alt

উপ-সম্পাদকীয়

বৈদেশিক ঋণে কি সংকট ঘুচবে

রেজাউল করিম খোকন

: বুধবার, ১৭ আগস্ট ২০২২

কিছু দিন আগে বিশ্বের ঋণগ্রস্ত দেশগুলোকে সতর্ক হতে বলেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএফএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বলেছেন, যেসব দেশের ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি, সেই দেশগুলো এখন আরও চাপে পড়বে। তিনি শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দিয়ে সবাইকে সতর্ক হতে পরামর্শ দিয়েছেন। তার আশঙ্কা, ঋণগ্রস্ততার কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো গত তিন দশক সময়ে যে উন্নতি করেছিল, তা উল্টে যাওয়ার শঙ্কা ও সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি আরও পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। যার নমুনা আমরা প্রতিনিয়তই লক্ষ্য করছি। মূল্যস্ফীতি চরমে পৌঁছেছে, ডালারে দাম বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায়, জরুরি নয়, এমন পণ্য আমদানি বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। জ্বালানি সংকটের কারণে অপ্রত্যাশিত ও অনাকাক্সিক্ষত লোডশেডিং শুরু হয়েছে। যার প্রভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি কলকারখানার উৎপাদনও কমে এসেছে। জ্বালানি তেলের মূল্য হঠাৎ করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। এটাও সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ক্ষুব্ধ, হতাশ এবং অসন্তুষ্ট করেছে।

গত প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির যে ধারাবাহিক চিত্র দেখানো হচ্ছিল, তা যেন রাতারাতি উল্টে যেতে শুরু করেছে। দেশের রিজার্ভ নিয়ে এতদিন যে ধরনের বাগাড়ম্ভর চলছিল, প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কমে যাওয়ায় তা গত বেশ কিছু দিন থেকে ভাটা পড়তে শুরু করেছে । এখন প্রবাসী আয় বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নানা বিধি নিষেধ শিথিল করে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। আগে যেখানে বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতা কমে আসার কথা ফলাওভাবে প্রচার করা হচ্ছিল। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না-তেমন কথা শোনা গেছে বহুবার সরকারের দায়িত্বশীল নেতা ও মন্ত্রীদের মুখ থেকে।

ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কঠিন শর্তের বেড়াজালে বন্দী হতে রাজি নয় বাংলাদেশ- কারণ হিসেবে এমন কথা বলতেন তারা। কিন্তু, বাংলাদেশ অবশেষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণ চেয়েছে। বাংলাদেশ ৩ বছরের জন্য চেয়েছে ৪৫০ কোটি ডলার। দেশে গুরুত্বপূর্ণ যে সব প্রকল্প চলমান, সেগুলো শেষ করতেই প্রচুর অর্থ দরকার। পদ্মা সেতুসহ কিছু বড় প্রকল্প ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। আরও কিছু বাকি রয়েছে। যে প্রকল্পগুলো অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো আপাতত স্থগিত রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ব্যয় কমাতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি পদক্ষেপ হলো, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দে কাটছাঁট। চলতি অর্থবছরের কিছু কিছু প্রকল্পে কোনো অর্থ ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। আবার কিছু প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ ২৫ শতাংশ কম দেওয়া হবে। টানা তিন মেয়াদে সরকার উন্নয়ন কর্মকান্ডে বিশেষ জোর দিয়ে এসেছে। শুধু অবকাঠামোগত খাতেই নয়, সবখাতেই অনেকটা উদারভাবে প্রকল্প নেয়া হয়েছে। তবে এখন পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট এমন দাঁড়িয়েছে যে সরকারকে উন্নয়ন প্রকল্পে কাটছাঁট করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ আগে থেকেই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বেশ কয়েকটি দেশ থেকে ঋণ নিয়েছে। রাশিয়া, চীন ও ভারতের কাছ থেকে নেওয়া কঠিন শর্তের ঋণগুলোই এখন বেশি ভোগাবে বলে ধারণা করা যায়। এ তিন দেশ থেকে এ পর্যন্ত সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ চুক্তি হয়েছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে সুদ-আসলসহ এ বিপুল অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। দায় বেড়ে যাওয়ায় আগামী তিন বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হবে। সাধারণত বিশ্বব্যাংক এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে ঋণ নিলে ৩০ থেকে ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু সুদের হার এর প্রায় কাছাকাছি হলেও চীন, রাশিয়া, ভারত-এ তিন দেশের ঋণ পরিশোধ করতে হবে এর অর্ধেক সময়ে। এ তিন দেশের ঋণের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল, শাহজালাল সার কারখানা, দাশেরকান্দি পয়োবর্জ্য শোধনাগারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে।

