গৌতম রায়
শিক্ষা দুর্নীতি ঘিরে ছাত্র যুবদের পথের আন্দোলন, বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের আদালতে আন্দোলন... এই সব কিছুকেই আনিস-বাগটুই, হাঁসখালী ইত্যাদি দিয়ে মহঃ সেলিম গণ-আন্দোলনকে যে উচ্চতায় তুলে এনেছেন, মানি লন্ডারিং অভিযোগে আরইডির পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভবপর হয়নি। গণ-আন্দোলনকে ধাপে ধাপে একটা স্তরে পৌঁছে শাসকের অচলায়নকে কীভাবে ভাঙতে হয় যাতে কেলেঙ্কারি চেপে রাখা আর কোনো বোঝাপড়া দিয়েই শাসকের পক্ষে সম্ভব হয় না... সেলিম সেটা করে দেখাতে পেরেছেন। মাত্র কয়েক মাস দলের দায়িত্ব নেয়ার ভেতরেই শাসকের ওপরে এমন একটা রাজনৈতিক চাপ সেলিম তৈরি করতে পেরেছেন যার জেরে তৃণমূল কংগ্রেস এখন আরএসএসপ্রধান মোহন ভাগবতের শরণ নিয়েও আর নিস্তার পাচ্ছে না আইনের বেড়াজাল থেকে।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর থেকে যে পরিমাণ দুর্নীতি, স্বজন পোষণের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস জড়িয়ে পড়েছে তা ভারতের অন্য যে কোন সময়ের, যে কোন বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। এত দুর্নীতি করেও তৃণমূল কংগ্রেস পার পেয়ে যাচ্ছিল প্রধানত আরএসএসের সার্বিক আশীর্বাদ ওই দল এবং দলটির সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর থাকার দরুন। আরএসএসপ্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে মমতার সুসম্পর্ক, তাকে ফুল ইত্যাদি মমতার ভেট পাঠানো... এসব রাজনীতি নিরপেক্ষ সৌজন্য, তেমনটা ভাববার আদৌ কোন কারণ নেই। অতি সম্প্রতি আরএসএসের ঘরের লোক জগদীপ ধনকরকে কার্যত বিনা বাধায় উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করবার লক্ষ্যে একটা তুচ্ছ অজুহাত দেখিয়ে মমতার সেই ভোটে নিজের দলকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত ও কখনোই রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়। আরএসএসের পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা পূর্বাঞ্চলে ধর্মান্ধ রাজনীতি কায়েম রাখতে, মুসলমানদের প্রতি ঘৃণার রাজনীতিকে আর ও তীব্র করে তুলতে মমতার প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে গাঁটছড়াটি অক্ষুণ্ন রাখা রাষ্ট্রক্ষমতা টিকিয়ে রাখবার প্রশ্নে একটা বড় রকমের বাধ্যবাধকতা।
আরএসএসের সঙ্গে এই বোঝাপড়ার দৌলতেই মমতা এবং তার দলের সমস্ত স্তরের নেতারা এতকাল দুর্নীতির প্রশ্নে ছাড় পেয়ে যেতেন। নারদা-সারদা থেকে শুরু করে শিক্ষা ক্ষেত্রে সমস্ত রকমের দুর্নীতিতেই কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন, কখনোবা নামকাওয়াস্তে স্বনিয়ন্ত্রিত সংস্থা গুলি তৃণমূল সরকারের নানা দুর্নীতি, ওই দলের কর্তা ব্যক্তিদের নানা দুর্নীতি ঘিরে একটু তদন্ত তদন্ত খেলার আয়োজন করত। কিছু মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করত। সেসব নিয়ে কখন ও মমতা রাস্তায় একটু বিজেপিবিরোধী আন্দোলনের অভিনয় করতেন, পছন্দের-বৃত্তের লোকেদের দিকে কেন্দ্রীয় সংস্থা একটু বেশি আঙুল তুললে মমতার আস্ফালন বেড়ে যেত আর ও কয়েকগুণ, কিন্তু অল্প কিছু দিনের ভেতরেই আবার সব চুপচাপ। বোঝাই যেত কেন্দ্রীয় সরকার তালের পরিচালক বিজেপির মূল মস্তিষ্ক আরএসএসের পরম সহায়ক তৃণমূল কংগ্রেস অস্বস্তিতে পড়ুক... এমন কিছু চায় না।
