মোহাম্মদ আবু নোমান
বাংলাদেশ সরকার সুইস ব্যাংকের কাছে তথ্য চায়নি মানলাম; কিন্তু আপনারা জমা রাখার সময় কেন এসব টাকার উৎস সম্পর্কে তথ্য চাননি? চুরি, ডাকাতি, লুটপাটের টাকা, না সাদা টাকা- এটুকু যাচাই করার নৈতিক সততা কেন আপনাদের নেই? বাংলাদেশে নিজের অ্যাকাউন্টে সপ্তাহে কয়েকবার লেনদেন করলেই টাকার উৎস ছাড়াও ইনকান ট্যাক্সের ডকুমেন্ট চাওয়া হয়, কিন্তু আপনাদের সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্টগুলোতে হাজার কোটি টাকা জমা রাখলেও কেন আপনারা উৎস জানতে চান না? সুইস ব্যাংকের এই উদার নীতির কারণেই দেশে দেশে লুটেরা পয়দা হচ্ছে নাতো? সারা বিশ্বের লুটেরাদের (সবাই নয়) টাকা লুকিয়ে রেখে কী করে গলা উচু করে কথা বলেন?
গত ১০ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজিত ‘ডিকাব টক’ অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড বলেন, ‘সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের বেশির ভাগ অবৈধ পথে আয় করা হয়েছে, এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তবে সুইস ব্যাংকে জমা রাখা অর্থের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির জন্য তথ্য চায়নি।’
সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড স্বীকার করলেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের সুইস ব্যাংকে জমা করা অর্থের বেশির ভাগ অবৈধ পথে আয় করা। তাহলে বলাই যায়, সুইস সরকার তাদের পৃষ্ঠপোষক! তৃতীয় বিশ্বের বড়-বড় চোরেরা তাদের মক্কেল। নানা চাতুরির মাধ্যমে তারা তৃতীয় বিশ্বের রক্তঝড়ানো অর্থ লালন-পালন করছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বড় ধরনের জমাকারীর জমার উৎস এবং ডকুমেন্ট হিসেবে ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্নের কপি চেয়ে থাকে। আর তারা সভ্য জগতে বাস করে এটা করে না, তা মানা যায় কী?
প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানে সুইস রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড বলেন, ‘সুইস ব্যাংক সে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের ১০ শতাংশের মতো অবদান রেখে থাকে।’ এটা অনেক বড় ব্যাপার। এভাবে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও যদি ব্যাংক পয়দা করে টাকার উপার্জনের উৎস যাচাই-বাছাই না করে রাখা শুরু করে তাহলে বিশ্বের অবস্থা কী হবে? মানুষের রক্ত চোষা সরকারি, বেসরকারি, দুর্নীতিবাজদের টাকা থেকে অর্থনীতিতে ১০ ভাগ অবদান কীভাবে চলতে পারে! সুইজারল্যান্ডের মতো একটি দুর্নীতিমুক্ত, সুখী ও শান্তিপ্রিয় দেশ কী করে দুনিয়ার সমস্ত দুর্নীতিবাজদের অর্থ রাখে!
অন্যদিকে গত ১২ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘সুইস রাষ্ট্রদূত মিথ্যা বলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ফিন্যান্স সেক্রেটারি আমাকে আগে জানিয়েছিলেন, তারা তথ্য চেয়েছিলেন, তারা (সুইস ব্যাংক) উত্তর দেননি।’ তাহলে প্রমাণ হোক কে সত্য বলছে?
টাকা পাচারের খবর কোন নতুন টোপিক নয়। জাতি তাদের দেখতে চায়, যারা এ দেশটাকে চেটেপুটে সুইস ব?্যাংকে টাকার পাহাড় বানিয়েছে। সবার মুখোশ উন্মোচন করা হোক। ক্ষমতাসীনদের বোঝা উচিত, এভাবে চলতে পারে না। মানুষের মনের ভাষা জানুন, মানুষ কি বলতে চায়। দেয়ালে মানুষের পিঠ ঠেকে গেছে। একদিকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমানো অর্থের স্ফীতি! অন্যদিকে বাংলার মাটিতে এখনো বহু অনাহারী, উপবাসী, নিরন্ন মানুষ, যারা দুই বেলা খাবারের জন্য রাতদিন সংগ্রাম করে চলছে! আজকের ডলার সঙ্কট এদের কারণেই। আমাদের প্রিয় সোনার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শেষ করে দিচ্ছে এই লুটেরা দল। আমরা তাদের পরিচয় জানাতে চাই, তাদের দেখতে চাই।
অতীতের সব সরকারের আমলেই দলীয় নেতাকর্মী, এমপি, মন্ত্রী, আমলা, শিল্পপতিরা দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল করে দিয়েছে। তাদেরকে না ধরার কারণেই আজকে আমজনতার উপরই সমস্ত দায়ভার চেপেছে। মূল্যবৃদ্ধি এডজাস্ট করতে হয় নিরপরাধ জনগণকে। এটা রীতিমতো জুলুম নয় কী?
