বাবুল রবিদাস
অনেক মানুষকে প্রশ্ন করতে দেখা যায় যে, দলিত, আদিবাসী, ওবিসি, সংখ্যালঘু কী? তাই কোন যুক্তিপূর্ণ লেখা জনগণের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা পাইতে হলে বা প্রকাশ করতে হলে বিভিন্ন বইয়ের রেফারেন্স লাগে। আজকের বিষয়ে উত্তর দিতে গেলে ‘ভারতের মন্ডল কমিশনের’ রিপোর্ট থেকে বলতে হবে। পাঠকরা আপনারা যদি মন্ডল কমিশন রিপোর্টটি মনোযোগসহকারে পড়েন তাহলে দেখবেন যে, অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণী (OBC)+ তফসিলীজাতি (SC)+তফসিলী উপজাতি (ST)+সংখ্যালঘু (গরহড়ৎরঃরবং)=দলিত শ্রেণী বলে উল্লেখ রয়েছে। দলিত শ্রেণীর সংখ্যা ভারতে প্রায় ৮৫%। সবচেয়ে বৃহত্তর জনসংখ্যা হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতিতে তারা মাত্র ৩৪% চাকরিতে মাত্র ১৩%, ব্যবসাতে মাত্র ৬% আর ভূমি তাদের হাতে আছে মাত্র ৮% (তথ্য সূত্র : আম্বেদেকর প্রকাশী-কলকাতা, মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট)।
সমাজ ব্যবস্থার শিকার ৮৫ শতাংশ মানুষেরা হলেন ভারতে মুল অধিবাসী। এরা শূদ্র, অস্পৃশ্য ও আদিবাসী নামে অভিহিত। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সমূহের জনসাধারণের ৯৫ ভাগই শূদ্র, অস্পৃশ্য ও আদিবাসী থেকে ধর্মান্তরিত। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বড় বড় নেতারা প্রায়ই বলে থাকেন কেউ কি ধর্মান্তরিত হলে তারা রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষিত সুযোগ সুবিধা ও আদিবাসী আইন দ্বারা আর পরিচালিত হবেন না। এরকম অভিজ্ঞ নেতারা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাই যদি হয় তাহলে ময়মনসিংহের ‘গারো’ জাতি প্রায় ৯০ ভাগ খ্রিস্টান হয়েও তারা আদিবাসীদের বড় বড় অনুষ্ঠানে স্বগর্বে বক্তব্য পেশ করছেন।
কেউ কেউ বলছেন, ধর্মান্তরিত আদিবাসী খ্রিস্টানরা সাঁওতালদের ভাষা ছাড়া সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। ধর্মান্তরিত সাঁওতালদের রোমান হরফে সাঁওতালী ভাষায় শিক্ষাদান দেওয়ার চেয়ে বাংলা হরফে সাঁওতালী ভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার পক্ষে মতামত দেন অনেকে। এর ফলে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু বা চালুর ব্যবস্থা করা হলেও সাঁওতালী ভাষায় মতদ্বন্দ্বের কবলে পড়ে শিক্ষা কার্যক্রম এখন পর্যন্ত বন্ধ আছে। এটা কি যুক্তিযুক্ত ও আইন সঙ্গত?