কোন দেশের সঙ্গে ঋণচুক্তি করার সময় অর্থ পরিশোধের একটি মেয়াদ নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এ মেয়াদের মধ্যে একটি গ্রেস পিরিয়ড থাকে। ওই গ্রেস পিরিয়ডে ঋণের কিস্তির সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয় না। এ সব ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে বেশির ভাগ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হবে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের আসল, সুদসহ ২০১ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ৪০০ কোটি ডলার অতিক্রম করবে ধারণা করা যায়।

হালে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের জন্য লাগামহীন বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করাকে দায়ী করার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কঠিন শর্তের এসব ঋণ নেয়ার কয়েক বছর পরই ঋণ পরিশোধ বাড়তি চাপ আসবেই। চীন, রাশিয়া ও ভারতের ঋণগুলোর গ্রেস পিরিয়ড শেষ হলে প্রতি বছর গড়ে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হবে। হঠাৎ করে যেন বাড়তি ঋণ পরিশোধের চাপ না আসে, সে জন্য মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। সেজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। বর্তমান বিদেশি মুদ্রার মজুদ ব্যবস্থাপনাও ঠিক করতে হবে। বছরে গড়পড়তায় ঋণ পরিশোধের হিসাব থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিটি ঋণের বিপরীতে কত টাকা পরিশোধ করতে হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিশোধের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২৭৮ কোটি ডলার খরচ হবে বাংলাদেশের। তবে এরপর থেকে ঋণ পরিশোধ কমতে থাকবে। বিদ্যমান ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আগামী তিন বছর বাংলাদেশের ক্রমপুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণও বাড়তে থাকবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ক্রমপুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৮ হাজার ৫২৪ কোটি ডলার। তবে ২০২৯-৩০ অর্থবছর নাগাদ তা কমে ৭ হাজার ২৯১ কোটি ডলার হবে।

অর্থনৈতিক চাপ কমাতে সরকার এখন যে উদ্যোগগুলো নিচ্ছে, তা অপর্যাপ্ত এবং স্বল্পমেয়াদি। সরকারকে মধ্য মেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে উদ্যোগ নিতে হবে

সব মিলিয়ে অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে, শিগগিরই কাটছে না আমাদের অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকট আরও দুই তিন বছর থাকতে পারে। অর্থনৈতিক চাপ কমাতে সরকার এখন যে উদ্যোগগুলো নিচ্ছে, তা অপর্যাপ্ত এবং স্বল্পমেয়াদি। সরকারকে মধ্য মেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য পাঁচটি বিষয়ে জোর দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সেগুলো হলো-বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ স্থিতিশীল রাখা, মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতি ধরে রাখতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি। এসব খাতে নানা ধরনের সংস্কারও সম্পৃক্ত করে অর্থনীতির চাপ মোকাবিলা করতে হবে। এখন অবস্থা এমন হয়ে উঠেছে যে, একটি সমস্যা সমাধানে গৃহীত পদক্ষেপ নতুন করে সংকট সৃষ্টি করছে, যা আগে থেকে হয়তো ধারণা করা যাচ্ছে না। বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধান এককভাবে গৃহীত উদ্যোগ কাজ দেবে না, সংশ্লিষ্ট সবার যৌথ পদক্ষেপ এবং পারস্পরিক সমন্বয় এখন বেশি প্রয়োজন।

সরকার পরিস্থিতির চাপে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পথে পা বাড়িয়েছে-এটা সহজেই বোঝা যায়। বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে চাওয়া ঋণের মধ্যে ১৫০ কোটি ডলার দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে অনুরোধ জানিয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কোন দেশই পারতপক্ষে বৈদেশিক দাতাসংস্থা কিংবা বিভিন্ন দেশ থেকে ঋণ নিতে চায় না। কারণ, প্রতিটি ঋণই থাকে নানা শর্তের বেড়াজালে বন্দী, যা সেই দেশের স্বাধীন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বিকাশে চরম বাধা সৃষ্টি করে।

