alt

উপ-সম্পাদকীয়

নাম তার পারুল চাকমা

এম এ কবীর

: শুক্রবার, ১৯ আগস্ট ২০২২

মহাভারতে উল্লেখ আছে- বড় ভাই তার ছোট ভাইকে নির্দেশ করেন ফসলের ক্ষেতে বাঁধ দিতে। না হলে সব জল তার জমিতে ঢুকে যাচ্ছে। ছোট ভাই বাঁধ দিতে অস্বীকার করলে রেগে গিয়ে বড় ভাই ছোট ভাইকে খুন করে তার মৃতদেহ টেনে নিয়ে পানি প্রবেশের মুখ আটকে দেয়। এ ঘটনা বাসুদেব কৃষ্ণকে মর্মাহত করে। এই নিষ্ঠুরতা কোনভাবেই তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। বুঝতে পারেন মানুষের মাঝে অজ্ঞতা কোন পর্যায়ে পৌঁছলে বড় ভাই এ রকম নৃশংস হতে পারে। তিনি স্থির করেন এই স্থানে রক্তপাত ঘটিয়ে অজ্ঞতাকে নিঃশেষ করে দেবেন। ন্যায় এবং জ্ঞানের বিজয় ঘটাবেন। প্রস্ফুটিত হবে বিদ্যা, বিনয় আর মনুষ্যত্বের। পান্ডবরা ছিলেন জ্ঞানের প্রতীক, কৌরবরা নৃশংসতা আর অজ্ঞতার মূর্ত প্রতীক। আঠারো দিনের এই যুদ্ধে রক্তের গঙ্গা বয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত নৈতিকতা আর জ্ঞানের বিজয় হয়।

অভাবে সন্তানকে বাজারে বিক্রি করতে এসেছেন মা। নাম তার পারুল চাকমা। স্বামী ছেড়ে গেছেন অনেক দিন আগে। নিজেও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। থাকেন বাবার বাড়িতে। সেখানেও অভাব নিত্যসঙ্গী। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হয়। খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার একটি বাজারে নিজের বুকের ধন ছয় বছরের রামকৃষ্ণ চাকমাকে বিক্রি করতে আনেন। তিনি ছেলের দাম চান ১২ হাজার টাকা। পারুল চাকমা খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া পাকোজ্জ্যাছড়ি গ্রামের কালাবো চাকমার মেয়ে। সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য বাসন্তী চাকমা বলেন, পারুল চাকমা খুব বেশি অভাবে থাকার কারণে এই কাজটি করেছেন বলে জানতে পেরেছি।

বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছেন, সুখে আছেন-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের এ বক্তব্যে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দলের নেতাকর্মী ও মন্ত্রীদের সতর্ক করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান ফেসবুকে লিখেছেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা দায়িত্বপূর্ণ কথা বলবেন, এ প্রত্যাশা কি আসলেই বেশি? তা না হলে অনেক কথাই তো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো মনে হতে পারে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতির অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ ফেসবুকে লম্বা সমালোচনা লিখেছেন। এলজিআরডিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, গ্রামগঞ্জে কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে। আমি মনে করি না আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক ৩১ জুলাই বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের জন্য গম আমদানি কমাতে আটার রুটির বদলে চালের রুটি খাওয়ার পরামর্শ দেন। ৬ আগস্ট কুমিল্লায় এক কর্মশালায় কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক দেশের মানুষকে কম খাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘এখন তো বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিলে রিজার্ভ একদম কমে যাবে। এতে দেশ হুমকির মুখে পড়ে যাবে। তার চেয়ে বরং এখনই কিছুটা কষ্ট করে আমরা সাবধান হই। তেল কম খরচ করেন, বিদ্যুৎ কম খরচ করেন, আমরা একটু সাশ্রয় করি, একটু কম খাই।’