আইন কী বলে? ধর্মান্তরিত হলে আদিবাসীরা কি তাদের আইন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাসহ বঞ্চিত হবে? বিজ্ঞ আইনজীবীরা সমস্যার সমাধান কল্পে প্রথমে দেশের আইন দেখবেন, এরপর দেশের নজির। অতঃপর বিদেশের নজির। ভারতের কলকাতা হাইকোর্ট বলেছেন- ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের ৪৯-কে ধারা মতে একজন আদিবাসী ধর্ম পরিবর্তনের কারণে আদিবাসী আইন থেকে বঞ্চিত হবেন না।
আরো একটি প্রশ্ন হলো কে আদিবাসী আর কে দলিত? দেশে কেউ কেউ একই জাতিকে দু’বার (কোচ, বর্মণ) অন্তর্ভূক্ত করার সুপারিশ করেছেন। পরবর্তীতে ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতির তালিকায় পাশের মধ্য দিয়ে সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে। অর্থাৎ কোচ ও বর্মণের স্থলে ‘রাজবংশী’ লেখা হয়। জানিনা কোন যুক্তির ভিত্তিতে ‘রাজবংশী’ জাতিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকায় আনতে তারা সুপারিশ করলেন। আর ‘রবিদাস’ জাতিকে তালিকা থেকে বাদ দিতে বিরোধিতা করলেন। শুধু তাই নয় তারা ‘রবিদাস’ জাতিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা ভুল হবে বলে মতামত দেন।
এ উত্তর দিতে আবার মন্ডল কমিশন রিপোর্টে যেতে হবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ তফসিলী জাতি (Scheduled Caste) সমূহের তালিকা মতে ভূঁইমালী, ঝালো-মালো, কোচ, রাজবংশী, রাজওয়ার, তুরী এবং চামার, চর্মকার মুচি, রবিদাস, রই দাস, ঋষি ইত্যাদির নাম পাওয়া যায়। ভারতের তফাসলী জাতি বাংলাদেশে যদি আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তালিকায় স্থান পায়, যেমন- রাজবংশী, কোচ, মালো, রাজওয়ার ইত্যাদি। তবে ‘রবিদাস’ জাতি বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তালিকায় স্থান পেতে নেতাদের আপত্তি থাকার কথা নয়।
নওগাঁ জজ কোর্ট বিজ্ঞ অ্যাডভোকেট মি. মতিলাল বর্মণ, পিতা-ননী গোপাল বর্মণ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ‘বর্মণ’ জাতির পক্ষ থেকে একটি পত্র পেরণ করেন এই বলে যে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ এর তফসিল থেকে ‘বর্মণ’ জাতির নাম বাদ দিতে (তারিখ-৩ মার্চ ২০১৫) তিনি মোবাইল ফোনে বলেন- যত দ্রুত সম্ভব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ থেকে রাজবংশী জাতিকে বাদ দেওয়া যায় ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।
‘বর্মণদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত করার প্রতিবাদে অতীতে নীলফামারীতে মানববন্ধন করেছে ও স্মারকলিপি দিয়েছে, বাংলাদেশ ক্ষত্রীয় সমিতি নীলফামারী জেলা শাখা।
এ প্রসঙ্গে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে রাজবংশী জাতির ঘরে জন্ম নেওয়া ব্যক্তির নাম ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি রাজবংশী সমাজের লোক ছিলেন। তিনি রংপুরে ১৯০১ সালে ওকালতি ব্যবসা আরম্ভ এবং ১৯১০ সালে ‘ক্ষত্রীয় সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার অন্যতম স্মরণীয় কাজ হলো নির্যাতিত দলিত সমাজের তফসিলী সংজ্ঞা প্রদান এবং রাজবংশী সমাজকে তফসিলী জাতির (Scheduled Caste) অন্তর্ভুক্ত করা। ১৯৩৫ সালের ‘ভারত শাসন আইন’ পাশের প্রাক্কালে গোপনে খবর পান যে, রাজবংশী জাতিকে তফসিলী জাতির (Scheduled Caste) তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এরপর তিনি সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ডকে টেলিগ্রাম করে রাজবংশী জাতির নাম তালিকাভুক্ত রাখার দাবি জানান। ভারতে এখনো তফসিলী জাতি (Scheduled Caste) হিসেবে রাজবংশী জাতি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন।
আদিবাসী হতে হলে অর্থাৎ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকা চাই। যেমন-ভাষা, সাংস্কৃতি, অলিখিত প্রথা, প্রকৃতি পুজারী, দূর্গম অঞ্চলে বসবাস, নিজেকে আদিবাসী বলে দাবী করা, তীর ধুনক ও বিভিন্ন অস্ত্র থাকা ইত্যাদি। ‘বর্মণ’ জাতির কোন নিজস্ব ভাষা নাই। সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন, তারা প্রকৃতির পুজারী নন, মাটির তৈরী হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীকে পূজা করেন। তারা ভারতে তফসিলী জাতি বলে দাবি করে ও বাংলাদেশে নিজেদের ক্ষত্রীয় বলে। এছাড়া নিজেদের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে দাবিও করে না। তাহলে কিভাবে তারা আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হলো? অধিকাংশ বর্মণ এখন শহরে বসবাস করেন, শিক্ষা-দীক্ষায় ও আধুনিকতায় অনেক এগিয়ে। অপরদিকে ‘রবিদাস’ জাতি একটি আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতি। তার প্রমাণ হচ্ছে- ‘রবিদাস’ জাতি নিজস্ব নাগরি ও ভূত নাগরি ভাষায় কথা বলে, তাদের পৃথক সাংস্কৃতি, প্রথা, রীতিনীতি, রেওয়াজ রয়েছে।
