alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে বাধা কোথায়

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট ২০২২

উনিশ শতকের প্রথম দিকে কিছু বেসরকারি সংস্থা বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তেল গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে। ইন্ডিয়ান পেট্রোলিয়াম কোম্পানি নামে একটি সংস্থা চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে ১৯০৮ সালে অনুসন্ধান চালায়। ১৯২১-২৩ সালে Burmah Oil Company (BOC) পাথারিয়া নামক স্থানে তেল গ্যাস উত্তোলনের জন্য খনন কাজ শুরু করে। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান Pakistan Petroleum Act in 1948 চালু হয়। এই আইনের অধীন তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানে The Standard Vacuum Oil Company (STANVAC) of USA, Pakistan Petroleum Ltd. (PPL)- a Burmah Oil Company and Pakistan Shell Oil Company (PSOC) তেল গ্যাস এর অনু সন্ধান চালায় তারা ১৬টি অঞ্চলে অনুসন্ধান চালিয়ে সাতটি গ্যাসকুপ আবিস্কার করে। ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের জাতীয়ভিত্তিক পাবলিক সেক্টরে Oil and Gas Development Corporation (OGDC) প্রতিষ্ঠা পায়। এই কোম্পানিটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের পদ্বতি অনুসরণ করে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান চালায়।

১৯৭১ সালে বালাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসব কোম্পানির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার সেই সময়ে বাংলাদেশে তেল-গ্যাস আহরনকারী দুইটি বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস ক্ষেত্রগুলো রাষ্টের জন্য কিনে নেয় ফলে সকল প্রকার প্রাকৃতিক সম্পদ জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়। ১৯৭২ সালের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-২৭ অনুসারে বাংলাদেশ খনিজ তৈল এবং গ্যাস করপোরেশন (BMOGC) প্রতিষ্ঠা পায়। সেই সময়ে সারাদেশ ৬টি ব্লকে বিভক্ত করে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের চেষ্টা চালানো হয়। বর্তমানে সমুদ্র পৃষ্ঠসহ সমগ্র দেশকে ৫৬টি ব্লকে বিভক্ত করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে ২২ আগস্ট বাংলাদেশ খনিজ তৈল এবং গ্যাস করপোরেশন (BMOGC) পেট্রোবাংলায় রুপান্তরিত হয়। পেট্রোবাংলা একটি স্ব শাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। দেশের অভ্যান্তরে জ্বালানি বিষয়ক সকল দায় দায়িত্ব পেট্রোবাংলার ওপর বর্তায়, নিয়মানুসারে পেট্রোবাংলার ব্যবস্থাপনাসহ সকল দায়দায়িত্ব পালন করবে প্রযুক্তিবিদ প্রকৌশলীরা।

১৯৮৫ সালে এসে পেট্রোবাংলার ওপর শুধুমাত্র তেল গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। এরশাদের আমলে বাংলাদেশের ভুমিকে ২৩ টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা সরকারের আমলে তেল গ্যাস সমৃদ্ধ ১৫টি ব্লককে বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়া হয়। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক জনগণ এই সম্পদ কাউকে ইজারা দিতে হলে জনগনের সম্মতি নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু আমরা দেখতে পাই কোন সরকারই ব্লকগুলো ইজারা দেয়ার সময় জনগণের সম্মতি নেয় নাই, জনগণের অগোচরে তারা বিদেশিদের এই ব্লকগুলো ইজারা দেয়। এভাবে দেশের ভুখন্ড ইজারা দেয়া দেশের সংবিধান পরিপন্থী। যদি কোন কারণে ব্লকগুলো ইজারা দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিতো তাহলে গণভোটে নিতে হতো।