ফ্রান্সিস বেকন ১৬২০ সালে ‘নিউ ইনস্ট্রমেন্ট’ শিরোনামে এক বৈজ্ঞানিক ইশতেহারে দাবি করেন ‘জ্ঞানই শক্তি’। তিনি বিশ্বাস করতেন কুসংস্কার ও আত্মগরিমার প্রতিবন্ধকতা থেকে মনকে মুক্ত করতে পারলে মানুষ তার জ্ঞানের দ্বারা প্রকৃতির ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সমর্থ হবে। অজ্ঞতা স্বীকার করার মধ্য দিয়েই আধুনিক বিজ্ঞানকে করে তুলেছে পূর্ববর্তী যে কোন জ্ঞানের ঐতিহ্যের তুলনায় আরও বেশি শক্তিশালী, নমনীয় ও কৌতূহলী। ফলে মহাজগত কীভাবে কাজ করে তা বোঝা ও নব নব আবিষ্কারের সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগে এসেও ‘জ্ঞানই শক্তি’ বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞাটি আজও সর্বজনস্বীকৃত এবং নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত। জ্ঞানই শক্তি এই আলোকবর্তিকার পথ ধরে এগোচ্ছে সভ্যতা। যেরূপ বিকশিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব সিন্ধু, মেসোপটেমিয়া, মিসরীয়, মিনোয়ান, চৈনিক, নুবিয়া, মায়া, হিতিতেস, ওলমেক, শাভিন, ইনকা, রোমান, গ্রিস, আসীরিয়ান সভ্যতা। সভ্যতার ইতিহাসে মানবজাতি অন্যায়কে পরাভূত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছে, তেমনি অসত্যকে পরাভূত করে সত্য, অকল্যাণকে পরাভূত করে কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ প্রক্রিয়ায় মূর্খতা ও অজ্ঞতাকে পরাভূত করেই জ্ঞানকে জয়ী হতে হয়েছে। সমাজ রাষ্ট্র ও ব্যক্তি পর্যায়ে মূর্খতা, অজ্ঞতার সঙ্গে জ্ঞানের দ্বন্দ্ব আজও বিদ্যমান। পৃথিবীর ইতিহাস যুগে যুগে মাঝেমধ্যে জ্ঞান ও জ্ঞানীকে পথভ্রষ্ট করতে না পেরে মূর্খতা অজ্ঞতা হিংস্ররূপ ধারণ করেছে। এভাবে সভ্যতার অগ্রগমন ব্যাহত হয়েছে।

কয়েক দিন আগে ইউরিয়ার দাম বাড়ানো হয়েছে। এবার ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনের দাম বাড়ানো হলো। গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত আছে। সারের অভাবে কৃষি উৎপাদন কমে গেলে বর্তমান পরিস্থিতিতে তার ফলাফল হবে খুবই মারাত্মক। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, ইউরিয়ার অপব্যবহার রোধ করতে দাম বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ঘোষণার আগে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলার চেষ্টা করেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির যে দাম চলছে, তার সঙ্গে স্থানীয় মূল্যের সমন্বয় না করা হলে সরবরাহ টেকসই করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম যে এবারই এত বেড়েছে তা নয়, ২০০৭-০৮ সালে জ্বালানির মূল্য আরও বেশি বেড়েছিল। ‘ইনডেক্সমান্ডি’-এর তথ্যভান্ডার থেকে দেখা যায়, ২০০৮ সালের জুন পর্যন্ত ক্রুড অয়েলের ব্যারেলপ্রতি মাসিক গড়মূল্য ছিল ১০৮ মার্কিন ডলার, আর চলতি বছরে জুন পর্যন্ত তা ১০৩ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ২০০৮ সালের জুন ও জুলাই মাসে জ্বালানির গড় মূল্য ছিল ব্যারেল প্রতি ১৩০ মার্কিন ডলারের ওপরে। তখন এদেশে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ছিল ৪৬ টাকা, ভারতে ৩৫ রুপি। তখনো আন্তর্জাতিক বাজারে ফুড, ফুয়েল ও ফার্টিলাইজারের সরবরাহ ও মূল্য উদ্বায়ী হয়ে পড়ে। এবারের পরিস্থিতি তখনকার চেয়েও গুরুতর কারণ, কভিড আক্রমণ চালিয়ে মানুষকে আগেই কাবু করে ফেলেছে, তারপর ওই ৩টি অতি প্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য ভয়ংকর রূপ ধারণ করে তাদের তাড়িয়ে বেড়াতে শুরু করে।

