alt

উপ-সম্পাদকীয়

করোনার চতুর্থ ঢেউ : আশঙ্কা ও টিকার কার্যকারিতা

ইকবাল কবীর জাহিদ

: শুক্রবার, ০১ জুলাই ২০২২

বেশ কিছুদিন বাংলাদেশের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। করোনার শনাক্তের সংখ্যা শূন্য নেমে গিয়েছিল। আমরা যারা করোনা নিয়ে গবেষণা করি তারা অতটা আশাবাদী ছিলাম না। পৃথিবীর গড়ে ৬৫ ভাগের কাছাকাছি মানুষ করোনার এক ডোজ টিকা নিয়েছে। কিন্তু এই হার পৃথিবীব্যাপী সমান নয়। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশসমূহে মাত্র ১৭ ভাগ টিকা দেয়া হয়েছে। করোনা ভ্যাকসিন ডাটা সেটে দেখলে বাংলাদেশের মানুষ গর্ববোধ করবে এই কারণে যে, পৃথিবীর ১৬তম দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একই পর্যায়ে ৭৮ ভাগ একডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছে বরং দুই ডোজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আমেরিকা থেকেও এগিয়ে আছে। এটিকে সরকারের একটি বড় সাফল্য হিসেবে ধরা যেতে পারে। ঠিক যে সময় সমগ্র দেশের মানুষ পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সুখ পূর্ণাঙ্গভাবে অনুভব করতে পারছে না সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা ও করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের হাতছানি। কেন? এত টিকা নেয়ার পরেও চতুর্থ ঢেউ? এতে ক্ষতির আশঙ্কা কতটা? বিশ্বের অন্যান্য দেশের পরিসংখ্যান কী বলে? আমরা কি ধারণা করতে পারি না?

বাংলাদেশের পরিসংখ্যান কি উদ্বেগের? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যে ওয়েবসাইটে করোনার প্রতিদিনের রিপোর্ট দেয়া হয় সেটি দেখলে সহজেই বোঝা যায় ২০২১ সালে যে সময় করোনার ডেল্টা ঢেউ শুরু হয়েছিল, এটি সেই একই সময়। ২৫ ফেব্রুয়ারির পর এত দ্রুত পজিটিভ রেট ১৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা এক সপ্তাহ আগেও ৫ শতাংশ ছিল। গত সপ্তাহের কেস বৃদ্ধির হার ৩৮৩ শতাংশ, যা সত্যিই উদ্বেগের। এই বৃদ্ধির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার আগে ওমিক্রনের কি কি ভাগ সেটি জানা জরুরি।

ওমিক্রনের সাব-ভ্যারিয়্যান্ট কি?

এই মুহূর্তে ওমিক্রনের ৫টি সাব-ভ্যারিয়েন্ট আছে যাকে বিজ্ঞানীরা BA1, BA2, BA3, BA4 + BA5 বলেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্নটি এই মুহূর্তে বিচরণ করছে। যেমন যুক্তরাজ্যে BA1 প্রাধান্য বিস্তার করলেও BA4 ও BA5 যথাক্রমে ৬ ও ৯ ভাগ। বাংলাদেশের ১১টি নমুনায় ৯১ ভাগ BA2 ও ৯ ভাগে BA5 পাওয়া গেছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ০২টি নমুনা BA4/5 পাওয়া গেছে। BA4 ও BA5 সর্বপ্রথম দক্ষিণ আফ্রিকাতে পাওয়া যায় জানুয়ারিতে ও ফেব্রুয়ারি মাসে। তখন মাত্র ১ ভাগ ছিল BA4, যা এপ্রিলে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশ। একইভাবে BA5 ২০ ভাগে উন্নত হয়েছে এপ্রিলে। ইউরোপীয়ান সেন্টার ফর ডিজিসেস প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল ইতোমধ্যে BA4 ও ৫ কে উদ্বেগের ভ্যারিয়ান্ট বলছে। বর্তমানে পর্তুগালে ৩৫ ভাগ পজিটিভ নমুনায় BA5 পাওয়া যাচ্ছে। এই মুহূর্তের যুক্তরাজ্যের ডাটা হল সেখানকার করোনার শনাক্তের হার দ্বিগুণ BA4 ও BA5-এর কারণে সেখানে ধীরে ধীরে অন্যগুলোকে সরিয়ে BA4 ও BA5 জায়গা করে নিচ্ছে। সিডিসির জুন মাসের ২১ তারিখের রিপোর্ট বলছে BA4 ও ৫-এর কারণে ৩৫ ভাগ নতুন কেস হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এখন প্রশ্ন, কি যোগ্যতা আছে BA4 ও BA5 যার কারণে অন্য সবাইকে পরাজিত করে সমহিমায় এগিয়ে যাচ্ছে মানব সভ্যতাকে গুঁড়িয়ে দিতে?

