alt

উপ-সম্পাদকীয়

হার না মানা লাল-সবুজের মেয়েরা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
image

মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা নতুন রেকর্ড করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ১৯ সেপ্টেম্বর নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে খেলাটি হয়। স্টেডিয়ামের ১৫ হাজার দর্শক ভূকম্পন তুলে নেপাল নেপাল চিৎকার করেও বাংলাদেশের অদম্য মেয়েদের হতোদ্যম করতে পারেনি। গোটা টুর্নামেন্টেই বাংলাদেশের নারীরা দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। তারা শুধু শিরোপাই জেতেননি, টুর্নামেন্টে তারা ছিলেন অপরাজিত। সারা টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দল শুধু একটি গোল খেয়েছে, দিয়েছে ২৩টি। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল ম্যাচে এর আগে অনেকবার অংশগ্রহণ করলেও কখনও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি বাংলাদেশ। মেয়েদের খেলায় প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শিরোপা এসেছে বাংলাদেশের ঘরে। খেলার মান অনুযায়ী ফিফা যে তালিকা তৈরি করেছে সেই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭ এবং নেপালের ১০২। নেপালের মেয়েরা যে ভালো খেলে তা অতীত রেকর্ড থেকেই প্রতিপন্ন হয়; এ খেলার আগে বাংলাদেশ এবং নেপালের মধ্যে ৮ বার খেলা হয়েছে, বাংলাদেশ হেরেছে ৬ বার, ড্র ২ বার। বাংলাদেশের প্রায় সকল নাগরিক বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত।

নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে অতীতেও আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। ২০১৭ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে আমাদের কিশোরীরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলো। ২০১৮ সনে ভুটানে হওয়া অনূর্ধ্ব-১৮ নারী সাফ ফুটবল টুর্নামেন্টেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। গেলো বছরেই সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কাকে ১২-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ১-০ গোলে শক্তিশালী ভারতকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের খেলায় গত নভেম্বর মাসে পাকিস্তান নারী দলের বিপক্ষেও জিতেছে বাংলাদেশ। ফুটবল ছাড়া ক্রিকেট খেলায়ও বাংলাদেশের মেয়েদের অনেকগুলো সাফল্য রয়েছে। প্রথমবারের মতো ২০২২ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। ছেলে ক্রিকেটারদের সাম্প্রতিক কালের কিছু দৃষ্টিকটু পরাজয়ের গ্লানি বাঙালির মনে বিষাদের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলো, সেই বিষাদ কিছুটা অপসৃত হয়েছে মেয়েদের এমন একটি বিরাট সাফল্যে। ২০১৮ সালে কুয়ালালামপুরে ভারতকে সপ্তম এশিয়া কাপে হারিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম শিরোপা পেয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা।

নেপাল চ্যাম্পিয়নশিপের সব খেলায় বাংলাদেশ ফুটবল দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবিনা খাতুন। ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামের কিশোরীদের আবির্ভাবে প্রমীলা ফুটবল খেলায় বাংলাদেশের নৈপুণ্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। বলা যায়, মেয়েদের ফুটবল খেলার নাম-ডাক শুরু হয় কলসিন্দুরের মেয়েদের দিয়ে। ২০১৬ সালের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ মহিলা ফুটবল বাছাই পর্বে উতরে মূল পর্বে উঠা ১১ জনের মধ্যে ৯ জনই ছিলেন কলসিন্দুরের, এবারে আছে ৮ জন। ছাদখোলা বাসে শিরোপা উঁচিয়ে ধরার ইচ্ছা করেছিলেন মিডফিল্ডার সানজিদা খাতুন, তার ইচ্ছা পূরণে এগিয়ে এসেছেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল; তার আগ্রহে চ্যাম্পিয়নদের বরণ করার জন্য ছাদ কেটে তৈরি করা হয়েছে ছাদখোলা বাস। সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি নিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দরে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী তাদের অভ্যর্থনা জানান। ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো বিমানবন্দর এলাকা। জয়যাত্রায় ছাদখোলা বাস ঘিরে পথে পথে ছিল সব বয়সি উৎসুক জনতার ঢল। বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ভবন পর্যন্ত পথে পথে অপেক্ষায় ছিল সমর্থকরা, সেøাগান দিয়ে, ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে সংবর্ধনা জানিয়েছে তারাও।