মহ. সেলিম তার দলের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই বলেছিলেন; যারা ঘুম কেড়েছে, তাদের নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেব না। সেলিমের নেতৃত্বে মোদি, মমতার সরকারের দুর্নীতি, হত্যা, স্বজনপোষণ, সাম্প্রদায়িকতা, বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন এমন একটা জায়গায় অল্প দিনের ভেতরেই পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছেছে যে, আরএসএস ও মমতাকে আড়ালের শত চেষ্টা করে আর সফল হতে পারছে না। আদালতে বিকাশ ভট্টাচার্যের যে লড়াই, সেই লড়াইকে মানুষের দরবারে কেবল পৌঁছে দেয়াই নয়, এমন উচ্চ শিখরে ছাত্র-যুবদের মাধ্যমে সেলিম তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন যে সত্যিই আজ কেবল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই নন, তার দলের সর্বস্তরের নেতৃত্বেরই আজ রাতের ঘুম ছুটে গেছে।
নিছক কোনো আঞ্চলিক প্তর থেকে উঠে এসে ঘটনাচক্রে সেলিম আজ বাম আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বে পৌঁছাননি। সর্বভারতীয় স্তরে তিনি যে যুব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই সময়ে আন্দোলনের পথ কোনো ফুল বিছানো রাস্তা ছিল না। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে সেই সময়কালটায় ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ভেতর দিয়ে গোটা সাম্প্রদায়িক শক্তি ভারতের রাজনৈতিক চরিত্রটাকেই বদলে ফেলবার নোংরা ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের আগের থেকেই কংগ্রেসের ভেতরে আরএসএসের যে প্রভাব বাড়তে শুরু করেছিল, রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে সেই প্রভাব কার্যত ব-াহীন হয়ে পড়তে শুরু করেছে। কংগ্রেসের ভেতরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সেই বল্লভভাই প্যাটেলের সময়কালের মত শক্তিশালী করতে তখন আরএসএস তৎপর। তার পাশাপাশি সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতাকে শক্তিশালী করতে প্রতিযতগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতাকেও সংঘ মদত জোগাচ্ছে।
এই পর্বেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার প্রধান মুখ করে তোলবার পরিকল্পাও সেরে ফেলেছে সংঘ। মমতাকে ঘিরে সংঘের এই পরিকল্পনা বোঝা যায় রাজীবের আমলে শাহবানু মামলাকে কেন্দ্র করে ভারতের সংখ্যালঘু মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে রাজীব গান্ধীর ‘মুসলিম নারী অধিকার রক্ষা বিল’ আনার ভেতর দিয়ে। এই পর্বে নিশ্চুপ মমতা আবার আরএসএসের ফাঁদে পা দিয়েই ’৯২-’৯৩-এর মুম্বাই বিস্ফোরণ ঘিরে ‘টাডা’ আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে সোচ্চারের আড়ালে মহারাষ্ট্রে শিবসেনা আর কংগ্রেসের ভেতরকার সাম্প্রদায়িক অংশের সঙ্গে সেতু গড়ে তোলা সেই সময়ের কংগ্রেস সাংসদ সুনীল দত্তের পুত্র অভিনেতা সঞ্জয় দত্তকে বেআইনি অস্ত্র রাখার দায় থেকে মুকাত করবার জন্যে আদা জল খেয়ে নেমে পড়বার ভেতর দিয়েই।
গোটা এই সময়ালটা ধরে ভারতের জাতীয় স্তরে যুব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেলিম। যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করতে, তাদের জীবন-জীবিকা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে শুধু ভারতের ভেতরেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরে কি ষড়যন্ত্র চলছে, আর সেই ষড়যন্ত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিশেবেই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকে কোন পর্যায়ে নিয়ে আসা হচ্ছে, সেটা বুঝে, সেই পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে, সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবার সাহস যুব সমাজের ভিতর সঞ্চারিত করেই সেলিম নিজের রাজনৈতিক জীবনের বিকাশ ঘটিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতা সেলিম দীর্ঘকাল একদিকে প্রয়োগ আর একদিকে অভিজ্ঞতার ঝুলিকে আরও ঋদ্ধ করেছেন সংসদীয় রাজনীতির ভেতর দিয়ে। সেলিমই হলেন এখন ও পর্যন্ত রাজ্যসভার সবথেকে কনিষ্ঠ চেয়ারম্যান প্যানেলভুক্ত সাংসদ। সেলিম যে বয়সে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান প্যানেলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই বয়সের কোনো সংসদ সদস্য তার আগে বা পরে, আজ পর্যন্ত রাজ্যসভার চেয়ারম্যান প্যানেলের সদস্য নির্বাচিত হননি।