উপসর্গ কি?

ডেল্টা ও ওমিক্রনের মধ্যে উপসর্গের কিছু পার্থক্য ছিল। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৫৩ ভাগ ডেল্টা রোগী স্বাদ পায় না খাবারে। কিন্তু মাত্র ১৭ ভাগ স্বাদ পায় না ওমিক্রনের। ৭০ ভাগ ওমিক্রনের ক্ষেত্রে গলায় ব্যথা থাকে। কিন্তু ডেল্টাতে তা ৬০ ভাগ। ২ ভাগ ওমিক্রনে হাসপাতালে যায়। কিন্তু ডেল্টায় তা ২.৬ ভাগ। BA4 ও ৫ এর উপসর্গগুলো ডেল্টার কাছাকাছি তুলনামূলকভাবে ওমিক্রনের চেয়ে। যদিও তাদের ওমিক্রন বলা হচ্ছে। ৩০ টিরও অধিক দেশে BA4 ও BA5 ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের মহারাষ্ট্রের মধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে বাংলাদেশে এটি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

BA4 ও BA5-এর অতিরিক্ত যোগ্যতা কি?

যোগ্যতার বিষটি বোঝার জন্য আমাদের দুটি বিষয়ে আলোকপাত করতে হবে। একটি রোগ সৃষ্টি করার সক্ষমতা এবং দ্বিতীয়টি ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতা। প্রথমে আসি ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতায়। এটি বিজ্ঞানীদের ভাষায় বলা হয় প্রজনন সংখ্যা (জড়) যার ব্যাখ্যা হল একজন অসুস্থ ব্যক্তি তার ভাইরাস দ্বারা বিনা বাধায় কতজনকে আক্রান্ত করতে পারে। এই ভাইরাস ১ হতে যত বড় হবে তত দ্রুত ভাইরাস ছড়াবে।

এখন প্রথম যেটি চীন হতে প্রথম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল সেখান হতে হিসাব শুরু করি। যদি কোন ব্যক্তি টিকা গ্রহণ না করে থাকে এবং মাস্ক না পরে তবে বিনা বাধায় প্রথমে ভাইরাসটি পারত ২ জনকে। যেখানে ডেল্টা পারত ৩.৫ থেকে ৪ জনকে। সেখানে ওমিক্রন পারত ডেল্টার চেয়ে ৩-৪ গুণ বেশি। এখন পর্যন্ত সকল ধরনের মধ্যে ওমিক্রনের মতো এত দ্রুত ছড়ানো আর কারো পক্ষে সম্ভব হয় নাই। কিন্তু কেন ওমিক্রন কম ক্ষতিকর? ওমিক্রন মিউটেশনগুলো এমন যে সে উপরের দিকে বেশি থাকে। ফলে হাসপাতালে যাওয়া বা মারা যাওয়ার রেট কম। কিন্তু ডেল্টা দ্বারা দ্বিগুণ হাসপাতালে যাওয়ার রেট পাওয়া গেছে যুক্তরাজ্যে একটি গবেষণায়। ফলে ওমিক্রনের ৪০-৮০ ভাগ হাসপাতালে যাওয়ার সম্ভবনা কম। মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ কম। কিন্তু না? BA4 এবং BA5 কিছু ভিন্নতা আছে। সেটিই আলোচ্য বিষয়। এই দুই ভাইয়ের মা BA2 হলেও তাদের শরীরে তিনটি নতুন মিউটেশন আছে যার একটি ছিল ডেল্টাতে। ফলে সাধারণ মানুষের ভাষায় এটিকে ওমিক্রনের সঙ্গে ডেল্টার কিছু বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভাইরাস বলা যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সরাসরি ডেল্টাক্রন বা ক্রনডেল্টা বলছেন না। তার তিনটি প্রধান মিউটেশনের, যা ওমিক্রনের জন্য তার একটি ডেল্টার? আমি এখানে পাঠকের জন্য নম্বরটি বলব সেটিকে বলে L452R. এই মিউটেশনের ফলে ভাইরাসটি বেশি শক্তিশালী হয়, কারণ মানুষের কোষে বেশি আটকাতে পারে। তার আরও একটি মিউটেশন আছে যেটিকে বলে F486v. এটির কারণে আপনার পূর্বে করোনা হয়েছিল কিংবা টিকা নিয়েছেন, সেটিকে ভাইরাস ফাঁকি দিয়ে আপনার শরীরে ঢুকতে পারবে। চোর যদি সিঁধ কেটে আপনার ঘরে ঢোকে, আপনি টের পাওয়ার আগে সে ক্ষতিও করে ফেলতে পারে। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা ২ থেকে ৫ ভাগ বেশি অন্যান্য ওমিক্রনের তুলনায়। ফলে বুঝতেই পারে দুই দুইটি মারাত্মক অস্ত্র, একটি হল ছড়ানোর ক্ষমতা আর একটি হল টিকা বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাকি দেওয়ার ক্ষমতায় এই দুই ভাইকে করে তুলেছে অনন্য।