ক্রিকেটার মাশরাফি, সাকিব, তামিম ইকবাল, মুশফিকের বার্ষিক আয়ের তুলনায় একেবারেই নস্যি ফুটবলার সাবিনা খাতুনদের আয়। সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে খেলার মাঠে এলেও এদের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দারুণ অবহেলা। চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারদের বেতন ক্যাটাগরি অনুযায়ী দেয়া হয়ে থাকে, যিনি যেই ক্যাটাগরিতে থাকবেন তিনি সেই ক্যাটাগরি অনুযায়ী মাসিক বেতন পাবেন। একজন ছেলে ক্রিকেটার সর্বোচ্চ ৪-৬ লাখ টাকা মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন, এখন নাকি তা ৮ লাখে উন্নীত হচ্ছে; অন্যদিকে একজন নারী ক্রিকেটার পান সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা, তবে ডি ক্যাটাগরির একজন নারী খেলোয়াড় পান মাত্র ২৫ হাজার টাকা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সাফল্য লাভ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে কিছু আর্থিক প্রণোদনা পেয়েছেন নারী খেলোয়াড়রা। এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলকে দুই কোটি টাকার আর্থিক পুরস্কার দিয়েছেন তিনি। কিন্তু যারা চুক্তিবদ্ধ নন তাদের অবহেলা চরম পর্যায়ের। অনেক ক্লাবে নাকি মেয়েরা বিনা পারিশ্রমিকেই খেলতে বাধ্য হন, তবে ক্লাব কর্তৃপক্ষের মতে তথ্যটি সত্য নয়, খেলোয়াড়দের যাতায়াত-ভাড়া দেয়া হয়। আমাদের অবশ্যই খেলাকে গুরুত্ব দিতে হবে; কারণ এই মেয়েরাই আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের শ্রেষ্ঠ সাফল্যের দূত। শত শত দূতাবাস দেশের পরিচিতির প্রচার ও প্রসারে যা করতে পারে না, একজন ম্যারাডোনা, একজন নেইমার, একজন মেসি ও একজন সাকিব তার চেয়ে অনেক বেশি করতে পারেন। আর্জেন্টিনাকে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করে দেয়ার জন্য একজন ম্যারাডোনা বা একজন মেসিই যথেষ্ট। পর্তুগালের প্রেসিডেন্টের ভাষ্যমতে- ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর জন্যই অনেক মানুষ পর্তুগালকে চেনে। নেইমার না থাকলে শুধু সাম্বা নাচ দিয়ে ব্রাজিল এত জনপ্রিয় হতে পারতো না।

বাংলাদেশে নারী ফুটবল দলের স্পন্সর পাওয়া যায় না, কারণ গ্যালারি বা মিডিয়ায় দর্শক কম। ছেলেদের ফুটবল খেলাও তো আজকাল কেউ দেখে বলে মনে হয় না, কিন্তু তাদের জন্য স্পন্সর পাওয়া যায়। মনে হচ্ছে- সামাজিক বাধা এক্ষেত্রে কাজ করছে। তবে সম্ভাব্য স্পন্সরকে আগ্রহী করে তুলতে ক্রীড়াঙ্গনের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। মেয়ে ফুটবল খেলোয়াড়দের এ বিজয়ে দেশে একটি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, এখন হয়ত স্পন্সর পাওয়া যাবে। ঢাকার মাঠে এখন মেয়েদের আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হলে দর্শকও থাকবে।