সুইজারল্যান্ড বিশ্বের মধ্যে শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্র হলেও এমন একটি ব্যাঙ্কিং সিস্টেম তৈরি করেছে, যেখানে পৃথিবীর সব বড়ো বড়ো চোর, বদমাইশ, ক্রিমিনাল, দুর্নীতিবাজ, ড্রাগডিলার, আর্মস ডিলার, ট্যাক্স ফাঁকিবাজরা নিরাপদে তাদের টাকা লুকিয়ে রাখে। সে টাকা দিয়ে সুইজারল্যান্ড বাণিজ্য করে থাকে। সুইজারল্যান্ড কি পারে না, তাদের খবর প্রকাশ করে দিতে? কিন্তু করে না বলেই আমাদেরকে উইকিলিকস, পানামা পেপার ইত্যাদির কাছ থেকে গোপন খবর জানতে হয়। সুইজারল্যান্ড যদি এসব মহা চোরদের লুক্কায়িত সম্পদের হিসাব এবং নাম-ঠিকানা তাদের নিজ নিজ সরকারের চাহিদা মতো দিয়ে দিতো, তাহলে বিশ্বের দুর্নীতি অনেকাংশে নির্মূল হয়ে যেত। সুইস ব্যাংক শব্দটাই কিংবা উইকিলিকস, পানামা পেপার এগুলোর নাম আমরা জানতামও না।
বিশ্বের ধনীদের বৈধ-অবৈধ অর্থ রাখার নিরাপদ জায়গা হিসেবে সুইজারল্যান্ডের খ্যাতি দীর্ঘদিনের। গ্রাহকদের নাম-পরিচয় গোপন রাখার ক্ষেত্রে কঠোর নীতির কারণে অর্থপাচারকারীদের প্রথম পছন্দ দেশটির ব্যাংকগুলো। নির্দিষ্ট গ্রাহকের তথ্য না দিলেও এক দশক ধরে এ বিষয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক। কিন্তু গ্রাহকদের তথ্য তারা গোপন রাখছে। এই গোপনীয়তার নীতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশের দুর্নীতিবাজ অর্থপাচারকারীরা তাদের অর্থ সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা রাখেন। সুইজার?ল্যান্ডের আইন অনুযায়ী দেশটির ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য নয়। গ্রাহকের জমা করা অর্থের উৎস সম্পর্কেও সুইস কর্তৃপক্ষ জানতে চায় না।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা (এক ফ্রাঁ=৯৫ টাকা)। ২০২০ সালে এর পরিমাণ ছিলো ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। এক বছরে এটা শতকরা ৫৫ ভাগ বেড়েছে। এটা এ পর্যন্ত এক বছরে সর্বোচ্চ; যা গত দুই দশকের মধ্যে গত বছরই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ জমার রেকর্ড হয়েছে। ২০০০ সালে সুইস ব্যাংকে জমা বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৯৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালে এসে সেটি বেড়ে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এর বাইরে কোনো বাংলাদেশি তার নাগরিকত্ব গোপন করে অর্থ জমা রেখে থাকেন, তবে ওই টাকা এই হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। গচ্ছিত রাখা সোনা বা মূল্যবান সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমানও হিসাব করা হয় না সুইস ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে। আমরা বলতে চাই, আট, দশ বা বিশ হাজার কোটি কোন বিষয় নয়; ফ্যাক্টর হলো টাকাটা যে ভদ্রলোক রেখেছে সে কে এবং কী প্রসেসে ওখানে নিয়ে গেল। এটা শুধু সুইজারল্যান্ডের হিসেব। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ সব দেশের হিসেব করলে বিদেশে অর্থপাচারের মোট অঙ্কটা লক্ষ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
ক্রমবর্ধমান অর্থ পাচার বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ যে গগনচুম্বী, এ বিষয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। একইভাবে কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের অর্থ পাচারের বেশির ভাগ সংঘটিত হয় আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে মিস ইনভয়েসিং বা চালান জালিয়াতির মাধ্যমে, যার ফলে একদিকে যেমন ব্যাপক কর ফাঁকি সংঘটিত হচ্ছে, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে।
