alt

উপ-সম্পাদকীয়

সেলিমই পারলেন জনগণ এবং আদালতকে সক্রিয় করতে

গৌতম রায়

: শুক্রবার, ১৯ আগস্ট ২০২২

পশ্চিমবঙ্গে শাসক দলের কর্তাব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানে ঘটে যাওয়া যে দুর্নীতির ছবি দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে গোটা দুনিয়া দেখছে, এমনটা কিন্তু ’৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে আজ পর্যন্ত কখনো গোটা বিশ্বের মানুষকে দেখতে হয়নি। রাজ্যের শাসক শিবিরের একাধিক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দুর্নীতির দায় মমতা ব্যানার্জির শাসনকালে জেলবাস করছেন। অতীতে আমরা দেখেছি; মদন মিত্র, সুদীপ বন্দোপাধ্যায়, কুনাল ঘোষ, সৃঞ্জয় বসু প্রমুখ শাসক শিবিরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা শুধু দুর্নীতির দায়ে তাদের নিজেদের সরকার রাজ্যের ক্ষমতাশীল থাকাকালীনই জেল বাস করতে বাধ্য হয়েছেন। আর এখন আমরা দেখছি, তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে দীর্ঘদিন জেলে রয়েছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের বীরভূম জেলার দোরদন্ড প্রতাপ সভাপতি অনুব্রত মন্ডল জেলে রয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গের শাসক শিবিরের এই যে কর্তা ব্যক্তিদের জেলে থাকার ঘটনা, এটা নিছক শাসক শিবিরের একটা দুর্নীতির চিত্র নয়। প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতিকে কি ভয়ংকর একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে, গোটা জাতির মেরুদন্ড ভেঙে দিতে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে, এই একের পর এক গ্রেপ্তার এবং শাসক শিবিরের প্রথম সারির কেষ্ট-বিষ্টুদের জেল যাত্রার মধ্যে দিয়ে তা আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।

মজার কথা হলো, শাসক-শিবিরের কর্তা ব্যক্তিদের এই জেল যাত্রায় ঘিরে শাসক কিন্তু একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম নীতি অবলম্বন করছেন। যে পার্থ চট্টোপাধ্যায় এক দিন ছিলেন কার্যত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর এই তৃণমূল কংগ্রেসের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সেই পার্থবাবুর জেলযাত্রার পর, তার দুর্নীতি ঘিরে কার্যত হাত ধুয়ে ফেলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। অথচ তাদের দলের বীরভূম জেলার সভাপতি অনুব্রত মন্ডলের দুর্নীতি ঘিরে নানা ধরনের যুক্তি-তর্কের অবতারণা করার চেষ্টা করা হচ্ছে শাসক শিবিরের পক্ষ থেকে।

স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুব্রত গ্রেপ্তার হওয়ার বেশ কয়েক দিন পর প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন এবং সেই মুখ খোলার ভেতর দিয়ে তিনি কিন্তু একটি বারের জন্য অনুব্রতের কোনরকম সমালোচনা করেননি, বরঞ্চ অনুব্রতের প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি তার কথার মধ্যে দিয়ে ঝরে পড়েছে। অনুব্রত রাজনৈতিক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন-এমন ধরনের কথাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ থেকে বের হয়েছে। অর্থাৎ অনুব্রতকে ঘিরে যে পর্বত প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ, গরু চুরি থেকে শুরু করে কয়লা খাদানের বেআইনি টাকা আদায়, কোটি কোটি টাকা হিসাববহির্ভূতভাবে তার একাউন্টে থাকা, তার কন্যার টেট পাস না করেই চাকরি পেয়ে যাওয়া, এমনকি কন্যার স্কুলের হাজিরার খাতা অনুব্রতের বাড়িতে নিয়ে এসে, অনুব্রতের কন্যাকে দিয়ে সই করানোর মতো ঘটনা ...এত কিছুর পরেও যখন এই অনুব্রত মন্ডলের পাশে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা দাঁড়ান, তখন বুঝতে হবে যে; অনুব্রতের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রসায়নটা এমন একটা জায়গায় রয়েছে যার জন্য অনুব্রতকে নিয়ে যদি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো দুর্নীতির প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাত ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করেন, তাহলে সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কেরিয়ারের পক্ষেই বিশেষ রকমের অসুবিধা জনক হবে।