টিকা কি কার্যকরি?

সম্পূর্ণভাবে টিকাবিহীন ব্যক্তির তুলনায় যিনি দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন তিনি অবশ্যই বেশি প্রতিরোধী। আবার যারা বুস্টার নিয়েছেন তারা আরও প্রতিরোধী। কিন্তু ওই যে বললাম, সিঁধ কাটা চোর। যদি চুরি করে আপনার শরীরে ঢুকে যায়, তাহলে রোগ সৃষ্টি করবে। যিনি টিকা গ্রহণ করেননি, তার তুলনায় যিনি গ্রহণ করেছেন তার শরীরে উপসর্গ কম হবে। বয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে টিকার কার্যকারিতা কম হবে।

এত টিকা নেয়ার পরেও চতুর্থ ঢেউ? এতে ক্ষতির আশঙ্কা কতটা? বিশ্বের অন্যান্য দেশের পরিসংখ্যান কী বলে?

তাহলে করণীয় কি?

যদি টিকা কার্যকরী না হয়, তাহলে কি টিকা নিবেন না? এখানে কতভাগ কার্যকরী সেটি বোঝার প্রয়োজন আছে। আপনি খোলা স্থানে থাকলে আপনার কাছ থেকে চুরি করা সহজ নাকি ঘরে থাকলে? এমনকি যারা বুস্টার ডোজ নেননি, তারা বুস্টার ডোজ নিলে আরেকটু প্রতিরোধ হবে। অনেকে করোনাকে পাত্তা দেন না। বলেন কাশি, জ্বর হয়ে ভালো হয়ে যায়। আমাদের একটি গবেষণায় দেখিয়েছি প্রায় ১৬ ভাগ মানুষ সুস্থ হলেও পরবর্তী সময়ে নানা জটিলতায় ভুগে থাকে। যেমন জ্বর জ্বর ভাব, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যাথা ইত্যাদি। সিঁধ কাটা ঠেকাতে সহজ উপায় মাস্ক ব্যবহার। তাহলে প্রায় ৯০-৯৫ ভাগ প্রতিরোধ হবে। বিভিন্ন কোম্পানি নতুন ধরনের জন্য পুনরায় টিকা বানাচ্ছে। যদি বাংলাদেশে নতুন ধরনের টিকা আসে তবে পুনরায় বুস্টার ডোজ নেওয়া প্রয়োজন। যদিও সেটি কতটা সবার কাছে পৌঁছানো যাবে, তা এখনো আমাদের জানার বাইরে। এই মুহূর্তে কোথাও কোন স্বাস্থ্যবিধি মানার লক্ষণ নেই। এছাড়া সামনে ঈদের সময় প্রচুর মানুষ নিয়ম না মেনে চলাফেরা করবে তখনই ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। তাই সর্বোপরি বলব, মাস্ক ব্যবহারই হতে পারে সর্বোত্তম সমাধান।

[লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ এবং সহযোগী পরিচালক, জিনোম সেন্টার যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

