alt

উপ-সম্পাদকীয়

ইভিএমে আস্থার সংকট

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: রোববার, ২২ মে ২০২২

সংবিধান অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং শুধু সংবিধান ও সংশ্লিষ্ট আইনের অধীনে তা পালন করতে হবে। সাংবিধানিক এই গুরুদায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নির্বাচন ব্যবস্থাপনার প্রতিটি অনুষঙ্গের কার্যকারিতা প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করে চিহ্নিত বাধাসমূহ অপসারণ কমিশনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নততর পদ্ধতি ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহার তাই কমিশনের কর্মকৌশলের অন্যতম প্রধান উপাদান। এই প্রেক্ষিতেই কমিশন বিগত ২০০৯ সাল থেকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে আসছে। সার্কভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বাদে আর সব দেশেই নির্বাচনে কাগজের ব্যালট ব্যবহারের পরিবর্তে ইভিএমএর মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ব্যালট ব্যবহার শুরু হয়েছে। পাকিস্তানও তাদের আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে চায় এবং সে লক্ষ্যে তারা কিছু কাল পূর্বে ওই মেশিন সংগ্রহের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করেছে।

ভোট গ্রহণে ইভিএম পদ্ধতি যে ত্রুটিমুক্ত নয়, তা বিভিন্ন দেশে প্রমাণিত একথা বলাই বাহুল্য। এ কারণে অনেক দেশে ইভিএমে ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যে ভোটপ্রদানের সঙ্গে সঙ্গে একটি কাগজের স্লিপ বেরিয়ে আসে এবং সেটি ব্যালট বাক্সে ফেলা হয়। অর্থাৎ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য দুই ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে। এজন্য পছন্দের প্রার্থীকে দেওয়া ভোট মেশিনের পাশাপাশি ছাপা কাগজেও যাতে সংরক্ষিত হয় এবং ভোটদাতা তার প্রমাণ পায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে ভোটারদের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। সব মিলে এ ক্ষেত্রে একটি চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকা প্রয়োজন।

তবে ইভিএম ভোট গ্রহণের একটি পদ্ধতি মাত্র। যদি অংগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা না যায় এবং হৃত আস্থা পুনরুদ্ধারে নতুন নির্বাচন কমিশন দৃষ্টান্ত দাঁড় করাতে না পারে, তাহলে যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন হোক না কেন; এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন-বিতর্ক নিরসন করা যাবে না। নতুন নির্বাচন কমিশনের পরীক্ষাটা হলো- তাদের যে মুখ্য কাজ প্রশ্নমুক্ত, স্বচ্ছ নির্বাচন করা এবং নির্বাচনে অংশীজন সবার জন্য মাঠ সমতল রাখা; সে ক্ষেত্রে তারা শতভাগ সফল কিনা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তাদের প্রস্তুতি কতটা আছে কিংবা তারা কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সংবিধান প্রদত্ত দায়িত্ব রক্ষায় এসব বিষয় তাদের কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে পৃথিবীর যতগুলো দেশ ইভিএম গ্রহণ করেছে, তার চেয়ে বেশি দেশ ইভিএম বাতিল করেছে।

বাতিল করেছে এমন দেশের তালিকায় আছে জার্মানি, স্পেন, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, নরওয়ে, ভেনেজুয়েলা, ইউক্রেন, মালয়েশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো রাজ্য। সম্প্রতি ভারতেও বিরোধী দলগুলো ইভিএমের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। বর্তমানে পুরোপুরি ইভিএম চালু আছে শুধুমাত্র ভারত, ব্রাজিল, ফিলিপাইন এবং এস্তোনিয়ায়। ভোট ব্যবস্থাপনাকে সহজতর করার লক্ষ্য থেকেই সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম পদ্ধতি চালু হয়। ইভিএম পদ্ধতির সময়কাল প্রায় ৬০ বছর অতিক্রান্ত হলেও বিশ্বের কোন দেশেই পুরোপুরি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি এটি। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৪টি দেশ ইভিএম ব্যবহার বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। এর মধ্যে ১৪টি দেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। ১১টি দেশে আংশিক ব্যবহার হচ্ছে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ৫টি দেশে। ভারতের ইকোনমিক টাইমস পত্রিকার অনুসন্ধানী রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে মাত্র যে ৪টি দেশে ইভিএম ব্যবহার করা হয়, সে সব দেশেও এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা আছে।