ইতিপূর্বে আমরা বিভিন্ন দাতা সংস্থা এবং দেশের ঋণ গ্রহণের পর তাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সরকারকে গণবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখেছি, যা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য চরম অস্বস্তির ব্যাপার সন্দেহ নেই। এবারও আইএমএফের কাছে বাংলাদেশ যে ঋণ চেয়েছে তার বিপরীতেও কিছু শর্তাবলী, প্রেসক্রিপশন তো থাকবেই, যা পরিপালন করতে গিয়ে সরকারকে ভর্তুকি প্রত্যাহারসহ নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে আইএমএফ থেকে ঋণ গ্রহণের জন্য শর্তের পরিপালন বলে মনে করছেন অনেকেই। একইভাবে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি হ্রাস কিংবা প্রত্যাহার, সঞ্চয়পত্রসহ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে সাধারণ মানুষের প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা হ্রাসকরণ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকসান কমাতে শ্রমিক-কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো পদক্ষেপ নিতে হতে পারে। এমনিতেই গোটা অর্থনীতিতে সৃষ্ট সংকটের চাপে জনজীবনে নাভিশ্বাস চলছে। এর মধ্যে যদি বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের প্রভাবে নতুন নতুন সংকট এসে সামনে দাঁড়ায় তাহলে সাধারণ মানুষ কোনদিকে যাবে, এটাই হলো বড় প্রশ্ন।

সরকার নিশ্চয়ই নিজের ইমেজ ক্ষুণ্ন করতে অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপ নিতে চাইছে না। সবার কল্যাণ এবং অর্থনীতির সংকট মোচন দুটোই চায় সরকার। সে ক্ষেত্রে বুঝে-শুনে পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনীতির সংকট ঘোচাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের মাথায় খরচের বোঝা চাপিয়ে জনরোষ সৃষ্টি প্রকারন্তরে সরকারের জন্যই চরম অনিশ্চয়তা, অস্বস্তি এবং বিপদ ডেকে আনবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বৈদেশিক ঋণে কি সংকট ঘুচবে

রেজাউল করিম খোকন

বুধবার, ১৭ আগস্ট ২০২২

কিছু দিন আগে বিশ্বের ঋণগ্রস্ত দেশগুলোকে সতর্ক হতে বলেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএফএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বলেছেন, যেসব দেশের ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি, সেই দেশগুলো এখন আরও চাপে পড়বে। তিনি শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দিয়ে সবাইকে সতর্ক হতে পরামর্শ দিয়েছেন। তার আশঙ্কা, ঋণগ্রস্ততার কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো গত তিন দশক সময়ে যে উন্নতি করেছিল, তা উল্টে যাওয়ার শঙ্কা ও সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি আরও পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। যার নমুনা আমরা প্রতিনিয়তই লক্ষ্য করছি। মূল্যস্ফীতি চরমে পৌঁছেছে, ডালারে দাম বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায়, জরুরি নয়, এমন পণ্য আমদানি বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। জ্বালানি সংকটের কারণে অপ্রত্যাশিত ও অনাকাক্সিক্ষত লোডশেডিং শুরু হয়েছে। যার প্রভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি কলকারখানার উৎপাদনও কমে এসেছে। জ্বালানি তেলের মূল্য হঠাৎ করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। এটাও সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ক্ষুব্ধ, হতাশ এবং অসন্তুষ্ট করেছে।

গত প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির যে ধারাবাহিক চিত্র দেখানো হচ্ছিল, তা যেন রাতারাতি উল্টে যেতে শুরু করেছে। দেশের রিজার্ভ নিয়ে এতদিন যে ধরনের বাগাড়ম্ভর চলছিল, প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কমে যাওয়ায় তা গত বেশ কিছু দিন থেকে ভাটা পড়তে শুরু করেছে । এখন প্রবাসী আয় বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নানা বিধি নিষেধ শিথিল করে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। আগে যেখানে বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতা কমে আসার কথা ফলাওভাবে প্রচার করা হচ্ছিল। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না-তেমন কথা শোনা গেছে বহুবার সরকারের দায়িত্বশীল নেতা ও মন্ত্রীদের মুখ থেকে।

ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কঠিন শর্তের বেড়াজালে বন্দী হতে রাজি নয় বাংলাদেশ- কারণ হিসেবে এমন কথা বলতেন তারা। কিন্তু, বাংলাদেশ অবশেষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণ চেয়েছে। বাংলাদেশ ৩ বছরের জন্য চেয়েছে ৪৫০ কোটি ডলার। দেশে গুরুত্বপূর্ণ যে সব প্রকল্প চলমান, সেগুলো শেষ করতেই প্রচুর অর্থ দরকার। পদ্মা সেতুসহ কিছু বড় প্রকল্প ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। আরও কিছু বাকি রয়েছে। যে প্রকল্পগুলো অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো আপাতত স্থগিত রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ব্যয় কমাতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি পদক্ষেপ হলো, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দে কাটছাঁট। চলতি অর্থবছরের কিছু কিছু প্রকল্পে কোনো অর্থ ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। আবার কিছু প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ ২৫ শতাংশ কম দেওয়া হবে। টানা তিন মেয়াদে সরকার উন্নয়ন কর্মকান্ডে বিশেষ জোর দিয়ে এসেছে। শুধু অবকাঠামোগত খাতেই নয়, সবখাতেই অনেকটা উদারভাবে প্রকল্প নেয়া হয়েছে। তবে এখন পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট এমন দাঁড়িয়েছে যে সরকারকে উন্নয়ন প্রকল্পে কাটছাঁট করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ আগে থেকেই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বেশ কয়েকটি দেশ থেকে ঋণ নিয়েছে। রাশিয়া, চীন ও ভারতের কাছ থেকে নেওয়া কঠিন শর্তের ঋণগুলোই এখন বেশি ভোগাবে বলে ধারণা করা যায়। এ তিন দেশ থেকে এ পর্যন্ত সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ চুক্তি হয়েছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে সুদ-আসলসহ এ বিপুল অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। দায় বেড়ে যাওয়ায় আগামী তিন বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হবে। সাধারণত বিশ্বব্যাংক এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে ঋণ নিলে ৩০ থেকে ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু সুদের হার এর প্রায় কাছাকাছি হলেও চীন, রাশিয়া, ভারত-এ তিন দেশের ঋণ পরিশোধ করতে হবে এর অর্ধেক সময়ে। এ তিন দেশের ঋণের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল, শাহজালাল সার কারখানা, দাশেরকান্দি পয়োবর্জ্য শোধনাগারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে।

কোন দেশের সঙ্গে ঋণচুক্তি করার সময় অর্থ পরিশোধের একটি মেয়াদ নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এ মেয়াদের মধ্যে একটি গ্রেস পিরিয়ড থাকে। ওই গ্রেস পিরিয়ডে ঋণের কিস্তির সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয় না। এ সব ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে বেশির ভাগ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হবে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের আসল, সুদসহ ২০১ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ৪০০ কোটি ডলার অতিক্রম করবে ধারণা করা যায়।

হালে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের জন্য লাগামহীন বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করাকে দায়ী করার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কঠিন শর্তের এসব ঋণ নেয়ার কয়েক বছর পরই ঋণ পরিশোধ বাড়তি চাপ আসবেই। চীন, রাশিয়া ও ভারতের ঋণগুলোর গ্রেস পিরিয়ড শেষ হলে প্রতি বছর গড়ে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হবে। হঠাৎ করে যেন বাড়তি ঋণ পরিশোধের চাপ না আসে, সে জন্য মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। সেজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। বর্তমান বিদেশি মুদ্রার মজুদ ব্যবস্থাপনাও ঠিক করতে হবে। বছরে গড়পড়তায় ঋণ পরিশোধের হিসাব থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিটি ঋণের বিপরীতে কত টাকা পরিশোধ করতে হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিশোধের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২৭৮ কোটি ডলার খরচ হবে বাংলাদেশের। তবে এরপর থেকে ঋণ পরিশোধ কমতে থাকবে। বিদ্যমান ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আগামী তিন বছর বাংলাদেশের ক্রমপুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণও বাড়তে থাকবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ক্রমপুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৮ হাজার ৫২৪ কোটি ডলার। তবে ২০২৯-৩০ অর্থবছর নাগাদ তা কমে ৭ হাজার ২৯১ কোটি ডলার হবে।