জ্বালানির মূল্যে রয়েছে ‘ডমিনো’ প্রভাব। এটার বৃদ্ধি অন্য সব পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে দেয়। পণ্যের উৎপাদন, পরিবহন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রতিটি স্তরে এর নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান। একটি পণ্যের উৎপাদন থেকে বিপণন প্রক্রিয়া বিবেচনায় নিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের প্রধান কৃষিপণ্য ধান উৎপাদনে সেচের জন্য ব্যাপকভাবে ডিজেল ব্যবহৃত হয়। পরিবহন খাতে ডিজেলের বহুল ব্যবহার কারও অজানা নয়। জ্বালানির বর্ধিত মূল্যের প্রভাবে সেচ,ধান কাটা, ছাঁটাই ও পলিশিং, পরিবহন প্রভৃতি কাজে বর্ধিত খরচ চালের মূল্য আরও বৃদ্ধি করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ আরও অনেক খাতে এখন এই জ্বালানি ব্যবহার করা হচ্ছে। কাজেই এই প্রাথমিক জ্বালানির দাম বাড়ার অর্থ নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্য সব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। মূল্যবৃদ্ধির এই ক্রমপুঞ্জিত প্রভাব চালের মতো প্রধান ভোগ্যপণ্যকে মহার্ঘ্য করে ফেলতে পারে। এতে শুধু যে পণ্যটির মূল্য বাড়বে, তা-ই না, অনেক প্রান্তিক চাষি পুঁজির অভাবে বাড়তি খরচের জোগান দিতে পারবে না। ফলে চালের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।

স্বল্প মুদ্রাস্ফীতি উদীয়মান অর্থনীতির জন্য টনিকের মতো কাজ করে; ব্যবসায়ীদের লাভ হয়, তারা মুনাফা পুনরায় বিনিয়োগ করেন, সম্পদের কাম্য ব্যবহার নিশ্চিত হয়, পর্যাপ্ত কর্ম সৃজন হয়, উৎপাদন ও আয় বাড়ে এবং সর্বোপরি প্রায় সমমাত্রিক বণ্টন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার মাধ্যমে এ সময়ে আয় বৈষম্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার কৌশল গ্রহণ করা যায়।

অভাবে সন্তানকে বাজারে বিক্রি করতে এসেছেন মা। নাম তার পারুল চাকমা। স্বামী ছেড়ে গেছেন অনেক দিন আগে। নিজেও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। থাকেন বাবার বাড়িতে। সেখানেও অভাব নিত্যসঙ্গী। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হয়। খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার একটি বাজারে নিজের বুকের ধন ছয় বছরের রামকৃষ্ণ চাকমাকে বিক্রি করতে আনেন

বিগত শতাব্দীর সত্তর দশকের জ্বালানি-তেল-তাড়িত উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে দেখা গেছে, সেটা বিনিয়োগ বাড়ায়নি, প্রবৃদ্ধি বাড়ায়নি; বাড়িয়েছে শুধু বেকারত্ব ও আয় বৈষম্য। অর্থনীতিবিদরা তখন এই নতুন অবস্থার নামকরণ করেন স্থবিরস্ফীতি বা ‘স্ট্যাগফ্লেশন’। এই সময় সমাজকে অস্থিরতা এবং অর্থনীতিকে নিশ্চলতা গ্রাস করে, সীমিত আয়ের মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খেয়ে জীবন রক্ষা করে, সঞ্চয়ের পরিমাণ কমে যায়, প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে প্রদেয় সুদহার বেড়ে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিতে ভাটা চলে আসে।

তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ছাড়া অর্থনীতি কখনো টেকসই হতে পারে না। এ পর্যায়ে প্রশ্ন হতে পারে সাধারণ মানুষই যদি না বাঁচে, তবে সে উন্নতি কার জন্য?