অর্থাৎ অনুব্রত এমন কোন কথা, এমন কোন ঘটনাবলি, এমন কোন তথ্য-প্রমাণ প্রকাশ্যে হাজির করতে পারেন, যা মমতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকারক হবে। তাই মমতা কোন অবস্থাতেই অনুব্রতের পাশ থেকে তার নিজের হাত সরিয়ে নিতে নারাজ। সেই কারণেই এই অনুব্রত মন্ডলের দুর্নীতির ঘিরে ইডিসিবিআই, যতই তথ্য-প্রমাণ হাজির করুক না কেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে সম্পর্কে একটিও নেতিবাচক কথা বলতে নারাজ।

মমতা কিন্তু বুঝতে পারছেন না, তার যে তথাকথিত একটা ‘সততার ইমেজ’, যা এখনো সামান্য হলেও কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন, সেই ইমেজ যে অনুব্রতকে এইভাবে তার আড়াল করবার যে কার্যক্রম, সেই কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে ভয়ঙ্কর রকমভাবে অতিগ্রস্ত হচ্ছে, এই ক্ষতিকে মমতা স্বীকার করে নিতে বোধহয় রাজি আছেন, কিন্তু কোন অবস্থাতেই অনুব্রতের প্রতি তার অনুকম্পার হাত সরিয়ে নিতে মমতা রাজি নন। কেন রাজি নন? অনুব্রত কি মমতার এমন কোন গোপন রাজনৈতিক খবর জানেন, যার জন্য মমতা ভীত? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি এই ভয় পাচ্ছেন যে, যদি তিনি অনুব্রতের প্রতি তার অনুকম্পার হাত সরিয়ে নেন, তাহলে এমন কোন তথ্য অনুব্রত ইডিসিবিআইকে বা সংবাদমাধ্যমকে বলে দিতে পারেন, যার জেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে? তাই তিনি নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের কার্যত তোয়াক্কা না করে, এইভাবে একজন আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি অনুব্রত মন্ডল, তার হয়ে প্রকাশ্যে সরব হচ্ছেন?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেসের পার্থ চট্টোপাধ্যায় বা অনুব্রত মন্ডলের দুর্নীতি ঘিরে প্রশ্নগুলোয় যে এই দলটি সম্পর্কে দুর্নীতির অভিযোগ শেষ হয়ে যাচ্ছে এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। ইতোমধ্যেই কোলকাতা হাইকোর্টে মমতার দলের একাধিক ক্ষমতাবান লোকেদের আর্থিক অস্বচ্ছতা গিয়ে স্পষ্ট অভিযোগ উঠেছে। হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় প্রকাশ্যে বলেছেন; গোটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে সরকারি চাকরি ঘিরে অস্বচ্ছতার কথা। বস্তুত বামপন্থিরা দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গে অভিযোগ করে চলেছেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে একটি সরকারি চাকরি ও শাসকদলের কেষ্ট-বিষ্টুদের উৎকোচ না দিয়ে সাধারণ মানুষ পান না।

সেই অভিযোগটির প্রতি কার্যত শীলমোহর দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায় ১২ বছরের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতি আজকে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে, যা ভারতের অন্য রাজ্যগুলির সমন্বিত দুর্নীতিকেও লজ্জা দেবে। যে বাঙালির স্বচ্ছতা, সততা, আদর্শবোধ ঘিরে ব্রিটিশ আমল থেকে একটা সম্ভ্রমবোধ গোটা ভারত তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ছিল, সেই বাঙালিকে আজকে অত্যন্ত বড় রকমের সমালোচনার সামনে এসে দাঁড়াতে হয়েছে শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার রাজনৈতিক সতীর্থদের ধারাবাহিক চৌর্যাবৃত্তির জন্য। রাজনৈতিক অপদার্থতার পাশাপাশি প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবং তার সতীর্থদের দুর্নীতি যে সীমাহীন জায়গায় এসে পৌঁছেছে, তার জেরে পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অগ্রগতির পথকে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে।

শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকাল এমন একটি ছবি সমাজের বুকে এঁকে দিয়েছে যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে নিয়োগ পাওয়া যে কোন শিক্ষকের সততা ঘিরে ই সাধারণ মানুষ আজ সন্দিহান। এর ফলে যে সামান্য এক দুই শতাংশ মানুষ যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষকতাসহ অন্যান্য সরকারি চাকরি পাচ্ছেন, তারাও আজ সাধারণ মানুষের হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের এই বলগাহীন দুর্নীতির জেরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করা বিজেপি আজ এখানে নিজেদের নখদান্ত বিস্তারের সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গিয়েছে মমতা নিজের দুর্নীতিকে আড়াল করবার তাগিদেই কখনো কোন অবস্থাতেই হিন্দু সম্প্রদায়িক শিবিরের কোন ধরনের রাজনৈতিক আগ্রাসন সম্পর্কে একটি শব্দ উচ্চারণ করেন না। বিজেপি সম্বন্ধে তিনি কখনো লোক দেখানো কিছু ছদ্ম অভিযোগ করে থাকেন। মজার কথা হলো বিজেপির যে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন, সেই আগ্রাসনকে রুখবার স্বার্থে, কোন ধরনের প্রশাসনিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক পদক্ষেপ দীর্ঘ ১২ বছরের শাসনকালে মমতার একটিও নেননি।