পেট্রোবালা গঠনের সময় এ সংস্থা সম্পর্কিত একটি আইন সরকার প্রণয়ণ করেন কিন্তু ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর পেট্রোবাংলা গঠনের আইন অক্ষত রেখে একটি স্বশাসিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে মন্ত্রণালয়ের অধীনে করা হয়। পেট্রোবাংলা জ্বালানি মন্ত্রণালায়ের অধিদপ্তর হিসেবে কাজ করতে আরম্ভ করে। ফলে জ্বালানি খাতটি আমলানির্ভর হয়ে উঠে। একজন যুগ্ম সচিব পেট্রোবালার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার কোনো জ্ঞান নেই তারপরও তিনি প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। বিষয়টা হয়ে যায় গাধা দিয়ে গরুর লাঙ্গল টানানোর মতো। আর এই কারণে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদে বিদেশিরা সহজেই হস্তক্ষেপ করতে পারে। আজকের জ্বালানি উপদেষ্টা যখন জ্বালানি সচিব ছিলেন তার ভুমিকাই বলে দেয় এই খাতটি কতখানি আমলানির্ভর হয়ে ঊঠেছে। সে সময় মাগুরছড়া গ্যাস ফিল্ড এবং টেংরাটিলার গ্যাস ফিল্ডের চুক্তি নাইকোর সঙ্গে সম্পাদিত হয়। এই সম্পাদিত চুক্তির বৈধতা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। নাইকো এই দুইটি গ্যাস ফিল্ডে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণে দেশের কোটি কোটি ঘনফুট গ্যাস বিনষ্ট হয়ে গেছে।

আন্তর্জাতিকভাবে পুঁজিবাদীদের লোলুপদৃষ্টির রোষানলে পড়ে বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ আজ বির্পযস্ত। যেমন আমরা সাধারণভাবে জানি যে সমুদ্র বিশ্বের সকল মানুষের সম্পদ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আগ্রাসী বিশ্ব ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের সমুদ্র সম্পদ আজ তাদের হস্তচ্যুত, এই সমুদ্রে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করছে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক কোম্পানি। পৃথিবীর দেশে দেশে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক কোম্পানি হায়েনার মতে হামলে পড়ছে সমুদ্রর গর্ভে রক্ষিত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর। বহুজাতিক কোম্পানির এ হামলার বাইরে থাকতে পারেনি বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ।

পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক শাসক পেট্রোবাংলাকে প্রযুক্তিবিদের হাত থেকে নিয়ে অদক্ষ আমলাদের হাতে তুলে দেয়। পেট্রোবাংলা নিয়ন্ত্রণকারীদের কারিগরি বিষয়ে জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তাই এ দেশের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ যথাযথ প্রযুক্তির ব্যবহারে উত্তোলিত হচ্ছে না। দক্ষ পেট্রোবাংলা গড়ে উঠলে এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে রাষ্ট্র মাধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারে। বিশাল সমুদ্র বক্ষে রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। সমুদ্রের গভীরে বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস। সরকার পেট্রোবাংলার মাধ্যমে সমুদ্রপৃষ্টের প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণ করে এই গ্যাসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে পারে।

অনেকেই মনে করেন সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে গ্যাস আহরণের সক্ষমতা সরকারের নেই এই ধারণাটা সঠিক নয় কারণ অনেক বাংলাদেশি প্রকৌশলী প্রবাসে গিয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে, এসব প্রকৌশলীদের দেশে ফিরিয়ে এনে যথাযথ সম্মান দিয়ে পদায়ন করলে তাদের জ্ঞানের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা সম্ভব, তাছাড়া বাংলাদেশের অর্থ সংকট নেই। গ্যাস আহরণে সরকারের বিদেশি নির্ভরতা কমাতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। সক্ষমতা বলতে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে বুঝানো হচ্ছে। কারণ সরকার আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রেসক্রিপশানে জ্বালানি খাতের নীতি গ্রহণ করলে কোন দিনই দেশ বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণ করতে পারবে না। বর্তমানে সরকারকে ব্যাক্তি খাতে বিদ্যুৎ কেনায় প্রতি বছর ৬ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হচ্ছে। এই পেমেন্টের অর্থ দিয়ে বছরে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হতো।

দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরনের প্রক্রিয়া চালানো উচিত। প্রযুক্তিগতভাবে এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলা দরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ করে গড়ে তুললে এর ফলে বিদেশি কোম্পানির নির্ভরতা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। বিদেশি কোম্পানির নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারলে জ্বালানি খাতের ভর্তুকি অনেক কমে যাবে। আর বিদ্যুৎ সংকট নিরসন সম্ভব হবে।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে বাধা কোথায়