অর্থনৈতিক চাপ কমাতে সরকার এখন যে উদ্যোগগুলো নিচ্ছে, তা অপর্যাপ্ত এবং স্বল্পমেয়াদি। সরকারকে মধ্য মেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে উদ্যোগ নিতে হবে

সব মিলিয়ে অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে, শিগগিরই কাটছে না আমাদের অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকট আরও দুই তিন বছর থাকতে পারে। অর্থনৈতিক চাপ কমাতে সরকার এখন যে উদ্যোগগুলো নিচ্ছে, তা অপর্যাপ্ত এবং স্বল্পমেয়াদি। সরকারকে মধ্য মেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য পাঁচটি বিষয়ে জোর দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সেগুলো হলো-বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ স্থিতিশীল রাখা, মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতি ধরে রাখতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি। এসব খাতে নানা ধরনের সংস্কারও সম্পৃক্ত করে অর্থনীতির চাপ মোকাবিলা করতে হবে। এখন অবস্থা এমন হয়ে উঠেছে যে, একটি সমস্যা সমাধানে গৃহীত পদক্ষেপ নতুন করে সংকট সৃষ্টি করছে, যা আগে থেকে হয়তো ধারণা করা যাচ্ছে না। বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধান এককভাবে গৃহীত উদ্যোগ কাজ দেবে না, সংশ্লিষ্ট সবার যৌথ পদক্ষেপ এবং পারস্পরিক সমন্বয় এখন বেশি প্রয়োজন।

সরকার পরিস্থিতির চাপে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পথে পা বাড়িয়েছে-এটা সহজেই বোঝা যায়। বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে চাওয়া ঋণের মধ্যে ১৫০ কোটি ডলার দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে অনুরোধ জানিয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কোন দেশই পারতপক্ষে বৈদেশিক দাতাসংস্থা কিংবা বিভিন্ন দেশ থেকে ঋণ নিতে চায় না। কারণ, প্রতিটি ঋণই থাকে নানা শর্তের বেড়াজালে বন্দী, যা সেই দেশের স্বাধীন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বিকাশে চরম বাধা সৃষ্টি করে।

ইতিপূর্বে আমরা বিভিন্ন দাতা সংস্থা এবং দেশের ঋণ গ্রহণের পর তাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সরকারকে গণবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখেছি, যা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য চরম অস্বস্তির ব্যাপার সন্দেহ নেই। এবারও আইএমএফের কাছে বাংলাদেশ যে ঋণ চেয়েছে তার বিপরীতেও কিছু শর্তাবলী, প্রেসক্রিপশন তো থাকবেই, যা পরিপালন করতে গিয়ে সরকারকে ভর্তুকি প্রত্যাহারসহ নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে আইএমএফ থেকে ঋণ গ্রহণের জন্য শর্তের পরিপালন বলে মনে করছেন অনেকেই। একইভাবে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি হ্রাস কিংবা প্রত্যাহার, সঞ্চয়পত্রসহ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে সাধারণ মানুষের প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা হ্রাসকরণ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকসান কমাতে শ্রমিক-কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো পদক্ষেপ নিতে হতে পারে। এমনিতেই গোটা অর্থনীতিতে সৃষ্ট সংকটের চাপে জনজীবনে নাভিশ্বাস চলছে। এর মধ্যে যদি বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের প্রভাবে নতুন নতুন সংকট এসে সামনে দাঁড়ায় তাহলে সাধারণ মানুষ কোনদিকে যাবে, এটাই হলো বড় প্রশ্ন।

সরকার নিশ্চয়ই নিজের ইমেজ ক্ষুণ্ন করতে অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপ নিতে চাইছে না। সবার কল্যাণ এবং অর্থনীতির সংকট মোচন দুটোই চায় সরকার। সে ক্ষেত্রে বুঝে-শুনে পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনীতির সংকট ঘোচাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের মাথায় খরচের বোঝা চাপিয়ে জনরোষ সৃষ্টি প্রকারন্তরে সরকারের জন্যই চরম অনিশ্চয়তা, অস্বস্তি এবং বিপদ ডেকে আনবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top