ধর্মীয় বিধান অনুসারে মেয়েদের কিছু কিছু কাজে বাধা-নিষেধ রয়েছে পর্দা খেলাপের আশঙ্কায়। তাই বাঙালি মুসলমান এখনো মেয়েদের মাঠে নামাতে ইতস্তত করছে, মেয়েদের খেলাধুলায় মাঠে নামানো এখনো সহজ হচ্ছে না। শুরু থেকেই দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মেয়েদের ফুটবলে অংশগ্রহণ বেশি; অথচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র দুই শতাংশ। ধর্মীয় বিধি নিষেধের কারণে মেয়ে খেলোয়াড়দের হেনস্তার শিকারও হতে হয়। অনূর্ধ্ব-১৬ আন্তর্জাতিক ট্রফি জিতে ফেরার সময় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বাসের ব্যবস্থা না করায় প্রাইভেট বাসে অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে চড়ার কারণে নারী খেলোয়াড়দের কিছু যাত্রীর রোষানলে পড়তে হয়েছিল। ধর্মের বিধিনিষেধ, সমাজের কটূক্তি আর বিরূপ চাহনির জন্য মেয়ে সন্তানের মাঠের খেলায় অংশগ্রহণে মা-বাবাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। খেলাধুলায় নারীদের অংশগ্রহণের একটি বড় বাধা পরিধেয় পোশাক। খেলাধুলার উপযোগী পোশাক পরে খেললে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তা মানতে চায় না; সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে খেলোয়াড়রাও বিব্রতবোধ করে। ঘরে-বাইরে সর্বত্র পিছুটান; তবে এবার চলার গতি থামিয়ে দেওয়ার অপূরাণ চেষ্টা সর্বস্তরের মানুষের জয়ধ্বনিতে ভেসে গেছে। আমাদের মেয়েদের এই সাফল্য ব্যাপকভাবে উদযাপিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে সর্বত্র, আনন্দের এমন বাঁধভাঙা জোয়ারে বিপক্ষের কটাক্ষ ও অশ্লীল কথাগুলোও চাপা পড়ে গেছে।

আমাদের পরিবার ও সমাজ মেয়েদের চাকরিজীবী হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও খেলাকে পেশা হিসেবে দেখতে এখনো প্রস্তুত নয়। তাই খেলাধুলায় নৈপুণ্য দেখিয়ে একটি চাকরি পাওয়ায় আশায় নিম্নবিত্তের মেয়েরা কোন একটি প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় খেলতে বেশি আগ্রহী। খেলাধুলার জগতে আসার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা পার হয়ে ক্রীড়া জগতে প্রবেশ করার পর দিনমজুরদের মতো পারিশ্রমিক দেয়া হলে আমাদের মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ধর্ম ও সমাজের বিরূপ পরিবেশে যুদ্ধ করে অনেকে টিকছেন না, এর মধ্যে আর্থিক অনটন না ঘুচলে মেয়েদের খেলাধুলায় মনোনিবেশ করা সহজ হবে না। খেলাধুলায় কিন্তু উচ্চবিত্তের মেয়েরা আগ্রহ দেখাচ্ছে না; মনে হচ্ছে আর্থিক দীনতা লাঘবের প্রত্যাশায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মেয়েরাই শুধু খেলাধুলায় অংশ নিচ্ছে। ফিফা নারী খেলোয়াড়দের জন্য যে টাকা দেয় তার পুরোটা মেয়ে ফুটবল খেলোয়াড়দের জন্য খরচ করা হয় কিনা- তা আমাদের জানা নেই। অনটন তাদের নিত্যসঙ্গী। অন্নপূর্ণা দেবী বর দিতে চাইলে মধ্যযুগের অন্নদামঙ্গল কাব্যের মাঝি ঈশ্বরী পাটনীর চাওয়া ছিল- ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। আধুনিক যুগে বাংলাদেশের নারী খেলোয়াড়দের চাহিদা আরও কম। নারী খেলোয়াড়দের আর্থিক দীনতার প্রকাশ ঘটেছে ২০১৫ সালের সাফ গেমস বিজয়ী ক্ষুদে ফুটবলারদের কাছে উপন্যাসিক আনিসুল হক যখন জানতে চেয়েছিলেন- তারা কী চায়, তখন তাদের উত্তর ছিল ‘দুপুরে ভাত খেতে চাই’। তিনি যখন আরও একটু বেশি কিছু চাইতে বললেন তখন তারা বলল- ‘দুপুরের খাবারটা বাড়িয়ে দিলে পরিবারের সবাই খেতে পারবে’। হার না মানা লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্বকারী নারী খেলোয়াড়দের জন্য রইল আমাদের সবার অভিবাদন। কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের জন্যও রইল আমাদের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