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট ২০২২

উনিশ শতকের প্রথম দিকে কিছু বেসরকারি সংস্থা বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তেল গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে। ইন্ডিয়ান পেট্রোলিয়াম কোম্পানি নামে একটি সংস্থা চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে ১৯০৮ সালে অনুসন্ধান চালায়। ১৯২১-২৩ সালে Burmah Oil Company (BOC) পাথারিয়া নামক স্থানে তেল গ্যাস উত্তোলনের জন্য খনন কাজ শুরু করে। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান Pakistan Petroleum Act in 1948 চালু হয়। এই আইনের অধীন তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানে The Standard Vacuum Oil Company (STANVAC) of USA, Pakistan Petroleum Ltd. (PPL)- a Burmah Oil Company and Pakistan Shell Oil Company (PSOC) তেল গ্যাস এর অনু সন্ধান চালায় তারা ১৬টি অঞ্চলে অনুসন্ধান চালিয়ে সাতটি গ্যাসকুপ আবিস্কার করে। ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের জাতীয়ভিত্তিক পাবলিক সেক্টরে Oil and Gas Development Corporation (OGDC) প্রতিষ্ঠা পায়। এই কোম্পানিটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের পদ্বতি অনুসরণ করে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান চালায়।

১৯৭১ সালে বালাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসব কোম্পানির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার সেই সময়ে বাংলাদেশে তেল-গ্যাস আহরনকারী দুইটি বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস ক্ষেত্রগুলো রাষ্টের জন্য কিনে নেয় ফলে সকল প্রকার প্রাকৃতিক সম্পদ জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়। ১৯৭২ সালের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-২৭ অনুসারে বাংলাদেশ খনিজ তৈল এবং গ্যাস করপোরেশন (BMOGC) প্রতিষ্ঠা পায়। সেই সময়ে সারাদেশ ৬টি ব্লকে বিভক্ত করে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের চেষ্টা চালানো হয়। বর্তমানে সমুদ্র পৃষ্ঠসহ সমগ্র দেশকে ৫৬টি ব্লকে বিভক্ত করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে ২২ আগস্ট বাংলাদেশ খনিজ তৈল এবং গ্যাস করপোরেশন (BMOGC) পেট্রোবাংলায় রুপান্তরিত হয়। পেট্রোবাংলা একটি স্ব শাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। দেশের অভ্যান্তরে জ্বালানি বিষয়ক সকল দায় দায়িত্ব পেট্রোবাংলার ওপর বর্তায়, নিয়মানুসারে পেট্রোবাংলার ব্যবস্থাপনাসহ সকল দায়দায়িত্ব পালন করবে প্রযুক্তিবিদ প্রকৌশলীরা।

১৯৮৫ সালে এসে পেট্রোবাংলার ওপর শুধুমাত্র তেল গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। এরশাদের আমলে বাংলাদেশের ভুমিকে ২৩ টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা সরকারের আমলে তেল গ্যাস সমৃদ্ধ ১৫টি ব্লককে বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়া হয়। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক জনগণ এই সম্পদ কাউকে ইজারা দিতে হলে জনগনের সম্মতি নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু আমরা দেখতে পাই কোন সরকারই ব্লকগুলো ইজারা দেয়ার সময় জনগণের সম্মতি নেয় নাই, জনগণের অগোচরে তারা বিদেশিদের এই ব্লকগুলো ইজারা দেয়। এভাবে দেশের ভুখন্ড ইজারা দেয়া দেশের সংবিধান পরিপন্থী। যদি কোন কারণে ব্লকগুলো ইজারা দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিতো তাহলে গণভোটে নিতে হতো।