আন্দোলনের এই বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার দরুণই সেলিমের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গের বাম আন্দোলনের ব্যাটনটা তুলে নেয়ার এত অল্পদিনের ভেতরে ইডির মতো কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনাধীন সংস্থাকে শিক্ষক নিয়োগসংক্রান্ত দুর্নীতির প্রশ্নে সত্যিই চোখে পড়ার মতো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করানো গিয়েছে। আদালত ও গণ-আন্দোলনের এই ঢেউকে এড়িয়ে যেতে পারেননি, অস্বীকার করতে তো পারেনইনি। ফলে সাম্প্রতিক অতীতে ফিরহাদ হাকিম, শোভন চট্টোপাধ্যায়, প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায় সিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার হয়েও যেমন অল্প সময়ের ভেতরেই ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন, তেমন ‘সৌভাগ্য’-এর অধিকারী পার্থ চট্টোপাধ্যায় হলেন না। সেলিমের নেতৃত্বে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন যদি না আজ এই পর্যায়ে পৌঁছতে পারত, তাহলে কিন্তু ইডি, সিবিআই যাই ধরুক না কেন, সেই বাঁস ছিঁড়ে পার্থের বের হয়ে আসাটা ঘিরে আদৌ তেমন কোনো সংশয় থাকত না।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
শুক্রবার, ২৯ জুলাই ২০২২
শিক্ষা দুর্নীতি ঘিরে ছাত্র যুবদের পথের আন্দোলন, বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের আদালতে আন্দোলন... এই সব কিছুকেই আনিস-বাগটুই, হাঁসখালী ইত্যাদি দিয়ে মহঃ সেলিম গণ-আন্দোলনকে যে উচ্চতায় তুলে এনেছেন, মানি লন্ডারিং অভিযোগে আরইডির পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভবপর হয়নি। গণ-আন্দোলনকে ধাপে ধাপে একটা স্তরে পৌঁছে শাসকের অচলায়নকে কীভাবে ভাঙতে হয় যাতে কেলেঙ্কারি চেপে রাখা আর কোনো বোঝাপড়া দিয়েই শাসকের পক্ষে সম্ভব হয় না... সেলিম সেটা করে দেখাতে পেরেছেন। মাত্র কয়েক মাস দলের দায়িত্ব নেয়ার ভেতরেই শাসকের ওপরে এমন একটা রাজনৈতিক চাপ সেলিম তৈরি করতে পেরেছেন যার জেরে তৃণমূল কংগ্রেস এখন আরএসএসপ্রধান মোহন ভাগবতের শরণ নিয়েও আর নিস্তার পাচ্ছে না আইনের বেড়াজাল থেকে।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর থেকে যে পরিমাণ দুর্নীতি, স্বজন পোষণের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস জড়িয়ে পড়েছে তা ভারতের অন্য যে কোন সময়ের, যে কোন বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। এত দুর্নীতি করেও তৃণমূল কংগ্রেস পার পেয়ে যাচ্ছিল প্রধানত আরএসএসের সার্বিক আশীর্বাদ ওই দল এবং দলটির সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর থাকার দরুন। আরএসএসপ্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে মমতার সুসম্পর্ক, তাকে ফুল ইত্যাদি মমতার ভেট পাঠানো... এসব রাজনীতি নিরপেক্ষ সৌজন্য, তেমনটা ভাববার আদৌ কোন কারণ নেই। অতি সম্প্রতি আরএসএসের ঘরের লোক জগদীপ ধনকরকে কার্যত বিনা বাধায় উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করবার লক্ষ্যে একটা তুচ্ছ অজুহাত দেখিয়ে মমতার সেই ভোটে নিজের দলকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত ও কখনোই রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়। আরএসএসের পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা পূর্বাঞ্চলে ধর্মান্ধ রাজনীতি কায়েম রাখতে, মুসলমানদের প্রতি ঘৃণার রাজনীতিকে আর ও তীব্র করে তুলতে মমতার প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে গাঁটছড়াটি অক্ষুণ্ন রাখা রাষ্ট্রক্ষমতা টিকিয়ে রাখবার প্রশ্নে একটা বড় রকমের বাধ্যবাধকতা।
