alt

উপ-সম্পাদকীয়

সুশীল সমাজের বিকাশ কেন জরুরি

শেখর ভট্টাচার্য

: বৃহস্পতিবার, ২৬ মে ২০২২

সুশীল সমাজ। মূল্যবোধের ব্যরোমিটার হাতে সমাজকে তারা পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। সতর্ক প্রহরী, ইংরেজিতে বলা হয় সমাজের ‘ওয়াচ ডগ’। সিভিল সোসাইটিকে ভাষান্তর করে সুশীল সমাজ বলি আমরা। ভাষান্তরিত আরও নাম আছে জনসমাজ, নাগরিক সমাজ ইত্যাদি। সমাজে সব চেয়ে সক্রিয় এবং প্রভাব বিস্তারকারী দুটি শক্তি কেন্দ্র আছে। একটি হলো ‘রাষ্ট্র’, অন্যটি ‘বাজার’। এর বাইরে একটি তৃতীয় শক্তি, স্রোতধারা অথবা প্রবণতা যা-ই বলা হোক না কেন তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। স্বতপ্রণোদিত হয়ে সমাজের বিবেক হিসেবে সমাজ প্রগতির বাধা নিরসনের জন্য তারা কাজ করে যান, এই তৃতীয় ধারাই হলো সুশীল সমাজ। সুশীল সমাজের অংশীজন কারা? সাধারণত বিদ্বজন, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার, জেন্ডার, পরিবেশ, শান্তি ইত্যাদি ইস্যুতে কর্মরত বিবেকতাড়িত নাগরিক সমাজের সদস্যরা। সমাজ যাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের নিঃস্বার্থ নিরপেক্ষ ভূমিকার জন্য, চরিত্রের স্বচ্ছতার জন্য নাগরিকেরা যাদের আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করে থাকেন তারাই সুশীল সমাজের সদস্য।

সুশীল সমাজকে যদি আমরা বিবেকতাড়িত নাগরিক, বিদ্বজন, স্বশিক্ষিত মানুষ, সমাজ একসময় যাদের স্বভাব নেতা হিসেবে চিহ্নিত করত, সেরকম নাগরিক কিংবা জোটবদ্ধ সমাজের মতো ভাবি, তাহলে আমাদের এই দেশে শতাধিক বছর পূর্ব থেকে সুশীল সমাজ সক্রিয় রয়েছে। আমাদের গ্রামীণ সমাজে কিছু স্বভাব নেতা আছেন তারা সামাজিক কাজ স্বেচ্ছায়, অন্তরের টানে সমাধান করে আসছেন প্রাক-ব্রিটিশ আমল থেকে। এক সময় তাদের কাজ ছিলো পাড়া প্রতিবেশীদের জন্য পানিয় জলের ব্যবস্থা করা, এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যাওয়ার জন্য ছোট, ছোট সেতু নির্মাণ করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন পাঠশালা বা টোল অথবা মক্তব প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ জনকল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করা। প্রান্তিক মানুষের কন্যাসন্তানের বিয়ের সামগ্রিক ব্যবস্থা, যে কোন প্রতিবেশীর পারিবারিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার দায়িত্বে নিজেরাই গ্রহণ করতেন। অনেকটা বাংলা এই প্রবাদের মতো, ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’। সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়ে আধুনিক বিশ্বে ব্যাপক আলোচনা হয়ে থাকলেও আমাদের দেশে ‘সুশীল’ নাম ধারণ না করেও বহু কাল থেকে সমাজের কিছু ‘স্বভাব নেতা’ জনসমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করে আসছেন। সুশীল সমাজের আলোচনায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবহ এই ‘স্বতপ্রণোদিত সমাজ’ বিষয়ে খুব একটা আলোচনা শুনতে পাই না।