করোনার চতুর্থ ঢেউ : আশঙ্কা ও টিকার কার্যকারিতা

ইকবাল কবীর জাহিদ

শুক্রবার, ০১ জুলাই ২০২২

বেশ কিছুদিন বাংলাদেশের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। করোনার শনাক্তের সংখ্যা শূন্য নেমে গিয়েছিল। আমরা যারা করোনা নিয়ে গবেষণা করি তারা অতটা আশাবাদী ছিলাম না। পৃথিবীর গড়ে ৬৫ ভাগের কাছাকাছি মানুষ করোনার এক ডোজ টিকা নিয়েছে। কিন্তু এই হার পৃথিবীব্যাপী সমান নয়। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশসমূহে মাত্র ১৭ ভাগ টিকা দেয়া হয়েছে। করোনা ভ্যাকসিন ডাটা সেটে দেখলে বাংলাদেশের মানুষ গর্ববোধ করবে এই কারণে যে, পৃথিবীর ১৬তম দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একই পর্যায়ে ৭৮ ভাগ একডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছে বরং দুই ডোজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আমেরিকা থেকেও এগিয়ে আছে। এটিকে সরকারের একটি বড় সাফল্য হিসেবে ধরা যেতে পারে। ঠিক যে সময় সমগ্র দেশের মানুষ পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সুখ পূর্ণাঙ্গভাবে অনুভব করতে পারছে না সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা ও করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের হাতছানি। কেন? এত টিকা নেয়ার পরেও চতুর্থ ঢেউ? এতে ক্ষতির আশঙ্কা কতটা? বিশ্বের অন্যান্য দেশের পরিসংখ্যান কী বলে? আমরা কি ধারণা করতে পারি না?

বাংলাদেশের পরিসংখ্যান কি উদ্বেগের? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যে ওয়েবসাইটে করোনার প্রতিদিনের রিপোর্ট দেয়া হয় সেটি দেখলে সহজেই বোঝা যায় ২০২১ সালে যে সময় করোনার ডেল্টা ঢেউ শুরু হয়েছিল, এটি সেই একই সময়। ২৫ ফেব্রুয়ারির পর এত দ্রুত পজিটিভ রেট ১৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা এক সপ্তাহ আগেও ৫ শতাংশ ছিল। গত সপ্তাহের কেস বৃদ্ধির হার ৩৮৩ শতাংশ, যা সত্যিই উদ্বেগের। এই বৃদ্ধির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার আগে ওমিক্রনের কি কি ভাগ সেটি জানা জরুরি।

ওমিক্রনের সাব-ভ্যারিয়্যান্ট কি?

এই মুহূর্তে ওমিক্রনের ৫টি সাব-ভ্যারিয়েন্ট আছে যাকে বিজ্ঞানীরা BA1, BA2, BA3, BA4 + BA5 বলেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্নটি এই মুহূর্তে বিচরণ করছে। যেমন যুক্তরাজ্যে BA1 প্রাধান্য বিস্তার করলেও BA4 ও BA5 যথাক্রমে ৬ ও ৯ ভাগ। বাংলাদেশের ১১টি নমুনায় ৯১ ভাগ BA2 ও ৯ ভাগে BA5 পাওয়া গেছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ০২টি নমুনা BA4/5 পাওয়া গেছে। BA4 ও BA5 সর্বপ্রথম দক্ষিণ আফ্রিকাতে পাওয়া যায় জানুয়ারিতে ও ফেব্রুয়ারি মাসে। তখন মাত্র ১ ভাগ ছিল BA4, যা এপ্রিলে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশ। একইভাবে BA5 ২০ ভাগে উন্নত হয়েছে এপ্রিলে। ইউরোপীয়ান সেন্টার ফর ডিজিসেস প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল ইতোমধ্যে BA4 ও ৫ কে উদ্বেগের ভ্যারিয়ান্ট বলছে। বর্তমানে পর্তুগালে ৩৫ ভাগ পজিটিভ নমুনায় BA5 পাওয়া যাচ্ছে। এই মুহূর্তের যুক্তরাজ্যের ডাটা হল সেখানকার করোনার শনাক্তের হার দ্বিগুণ BA4 ও BA5-এর কারণে সেখানে ধীরে ধীরে অন্যগুলোকে সরিয়ে BA4 ও BA5 জায়গা করে নিচ্ছে। সিডিসির জুন মাসের ২১ তারিখের রিপোর্ট বলছে BA4 ও ৫-এর কারণে ৩৫ ভাগ নতুন কেস হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এখন প্রশ্ন, কি যোগ্যতা আছে BA4 ও BA5 যার কারণে অন্য সবাইকে পরাজিত করে সমহিমায় এগিয়ে যাচ্ছে মানব সভ্যতাকে গুঁড়িয়ে দিতে?