আরএসএসের সঙ্গে এই বোঝাপড়ার দৌলতেই মমতা এবং তার দলের সমস্ত স্তরের নেতারা এতকাল দুর্নীতির প্রশ্নে ছাড় পেয়ে যেতেন। নারদা-সারদা থেকে শুরু করে শিক্ষা ক্ষেত্রে সমস্ত রকমের দুর্নীতিতেই কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন, কখনোবা নামকাওয়াস্তে স্বনিয়ন্ত্রিত সংস্থা গুলি তৃণমূল সরকারের নানা দুর্নীতি, ওই দলের কর্তা ব্যক্তিদের নানা দুর্নীতি ঘিরে একটু তদন্ত তদন্ত খেলার আয়োজন করত। কিছু মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করত। সেসব নিয়ে কখন ও মমতা রাস্তায় একটু বিজেপিবিরোধী আন্দোলনের অভিনয় করতেন, পছন্দের-বৃত্তের লোকেদের দিকে কেন্দ্রীয় সংস্থা একটু বেশি আঙুল তুললে মমতার আস্ফালন বেড়ে যেত আর ও কয়েকগুণ, কিন্তু অল্প কিছু দিনের ভেতরেই আবার সব চুপচাপ। বোঝাই যেত কেন্দ্রীয় সরকার তালের পরিচালক বিজেপির মূল মস্তিষ্ক আরএসএসের পরম সহায়ক তৃণমূল কংগ্রেস অস্বস্তিতে পড়ুক... এমন কিছু চায় না।
মহ. সেলিম তার দলের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই বলেছিলেন; যারা ঘুম কেড়েছে, তাদের নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেব না। সেলিমের নেতৃত্বে মোদি, মমতার সরকারের দুর্নীতি, হত্যা, স্বজনপোষণ, সাম্প্রদায়িকতা, বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন এমন একটা জায়গায় অল্প দিনের ভেতরেই পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছেছে যে, আরএসএস ও মমতাকে আড়ালের শত চেষ্টা করে আর সফল হতে পারছে না। আদালতে বিকাশ ভট্টাচার্যের যে লড়াই, সেই লড়াইকে মানুষের দরবারে কেবল পৌঁছে দেয়াই নয়, এমন উচ্চ শিখরে ছাত্র-যুবদের মাধ্যমে সেলিম তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন যে সত্যিই আজ কেবল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই নন, তার দলের সর্বস্তরের নেতৃত্বেরই আজ রাতের ঘুম ছুটে গেছে।
নিছক কোনো আঞ্চলিক প্তর থেকে উঠে এসে ঘটনাচক্রে সেলিম আজ বাম আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বে পৌঁছাননি। সর্বভারতীয় স্তরে তিনি যে যুব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই সময়ে আন্দোলনের পথ কোনো ফুল বিছানো রাস্তা ছিল না। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে সেই সময়কালটায় ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ভেতর দিয়ে গোটা সাম্প্রদায়িক শক্তি ভারতের রাজনৈতিক চরিত্রটাকেই বদলে ফেলবার নোংরা ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের আগের থেকেই কংগ্রেসের ভেতরে আরএসএসের যে প্রভাব বাড়তে শুরু করেছিল, রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে সেই প্রভাব কার্যত ব-াহীন হয়ে পড়তে শুরু করেছে। কংগ্রেসের ভেতরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সেই বল্লভভাই প্যাটেলের সময়কালের মত শক্তিশালী করতে তখন আরএসএস তৎপর। তার পাশাপাশি সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতাকে শক্তিশালী করতে প্রতিযতগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতাকেও সংঘ মদত জোগাচ্ছে।