ব্রিটিশ-ভারতে আমরা সরকার আর রাজনৈতিক দলের বাইরে এক বিদ্বৎসমাজের অস্তিত্ব দেখতে পেয়েছিলাম, যারা অনেকটা সামাজিক ভালোমন্দের তথা অনুশাসনের দেখভাল করতেন, অনেক সময় সরকারকে সহায়তা করতেন, তবে বেশিরভাগ সময় সাধারণ লোকের ওপর সরকার, সরকারি প্রতিষ্ঠান তথা সরকারি লোকের বাড়াবাড়ির নজরদারি করতেন। আমরা মহাত্মা গান্ধী এমনকি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও এই বিদ্বৎসমাজের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাই। তারা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং তৎপরবর্তীতে সামাজিক তথা রাজনৈতিক অনুশাসন বলয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরও আমরা আমাদের ভৌগোলিক সীমানায় শিক্ষক, আইনজীবী, বিচারক এমনকি কিছু চিকিৎসক ও সংস্কৃতিকর্মীর সমন্বয়ে একটি বিদ্বৎসমাজ তথা নাগরিক সমাজের সরব উপস্থিতি দেখতে পাই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বিশেষ করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিক দর্শন বিনির্মাণে তাদের ভূমিকা ছিল উচ্চকিত।

১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের দার্শনিক প্রেক্ষাপট রচনায় আমাদের সুশীল সমাজের ভূমিকা ছিলো উল্লেখযোগ্য। একইভাবে পরবর্তী সকল আন্দোলনে জাতীয় সংহতি বিনির্মাণ, দার্শনিক দিকনির্দেশনা প্রদানের ক্ষেত্রে তারাই জাতির অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দর্শনকে দৃশ্যমান করে তোলেন সুশীল সমাজের সদস্যরা। বহুমত ও বহুদলে বিভক্ত একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে সুশীল সমাজ জাতীয় অধিকারের বিষয়টি সবার সামনে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে সমর্থ হন। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তারা পাকিস্তানিদের দ্বারা শোষণ ও নির্যাতনকে নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহজভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করেন। অর্থনিতিক ক্ষেত্রে বঞ্চনার অবসানের জন্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা যে অত্যন্ত জরুরি ছিল- এ বিষয়টিকে তারা আলোচনায় নিয়ে আসেন। ধর্মের নামে শোষণ, নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার দাবির যৌক্তিকতা সহজ ভাবে মানুষকে উপলব্ধি করাতে সমর্থ হন। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কারণে পাকিস্তানি শাসকেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের যে অন্যায়ভাবে অধিকার বঞ্চিত করছে সে বিষয়টি দক্ষতার সঙ্গে আন্দোলনের মূল বিষয় হিসেবে যুক্ত করতে সমর্থ হন। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এ সমস্ত দাবির ভিত্তিতে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলে আর বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলনের রাজনৈতিক দর্শন ব্যাখ্যা করে আন্দোলনকে বেগবান করে তোলেন।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সাধারণ মানুষদের প্রত্যাশা ছিলো জাতীয় ও আঞ্চলিক সংকটে সুশীল সমাজ উজ্জ্বলতর ভূমিকা পালন করে যাবেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় স্বাধীন বাংলাদেশে সুশীল সমাজের ভাবমূর্তি খুব একটা উজ্জ্বল নয়। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর থেকে জাতির মধ্যে নানারকমের বিভক্তি তৈরি করা হয়। বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে অদম্য দেশপ্রেম নিয়ে এক অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছিলো, সে জাতিয় ঐক্যকে দেশ গঠনের কাজে ব্যবহারের এক অপূর্ব সুযোগও তৈরি হয়েছিলো। যে আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো, তার প্রতিফলন ঘটেছিলো বায়াত্তরের সংবিধানে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেই সংবিধানের খোলনলচে পালটে ফেলা হয়। সামরিক শাসনের ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক দল গুলোতে আসে নানা বিভক্তি। একইভাবে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা নানামতে, নানাপথে বিভক্ত হতে থাকেন। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে যেভাবে সুশীল সমাজের প্রতি মানুষের আস্থা ছিলো, স্বাধীন বাংলাদেশে অনেকেই স্বাধীনতার মৌলনীতির সঙ্গে বিরোধিতা করায় আস্থা ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে। এ ছাড়াও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তাদের নির্মোহ, নিরাপোস ভূমিকা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