বলা যেতে পারে বিজেপির মূল মস্তিষ্ক আরএসএসের সঙ্গে মমতার যে অদৃশ্য বোঝাপড়া, সেই বোঝাপড়ার জেরে, আরএসএস যাতে পশ্চিমবঙ্গে তাদের সামাজিক মেরুকরণের রাজনীতি এবং মুসলমান বিদ্বেষের রাজনীতি পরিপূর্ণভাবে চালাতে পারে, তার জন্য আদা জল খেয়ে নিজের সমস্ত ধরনের কর্মসূচিকে পরিচালিত করে চলেন মমতা। এই রকম একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে তার রাজনৈতিক নখদন্ত বিস্তারের জন্য সব রকমের সুযোগ করে দিয়ে চলেছেন।

বস্তুত বিজেপি তার ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পশ্চিমবঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্যেই। মমতা তার প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িকতার ভেতর দিয়ে বিজেপির ধর্মান্ধতাকে পশ্চিমবঙ্গের আনাচকানাচ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সব রকমভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। নিজের সতীর্থদের নিয়োজিত করেছেন।

এই রকম একটা সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বামপন্থিরা যে নতুন উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা এবং প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িকতা এই দুই রাজনীতির ধারকবাহক বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে চলেছেন, সেই আন্দোলনেরই কিন্তু অন্যতম ফসল হলো আদালতের এই জনজাগ্রত চেতনা। প্রস্তুত সিপিআই (এম) দলের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব মোহাম্মদ সেলিম গ্রহণ করবার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী রাজনীতির ক্ষেত্রে যে জনজোয়ার দেখা দিয়েছে, সেই জনজোয়ারই কিন্তু আদালতকে পর্যন্ত বাধ্য করছে, দুর্নীতির প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের যে অশুভ গাঁটছড়া আছে, সেই গাঁটছড়াকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সেলিমই পারলেন জনগণ এবং আদালতকে সক্রিয় করতে

গৌতম রায়

শুক্রবার, ১৯ আগস্ট ২০২২

পশ্চিমবঙ্গে শাসক দলের কর্তাব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানে ঘটে যাওয়া যে দুর্নীতির ছবি দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে গোটা দুনিয়া দেখছে, এমনটা কিন্তু ’৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে আজ পর্যন্ত কখনো গোটা বিশ্বের মানুষকে দেখতে হয়নি। রাজ্যের শাসক শিবিরের একাধিক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দুর্নীতির দায় মমতা ব্যানার্জির শাসনকালে জেলবাস করছেন। অতীতে আমরা দেখেছি; মদন মিত্র, সুদীপ বন্দোপাধ্যায়, কুনাল ঘোষ, সৃঞ্জয় বসু প্রমুখ শাসক শিবিরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা শুধু দুর্নীতির দায়ে তাদের নিজেদের সরকার রাজ্যের ক্ষমতাশীল থাকাকালীনই জেল বাস করতে বাধ্য হয়েছেন। আর এখন আমরা দেখছি, তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে দীর্ঘদিন জেলে রয়েছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের বীরভূম জেলার দোরদন্ড প্রতাপ সভাপতি অনুব্রত মন্ডল জেলে রয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গের শাসক শিবিরের এই যে কর্তা ব্যক্তিদের জেলে থাকার ঘটনা, এটা নিছক শাসক শিবিরের একটা দুর্নীতির চিত্র নয়। প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতিকে কি ভয়ংকর একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে, গোটা জাতির মেরুদন্ড ভেঙে দিতে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে, এই একের পর এক গ্রেপ্তার এবং শাসক শিবিরের প্রথম সারির কেষ্ট-বিষ্টুদের জেল যাত্রার মধ্যে দিয়ে তা আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।

