শেখর ভট্টাচার্য
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই রেডিওতে বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদ শুনে নির্বাক হয়ে পড়ি। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা। সিলেট শহরে বসবাস। শহরজুড়ে কেমন জানি এক দমবন্ধ পরিবেশ। দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলাম তখন। রাজনৈতিক পরিবেশ, পরিস্থিতি বিশ্লেষণের ক্ষমতা, দক্ষতা হয়ে ওঠেনি। নিয়মিত সংবাদপত্র পড়তাম বলে মনে হলো, এবার বোধ হয় সারা দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠবে। আমাদের বাসা ছিল সিলেট শহরের তালতলাতে। বাসাটি মূল রাস্তার লাগুয়া, তাই পরিবারের সবাই কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত। বাসা থেকে এ রকম পরিস্থিতিতে বের হতে সবাই ভয় পাচ্ছিলেন। জানালা দিয়ে মূল রাস্তায় তাকিয়ে থাকতাম, রাস্তা খাঁ খাঁ করছে। দিনরাত আতঙ্কের মধ্যে বসবাস। এ রকম বেশ কয়েক দিন কাটল। প্রান্তিক মানুষের মধ্যে বেশ বিমর্ষ ভাব লক্ষ্য করলাম। মধ্যবিত্তদের চেহারা ভাবলেশহীন। এ রকম নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড-সমগ্র জাতিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলে। সারা শহরের মানুষ যেন প্রাণহীন রোবট। ১৪ আগস্ট পর্যন্ত মুখোশপরা মানুষেরা সবাই ছিল, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সদস্য। বঙ্গবন্ধুর স্তুতি করতে করতে এ রকম অবস্থা তৈরি করেছিল যে, সারা দেশে বুঝি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ বিরোধী মানুষ একজনও নেই। তবে প্রান্তিক মানুষ, আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে ছাই চাপা দেয়া আগুন ছিল। তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনেকেই তাদের ভালোবাসার অকৃত্রিমতা প্রমাণ করতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে ছিলেন না, তাই তারা বেঁচে গিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শেখ হাসিনা তার অসাধারণ নেতৃত্বের গুণে বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনেও এক ধরনের বেদনাবোধ কাজ করে, তিনি মাঝেমধ্যে অকপটে তা প্রকাশও করেন। সাধারণ মানুষ ও বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের মনে এত ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও সে সময়ের শীর্ষ নেতৃত্বের একটি অংশের বঙ্গবন্ধু হত্যার যথাযথ প্রতিবাদ করার ব্যর্থতায় বিস্মিত হন বঙ্গবন্ধকন্যা।
বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি বাঙালির মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। বিশ্বের দেশে দেশে কালজয়ী মহাপুরুষদের অনেকেরই প্রাণ দিতে হয়েছে কিংবা হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়েছে। বিশ্বে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডগুলোর অন্যতম হলো ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, চিলির সালভাদর আলেন্দে, যুক্তরাষ্ট্রের আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং ও জন এফ কেনেডি, মায়ানমারের জেনারেল অং সান, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী সলোমন বন্দর নায়েক, ঘানার নক্রুমাসহ আরও অনেকে।
সব হত্যাকান্ডের নিষ্ঠুরতা ছাড়িয়ে যে হত্যাকান্ডটি পৃথিবীর সবচেয়ে বর্বরোচিত বলে আখ্যায়িত হয়েছে সেটি হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকান্ড। এটি কোন ব্যক্তির হত্যাকান্ড বলা যায় না, এটি হচ্ছে সদ্য স্বাধীন একটি দেশকে তার পূর্বের ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এবং জাতিসত্তার পরিচয় মুছে ফেলার জন্য সংঘটিত হত্যাকান্ড। নিঃসন্দেহে বলা যায় এই হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বিশ্বের বুক থেকে একটি জাতিগোষ্ঠী ও জাতিসত্তাকে সমূলে ধ্বংস করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ছিল সীমাহীন। প্রাণের চেয়েও তিনি বেশি ভালোবাসতেন দেশের মানুষকে। একদিকে, দেশের মানুষই ছিল তার শক্তি ও প্রেরণার উৎস। অন্যদিকে, তার বড় দুর্বলতার দিকটিও ছিল দেশের মানুষের প্রতি এই সীমাহীন ভালোবাসা। ১৯৭২ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় শক্তিটি কী? বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেন, আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি।’ এরপরই ফ্রস্ট তাকে প্রশ্ন করেন ‘আপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী?’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি তাদের খুব বেশি ভালোবাসি।’ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পূর্বে প্রতিবেশী ভারত বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে সরকারি সুরক্ষিত বাড়িতে চলে যেতে পরামর্শ দেয়। বাঙালি জাতির প্রতি তার বিশ্বাস ছিল হিমালয়ের মতো দৃঢ়। তিনি সে পরামর্শ গ্রহণ করেননি; তিনি জনবিচ্ছিন্ন হতে চাননি। একদিকে সুরক্ষিত প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি অন্যদিকে ভালোবেসে জনগণের পাশে থাকা। যত বিপদই আসুক বঙ্গবন্ধু জগণের পাশে থাকাকে বেছে নিয়েছিলেন।