ইভিএম ভোট গ্রহণের একটি পদ্ধতি মাত্র। যদি অংগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা না যায় এবং হৃত আস্থা পুনরুদ্ধারে নতুন নির্বাচন কমিশন দৃষ্টান্ত দাঁড় করাতে না পারে, তাহলে যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন হোক না কেন; এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন-বিতর্ক নিরসন করা যাবে না

ভোটের মাঠে সরেজমিনে ইভিএমের বেশকিছু দুর্বল দিক পাওয়া গেছে। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে ইভিএমে ভোট নেয়া কেন্দ্রগুলোতে ধীরগতি দেখা গেছে। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে- বয়স্ক, বিশেষ করে নারী ভোটারদের আঙ্গুলের ছাপ না মেলা। এ জন্য ভোটই দিতে পারেননি অনেকে। অবশ্য মেশিন ব্যবহারে ভোটারদের অনভ্যস্ততার কারণেও ভোট পড়ার গতি কমতে দেখা গেছে। সদ্যসমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও পৌরসভার ভোটেও ব্যালটের চেয়ে ইভিএমে ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত কম ভোট পড়েছে। এমন অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমে ভোট হলে স্বাভাবিকভাবেই অনেক ভোটারের ভোট দেয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে, যা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ইভিএম বিতর্ক যেমন নতুন নয়; তেমনি অস্বচ্ছ নির্বাচন নিয়ে বিতর্কও পুরোনো। নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক এবং প্রশ্নমুক্ত না হয়, তাহলে যত আধুনিক পদ্ধতিই গ্রহণ করা হোক না কেন; রাজনৈতিক জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না। আমাদের বিভাজিত রাজনীতি জাতীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তো বটেই; একই সঙ্গে জাতীয় সংহতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্রেও বড় প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। রাজনীতির মাঠ সমতল করে, অধিকাংশ ভোটারের ক্ষেত্রে বৈষম্যের নিরসন ঘটিয়ে জনমনে সৃষ্ট আস্থাহীনতা দূর করে দেশ-জাতির উন্নয়নে সবাইকে শরিক করে এগোতে পারলে এর আরও বড় সুফলভোগী হবো আমরা। সিইসি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে মতামত দিতে পারবে। তিনি বলেন, শুদ্ধ ও সঠিক ভোটার তালিকা ছাড়া প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই এ কাজটি আমরা সঠিকভাবে করার চেষ্টা করছি। ২০ মে থেকে সারা দেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করবে নির্বাচন কমিশন। এ ক্ষেত্রে চার ধাপে এ কর্মসূচি সম্পন্ন করা হবে। প্রথম ধাপে ১৪০ উপজেলায় কার্যক্রম চলবে ২০ মে থেকে ৯ জুন পর্যন্ত।” নির্বাচন কমিশনের এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের জন্য এক শুভসূচনা ও ভোটারদের স্বস্তির-বিষয়।

রাজনৈতিক দলগুলো ও ভোটারদের আস্থা অর্জন ছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা উচিত হবে না। এজন্য ভোটারদের সন্দেহ দূর করে আস্থায় ফেরানোকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। ইভিএমের মেমোরি কার্ডের মাধ্যমে নির্বাচনে কারচুপি করার সুযোগ আছে বলে মনে করেন অনেক ভোটার। ভোটারদের এ সন্দেহ দূর করা না গেলে ইভিএমে ভোট গ্রহণের পর নির্বাচনের ফলাফল বিতর্কিত হতে পারে। গণতন্ত্রের স্বার্থে, সুস্থ ধারার রাজনীতির প্রয়োজনে সর্বাগ্রে স্বচ্ছ, প্রশ্নমুক্ত, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে। পরস্পরকে উদার মনোভাব নিয়ে আলোচনায় বসে প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসান ঘটাতে হবে। সবাইকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করার চেষ্টা চালানোর যে কথা বলেছেন; এ জন্য আগে দরকার সরকারি দল বা জোটের ঐকান্তিক সদিচ্ছা। ইভিএম পদ্ধতিতেই নির্বাচন হবে, নাকি ব্যালট পেপারের মাধ্যমে; তাও ওই আলোচনাতেই চূড়ান্ত করা সম্ভব। তবে এ কথা সত্য, ইভিএম পদ্ধতি আমাদের বাস্তবতায় আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য যে প্রযুক্তি জ্ঞানে দক্ষ জনবল দরকার তা তো নেই-ই; প্রাতিষ্ঠানিক আরও নানা দিকেই এ ব্যাপারে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। তাই এ পথে পা না বাড়িয়ে রাজনৈতিক জটিলতা আর না বাড়ানোই শ্রেয়।