মজার কথা হলো, শাসক-শিবিরের কর্তা ব্যক্তিদের এই জেল যাত্রায় ঘিরে শাসক কিন্তু একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম নীতি অবলম্বন করছেন। যে পার্থ চট্টোপাধ্যায় এক দিন ছিলেন কার্যত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর এই তৃণমূল কংগ্রেসের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সেই পার্থবাবুর জেলযাত্রার পর, তার দুর্নীতি ঘিরে কার্যত হাত ধুয়ে ফেলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। অথচ তাদের দলের বীরভূম জেলার সভাপতি অনুব্রত মন্ডলের দুর্নীতি ঘিরে নানা ধরনের যুক্তি-তর্কের অবতারণা করার চেষ্টা করা হচ্ছে শাসক শিবিরের পক্ষ থেকে।

স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুব্রত গ্রেপ্তার হওয়ার বেশ কয়েক দিন পর প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন এবং সেই মুখ খোলার ভেতর দিয়ে তিনি কিন্তু একটি বারের জন্য অনুব্রতের কোনরকম সমালোচনা করেননি, বরঞ্চ অনুব্রতের প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি তার কথার মধ্যে দিয়ে ঝরে পড়েছে। অনুব্রত রাজনৈতিক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন-এমন ধরনের কথাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ থেকে বের হয়েছে। অর্থাৎ অনুব্রতকে ঘিরে যে পর্বত প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ, গরু চুরি থেকে শুরু করে কয়লা খাদানের বেআইনি টাকা আদায়, কোটি কোটি টাকা হিসাববহির্ভূতভাবে তার একাউন্টে থাকা, তার কন্যার টেট পাস না করেই চাকরি পেয়ে যাওয়া, এমনকি কন্যার স্কুলের হাজিরার খাতা অনুব্রতের বাড়িতে নিয়ে এসে, অনুব্রতের কন্যাকে দিয়ে সই করানোর মতো ঘটনা ...এত কিছুর পরেও যখন এই অনুব্রত মন্ডলের পাশে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা দাঁড়ান, তখন বুঝতে হবে যে; অনুব্রতের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রসায়নটা এমন একটা জায়গায় রয়েছে যার জন্য অনুব্রতকে নিয়ে যদি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো দুর্নীতির প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাত ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করেন, তাহলে সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কেরিয়ারের পক্ষেই বিশেষ রকমের অসুবিধা জনক হবে।

অর্থাৎ অনুব্রত এমন কোন কথা, এমন কোন ঘটনাবলি, এমন কোন তথ্য-প্রমাণ প্রকাশ্যে হাজির করতে পারেন, যা মমতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকারক হবে। তাই মমতা কোন অবস্থাতেই অনুব্রতের পাশ থেকে তার নিজের হাত সরিয়ে নিতে নারাজ। সেই কারণেই এই অনুব্রত মন্ডলের দুর্নীতির ঘিরে ইডিসিবিআই, যতই তথ্য-প্রমাণ হাজির করুক না কেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে সম্পর্কে একটিও নেতিবাচক কথা বলতে নারাজ।

মমতা কিন্তু বুঝতে পারছেন না, তার যে তথাকথিত একটা ‘সততার ইমেজ’, যা এখনো সামান্য হলেও কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন, সেই ইমেজ যে অনুব্রতকে এইভাবে তার আড়াল করবার যে কার্যক্রম, সেই কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে ভয়ঙ্কর রকমভাবে অতিগ্রস্ত হচ্ছে, এই ক্ষতিকে মমতা স্বীকার করে নিতে বোধহয় রাজি আছেন, কিন্তু কোন অবস্থাতেই অনুব্রতের প্রতি তার অনুকম্পার হাত সরিয়ে নিতে মমতা রাজি নন। কেন রাজি নন? অনুব্রত কি মমতার এমন কোন গোপন রাজনৈতিক খবর জানেন, যার জন্য মমতা ভীত? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি এই ভয় পাচ্ছেন যে, যদি তিনি অনুব্রতের প্রতি তার অনুকম্পার হাত সরিয়ে নেন, তাহলে এমন কোন তথ্য অনুব্রত ইডিসিবিআইকে বা সংবাদমাধ্যমকে বলে দিতে পারেন, যার জেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে? তাই তিনি নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের কার্যত তোয়াক্কা না করে, এইভাবে একজন আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি অনুব্রত মন্ডল, তার হয়ে প্রকাশ্যে সরব হচ্ছেন?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেসের পার্থ চট্টোপাধ্যায় বা অনুব্রত মন্ডলের দুর্নীতি ঘিরে প্রশ্নগুলোয় যে এই দলটি সম্পর্কে দুর্নীতির অভিযোগ শেষ হয়ে যাচ্ছে এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। ইতোমধ্যেই কোলকাতা হাইকোর্টে মমতার দলের একাধিক ক্ষমতাবান লোকেদের আর্থিক অস্বচ্ছতা গিয়ে স্পষ্ট অভিযোগ উঠেছে। হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় প্রকাশ্যে বলেছেন; গোটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে সরকারি চাকরি ঘিরে অস্বচ্ছতার কথা। বস্তুত বামপন্থিরা দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গে অভিযোগ করে চলেছেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে একটি সরকারি চাকরি ও শাসকদলের কেষ্ট-বিষ্টুদের উৎকোচ না দিয়ে সাধারণ মানুষ পান না।