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। এমনকি পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি, তার সহধর্মিণী আরজু মনি, কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ সদস্য ও আত্মীয়স্বজন। যে মানুষটি ফাসির কাষ্ঠে গিয়েও স্বাধীনতার জন্য, মানুষের জন্য আপোস করেননি, যে মানুষ পাকিস্তানের সামরিক আদালতে ওঠার সমর বারবার বাংলাদেশের জয় চেয়ে জয়বাংলা উচ্চারণ করেছেন তাকে এ রকম নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে হত্যা করে আমরা জাতি হিসেবে নিজেদের গায়ে অনেপনেয় কালিমা লেপন করেছি। বঙ্গবন্ধুর জীবনের ত্যাগের কথা বলতে গিয়ে ১ আগস্ট ২০০২ তারিখে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এ দেশের মানুষের কথা চিন্তা করেছেন। আর এটা করতে গিয়ে যখন পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, প্রতিবার তাকে কারাগারে বন্দী করা হয়েছে। ওই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবেই বার বার বন্দি... পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রটি হওয়ার ৭ মাসের মধ্যেই ৩ বার তিনি বন্দী হয়েছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাকে বলা হয়েছিল, ১৫ টাকা ফাইন দিলে এবং মুচলেকা দিলে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হবে। আমার বাবার কথা ছিল, ‘এটা করলে তো অপরাধটা স্বীকার করা হয়, আমি তো কোন অপরাধ করিনি। আমি ন্যায্য অধিকার নিয়েই কথা বলেছি, আন্দোলন করেছি। ‘তাই তিনি তা করেননি। বছরের পর বছর তিনি কারাগারে বন্দী থেকেছেন।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল পাকিস্তান এবং একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরাজিত বিশ্বশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশসমূহ। উদ্দেশ ছিল ধর্মাশ্রয়ী, পাকিস্তানের ছায়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এ হত্যাকান্ডে স্থানীয়ভাবে যারা যুক্ত ছিল তারা হলো মোশতাকের নেতৃত্বে একদল বিপথগামী সামরিক বাহিনীর সদস্য। সামরিক বাহিনীর মাস্টারমাইন্ড ছিল মঞ্চের নেপথ্যে। হত্যাকান্ড সংগঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল মাস্টার মাইন্ডকে ক্ষমতায় দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পর বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরন করা শুরু হয়। জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ নিষিদ্ধ করা হয়। পাকিস্তানি আদলে বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশে পরিণত করা হয়। স্কুল কলেজের পাঠ্য বই থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে অদৃশ্য করে ফেলা হয়। অর্থাৎ শিক্ষা সংস্কৃতিসহ সর্ব ক্ষেত্রে দেশকে পাকিস্তানের খোলসে আবৃত্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
প্রথম পর্যায়ে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসার পর আবার মুক্তিযুদ্ধের মূল নীতি অনুসরণ করা শুরু হয়। ২০০৯ থেকে ধারাবাহিকভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে সংস্কৃতিকভাবে পিছু হটা কিছুটা রদ করা সম্ভব হয়। অত্যন্ত বেদনার বিষয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের কিছু মানুষ ‘আওয়ামী’ রূপ ধারণ করে দেশকে আবার সাম্প্রদায়িকতার পথে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে দেশকে বিচ্যুত করার জন্য সুকৌশলে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক বাহক লেখকদের স্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। সব ক্ষেত্রে দেশকে সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রশাসনে ও রাজনীতিতে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি আদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা।
দেশকে প্রকৃত পক্ষে এগিয়ে নিতে হলে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্য হীন, উদার গণতন্ত্রের ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা মনে করেছিল বাংলাদশকে হত্যা করা সম্পন হলো, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে চিরতরে হত্যা করা গেলো; তারা বুঝতে পারেনি জীবিত বঙ্গবন্ধুর থেকে মৃত বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি শক্তিশালী। বঙ্গবন্ধুর মতো বিশ্বমানের নেতাকে হত্যা করা যায় না, স্ফিনিক্স পাখির মতো তারা উঠে আসেন তাদের আদর্শ নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে দেশ সরে আসে। আমরা আবার ধর্মাশ্রয়ী, অন্ধকার রাষ্ট্রের দিকে ধাবমান হই। শোকের মাসে আমাদের আবার বঙ্গবন্ধুর কাছে ফিরে যেতে হবে, তার আদর্শকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে ছোঁয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
শেখর ভট্টাচার্য