জাতীয়ভাবে নানা বিভক্তি সৃষ্টির কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকৃত সুশীল সমাজ গড়ে ওঠার সব সম্ভাবনা বিলীন হয়ে যায়। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে তরুণ সমাজ যে সমস্ত মহৎ নাগরিকদের অনুসরন করে এগিয়ে যেতেন তাদের অনেককেই পরিকল্পিতভাবে একাত্তরের ডিসেম্বরে হত্যা করা হয়, যাতে করে দেশ স্বাধীন হলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ও নৈতিক ভিত্তি গড়ে না ওঠে। আবার পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজনীতিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা চালানো হয় একই কারনে নাগরিক সমাজের বিকাশকেও গলাটিপে ধরা হয়। জাতীয়ভাবে বাংলাদেশ দার্শনিক অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে। বর্তমানে যারা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বলে নিজেদের দাবি করে থাকেন তাদের অধিকাংশই দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে থাকেন। স্বতপ্রণোদিত হয়ে জাতির বিবেক হয়ে এখন আর সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের জোটবদ্ধ হতে দেখা যায় না। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি দাবি করে যারা নানা সময়ে নানা উপদেশ বিলি করেন তাদের নাম শুনে, তাদের বক্তব্যের ধরন দেখে জনগণ বুঝতে পারে তারা আসলে কার এজেন্ডা বা স্বার্থসিদ্ধির জন্য সময়ে সময়ে সক্রিয় সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

জাতি হিসাবে পথ নির্দেশনা পাওয়ার জন্য নাগরিক সমাজের বিকাশের প্রয়োজন রয়েছে। যে জাতির দার্শনিক দিক নির্দেশনা অনুপস্থিত থাকে সে জাতির এগিয়ে যাওয়ার পথও ভঙ্গুর, মূল্যবোধহীন হয়ে থাকে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা প্রদান করার জন্য আমাদের চাই শহীদ মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সার, দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মতো নির্ভীক এবং নিরাপোস আলোক সন্ধানী মানুষ। মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে বলে আজ আমরা যতই রোদন করি না কেন, মানবিক উন্নয়নের জন্য আমাদের নিঃস্বার্থ, বিদ্বান, দলমতের ঊর্ধ্বে ওঠে ত্যাগী মনোভাব নিয়ে কাজ করা নাগরিক সমাজের খুব প্রয়োজন। নাগরিক সমাজ ইচ্ছে করলেই গড়ে তোলা যায় না। সুষ্ঠু গণতন্ত্র বিকাশের পথকে মসৃণ করার প্রচেষ্টা থাকলে হয়তো আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজের দেখা পাওয়া যেতে পারে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শুভ সময়ের প্রত্যাশায় থাকলাম।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সুশীল সমাজের বিকাশ কেন জরুরি

শেখর ভট্টাচার্য

বৃহস্পতিবার, ২৬ মে ২০২২

সুশীল সমাজ। মূল্যবোধের ব্যরোমিটার হাতে সমাজকে তারা পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। সতর্ক প্রহরী, ইংরেজিতে বলা হয় সমাজের ‘ওয়াচ ডগ’। সিভিল সোসাইটিকে ভাষান্তর করে সুশীল সমাজ বলি আমরা। ভাষান্তরিত আরও নাম আছে জনসমাজ, নাগরিক সমাজ ইত্যাদি। সমাজে সব চেয়ে সক্রিয় এবং প্রভাব বিস্তারকারী দুটি শক্তি কেন্দ্র আছে। একটি হলো ‘রাষ্ট্র’, অন্যটি ‘বাজার’। এর বাইরে একটি তৃতীয় শক্তি, স্রোতধারা অথবা প্রবণতা যা-ই বলা হোক না কেন তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। স্বতপ্রণোদিত হয়ে সমাজের বিবেক হিসেবে সমাজ প্রগতির বাধা নিরসনের জন্য তারা কাজ করে যান, এই তৃতীয় ধারাই হলো সুশীল সমাজ। সুশীল সমাজের অংশীজন কারা? সাধারণত বিদ্বজন, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার, জেন্ডার, পরিবেশ, শান্তি ইত্যাদি ইস্যুতে কর্মরত বিবেকতাড়িত নাগরিক সমাজের সদস্যরা। সমাজ যাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের নিঃস্বার্থ নিরপেক্ষ ভূমিকার জন্য, চরিত্রের স্বচ্ছতার জন্য নাগরিকেরা যাদের আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করে থাকেন তারাই সুশীল সমাজের সদস্য।