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের অর্থ জমার পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। তবে সব অর্থ অবৈধ তা আমরা বলছি না। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও সেখানে অর্থ রাখতে পারেন। তবে নানাভাবে দেশ থেকে অর্থপাচার বাড়ছে, এটা সত্য। বিদেশে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য সংগ্রহের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা বিএফআইইউ। পারস্পরিক আইনি সহায়তা ও চুক্তির মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করা জরুরি বলে আমরা মনে করছি।
অতীত অভিজ্ঞতা ও তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যায়। এছাড়া বাণিজ্যের আড়ালেও আর্থিক পুঁজি পাচার হয়। ইতোমধ্যে সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদন প্রকাশের পর পাচারের দায় নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বাহাস শুরু হয়েছে। বিএনপির বলছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই এই অর্থ পাচার করেছেন। আর আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, পাচারের রেকর্ড বিএনপির আছে, আওয়ামী লীগের নয়। কিন্তু গত দশ বছর যে আরও বেশি পরিমাণ অর্থ পাচার হলো, তার জবাব কী? অর্থ পাচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পারস্পরিক দোষারোপ সমাধান নয়। বিএনপির পাচারের রেকর্ড আছে বললেও ক্ষমতাসীনদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি। বিএনপির আমলে পাচার হওয়া অর্থের দায় যদি বিএনপি নেতাদের ওপর পড়ে, তাহলে আওয়ামী লীগের আমলে পাচার হওয়া অর্থের দায়ও ক্ষমতাসীনদের?
টাকা পাচার ঠেকানোর যথেষ্ট কোনো পদ্ধতি বা উদ্যোগও দেশে নেই। এখানেই সবার আগে প্রয়োজন রাজনীতির সদিচ্ছা, যা শূন্যের কোঠায়। আমাদের দেশে আগাছার আগাটা কাটা হয়, আমরা সবসময় দেখে আসছি গোড়াটা থেকেই যায়। পানি ঘোলা করার কোন দরকার নেই, সুইস ব্যাংকের টাকা কীভাবে বাংলাদেশ আনা যায় সেই ব্যবস্থা করুন, দেশের মানুষকে রক্ষা করুন।
[লেখক : সাংবাদিক]
মোহাম্মদ আবু নোমান
বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট ২০২২
বাংলাদেশ সরকার সুইস ব্যাংকের কাছে তথ্য চায়নি মানলাম; কিন্তু আপনারা জমা রাখার সময় কেন এসব টাকার উৎস সম্পর্কে তথ্য চাননি? চুরি, ডাকাতি, লুটপাটের টাকা, না সাদা টাকা- এটুকু যাচাই করার নৈতিক সততা কেন আপনাদের নেই? বাংলাদেশে নিজের অ্যাকাউন্টে সপ্তাহে কয়েকবার লেনদেন করলেই টাকার উৎস ছাড়াও ইনকান ট্যাক্সের ডকুমেন্ট চাওয়া হয়, কিন্তু আপনাদের সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্টগুলোতে হাজার কোটি টাকা জমা রাখলেও কেন আপনারা উৎস জানতে চান না? সুইস ব্যাংকের এই উদার নীতির কারণেই দেশে দেশে লুটেরা পয়দা হচ্ছে নাতো? সারা বিশ্বের লুটেরাদের (সবাই নয়) টাকা লুকিয়ে রেখে কী করে গলা উচু করে কথা বলেন?
গত ১০ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজিত ‘ডিকাব টক’ অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড বলেন, ‘সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের বেশির ভাগ অবৈধ পথে আয় করা হয়েছে, এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তবে সুইস ব্যাংকে জমা রাখা অর্থের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির জন্য তথ্য চায়নি।’
সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড স্বীকার করলেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের সুইস ব্যাংকে জমা করা অর্থের বেশির ভাগ অবৈধ পথে আয় করা। তাহলে বলাই যায়, সুইস সরকার তাদের পৃষ্ঠপোষক! তৃতীয় বিশ্বের বড়-বড় চোরেরা তাদের মক্কেল। নানা চাতুরির মাধ্যমে তারা তৃতীয় বিশ্বের রক্তঝড়ানো অর্থ লালন-পালন করছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বড় ধরনের জমাকারীর জমার উৎস এবং ডকুমেন্ট হিসেবে ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্নের কপি চেয়ে থাকে। আর তারা সভ্য জগতে বাস করে এটা করে না, তা মানা যায় কী?