ইভিএমে ভোট গ্রহণকে আমরা ই-ভোটিং বলতে পারি না। কেননা ই-ভোটিং হতে হলে তাতে কম্পিউটার ব্যবহারের প্রসঙ্গ এসে যায়। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ইভিএমের অধিকতর স্বচ্ছতা, নির্ভরযোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা ও শতভাগ বিশুদ্ধতার জন্যে কম্পিউটারের সাপোর্ট প্রয়োজন হতে পারে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে ভোটারদের অভিমত, রাজনৈতিক দলগুলোর অভিমত, সরকার ও বিরোধী দলের মতামত, সুশীল সমাজের মতামত তথা সব অংশীজনের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ইভিএমের ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হলে এ নিয়ে আর বিতর্ক হবে না। আগামী জাতীয় নির্বাচনে সব আসনে ইভিএম এ ভোট গ্রহণ খুবই চ্যালেঞ্জের বিষয়। একে তো প্রশিক্ষিত দক্ষ লোকবলের ঘাটতি অন্যদিকে মেশিনেরও অপ্রতুলতা। তবে পদ্ধতি যাই হোক না কেন গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে নিরপেক্ষ, অবাধ, সৎ ও নির্ভরযোগ্য অনুশীলনে যদি নির্বাচন পরিচালিত হয়- তাহলেই কোন সংশয়, সন্দেহ থাকবে না। নির্বাচনে স্বচ্ছতা আসবে, পাশাপাশি গণতন্ত্রের ভিতও শক্তিশালী হবে। কোন বিশেষ পদ্ধতির ব্যাপারকে নিয়ে কোন বিতর্কে জালে জড়িয়ে পরিবেশ ও পরিস্থিতি জটিল করে তোলা কোনভাবে শোভনীয় ও কাম্য নয়।

[লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ইভিএমে আস্থার সংকট

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

রোববার, ২২ মে ২০২২

সংবিধান অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং শুধু সংবিধান ও সংশ্লিষ্ট আইনের অধীনে তা পালন করতে হবে। সাংবিধানিক এই গুরুদায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নির্বাচন ব্যবস্থাপনার প্রতিটি অনুষঙ্গের কার্যকারিতা প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করে চিহ্নিত বাধাসমূহ অপসারণ কমিশনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নততর পদ্ধতি ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহার তাই কমিশনের কর্মকৌশলের অন্যতম প্রধান উপাদান। এই প্রেক্ষিতেই কমিশন বিগত ২০০৯ সাল থেকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে আসছে। সার্কভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বাদে আর সব দেশেই নির্বাচনে কাগজের ব্যালট ব্যবহারের পরিবর্তে ইভিএমএর মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ব্যালট ব্যবহার শুরু হয়েছে। পাকিস্তানও তাদের আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে চায় এবং সে লক্ষ্যে তারা কিছু কাল পূর্বে ওই মেশিন সংগ্রহের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করেছে।

ভোট গ্রহণে ইভিএম পদ্ধতি যে ত্রুটিমুক্ত নয়, তা বিভিন্ন দেশে প্রমাণিত একথা বলাই বাহুল্য। এ কারণে অনেক দেশে ইভিএমে ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যে ভোটপ্রদানের সঙ্গে সঙ্গে একটি কাগজের স্লিপ বেরিয়ে আসে এবং সেটি ব্যালট বাক্সে ফেলা হয়। অর্থাৎ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য দুই ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে। এজন্য পছন্দের প্রার্থীকে দেওয়া ভোট মেশিনের পাশাপাশি ছাপা কাগজেও যাতে সংরক্ষিত হয় এবং ভোটদাতা তার প্রমাণ পায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে ভোটারদের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। সব মিলে এ ক্ষেত্রে একটি চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকা প্রয়োজন।