হার না মানা লাল-সবুজের মেয়েরা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২

মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা নতুন রেকর্ড করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ১৯ সেপ্টেম্বর নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে খেলাটি হয়। স্টেডিয়ামের ১৫ হাজার দর্শক ভূকম্পন তুলে নেপাল নেপাল চিৎকার করেও বাংলাদেশের অদম্য মেয়েদের হতোদ্যম করতে পারেনি। গোটা টুর্নামেন্টেই বাংলাদেশের নারীরা দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। তারা শুধু শিরোপাই জেতেননি, টুর্নামেন্টে তারা ছিলেন অপরাজিত। সারা টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দল শুধু একটি গোল খেয়েছে, দিয়েছে ২৩টি। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল ম্যাচে এর আগে অনেকবার অংশগ্রহণ করলেও কখনও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি বাংলাদেশ। মেয়েদের খেলায় প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শিরোপা এসেছে বাংলাদেশের ঘরে। খেলার মান অনুযায়ী ফিফা যে তালিকা তৈরি করেছে সেই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭ এবং নেপালের ১০২। নেপালের মেয়েরা যে ভালো খেলে তা অতীত রেকর্ড থেকেই প্রতিপন্ন হয়; এ খেলার আগে বাংলাদেশ এবং নেপালের মধ্যে ৮ বার খেলা হয়েছে, বাংলাদেশ হেরেছে ৬ বার, ড্র ২ বার। বাংলাদেশের প্রায় সকল নাগরিক বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত।

নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে অতীতেও আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। ২০১৭ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে আমাদের কিশোরীরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলো। ২০১৮ সনে ভুটানে হওয়া অনূর্ধ্ব-১৮ নারী সাফ ফুটবল টুর্নামেন্টেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। গেলো বছরেই সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কাকে ১২-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ১-০ গোলে শক্তিশালী ভারতকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের খেলায় গত নভেম্বর মাসে পাকিস্তান নারী দলের বিপক্ষেও জিতেছে বাংলাদেশ। ফুটবল ছাড়া ক্রিকেট খেলায়ও বাংলাদেশের মেয়েদের অনেকগুলো সাফল্য রয়েছে। প্রথমবারের মতো ২০২২ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। ছেলে ক্রিকেটারদের সাম্প্রতিক কালের কিছু দৃষ্টিকটু পরাজয়ের গ্লানি বাঙালির মনে বিষাদের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলো, সেই বিষাদ কিছুটা অপসৃত হয়েছে মেয়েদের এমন একটি বিরাট সাফল্যে। ২০১৮ সালে কুয়ালালামপুরে ভারতকে সপ্তম এশিয়া কাপে হারিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম শিরোপা পেয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা।

নেপাল চ্যাম্পিয়নশিপের সব খেলায় বাংলাদেশ ফুটবল দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবিনা খাতুন। ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামের কিশোরীদের আবির্ভাবে প্রমীলা ফুটবল খেলায় বাংলাদেশের নৈপুণ্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। বলা যায়, মেয়েদের ফুটবল খেলার নাম-ডাক শুরু হয় কলসিন্দুরের মেয়েদের দিয়ে। ২০১৬ সালের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ মহিলা ফুটবল বাছাই পর্বে উতরে মূল পর্বে উঠা ১১ জনের মধ্যে ৯ জনই ছিলেন কলসিন্দুরের, এবারে আছে ৮ জন। ছাদখোলা বাসে শিরোপা উঁচিয়ে ধরার ইচ্ছা করেছিলেন মিডফিল্ডার সানজিদা খাতুন, তার ইচ্ছা পূরণে এগিয়ে এসেছেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল; তার আগ্রহে চ্যাম্পিয়নদের বরণ করার জন্য ছাদ কেটে তৈরি করা হয়েছে ছাদখোলা বাস। সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি নিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দরে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী তাদের অভ্যর্থনা জানান। ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো বিমানবন্দর এলাকা। জয়যাত্রায় ছাদখোলা বাস ঘিরে পথে পথে ছিল সব বয়সি উৎসুক জনতার ঢল। বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ভবন পর্যন্ত পথে পথে অপেক্ষায় ছিল সমর্থকরা, সেøাগান দিয়ে, ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে সংবর্ধনা জানিয়েছে তারাও।