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

নাম তার পারুল চাকমা

এম এ কবীর

শুক্রবার, ১৯ আগস্ট ২০২২

মহাভারতে উল্লেখ আছে- বড় ভাই তার ছোট ভাইকে নির্দেশ করেন ফসলের ক্ষেতে বাঁধ দিতে। না হলে সব জল তার জমিতে ঢুকে যাচ্ছে। ছোট ভাই বাঁধ দিতে অস্বীকার করলে রেগে গিয়ে বড় ভাই ছোট ভাইকে খুন করে তার মৃতদেহ টেনে নিয়ে পানি প্রবেশের মুখ আটকে দেয়। এ ঘটনা বাসুদেব কৃষ্ণকে মর্মাহত করে। এই নিষ্ঠুরতা কোনভাবেই তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। বুঝতে পারেন মানুষের মাঝে অজ্ঞতা কোন পর্যায়ে পৌঁছলে বড় ভাই এ রকম নৃশংস হতে পারে। তিনি স্থির করেন এই স্থানে রক্তপাত ঘটিয়ে অজ্ঞতাকে নিঃশেষ করে দেবেন। ন্যায় এবং জ্ঞানের বিজয় ঘটাবেন। প্রস্ফুটিত হবে বিদ্যা, বিনয় আর মনুষ্যত্বের। পান্ডবরা ছিলেন জ্ঞানের প্রতীক, কৌরবরা নৃশংসতা আর অজ্ঞতার মূর্ত প্রতীক। আঠারো দিনের এই যুদ্ধে রক্তের গঙ্গা বয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত নৈতিকতা আর জ্ঞানের বিজয় হয়।

অভাবে সন্তানকে বাজারে বিক্রি করতে এসেছেন মা। নাম তার পারুল চাকমা। স্বামী ছেড়ে গেছেন অনেক দিন আগে। নিজেও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। থাকেন বাবার বাড়িতে। সেখানেও অভাব নিত্যসঙ্গী। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হয়। খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার একটি বাজারে নিজের বুকের ধন ছয় বছরের রামকৃষ্ণ চাকমাকে বিক্রি করতে আনেন। তিনি ছেলের দাম চান ১২ হাজার টাকা। পারুল চাকমা খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া পাকোজ্জ্যাছড়ি গ্রামের কালাবো চাকমার মেয়ে। সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য বাসন্তী চাকমা বলেন, পারুল চাকমা খুব বেশি অভাবে থাকার কারণে এই কাজটি করেছেন বলে জানতে পেরেছি।

বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছেন, সুখে আছেন-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের এ বক্তব্যে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দলের নেতাকর্মী ও মন্ত্রীদের সতর্ক করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান ফেসবুকে লিখেছেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা দায়িত্বপূর্ণ কথা বলবেন, এ প্রত্যাশা কি আসলেই বেশি? তা না হলে অনেক কথাই তো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো মনে হতে পারে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতির অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ ফেসবুকে লম্বা সমালোচনা লিখেছেন। এলজিআরডিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, গ্রামগঞ্জে কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে। আমি মনে করি না আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক ৩১ জুলাই বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের জন্য গম আমদানি কমাতে আটার রুটির বদলে চালের রুটি খাওয়ার পরামর্শ দেন। ৬ আগস্ট কুমিল্লায় এক কর্মশালায় কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক দেশের মানুষকে কম খাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘এখন তো বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিলে রিজার্ভ একদম কমে যাবে। এতে দেশ হুমকির মুখে পড়ে যাবে। তার চেয়ে বরং এখনই কিছুটা কষ্ট করে আমরা সাবধান হই। তেল কম খরচ করেন, বিদ্যুৎ কম খরচ করেন, আমরা একটু সাশ্রয় করি, একটু কম খাই।’