উপসর্গ কি?

ডেল্টা ও ওমিক্রনের মধ্যে উপসর্গের কিছু পার্থক্য ছিল। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৫৩ ভাগ ডেল্টা রোগী স্বাদ পায় না খাবারে। কিন্তু মাত্র ১৭ ভাগ স্বাদ পায় না ওমিক্রনের। ৭০ ভাগ ওমিক্রনের ক্ষেত্রে গলায় ব্যথা থাকে। কিন্তু ডেল্টাতে তা ৬০ ভাগ। ২ ভাগ ওমিক্রনে হাসপাতালে যায়। কিন্তু ডেল্টায় তা ২.৬ ভাগ। BA4 ও ৫ এর উপসর্গগুলো ডেল্টার কাছাকাছি তুলনামূলকভাবে ওমিক্রনের চেয়ে। যদিও তাদের ওমিক্রন বলা হচ্ছে। ৩০ টিরও অধিক দেশে BA4 ও BA5 ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের মহারাষ্ট্রের মধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে বাংলাদেশে এটি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

BA4 ও BA5-এর অতিরিক্ত যোগ্যতা কি?

যোগ্যতার বিষটি বোঝার জন্য আমাদের দুটি বিষয়ে আলোকপাত করতে হবে। একটি রোগ সৃষ্টি করার সক্ষমতা এবং দ্বিতীয়টি ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতা। প্রথমে আসি ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতায়। এটি বিজ্ঞানীদের ভাষায় বলা হয় প্রজনন সংখ্যা (জড়) যার ব্যাখ্যা হল একজন অসুস্থ ব্যক্তি তার ভাইরাস দ্বারা বিনা বাধায় কতজনকে আক্রান্ত করতে পারে। এই ভাইরাস ১ হতে যত বড় হবে তত দ্রুত ভাইরাস ছড়াবে।

এখন প্রথম যেটি চীন হতে প্রথম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল সেখান হতে হিসাব শুরু করি। যদি কোন ব্যক্তি টিকা গ্রহণ না করে থাকে এবং মাস্ক না পরে তবে বিনা বাধায় প্রথমে ভাইরাসটি পারত ২ জনকে। যেখানে ডেল্টা পারত ৩.৫ থেকে ৪ জনকে। সেখানে ওমিক্রন পারত ডেল্টার চেয়ে ৩-৪ গুণ বেশি। এখন পর্যন্ত সকল ধরনের মধ্যে ওমিক্রনের মতো এত দ্রুত ছড়ানো আর কারো পক্ষে সম্ভব হয় নাই। কিন্তু কেন ওমিক্রন কম ক্ষতিকর? ওমিক্রন মিউটেশনগুলো এমন যে সে উপরের দিকে বেশি থাকে। ফলে হাসপাতালে যাওয়া বা মারা যাওয়ার রেট কম। কিন্তু ডেল্টা দ্বারা দ্বিগুণ হাসপাতালে যাওয়ার রেট পাওয়া গেছে যুক্তরাজ্যে একটি গবেষণায়। ফলে ওমিক্রনের ৪০-৮০ ভাগ হাসপাতালে যাওয়ার সম্ভবনা কম। মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ কম। কিন্তু না? BA4 এবং BA5 কিছু ভিন্নতা আছে। সেটিই আলোচ্য বিষয়। এই দুই ভাইয়ের মা BA2 হলেও তাদের শরীরে তিনটি নতুন মিউটেশন আছে যার একটি ছিল ডেল্টাতে। ফলে সাধারণ মানুষের ভাষায় এটিকে ওমিক্রনের সঙ্গে ডেল্টার কিছু বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভাইরাস বলা যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সরাসরি ডেল্টাক্রন বা ক্রনডেল্টা বলছেন না। তার তিনটি প্রধান মিউটেশনের, যা ওমিক্রনের জন্য তার একটি ডেল্টার? আমি এখানে পাঠকের জন্য নম্বরটি বলব সেটিকে বলে L452R. এই মিউটেশনের ফলে ভাইরাসটি বেশি শক্তিশালী হয়, কারণ মানুষের কোষে বেশি আটকাতে পারে। তার আরও একটি মিউটেশন আছে যেটিকে বলে F486v. এটির কারণে আপনার পূর্বে করোনা হয়েছিল কিংবা টিকা নিয়েছেন, সেটিকে ভাইরাস ফাঁকি দিয়ে আপনার শরীরে ঢুকতে পারবে। চোর যদি সিঁধ কেটে আপনার ঘরে ঢোকে, আপনি টের পাওয়ার আগে সে ক্ষতিও করে ফেলতে পারে। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা ২ থেকে ৫ ভাগ বেশি অন্যান্য ওমিক্রনের তুলনায়। ফলে বুঝতেই পারে দুই দুইটি মারাত্মক অস্ত্র, একটি হল ছড়ানোর ক্ষমতা আর একটি হল টিকা বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাকি দেওয়ার ক্ষমতায় এই দুই ভাইকে করে তুলেছে অনন্য।