সুশীল সমাজকে যদি আমরা বিবেকতাড়িত নাগরিক, বিদ্বজন, স্বশিক্ষিত মানুষ, সমাজ একসময় যাদের স্বভাব নেতা হিসেবে চিহ্নিত করত, সেরকম নাগরিক কিংবা জোটবদ্ধ সমাজের মতো ভাবি, তাহলে আমাদের এই দেশে শতাধিক বছর পূর্ব থেকে সুশীল সমাজ সক্রিয় রয়েছে। আমাদের গ্রামীণ সমাজে কিছু স্বভাব নেতা আছেন তারা সামাজিক কাজ স্বেচ্ছায়, অন্তরের টানে সমাধান করে আসছেন প্রাক-ব্রিটিশ আমল থেকে। এক সময় তাদের কাজ ছিলো পাড়া প্রতিবেশীদের জন্য পানিয় জলের ব্যবস্থা করা, এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যাওয়ার জন্য ছোট, ছোট সেতু নির্মাণ করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন পাঠশালা বা টোল অথবা মক্তব প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ জনকল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করা। প্রান্তিক মানুষের কন্যাসন্তানের বিয়ের সামগ্রিক ব্যবস্থা, যে কোন প্রতিবেশীর পারিবারিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার দায়িত্বে নিজেরাই গ্রহণ করতেন। অনেকটা বাংলা এই প্রবাদের মতো, ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’। সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়ে আধুনিক বিশ্বে ব্যাপক আলোচনা হয়ে থাকলেও আমাদের দেশে ‘সুশীল’ নাম ধারণ না করেও বহু কাল থেকে সমাজের কিছু ‘স্বভাব নেতা’ জনসমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করে আসছেন। সুশীল সমাজের আলোচনায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবহ এই ‘স্বতপ্রণোদিত সমাজ’ বিষয়ে খুব একটা আলোচনা শুনতে পাই না।

ব্রিটিশ-ভারতে আমরা সরকার আর রাজনৈতিক দলের বাইরে এক বিদ্বৎসমাজের অস্তিত্ব দেখতে পেয়েছিলাম, যারা অনেকটা সামাজিক ভালোমন্দের তথা অনুশাসনের দেখভাল করতেন, অনেক সময় সরকারকে সহায়তা করতেন, তবে বেশিরভাগ সময় সাধারণ লোকের ওপর সরকার, সরকারি প্রতিষ্ঠান তথা সরকারি লোকের বাড়াবাড়ির নজরদারি করতেন। আমরা মহাত্মা গান্ধী এমনকি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও এই বিদ্বৎসমাজের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাই। তারা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং তৎপরবর্তীতে সামাজিক তথা রাজনৈতিক অনুশাসন বলয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরও আমরা আমাদের ভৌগোলিক সীমানায় শিক্ষক, আইনজীবী, বিচারক এমনকি কিছু চিকিৎসক ও সংস্কৃতিকর্মীর সমন্বয়ে একটি বিদ্বৎসমাজ তথা নাগরিক সমাজের সরব উপস্থিতি দেখতে পাই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বিশেষ করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিক দর্শন বিনির্মাণে তাদের ভূমিকা ছিল উচ্চকিত।