ক্রিকেটার মাশরাফি, সাকিব, তামিম ইকবাল, মুশফিকের বার্ষিক আয়ের তুলনায় একেবারেই নস্যি ফুটবলার সাবিনা খাতুনদের আয়। সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে খেলার মাঠে এলেও এদের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দারুণ অবহেলা। চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারদের বেতন ক্যাটাগরি অনুযায়ী দেয়া হয়ে থাকে, যিনি যেই ক্যাটাগরিতে থাকবেন তিনি সেই ক্যাটাগরি অনুযায়ী মাসিক বেতন পাবেন। একজন ছেলে ক্রিকেটার সর্বোচ্চ ৪-৬ লাখ টাকা মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন, এখন নাকি তা ৮ লাখে উন্নীত হচ্ছে; অন্যদিকে একজন নারী ক্রিকেটার পান সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা, তবে ডি ক্যাটাগরির একজন নারী খেলোয়াড় পান মাত্র ২৫ হাজার টাকা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সাফল্য লাভ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে কিছু আর্থিক প্রণোদনা পেয়েছেন নারী খেলোয়াড়রা। এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলকে দুই কোটি টাকার আর্থিক পুরস্কার দিয়েছেন তিনি। কিন্তু যারা চুক্তিবদ্ধ নন তাদের অবহেলা চরম পর্যায়ের। অনেক ক্লাবে নাকি মেয়েরা বিনা পারিশ্রমিকেই খেলতে বাধ্য হন, তবে ক্লাব কর্তৃপক্ষের মতে তথ্যটি সত্য নয়, খেলোয়াড়দের যাতায়াত-ভাড়া দেয়া হয়। আমাদের অবশ্যই খেলাকে গুরুত্ব দিতে হবে; কারণ এই মেয়েরাই আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের শ্রেষ্ঠ সাফল্যের দূত। শত শত দূতাবাস দেশের পরিচিতির প্রচার ও প্রসারে যা করতে পারে না, একজন ম্যারাডোনা, একজন নেইমার, একজন মেসি ও একজন সাকিব তার চেয়ে অনেক বেশি করতে পারেন। আর্জেন্টিনাকে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করে দেয়ার জন্য একজন ম্যারাডোনা বা একজন মেসিই যথেষ্ট। পর্তুগালের প্রেসিডেন্টের ভাষ্যমতে- ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর জন্যই অনেক মানুষ পর্তুগালকে চেনে। নেইমার না থাকলে শুধু সাম্বা নাচ দিয়ে ব্রাজিল এত জনপ্রিয় হতে পারতো না।

বাংলাদেশে নারী ফুটবল দলের স্পন্সর পাওয়া যায় না, কারণ গ্যালারি বা মিডিয়ায় দর্শক কম। ছেলেদের ফুটবল খেলাও তো আজকাল কেউ দেখে বলে মনে হয় না, কিন্তু তাদের জন্য স্পন্সর পাওয়া যায়। মনে হচ্ছে- সামাজিক বাধা এক্ষেত্রে কাজ করছে। তবে সম্ভাব্য স্পন্সরকে আগ্রহী করে তুলতে ক্রীড়াঙ্গনের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। মেয়ে ফুটবল খেলোয়াড়দের এ বিজয়ে দেশে একটি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, এখন হয়ত স্পন্সর পাওয়া যাবে। ঢাকার মাঠে এখন মেয়েদের আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হলে দর্শকও থাকবে।