রোববার, ১৪ আগস্ট ২০২২
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই রেডিওতে বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদ শুনে নির্বাক হয়ে পড়ি। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা। সিলেট শহরে বসবাস। শহরজুড়ে কেমন জানি এক দমবন্ধ পরিবেশ। দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলাম তখন। রাজনৈতিক পরিবেশ, পরিস্থিতি বিশ্লেষণের ক্ষমতা, দক্ষতা হয়ে ওঠেনি। নিয়মিত সংবাদপত্র পড়তাম বলে মনে হলো, এবার বোধ হয় সারা দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠবে। আমাদের বাসা ছিল সিলেট শহরের তালতলাতে। বাসাটি মূল রাস্তার লাগুয়া, তাই পরিবারের সবাই কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত। বাসা থেকে এ রকম পরিস্থিতিতে বের হতে সবাই ভয় পাচ্ছিলেন। জানালা দিয়ে মূল রাস্তায় তাকিয়ে থাকতাম, রাস্তা খাঁ খাঁ করছে। দিনরাত আতঙ্কের মধ্যে বসবাস। এ রকম বেশ কয়েক দিন কাটল। প্রান্তিক মানুষের মধ্যে বেশ বিমর্ষ ভাব লক্ষ্য করলাম। মধ্যবিত্তদের চেহারা ভাবলেশহীন। এ রকম নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড-সমগ্র জাতিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলে। সারা শহরের মানুষ যেন প্রাণহীন রোবট। ১৪ আগস্ট পর্যন্ত মুখোশপরা মানুষেরা সবাই ছিল, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সদস্য। বঙ্গবন্ধুর স্তুতি করতে করতে এ রকম অবস্থা তৈরি করেছিল যে, সারা দেশে বুঝি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ বিরোধী মানুষ একজনও নেই। তবে প্রান্তিক মানুষ, আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে ছাই চাপা দেয়া আগুন ছিল। তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনেকেই তাদের ভালোবাসার অকৃত্রিমতা প্রমাণ করতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে ছিলেন না, তাই তারা বেঁচে গিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শেখ হাসিনা তার অসাধারণ নেতৃত্বের গুণে বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনেও এক ধরনের বেদনাবোধ কাজ করে, তিনি মাঝেমধ্যে অকপটে তা প্রকাশও করেন। সাধারণ মানুষ ও বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের মনে এত ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও সে সময়ের শীর্ষ নেতৃত্বের একটি অংশের বঙ্গবন্ধু হত্যার যথাযথ প্রতিবাদ করার ব্যর্থতায় বিস্মিত হন বঙ্গবন্ধকন্যা।
বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি বাঙালির মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। বিশ্বের দেশে দেশে কালজয়ী মহাপুরুষদের অনেকেরই প্রাণ দিতে হয়েছে কিংবা হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়েছে। বিশ্বে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডগুলোর অন্যতম হলো ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, চিলির সালভাদর আলেন্দে, যুক্তরাষ্ট্রের আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং ও জন এফ কেনেডি, মায়ানমারের জেনারেল অং সান, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী সলোমন বন্দর নায়েক, ঘানার নক্রুমাসহ আরও অনেকে।
সব হত্যাকান্ডের নিষ্ঠুরতা ছাড়িয়ে যে হত্যাকান্ডটি পৃথিবীর সবচেয়ে বর্বরোচিত বলে আখ্যায়িত হয়েছে সেটি হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকান্ড। এটি কোন ব্যক্তির হত্যাকান্ড বলা যায় না, এটি হচ্ছে সদ্য স্বাধীন একটি দেশকে তার পূর্বের ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এবং জাতিসত্তার পরিচয় মুছে ফেলার জন্য সংঘটিত হত্যাকান্ড। নিঃসন্দেহে বলা যায় এই হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বিশ্বের বুক থেকে একটি জাতিগোষ্ঠী ও জাতিসত্তাকে সমূলে ধ্বংস করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ছিল সীমাহীন। প্রাণের চেয়েও তিনি বেশি ভালোবাসতেন দেশের মানুষকে। একদিকে, দেশের মানুষই ছিল তার শক্তি ও প্রেরণার উৎস। অন্যদিকে, তার বড় দুর্বলতার দিকটিও ছিল দেশের মানুষের প্রতি এই সীমাহীন ভালোবাসা। ১৯৭২ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় শক্তিটি কী? বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেন, আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি।’ এরপরই ফ্রস্ট তাকে প্রশ্ন করেন ‘আপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী?’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি তাদের খুব বেশি ভালোবাসি।’ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পূর্বে প্রতিবেশী ভারত বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে সরকারি সুরক্ষিত বাড়িতে চলে যেতে পরামর্শ দেয়। বাঙালি জাতির প্রতি তার বিশ্বাস ছিল হিমালয়ের মতো দৃঢ়। তিনি সে পরামর্শ গ্রহণ করেননি; তিনি জনবিচ্ছিন্ন হতে চাননি। একদিকে সুরক্ষিত প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি অন্যদিকে ভালোবেসে জনগণের পাশে থাকা। যত বিপদই আসুক বঙ্গবন্ধু জগণের পাশে থাকাকে বেছে নিয়েছিলেন।