ফ্রান্সিস বেকন ১৬২০ সালে ‘নিউ ইনস্ট্রমেন্ট’ শিরোনামে এক বৈজ্ঞানিক ইশতেহারে দাবি করেন ‘জ্ঞানই শক্তি’। তিনি বিশ্বাস করতেন কুসংস্কার ও আত্মগরিমার প্রতিবন্ধকতা থেকে মনকে মুক্ত করতে পারলে মানুষ তার জ্ঞানের দ্বারা প্রকৃতির ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সমর্থ হবে। অজ্ঞতা স্বীকার করার মধ্য দিয়েই আধুনিক বিজ্ঞানকে করে তুলেছে পূর্ববর্তী যে কোন জ্ঞানের ঐতিহ্যের তুলনায় আরও বেশি শক্তিশালী, নমনীয় ও কৌতূহলী। ফলে মহাজগত কীভাবে কাজ করে তা বোঝা ও নব নব আবিষ্কারের সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগে এসেও ‘জ্ঞানই শক্তি’ বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞাটি আজও সর্বজনস্বীকৃত এবং নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত। জ্ঞানই শক্তি এই আলোকবর্তিকার পথ ধরে এগোচ্ছে সভ্যতা। যেরূপ বিকশিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব সিন্ধু, মেসোপটেমিয়া, মিসরীয়, মিনোয়ান, চৈনিক, নুবিয়া, মায়া, হিতিতেস, ওলমেক, শাভিন, ইনকা, রোমান, গ্রিস, আসীরিয়ান সভ্যতা। সভ্যতার ইতিহাসে মানবজাতি অন্যায়কে পরাভূত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছে, তেমনি অসত্যকে পরাভূত করে সত্য, অকল্যাণকে পরাভূত করে কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ প্রক্রিয়ায় মূর্খতা ও অজ্ঞতাকে পরাভূত করেই জ্ঞানকে জয়ী হতে হয়েছে। সমাজ রাষ্ট্র ও ব্যক্তি পর্যায়ে মূর্খতা, অজ্ঞতার সঙ্গে জ্ঞানের দ্বন্দ্ব আজও বিদ্যমান। পৃথিবীর ইতিহাস যুগে যুগে মাঝেমধ্যে জ্ঞান ও জ্ঞানীকে পথভ্রষ্ট করতে না পেরে মূর্খতা অজ্ঞতা হিংস্ররূপ ধারণ করেছে। এভাবে সভ্যতার অগ্রগমন ব্যাহত হয়েছে।

কয়েক দিন আগে ইউরিয়ার দাম বাড়ানো হয়েছে। এবার ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনের দাম বাড়ানো হলো। গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত আছে। সারের অভাবে কৃষি উৎপাদন কমে গেলে বর্তমান পরিস্থিতিতে তার ফলাফল হবে খুবই মারাত্মক। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, ইউরিয়ার অপব্যবহার রোধ করতে দাম বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ঘোষণার আগে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলার চেষ্টা করেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির যে দাম চলছে, তার সঙ্গে স্থানীয় মূল্যের সমন্বয় না করা হলে সরবরাহ টেকসই করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম যে এবারই এত বেড়েছে তা নয়, ২০০৭-০৮ সালে জ্বালানির মূল্য আরও বেশি বেড়েছিল। ‘ইনডেক্সমান্ডি’-এর তথ্যভান্ডার থেকে দেখা যায়, ২০০৮ সালের জুন পর্যন্ত ক্রুড অয়েলের ব্যারেলপ্রতি মাসিক গড়মূল্য ছিল ১০৮ মার্কিন ডলার, আর চলতি বছরে জুন পর্যন্ত তা ১০৩ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ২০০৮ সালের জুন ও জুলাই মাসে জ্বালানির গড় মূল্য ছিল ব্যারেল প্রতি ১৩০ মার্কিন ডলারের ওপরে। তখন এদেশে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ছিল ৪৬ টাকা, ভারতে ৩৫ রুপি। তখনো আন্তর্জাতিক বাজারে ফুড, ফুয়েল ও ফার্টিলাইজারের সরবরাহ ও মূল্য উদ্বায়ী হয়ে পড়ে। এবারের পরিস্থিতি তখনকার চেয়েও গুরুতর কারণ, কভিড আক্রমণ চালিয়ে মানুষকে আগেই কাবু করে ফেলেছে, তারপর ওই ৩টি অতি প্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য ভয়ংকর রূপ ধারণ করে তাদের তাড়িয়ে বেড়াতে শুরু করে।