তবে ইভিএম ভোট গ্রহণের একটি পদ্ধতি মাত্র। যদি অংগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা না যায় এবং হৃত আস্থা পুনরুদ্ধারে নতুন নির্বাচন কমিশন দৃষ্টান্ত দাঁড় করাতে না পারে, তাহলে যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন হোক না কেন; এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন-বিতর্ক নিরসন করা যাবে না। নতুন নির্বাচন কমিশনের পরীক্ষাটা হলো- তাদের যে মুখ্য কাজ প্রশ্নমুক্ত, স্বচ্ছ নির্বাচন করা এবং নির্বাচনে অংশীজন সবার জন্য মাঠ সমতল রাখা; সে ক্ষেত্রে তারা শতভাগ সফল কিনা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তাদের প্রস্তুতি কতটা আছে কিংবা তারা কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সংবিধান প্রদত্ত দায়িত্ব রক্ষায় এসব বিষয় তাদের কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে পৃথিবীর যতগুলো দেশ ইভিএম গ্রহণ করেছে, তার চেয়ে বেশি দেশ ইভিএম বাতিল করেছে।

বাতিল করেছে এমন দেশের তালিকায় আছে জার্মানি, স্পেন, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, নরওয়ে, ভেনেজুয়েলা, ইউক্রেন, মালয়েশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো রাজ্য। সম্প্রতি ভারতেও বিরোধী দলগুলো ইভিএমের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। বর্তমানে পুরোপুরি ইভিএম চালু আছে শুধুমাত্র ভারত, ব্রাজিল, ফিলিপাইন এবং এস্তোনিয়ায়। ভোট ব্যবস্থাপনাকে সহজতর করার লক্ষ্য থেকেই সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম পদ্ধতি চালু হয়। ইভিএম পদ্ধতির সময়কাল প্রায় ৬০ বছর অতিক্রান্ত হলেও বিশ্বের কোন দেশেই পুরোপুরি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি এটি। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৪টি দেশ ইভিএম ব্যবহার বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। এর মধ্যে ১৪টি দেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। ১১টি দেশে আংশিক ব্যবহার হচ্ছে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ৫টি দেশে। ভারতের ইকোনমিক টাইমস পত্রিকার অনুসন্ধানী রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে মাত্র যে ৪টি দেশে ইভিএম ব্যবহার করা হয়, সে সব দেশেও এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা আছে।

ইভিএম ভোট গ্রহণের একটি পদ্ধতি মাত্র। যদি অংগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা না যায় এবং হৃত আস্থা পুনরুদ্ধারে নতুন নির্বাচন কমিশন দৃষ্টান্ত দাঁড় করাতে না পারে, তাহলে যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন হোক না কেন; এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন-বিতর্ক নিরসন করা যাবে না

ভোটের মাঠে সরেজমিনে ইভিএমের বেশকিছু দুর্বল দিক পাওয়া গেছে। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে ইভিএমে ভোট নেয়া কেন্দ্রগুলোতে ধীরগতি দেখা গেছে। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে- বয়স্ক, বিশেষ করে নারী ভোটারদের আঙ্গুলের ছাপ না মেলা। এ জন্য ভোটই দিতে পারেননি অনেকে। অবশ্য মেশিন ব্যবহারে ভোটারদের অনভ্যস্ততার কারণেও ভোট পড়ার গতি কমতে দেখা গেছে। সদ্যসমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও পৌরসভার ভোটেও ব্যালটের চেয়ে ইভিএমে ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত কম ভোট পড়েছে। এমন অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমে ভোট হলে স্বাভাবিকভাবেই অনেক ভোটারের ভোট দেয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে, যা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ইভিএম বিতর্ক যেমন নতুন নয়; তেমনি অস্বচ্ছ নির্বাচন নিয়ে বিতর্কও পুরোনো। নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক এবং প্রশ্নমুক্ত না হয়, তাহলে যত আধুনিক পদ্ধতিই গ্রহণ করা হোক না কেন; রাজনৈতিক জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না। আমাদের বিভাজিত রাজনীতি জাতীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তো বটেই; একই সঙ্গে জাতীয় সংহতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্রেও বড় প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। রাজনীতির মাঠ সমতল করে, অধিকাংশ ভোটারের ক্ষেত্রে বৈষম্যের নিরসন ঘটিয়ে জনমনে সৃষ্ট আস্থাহীনতা দূর করে দেশ-জাতির উন্নয়নে সবাইকে শরিক করে এগোতে পারলে এর আরও বড় সুফলভোগী হবো আমরা। সিইসি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে মতামত দিতে পারবে। তিনি বলেন, শুদ্ধ ও সঠিক ভোটার তালিকা ছাড়া প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই এ কাজটি আমরা সঠিকভাবে করার চেষ্টা করছি। ২০ মে থেকে সারা দেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করবে নির্বাচন কমিশন। এ ক্ষেত্রে চার ধাপে এ কর্মসূচি সম্পন্ন করা হবে। প্রথম ধাপে ১৪০ উপজেলায় কার্যক্রম চলবে ২০ মে থেকে ৯ জুন পর্যন্ত।” নির্বাচন কমিশনের এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের জন্য এক শুভসূচনা ও ভোটারদের স্বস্তির-বিষয়।