ধর্মীয় বিধান অনুসারে মেয়েদের কিছু কিছু কাজে বাধা-নিষেধ রয়েছে পর্দা খেলাপের আশঙ্কায়। তাই বাঙালি মুসলমান এখনো মেয়েদের মাঠে নামাতে ইতস্তত করছে, মেয়েদের খেলাধুলায় মাঠে নামানো এখনো সহজ হচ্ছে না। শুরু থেকেই দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মেয়েদের ফুটবলে অংশগ্রহণ বেশি; অথচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র দুই শতাংশ। ধর্মীয় বিধি নিষেধের কারণে মেয়ে খেলোয়াড়দের হেনস্তার শিকারও হতে হয়। অনূর্ধ্ব-১৬ আন্তর্জাতিক ট্রফি জিতে ফেরার সময় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বাসের ব্যবস্থা না করায় প্রাইভেট বাসে অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে চড়ার কারণে নারী খেলোয়াড়দের কিছু যাত্রীর রোষানলে পড়তে হয়েছিল। ধর্মের বিধিনিষেধ, সমাজের কটূক্তি আর বিরূপ চাহনির জন্য মেয়ে সন্তানের মাঠের খেলায় অংশগ্রহণে মা-বাবাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। খেলাধুলায় নারীদের অংশগ্রহণের একটি বড় বাধা পরিধেয় পোশাক। খেলাধুলার উপযোগী পোশাক পরে খেললে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তা মানতে চায় না; সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে খেলোয়াড়রাও বিব্রতবোধ করে। ঘরে-বাইরে সর্বত্র পিছুটান; তবে এবার চলার গতি থামিয়ে দেওয়ার অপূরাণ চেষ্টা সর্বস্তরের মানুষের জয়ধ্বনিতে ভেসে গেছে। আমাদের মেয়েদের এই সাফল্য ব্যাপকভাবে উদযাপিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে সর্বত্র, আনন্দের এমন বাঁধভাঙা জোয়ারে বিপক্ষের কটাক্ষ ও অশ্লীল কথাগুলোও চাপা পড়ে গেছে।

আমাদের পরিবার ও সমাজ মেয়েদের চাকরিজীবী হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও খেলাকে পেশা হিসেবে দেখতে এখনো প্রস্তুত নয়। তাই খেলাধুলায় নৈপুণ্য দেখিয়ে একটি চাকরি পাওয়ায় আশায় নিম্নবিত্তের মেয়েরা কোন একটি প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় খেলতে বেশি আগ্রহী। খেলাধুলার জগতে আসার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা পার হয়ে ক্রীড়া জগতে প্রবেশ করার পর দিনমজুরদের মতো পারিশ্রমিক দেয়া হলে আমাদের মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ধর্ম ও সমাজের বিরূপ পরিবেশে যুদ্ধ করে অনেকে টিকছেন না, এর মধ্যে আর্থিক অনটন না ঘুচলে মেয়েদের খেলাধুলায় মনোনিবেশ করা সহজ হবে না। খেলাধুলায় কিন্তু উচ্চবিত্তের মেয়েরা আগ্রহ দেখাচ্ছে না; মনে হচ্ছে আর্থিক দীনতা লাঘবের প্রত্যাশায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মেয়েরাই শুধু খেলাধুলায় অংশ নিচ্ছে। ফিফা নারী খেলোয়াড়দের জন্য যে টাকা দেয় তার পুরোটা মেয়ে ফুটবল খেলোয়াড়দের জন্য খরচ করা হয় কিনা- তা আমাদের জানা নেই। অনটন তাদের নিত্যসঙ্গী। অন্নপূর্ণা দেবী বর দিতে চাইলে মধ্যযুগের অন্নদামঙ্গল কাব্যের মাঝি ঈশ্বরী পাটনীর চাওয়া ছিল- ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। আধুনিক যুগে বাংলাদেশের নারী খেলোয়াড়দের চাহিদা আরও কম। নারী খেলোয়াড়দের আর্থিক দীনতার প্রকাশ ঘটেছে ২০১৫ সালের সাফ গেমস বিজয়ী ক্ষুদে ফুটবলারদের কাছে উপন্যাসিক আনিসুল হক যখন জানতে চেয়েছিলেন- তারা কী চায়, তখন তাদের উত্তর ছিল ‘দুপুরে ভাত খেতে চাই’। তিনি যখন আরও একটু বেশি কিছু চাইতে বললেন তখন তারা বলল- ‘দুপুরের খাবারটা বাড়িয়ে দিলে পরিবারের সবাই খেতে পারবে’। হার না মানা লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্বকারী নারী খেলোয়াড়দের জন্য রইল আমাদের সবার অভিবাদন। কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের জন্যও রইল আমাদের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

back to top