টিকা কি কার্যকরি?

সম্পূর্ণভাবে টিকাবিহীন ব্যক্তির তুলনায় যিনি দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন তিনি অবশ্যই বেশি প্রতিরোধী। আবার যারা বুস্টার নিয়েছেন তারা আরও প্রতিরোধী। কিন্তু ওই যে বললাম, সিঁধ কাটা চোর। যদি চুরি করে আপনার শরীরে ঢুকে যায়, তাহলে রোগ সৃষ্টি করবে। যিনি টিকা গ্রহণ করেননি, তার তুলনায় যিনি গ্রহণ করেছেন তার শরীরে উপসর্গ কম হবে। বয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে টিকার কার্যকারিতা কম হবে।

এত টিকা নেয়ার পরেও চতুর্থ ঢেউ? এতে ক্ষতির আশঙ্কা কতটা? বিশ্বের অন্যান্য দেশের পরিসংখ্যান কী বলে?

তাহলে করণীয় কি?

যদি টিকা কার্যকরী না হয়, তাহলে কি টিকা নিবেন না? এখানে কতভাগ কার্যকরী সেটি বোঝার প্রয়োজন আছে। আপনি খোলা স্থানে থাকলে আপনার কাছ থেকে চুরি করা সহজ নাকি ঘরে থাকলে? এমনকি যারা বুস্টার ডোজ নেননি, তারা বুস্টার ডোজ নিলে আরেকটু প্রতিরোধ হবে। অনেকে করোনাকে পাত্তা দেন না। বলেন কাশি, জ্বর হয়ে ভালো হয়ে যায়। আমাদের একটি গবেষণায় দেখিয়েছি প্রায় ১৬ ভাগ মানুষ সুস্থ হলেও পরবর্তী সময়ে নানা জটিলতায় ভুগে থাকে। যেমন জ্বর জ্বর ভাব, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যাথা ইত্যাদি। সিঁধ কাটা ঠেকাতে সহজ উপায় মাস্ক ব্যবহার। তাহলে প্রায় ৯০-৯৫ ভাগ প্রতিরোধ হবে। বিভিন্ন কোম্পানি নতুন ধরনের জন্য পুনরায় টিকা বানাচ্ছে। যদি বাংলাদেশে নতুন ধরনের টিকা আসে তবে পুনরায় বুস্টার ডোজ নেওয়া প্রয়োজন। যদিও সেটি কতটা সবার কাছে পৌঁছানো যাবে, তা এখনো আমাদের জানার বাইরে। এই মুহূর্তে কোথাও কোন স্বাস্থ্যবিধি মানার লক্ষণ নেই। এছাড়া সামনে ঈদের সময় প্রচুর মানুষ নিয়ম না মেনে চলাফেরা করবে তখনই ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। তাই সর্বোপরি বলব, মাস্ক ব্যবহারই হতে পারে সর্বোত্তম সমাধান।

[লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ এবং সহযোগী পরিচালক, জিনোম সেন্টার যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়]

back to top