১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের দার্শনিক প্রেক্ষাপট রচনায় আমাদের সুশীল সমাজের ভূমিকা ছিলো উল্লেখযোগ্য। একইভাবে পরবর্তী সকল আন্দোলনে জাতীয় সংহতি বিনির্মাণ, দার্শনিক দিকনির্দেশনা প্রদানের ক্ষেত্রে তারাই জাতির অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দর্শনকে দৃশ্যমান করে তোলেন সুশীল সমাজের সদস্যরা। বহুমত ও বহুদলে বিভক্ত একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে সুশীল সমাজ জাতীয় অধিকারের বিষয়টি সবার সামনে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে সমর্থ হন। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তারা পাকিস্তানিদের দ্বারা শোষণ ও নির্যাতনকে নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহজভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করেন। অর্থনিতিক ক্ষেত্রে বঞ্চনার অবসানের জন্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা যে অত্যন্ত জরুরি ছিল- এ বিষয়টিকে তারা আলোচনায় নিয়ে আসেন। ধর্মের নামে শোষণ, নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার দাবির যৌক্তিকতা সহজ ভাবে মানুষকে উপলব্ধি করাতে সমর্থ হন। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কারণে পাকিস্তানি শাসকেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের যে অন্যায়ভাবে অধিকার বঞ্চিত করছে সে বিষয়টি দক্ষতার সঙ্গে আন্দোলনের মূল বিষয় হিসেবে যুক্ত করতে সমর্থ হন। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এ সমস্ত দাবির ভিত্তিতে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলে আর বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলনের রাজনৈতিক দর্শন ব্যাখ্যা করে আন্দোলনকে বেগবান করে তোলেন।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সাধারণ মানুষদের প্রত্যাশা ছিলো জাতীয় ও আঞ্চলিক সংকটে সুশীল সমাজ উজ্জ্বলতর ভূমিকা পালন করে যাবেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় স্বাধীন বাংলাদেশে সুশীল সমাজের ভাবমূর্তি খুব একটা উজ্জ্বল নয়। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর থেকে জাতির মধ্যে নানারকমের বিভক্তি তৈরি করা হয়। বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে অদম্য দেশপ্রেম নিয়ে এক অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছিলো, সে জাতিয় ঐক্যকে দেশ গঠনের কাজে ব্যবহারের এক অপূর্ব সুযোগও তৈরি হয়েছিলো। যে আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো, তার প্রতিফলন ঘটেছিলো বায়াত্তরের সংবিধানে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেই সংবিধানের খোলনলচে পালটে ফেলা হয়। সামরিক শাসনের ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক দল গুলোতে আসে নানা বিভক্তি। একইভাবে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা নানামতে, নানাপথে বিভক্ত হতে থাকেন। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে যেভাবে সুশীল সমাজের প্রতি মানুষের আস্থা ছিলো, স্বাধীন বাংলাদেশে অনেকেই স্বাধীনতার মৌলনীতির সঙ্গে বিরোধিতা করায় আস্থা ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে। এ ছাড়াও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তাদের নির্মোহ, নিরাপোস ভূমিকা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

জাতীয়ভাবে নানা বিভক্তি সৃষ্টির কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকৃত সুশীল সমাজ গড়ে ওঠার সব সম্ভাবনা বিলীন হয়ে যায়। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে তরুণ সমাজ যে সমস্ত মহৎ নাগরিকদের অনুসরন করে এগিয়ে যেতেন তাদের অনেককেই পরিকল্পিতভাবে একাত্তরের ডিসেম্বরে হত্যা করা হয়, যাতে করে দেশ স্বাধীন হলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ও নৈতিক ভিত্তি গড়ে না ওঠে। আবার পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজনীতিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা চালানো হয় একই কারনে নাগরিক সমাজের বিকাশকেও গলাটিপে ধরা হয়। জাতীয়ভাবে বাংলাদেশ দার্শনিক অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে। বর্তমানে যারা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বলে নিজেদের দাবি করে থাকেন তাদের অধিকাংশই দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে থাকেন। স্বতপ্রণোদিত হয়ে জাতির বিবেক হয়ে এখন আর সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের জোটবদ্ধ হতে দেখা যায় না। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি দাবি করে যারা নানা সময়ে নানা উপদেশ বিলি করেন তাদের নাম শুনে, তাদের বক্তব্যের ধরন দেখে জনগণ বুঝতে পারে তারা আসলে কার এজেন্ডা বা স্বার্থসিদ্ধির জন্য সময়ে সময়ে সক্রিয় সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

জাতি হিসাবে পথ নির্দেশনা পাওয়ার জন্য নাগরিক সমাজের বিকাশের প্রয়োজন রয়েছে। যে জাতির দার্শনিক দিক নির্দেশনা অনুপস্থিত থাকে সে জাতির এগিয়ে যাওয়ার পথও ভঙ্গুর, মূল্যবোধহীন হয়ে থাকে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা প্রদান করার জন্য আমাদের চাই শহীদ মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সার, দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মতো নির্ভীক এবং নিরাপোস আলোক সন্ধানী মানুষ। মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে বলে আজ আমরা যতই রোদন করি না কেন, মানবিক উন্নয়নের জন্য আমাদের নিঃস্বার্থ, বিদ্বান, দলমতের ঊর্ধ্বে ওঠে ত্যাগী মনোভাব নিয়ে কাজ করা নাগরিক সমাজের খুব প্রয়োজন। নাগরিক সমাজ ইচ্ছে করলেই গড়ে তোলা যায় না। সুষ্ঠু গণতন্ত্র বিকাশের পথকে মসৃণ করার প্রচেষ্টা থাকলে হয়তো আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজের দেখা পাওয়া যেতে পারে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শুভ সময়ের প্রত্যাশায় থাকলাম।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top