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। এমনকি পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি, তার সহধর্মিণী আরজু মনি, কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ সদস্য ও আত্মীয়স্বজন। যে মানুষটি ফাসির কাষ্ঠে গিয়েও স্বাধীনতার জন্য, মানুষের জন্য আপোস করেননি, যে মানুষ পাকিস্তানের সামরিক আদালতে ওঠার সমর বারবার বাংলাদেশের জয় চেয়ে জয়বাংলা উচ্চারণ করেছেন তাকে এ রকম নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে হত্যা করে আমরা জাতি হিসেবে নিজেদের গায়ে অনেপনেয় কালিমা লেপন করেছি। বঙ্গবন্ধুর জীবনের ত্যাগের কথা বলতে গিয়ে ১ আগস্ট ২০০২ তারিখে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এ দেশের মানুষের কথা চিন্তা করেছেন। আর এটা করতে গিয়ে যখন পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, প্রতিবার তাকে কারাগারে বন্দী করা হয়েছে। ওই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবেই বার বার বন্দি... পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রটি হওয়ার ৭ মাসের মধ্যেই ৩ বার তিনি বন্দী হয়েছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাকে বলা হয়েছিল, ১৫ টাকা ফাইন দিলে এবং মুচলেকা দিলে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হবে। আমার বাবার কথা ছিল, ‘এটা করলে তো অপরাধটা স্বীকার করা হয়, আমি তো কোন অপরাধ করিনি। আমি ন্যায্য অধিকার নিয়েই কথা বলেছি, আন্দোলন করেছি। ‘তাই তিনি তা করেননি। বছরের পর বছর তিনি কারাগারে বন্দী থেকেছেন।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল পাকিস্তান এবং একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরাজিত বিশ্বশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশসমূহ। উদ্দেশ ছিল ধর্মাশ্রয়ী, পাকিস্তানের ছায়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এ হত্যাকান্ডে স্থানীয়ভাবে যারা যুক্ত ছিল তারা হলো মোশতাকের নেতৃত্বে একদল বিপথগামী সামরিক বাহিনীর সদস্য। সামরিক বাহিনীর মাস্টারমাইন্ড ছিল মঞ্চের নেপথ্যে। হত্যাকান্ড সংগঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল মাস্টার মাইন্ডকে ক্ষমতায় দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পর বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরন করা শুরু হয়। জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ নিষিদ্ধ করা হয়। পাকিস্তানি আদলে বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশে পরিণত করা হয়। স্কুল কলেজের পাঠ্য বই থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে অদৃশ্য করে ফেলা হয়। অর্থাৎ শিক্ষা সংস্কৃতিসহ সর্ব ক্ষেত্রে দেশকে পাকিস্তানের খোলসে আবৃত্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
প্রথম পর্যায়ে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসার পর আবার মুক্তিযুদ্ধের মূল নীতি অনুসরণ করা শুরু হয়। ২০০৯ থেকে ধারাবাহিকভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে সংস্কৃতিকভাবে পিছু হটা কিছুটা রদ করা সম্ভব হয়। অত্যন্ত বেদনার বিষয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের কিছু মানুষ ‘আওয়ামী’ রূপ ধারণ করে দেশকে আবার সাম্প্রদায়িকতার পথে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে দেশকে বিচ্যুত করার জন্য সুকৌশলে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক বাহক লেখকদের স্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। সব ক্ষেত্রে দেশকে সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রশাসনে ও রাজনীতিতে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি আদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা।
দেশকে প্রকৃত পক্ষে এগিয়ে নিতে হলে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্য হীন, উদার গণতন্ত্রের ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা মনে করেছিল বাংলাদশকে হত্যা করা সম্পন হলো, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে চিরতরে হত্যা করা গেলো; তারা বুঝতে পারেনি জীবিত বঙ্গবন্ধুর থেকে মৃত বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি শক্তিশালী। বঙ্গবন্ধুর মতো বিশ্বমানের নেতাকে হত্যা করা যায় না, স্ফিনিক্স পাখির মতো তারা উঠে আসেন তাদের আদর্শ নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে দেশ সরে আসে। আমরা আবার ধর্মাশ্রয়ী, অন্ধকার রাষ্ট্রের দিকে ধাবমান হই। শোকের মাসে আমাদের আবার বঙ্গবন্ধুর কাছে ফিরে যেতে হবে, তার আদর্শকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে ছোঁয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]