পেট্রোবালা গঠনের সময় এ সংস্থা সম্পর্কিত একটি আইন সরকার প্রণয়ণ করেন কিন্তু ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর পেট্রোবাংলা গঠনের আইন অক্ষত রেখে একটি স্বশাসিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে মন্ত্রণালয়ের অধীনে করা হয়। পেট্রোবাংলা জ্বালানি মন্ত্রণালায়ের অধিদপ্তর হিসেবে কাজ করতে আরম্ভ করে। ফলে জ্বালানি খাতটি আমলানির্ভর হয়ে উঠে। একজন যুগ্ম সচিব পেট্রোবালার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার কোনো জ্ঞান নেই তারপরও তিনি প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। বিষয়টা হয়ে যায় গাধা দিয়ে গরুর লাঙ্গল টানানোর মতো। আর এই কারণে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদে বিদেশিরা সহজেই হস্তক্ষেপ করতে পারে। আজকের জ্বালানি উপদেষ্টা যখন জ্বালানি সচিব ছিলেন তার ভুমিকাই বলে দেয় এই খাতটি কতখানি আমলানির্ভর হয়ে ঊঠেছে। সে সময় মাগুরছড়া গ্যাস ফিল্ড এবং টেংরাটিলার গ্যাস ফিল্ডের চুক্তি নাইকোর সঙ্গে সম্পাদিত হয়। এই সম্পাদিত চুক্তির বৈধতা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। নাইকো এই দুইটি গ্যাস ফিল্ডে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণে দেশের কোটি কোটি ঘনফুট গ্যাস বিনষ্ট হয়ে গেছে।

আন্তর্জাতিকভাবে পুঁজিবাদীদের লোলুপদৃষ্টির রোষানলে পড়ে বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ আজ বির্পযস্ত। যেমন আমরা সাধারণভাবে জানি যে সমুদ্র বিশ্বের সকল মানুষের সম্পদ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আগ্রাসী বিশ্ব ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের সমুদ্র সম্পদ আজ তাদের হস্তচ্যুত, এই সমুদ্রে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করছে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক কোম্পানি। পৃথিবীর দেশে দেশে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক কোম্পানি হায়েনার মতে হামলে পড়ছে সমুদ্রর গর্ভে রক্ষিত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর। বহুজাতিক কোম্পানির এ হামলার বাইরে থাকতে পারেনি বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ।

পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক শাসক পেট্রোবাংলাকে প্রযুক্তিবিদের হাত থেকে নিয়ে অদক্ষ আমলাদের হাতে তুলে দেয়। পেট্রোবাংলা নিয়ন্ত্রণকারীদের কারিগরি বিষয়ে জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তাই এ দেশের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ যথাযথ প্রযুক্তির ব্যবহারে উত্তোলিত হচ্ছে না। দক্ষ পেট্রোবাংলা গড়ে উঠলে এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে রাষ্ট্র মাধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারে। বিশাল সমুদ্র বক্ষে রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। সমুদ্রের গভীরে বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস। সরকার পেট্রোবাংলার মাধ্যমে সমুদ্রপৃষ্টের প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণ করে এই গ্যাসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে পারে।

অনেকেই মনে করেন সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে গ্যাস আহরণের সক্ষমতা সরকারের নেই এই ধারণাটা সঠিক নয় কারণ অনেক বাংলাদেশি প্রকৌশলী প্রবাসে গিয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে, এসব প্রকৌশলীদের দেশে ফিরিয়ে এনে যথাযথ সম্মান দিয়ে পদায়ন করলে তাদের জ্ঞানের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা সম্ভব, তাছাড়া বাংলাদেশের অর্থ সংকট নেই। গ্যাস আহরণে সরকারের বিদেশি নির্ভরতা কমাতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। সক্ষমতা বলতে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে বুঝানো হচ্ছে। কারণ সরকার আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রেসক্রিপশানে জ্বালানি খাতের নীতি গ্রহণ করলে কোন দিনই দেশ বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণ করতে পারবে না। বর্তমানে সরকারকে ব্যাক্তি খাতে বিদ্যুৎ কেনায় প্রতি বছর ৬ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হচ্ছে। এই পেমেন্টের অর্থ দিয়ে বছরে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হতো।

দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরনের প্রক্রিয়া চালানো উচিত। প্রযুক্তিগতভাবে এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলা দরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ করে গড়ে তুললে এর ফলে বিদেশি কোম্পানির নির্ভরতা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। বিদেশি কোম্পানির নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারলে জ্বালানি খাতের ভর্তুকি অনেক কমে যাবে। আর বিদ্যুৎ সংকট নিরসন সম্ভব হবে।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

back to top