জ্বালানির মূল্যে রয়েছে ‘ডমিনো’ প্রভাব। এটার বৃদ্ধি অন্য সব পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে দেয়। পণ্যের উৎপাদন, পরিবহন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রতিটি স্তরে এর নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান। একটি পণ্যের উৎপাদন থেকে বিপণন প্রক্রিয়া বিবেচনায় নিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের প্রধান কৃষিপণ্য ধান উৎপাদনে সেচের জন্য ব্যাপকভাবে ডিজেল ব্যবহৃত হয়। পরিবহন খাতে ডিজেলের বহুল ব্যবহার কারও অজানা নয়। জ্বালানির বর্ধিত মূল্যের প্রভাবে সেচ,ধান কাটা, ছাঁটাই ও পলিশিং, পরিবহন প্রভৃতি কাজে বর্ধিত খরচ চালের মূল্য আরও বৃদ্ধি করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ আরও অনেক খাতে এখন এই জ্বালানি ব্যবহার করা হচ্ছে। কাজেই এই প্রাথমিক জ্বালানির দাম বাড়ার অর্থ নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্য সব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। মূল্যবৃদ্ধির এই ক্রমপুঞ্জিত প্রভাব চালের মতো প্রধান ভোগ্যপণ্যকে মহার্ঘ্য করে ফেলতে পারে। এতে শুধু যে পণ্যটির মূল্য বাড়বে, তা-ই না, অনেক প্রান্তিক চাষি পুঁজির অভাবে বাড়তি খরচের জোগান দিতে পারবে না। ফলে চালের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।

স্বল্প মুদ্রাস্ফীতি উদীয়মান অর্থনীতির জন্য টনিকের মতো কাজ করে; ব্যবসায়ীদের লাভ হয়, তারা মুনাফা পুনরায় বিনিয়োগ করেন, সম্পদের কাম্য ব্যবহার নিশ্চিত হয়, পর্যাপ্ত কর্ম সৃজন হয়, উৎপাদন ও আয় বাড়ে এবং সর্বোপরি প্রায় সমমাত্রিক বণ্টন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার মাধ্যমে এ সময়ে আয় বৈষম্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার কৌশল গ্রহণ করা যায়।

অভাবে সন্তানকে বাজারে বিক্রি করতে এসেছেন মা। নাম তার পারুল চাকমা। স্বামী ছেড়ে গেছেন অনেক দিন আগে। নিজেও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। থাকেন বাবার বাড়িতে। সেখানেও অভাব নিত্যসঙ্গী। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হয়। খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার একটি বাজারে নিজের বুকের ধন ছয় বছরের রামকৃষ্ণ চাকমাকে বিক্রি করতে আনেন

বিগত শতাব্দীর সত্তর দশকের জ্বালানি-তেল-তাড়িত উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে দেখা গেছে, সেটা বিনিয়োগ বাড়ায়নি, প্রবৃদ্ধি বাড়ায়নি; বাড়িয়েছে শুধু বেকারত্ব ও আয় বৈষম্য। অর্থনীতিবিদরা তখন এই নতুন অবস্থার নামকরণ করেন স্থবিরস্ফীতি বা ‘স্ট্যাগফ্লেশন’। এই সময় সমাজকে অস্থিরতা এবং অর্থনীতিকে নিশ্চলতা গ্রাস করে, সীমিত আয়ের মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খেয়ে জীবন রক্ষা করে, সঞ্চয়ের পরিমাণ কমে যায়, প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে প্রদেয় সুদহার বেড়ে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিতে ভাটা চলে আসে।

তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ছাড়া অর্থনীতি কখনো টেকসই হতে পারে না। এ পর্যায়ে প্রশ্ন হতে পারে সাধারণ মানুষই যদি না বাঁচে, তবে সে উন্নতি কার জন্য?

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

back to top