প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানে সুইস রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড বলেন, ‘সুইস ব্যাংক সে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের ১০ শতাংশের মতো অবদান রেখে থাকে।’ এটা অনেক বড় ব্যাপার। এভাবে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও যদি ব্যাংক পয়দা করে টাকার উপার্জনের উৎস যাচাই-বাছাই না করে রাখা শুরু করে তাহলে বিশ্বের অবস্থা কী হবে? মানুষের রক্ত চোষা সরকারি, বেসরকারি, দুর্নীতিবাজদের টাকা থেকে অর্থনীতিতে ১০ ভাগ অবদান কীভাবে চলতে পারে! সুইজারল্যান্ডের মতো একটি দুর্নীতিমুক্ত, সুখী ও শান্তিপ্রিয় দেশ কী করে দুনিয়ার সমস্ত দুর্নীতিবাজদের অর্থ রাখে!
অন্যদিকে গত ১২ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘সুইস রাষ্ট্রদূত মিথ্যা বলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ফিন্যান্স সেক্রেটারি আমাকে আগে জানিয়েছিলেন, তারা তথ্য চেয়েছিলেন, তারা (সুইস ব্যাংক) উত্তর দেননি।’ তাহলে প্রমাণ হোক কে সত্য বলছে?
টাকা পাচারের খবর কোন নতুন টোপিক নয়। জাতি তাদের দেখতে চায়, যারা এ দেশটাকে চেটেপুটে সুইস ব?্যাংকে টাকার পাহাড় বানিয়েছে। সবার মুখোশ উন্মোচন করা হোক। ক্ষমতাসীনদের বোঝা উচিত, এভাবে চলতে পারে না। মানুষের মনের ভাষা জানুন, মানুষ কি বলতে চায়। দেয়ালে মানুষের পিঠ ঠেকে গেছে। একদিকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমানো অর্থের স্ফীতি! অন্যদিকে বাংলার মাটিতে এখনো বহু অনাহারী, উপবাসী, নিরন্ন মানুষ, যারা দুই বেলা খাবারের জন্য রাতদিন সংগ্রাম করে চলছে! আজকের ডলার সঙ্কট এদের কারণেই। আমাদের প্রিয় সোনার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শেষ করে দিচ্ছে এই লুটেরা দল। আমরা তাদের পরিচয় জানাতে চাই, তাদের দেখতে চাই।
অতীতের সব সরকারের আমলেই দলীয় নেতাকর্মী, এমপি, মন্ত্রী, আমলা, শিল্পপতিরা দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল করে দিয়েছে। তাদেরকে না ধরার কারণেই আজকে আমজনতার উপরই সমস্ত দায়ভার চেপেছে। মূল্যবৃদ্ধি এডজাস্ট করতে হয় নিরপরাধ জনগণকে। এটা রীতিমতো জুলুম নয় কী?
সুইজারল্যান্ড বিশ্বের মধ্যে শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্র হলেও এমন একটি ব্যাঙ্কিং সিস্টেম তৈরি করেছে, যেখানে পৃথিবীর সব বড়ো বড়ো চোর, বদমাইশ, ক্রিমিনাল, দুর্নীতিবাজ, ড্রাগডিলার, আর্মস ডিলার, ট্যাক্স ফাঁকিবাজরা নিরাপদে তাদের টাকা লুকিয়ে রাখে। সে টাকা দিয়ে সুইজারল্যান্ড বাণিজ্য করে থাকে। সুইজারল্যান্ড কি পারে না, তাদের খবর প্রকাশ করে দিতে? কিন্তু করে না বলেই আমাদেরকে উইকিলিকস, পানামা পেপার ইত্যাদির কাছ থেকে গোপন খবর জানতে হয়। সুইজারল্যান্ড যদি এসব মহা চোরদের লুক্কায়িত সম্পদের হিসাব এবং নাম-ঠিকানা তাদের নিজ নিজ সরকারের চাহিদা মতো দিয়ে দিতো, তাহলে বিশ্বের দুর্নীতি অনেকাংশে নির্মূল হয়ে যেত। সুইস ব্যাংক শব্দটাই কিংবা উইকিলিকস, পানামা পেপার এগুলোর নাম আমরা জানতামও না।
বিশ্বের ধনীদের বৈধ-অবৈধ অর্থ রাখার নিরাপদ জায়গা হিসেবে সুইজারল্যান্ডের খ্যাতি দীর্ঘদিনের। গ্রাহকদের নাম-পরিচয় গোপন রাখার ক্ষেত্রে কঠোর নীতির কারণে অর্থপাচারকারীদের প্রথম পছন্দ দেশটির ব্যাংকগুলো। নির্দিষ্ট গ্রাহকের তথ্য না দিলেও এক দশক ধরে এ বিষয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক। কিন্তু গ্রাহকদের তথ্য তারা গোপন রাখছে। এই গোপনীয়তার নীতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশের দুর্নীতিবাজ অর্থপাচারকারীরা তাদের অর্থ সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা রাখেন। সুইজার?ল্যান্ডের আইন অনুযায়ী দেশটির ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য নয়। গ্রাহকের জমা করা অর্থের উৎস সম্পর্কেও সুইস কর্তৃপক্ষ জানতে চায় না।