এই পর্বেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার প্রধান মুখ করে তোলবার পরিকল্পাও সেরে ফেলেছে সংঘ। মমতাকে ঘিরে সংঘের এই পরিকল্পনা বোঝা যায় রাজীবের আমলে শাহবানু মামলাকে কেন্দ্র করে ভারতের সংখ্যালঘু মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে রাজীব গান্ধীর ‘মুসলিম নারী অধিকার রক্ষা বিল’ আনার ভেতর দিয়ে। এই পর্বে নিশ্চুপ মমতা আবার আরএসএসের ফাঁদে পা দিয়েই ’৯২-’৯৩-এর মুম্বাই বিস্ফোরণ ঘিরে ‘টাডা’ আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে সোচ্চারের আড়ালে মহারাষ্ট্রে শিবসেনা আর কংগ্রেসের ভেতরকার সাম্প্রদায়িক অংশের সঙ্গে সেতু গড়ে তোলা সেই সময়ের কংগ্রেস সাংসদ সুনীল দত্তের পুত্র অভিনেতা সঞ্জয় দত্তকে বেআইনি অস্ত্র রাখার দায় থেকে মুকাত করবার জন্যে আদা জল খেয়ে নেমে পড়বার ভেতর দিয়েই।
গোটা এই সময়ালটা ধরে ভারতের জাতীয় স্তরে যুব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেলিম। যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করতে, তাদের জীবন-জীবিকা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে শুধু ভারতের ভেতরেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরে কি ষড়যন্ত্র চলছে, আর সেই ষড়যন্ত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিশেবেই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকে কোন পর্যায়ে নিয়ে আসা হচ্ছে, সেটা বুঝে, সেই পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে, সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবার সাহস যুব সমাজের ভিতর সঞ্চারিত করেই সেলিম নিজের রাজনৈতিক জীবনের বিকাশ ঘটিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতা সেলিম দীর্ঘকাল একদিকে প্রয়োগ আর একদিকে অভিজ্ঞতার ঝুলিকে আরও ঋদ্ধ করেছেন সংসদীয় রাজনীতির ভেতর দিয়ে। সেলিমই হলেন এখন ও পর্যন্ত রাজ্যসভার সবথেকে কনিষ্ঠ চেয়ারম্যান প্যানেলভুক্ত সাংসদ। সেলিম যে বয়সে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান প্যানেলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই বয়সের কোনো সংসদ সদস্য তার আগে বা পরে, আজ পর্যন্ত রাজ্যসভার চেয়ারম্যান প্যানেলের সদস্য নির্বাচিত হননি।
আন্দোলনের এই বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার দরুণই সেলিমের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গের বাম আন্দোলনের ব্যাটনটা তুলে নেয়ার এত অল্পদিনের ভেতরে ইডির মতো কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনাধীন সংস্থাকে শিক্ষক নিয়োগসংক্রান্ত দুর্নীতির প্রশ্নে সত্যিই চোখে পড়ার মতো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করানো গিয়েছে। আদালত ও গণ-আন্দোলনের এই ঢেউকে এড়িয়ে যেতে পারেননি, অস্বীকার করতে তো পারেনইনি। ফলে সাম্প্রতিক অতীতে ফিরহাদ হাকিম, শোভন চট্টোপাধ্যায়, প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায় সিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার হয়েও যেমন অল্প সময়ের ভেতরেই ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন, তেমন ‘সৌভাগ্য’-এর অধিকারী পার্থ চট্টোপাধ্যায় হলেন না। সেলিমের নেতৃত্বে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন যদি না আজ এই পর্যায়ে পৌঁছতে পারত, তাহলে কিন্তু ইডি, সিবিআই যাই ধরুক না কেন, সেই বাঁস ছিঁড়ে পার্থের বের হয়ে আসাটা ঘিরে আদৌ তেমন কোনো সংশয় থাকত না।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]