধ প্রকাশে এত অস্থির হয়ে পড়েছিলেন।
বিদ্রোহী কবিতার “আমি” আসলে উৎপীড়িতের প্রতিনিধি। অসাম্য, অনায্য শাসন, সমাজের সব অসঙ্গতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, “বিদ্রোহ” ঘোষণাই আসলে কবিতাটির মর্মবাণী। কবিতাটিতে ভারতবর্ষের সমসাময়িক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে শক্তিশালী একটি অবস্থানের প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে। চির দুরন্ত, দুর্ধর্ষ, দুর্মর এই বিদ্রোহী সত্তা আপনাকে ছাড়া কাউকে কুর্নীশ করে না। মহাশক্তিশালীর এই সংহার মূর্তির মধ্যে কবি প্রেম ও করুণার এক অন্তঃলীলা প্রগ্রবণ বহমান রেখেছেন। কারণ বিদ্রোহ তো জাতের কল্যাণের জন্য দুঃখ মোচনের জন্য। এই জন্যই কবির এক হাতে বাঁশের বাঁশরী অন্য হাতে রণতুর্য।
“বিদ্রোহী” কবিতার শতবর্ষ পূর্তির পরেও আমরা দেখি শোষণ, অপশাসন, প্রান্তিক মানুষের ওপর নির্যাতন এবং নিষ্ঠুরতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। কবি নজরুল ছিলেন সাম্যের কবি। বহমান সময়ে বিশ্বজগতে এবং স্বদেশে অসাম্য, বৈষম্য এবং ভেদাভেদ সমাজকে বহুধা বিভক্ত করে ফেলেছে। “অত্যাচারীর খরগ কৃপান” নির্ভয়ে মানুষের মাথার উপর অবস্থান করে ভীতি সৃষ্টি করে যাচ্ছে। ধর্মের নামে অধর্ম, সাম্প্রদায়িকতার নোংরা ও সহিংস খেলা অবারিত ভাবে দেশে দেশে রাজনীতির ছায়ায় প্রবল দাপট দেখিয়ে চলছে। “বিদ্রোহী” কবিতাটি শুধু নব কাব্য ধারারই সূচনা করেনি, হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা বাঙালির জন্য কবিতাটি হলো জাগরণের স্মারক। নজরুল কবিতাটির মাধ্যমে একধরনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন যে প্রতিশ্রুতি বয়ে নিয়ে যাওয়ার দায় এখন আমাদের। দিনে দিনে আমাদের দায় ও ঋণ বেড়েই চলছে। এবার আমাদের জাগতে হবে। “বিদ্রোহী” কবিতাটি শতবর্ষ ধরে আমাদের এই আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]