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা (এক ফ্রাঁ=৯৫ টাকা)। ২০২০ সালে এর পরিমাণ ছিলো ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। এক বছরে এটা শতকরা ৫৫ ভাগ বেড়েছে। এটা এ পর্যন্ত এক বছরে সর্বোচ্চ; যা গত দুই দশকের মধ্যে গত বছরই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ জমার রেকর্ড হয়েছে। ২০০০ সালে সুইস ব্যাংকে জমা বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৯৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালে এসে সেটি বেড়ে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এর বাইরে কোনো বাংলাদেশি তার নাগরিকত্ব গোপন করে অর্থ জমা রেখে থাকেন, তবে ওই টাকা এই হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। গচ্ছিত রাখা সোনা বা মূল্যবান সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমানও হিসাব করা হয় না সুইস ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে। আমরা বলতে চাই, আট, দশ বা বিশ হাজার কোটি কোন বিষয় নয়; ফ্যাক্টর হলো টাকাটা যে ভদ্রলোক রেখেছে সে কে এবং কী প্রসেসে ওখানে নিয়ে গেল। এটা শুধু সুইজারল্যান্ডের হিসেব। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ সব দেশের হিসেব করলে বিদেশে অর্থপাচারের মোট অঙ্কটা লক্ষ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
ক্রমবর্ধমান অর্থ পাচার বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ যে গগনচুম্বী, এ বিষয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। একইভাবে কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের অর্থ পাচারের বেশির ভাগ সংঘটিত হয় আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে মিস ইনভয়েসিং বা চালান জালিয়াতির মাধ্যমে, যার ফলে একদিকে যেমন ব্যাপক কর ফাঁকি সংঘটিত হচ্ছে, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে।
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের অর্থ জমার পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। তবে সব অর্থ অবৈধ তা আমরা বলছি না। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও সেখানে অর্থ রাখতে পারেন। তবে নানাভাবে দেশ থেকে অর্থপাচার বাড়ছে, এটা সত্য। বিদেশে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য সংগ্রহের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা বিএফআইইউ। পারস্পরিক আইনি সহায়তা ও চুক্তির মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করা জরুরি বলে আমরা মনে করছি।
অতীত অভিজ্ঞতা ও তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যায়। এছাড়া বাণিজ্যের আড়ালেও আর্থিক পুঁজি পাচার হয়। ইতোমধ্যে সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদন প্রকাশের পর পাচারের দায় নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বাহাস শুরু হয়েছে। বিএনপির বলছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই এই অর্থ পাচার করেছেন। আর আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, পাচারের রেকর্ড বিএনপির আছে, আওয়ামী লীগের নয়। কিন্তু গত দশ বছর যে আরও বেশি পরিমাণ অর্থ পাচার হলো, তার জবাব কী? অর্থ পাচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পারস্পরিক দোষারোপ সমাধান নয়। বিএনপির পাচারের রেকর্ড আছে বললেও ক্ষমতাসীনদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি। বিএনপির আমলে পাচার হওয়া অর্থের দায় যদি বিএনপি নেতাদের ওপর পড়ে, তাহলে আওয়ামী লীগের আমলে পাচার হওয়া অর্থের দায়ও ক্ষমতাসীনদের?
টাকা পাচার ঠেকানোর যথেষ্ট কোনো পদ্ধতি বা উদ্যোগও দেশে নেই। এখানেই সবার আগে প্রয়োজন রাজনীতির সদিচ্ছা, যা শূন্যের কোঠায়। আমাদের দেশে আগাছার আগাটা কাটা হয়, আমরা সবসময় দেখে আসছি গোড়াটা থেকেই যায়। পানি ঘোলা করার কোন দরকার নেই, সুইস ব্যাংকের টাকা কীভাবে বাংলাদেশ আনা যায় সেই ব্যবস্থা করুন, দেশের মানুষকে রক্ষা করুন।
[লেখক : সাংবাদিক]