সেই অভিযোগটির প্রতি কার্যত শীলমোহর দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায় ১২ বছরের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতি আজকে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে, যা ভারতের অন্য রাজ্যগুলির সমন্বিত দুর্নীতিকেও লজ্জা দেবে। যে বাঙালির স্বচ্ছতা, সততা, আদর্শবোধ ঘিরে ব্রিটিশ আমল থেকে একটা সম্ভ্রমবোধ গোটা ভারত তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ছিল, সেই বাঙালিকে আজকে অত্যন্ত বড় রকমের সমালোচনার সামনে এসে দাঁড়াতে হয়েছে শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার রাজনৈতিক সতীর্থদের ধারাবাহিক চৌর্যাবৃত্তির জন্য। রাজনৈতিক অপদার্থতার পাশাপাশি প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবং তার সতীর্থদের দুর্নীতি যে সীমাহীন জায়গায় এসে পৌঁছেছে, তার জেরে পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অগ্রগতির পথকে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে।

শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকাল এমন একটি ছবি সমাজের বুকে এঁকে দিয়েছে যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে নিয়োগ পাওয়া যে কোন শিক্ষকের সততা ঘিরে ই সাধারণ মানুষ আজ সন্দিহান। এর ফলে যে সামান্য এক দুই শতাংশ মানুষ যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষকতাসহ অন্যান্য সরকারি চাকরি পাচ্ছেন, তারাও আজ সাধারণ মানুষের হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের এই বলগাহীন দুর্নীতির জেরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করা বিজেপি আজ এখানে নিজেদের নখদান্ত বিস্তারের সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গিয়েছে মমতা নিজের দুর্নীতিকে আড়াল করবার তাগিদেই কখনো কোন অবস্থাতেই হিন্দু সম্প্রদায়িক শিবিরের কোন ধরনের রাজনৈতিক আগ্রাসন সম্পর্কে একটি শব্দ উচ্চারণ করেন না। বিজেপি সম্বন্ধে তিনি কখনো লোক দেখানো কিছু ছদ্ম অভিযোগ করে থাকেন। মজার কথা হলো বিজেপির যে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন, সেই আগ্রাসনকে রুখবার স্বার্থে, কোন ধরনের প্রশাসনিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক পদক্ষেপ দীর্ঘ ১২ বছরের শাসনকালে মমতার একটিও নেননি।

বলা যেতে পারে বিজেপির মূল মস্তিষ্ক আরএসএসের সঙ্গে মমতার যে অদৃশ্য বোঝাপড়া, সেই বোঝাপড়ার জেরে, আরএসএস যাতে পশ্চিমবঙ্গে তাদের সামাজিক মেরুকরণের রাজনীতি এবং মুসলমান বিদ্বেষের রাজনীতি পরিপূর্ণভাবে চালাতে পারে, তার জন্য আদা জল খেয়ে নিজের সমস্ত ধরনের কর্মসূচিকে পরিচালিত করে চলেন মমতা। এই রকম একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে তার রাজনৈতিক নখদন্ত বিস্তারের জন্য সব রকমের সুযোগ করে দিয়ে চলেছেন।

বস্তুত বিজেপি তার ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পশ্চিমবঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্যেই। মমতা তার প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িকতার ভেতর দিয়ে বিজেপির ধর্মান্ধতাকে পশ্চিমবঙ্গের আনাচকানাচ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সব রকমভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। নিজের সতীর্থদের নিয়োজিত করেছেন।

এই রকম একটা সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বামপন্থিরা যে নতুন উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা এবং প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িকতা এই দুই রাজনীতির ধারকবাহক বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে চলেছেন, সেই আন্দোলনেরই কিন্তু অন্যতম ফসল হলো আদালতের এই জনজাগ্রত চেতনা। প্রস্তুত সিপিআই (এম) দলের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব মোহাম্মদ সেলিম গ্রহণ করবার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী রাজনীতির ক্ষেত্রে যে জনজোয়ার দেখা দিয়েছে, সেই জনজোয়ারই কিন্তু আদালতকে পর্যন্ত বাধ্য করছে, দুর্নীতির প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের যে অশুভ গাঁটছড়া আছে, সেই গাঁটছড়াকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top