রাজনৈতিক দলগুলো ও ভোটারদের আস্থা অর্জন ছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা উচিত হবে না। এজন্য ভোটারদের সন্দেহ দূর করে আস্থায় ফেরানোকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। ইভিএমের মেমোরি কার্ডের মাধ্যমে নির্বাচনে কারচুপি করার সুযোগ আছে বলে মনে করেন অনেক ভোটার। ভোটারদের এ সন্দেহ দূর করা না গেলে ইভিএমে ভোট গ্রহণের পর নির্বাচনের ফলাফল বিতর্কিত হতে পারে। গণতন্ত্রের স্বার্থে, সুস্থ ধারার রাজনীতির প্রয়োজনে সর্বাগ্রে স্বচ্ছ, প্রশ্নমুক্ত, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে। পরস্পরকে উদার মনোভাব নিয়ে আলোচনায় বসে প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসান ঘটাতে হবে। সবাইকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করার চেষ্টা চালানোর যে কথা বলেছেন; এ জন্য আগে দরকার সরকারি দল বা জোটের ঐকান্তিক সদিচ্ছা। ইভিএম পদ্ধতিতেই নির্বাচন হবে, নাকি ব্যালট পেপারের মাধ্যমে; তাও ওই আলোচনাতেই চূড়ান্ত করা সম্ভব। তবে এ কথা সত্য, ইভিএম পদ্ধতি আমাদের বাস্তবতায় আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য যে প্রযুক্তি জ্ঞানে দক্ষ জনবল দরকার তা তো নেই-ই; প্রাতিষ্ঠানিক আরও নানা দিকেই এ ব্যাপারে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। তাই এ পথে পা না বাড়িয়ে রাজনৈতিক জটিলতা আর না বাড়ানোই শ্রেয়।

ইভিএমে ভোট গ্রহণকে আমরা ই-ভোটিং বলতে পারি না। কেননা ই-ভোটিং হতে হলে তাতে কম্পিউটার ব্যবহারের প্রসঙ্গ এসে যায়। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ইভিএমের অধিকতর স্বচ্ছতা, নির্ভরযোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা ও শতভাগ বিশুদ্ধতার জন্যে কম্পিউটারের সাপোর্ট প্রয়োজন হতে পারে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে ভোটারদের অভিমত, রাজনৈতিক দলগুলোর অভিমত, সরকার ও বিরোধী দলের মতামত, সুশীল সমাজের মতামত তথা সব অংশীজনের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ইভিএমের ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হলে এ নিয়ে আর বিতর্ক হবে না। আগামী জাতীয় নির্বাচনে সব আসনে ইভিএম এ ভোট গ্রহণ খুবই চ্যালেঞ্জের বিষয়। একে তো প্রশিক্ষিত দক্ষ লোকবলের ঘাটতি অন্যদিকে মেশিনেরও অপ্রতুলতা। তবে পদ্ধতি যাই হোক না কেন গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে নিরপেক্ষ, অবাধ, সৎ ও নির্ভরযোগ্য অনুশীলনে যদি নির্বাচন পরিচালিত হয়- তাহলেই কোন সংশয়, সন্দেহ থাকবে না। নির্বাচনে স্বচ্ছতা আসবে, পাশাপাশি গণতন্ত্রের ভিতও শক্তিশালী হবে। কোন বিশেষ পদ্ধতির ব্যাপারকে নিয়ে কোন বিতর্কে জালে জড়িয়ে পরিবেশ ও পরিস্থিতি জটিল করে তোলা কোনভাবে শোভনীয় ও কাম্য নয়।

[লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top