ইতিহাস থেকে দেখা যায়- পাঁচবিবি উপজেলা আদিবাসী বহুমুখী উন্নয়ন সংস্থা ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। তাদের প্রকাশিত তালিকায় ‘রবিদাস’ জাতি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত। সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরর জন্য গৃহীত উন্নয়ন কর্মসূচি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি অনন্য উদ্যোগ বইটিতে ‘রবিদাস’ জাতির নাম ছবিসহ উল্লেখ পাওয়া যায়; যা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ এর অনেক পরে প্রকাশিত। বহু রবিদাস ছাত্রছাত্রী স্টাইপেন্ড পেয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকায় যারা জমি ঘর পেয়েছেন তাদের মধ্যে বহু ‘রবিদাস’ জাতির নাম পত্রপত্রিকায় পাওয়া যায়। ‘রবিদাস’ জাতি আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে দাবিও করেন।
সুতরাং কিছু মানুষের বিরোধিতার কারণে ও কারও কারও নীরবতার কারণে ‘অনগ্রসর’ ‘রবিদাস’ জাতিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে বিরত রাখা হয়েছে কেন? যা বহুপ্রশ্নের জন্ম দেয়।
ময়মনসিংহের গারো জাতি সবাই খ্রিস্টান আর পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা বৌদ্ধ বটে। ভারতে দলিত ও আদিবাসীদের জন্য একই আইন। যেমন তফসিলী জাতি ও তফসিলী উপজাতি (নিষ্ঠুরতা নিবারণ) আইন ১৯৮৯। ব্রিটিশদের কৌশল হলো একত্রিত জাতিগুলোকে ভাগ করো আর শাসন করো, এ নীতি আধুনিক দেশে আর চলে না। এ দেশে যারা আদিবাসী আছেন তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ভাই-ভাইয়ের মধ্যে হিংসাবিদ্বেষ নয়। এতে শত্রুরা সুযোগ পাবে। অধিকার আদায় করতে হলে মিছিল, মিটিং, আন্দোলন প্রয়োজন হয়। তখন জনবলের ভোট প্রয়োজন। প্রকৃত বন্ধু দরকার। এখনও সময় আছে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না করে প্রকৃত সত্যকে উপলদ্ধি করে বিরোধিতা থেকে দূরে থাকবেন। শ্রমিক দলিত, বঞ্চিত, শোষিত, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের অধিকার আদায়ে ও একত্র করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন বলে প্রত্যাশা করছি।
গরিব, দুঃখী, অসহায় ও অনগ্রসর জাতিকে রাষ্ট্র যে নামে আখ্যায়িত করে তারা সেই নামেই পরিচিতি পায়। দলিত, বঞ্চিত, অন্ত্যজ, নমঃশূদ্র, হরিজন, মোথিত আদিবাসী, উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রান্তিক জাতি প্রায় সবাই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞানে অনগ্রসর বিধায় রাষ্ট্রের সুবিধা সব জাতিকে সমানভাবে প্রদান করা। যারা অনগ্রসর তাদের জন্য আলাদাভাবে বিশেষ যত্ন নিয়ে থাকে। এটিই হচ্ছে কোটা পদ্ধতি প্রবর্তন। যেমন- যুবক ও বৃদ্ধকে যদি দৌড় প্রতিযোগিতায় সমান অধিকার দিয়ে নামিয়ে দিই তাহলে যুবকটিই জয়লাভ করবে। এক্ষেত্রে বৃদ্ধের প্রতি বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
তাই দলিত, বঞ্চিত, মোথিত, অন্ত্যজ, নমঃশূদ্র, হরিজন, আদিবাসী, উপ-জাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণ প্রায় সবাই গরিব, দিনমজুর শ্রমিক শ্রেণী। এ গরিব দুঃখী শ্রমিক শ্রেণী মানুষদের উন্নয়ন দরকার। এজন্য রাষ্ট্র বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়ে মূল স্রোতধারায় তুলে আনে। উপরোক্ত আলোচনায় ‘রবিদাস’ জাতি অনগ্রসর ও বঞ্চিত তা ফুটে উঠেছে দলিত বা আদিবাসী যে নামেই ডাকি না কেন? তাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতির তালিকায় গেজেটে প্রকাশ (Live no one behind) পেতে বিরোধিতা নয়, সহযোগিতা আবশ্যক।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]
বাবুল রবিদাস
বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
অনেক মানুষকে প্রশ্ন করতে দেখা যায় যে, দলিত, আদিবাসী, ওবিসি, সংখ্যালঘু কী? তাই কোন যুক্তিপূর্ণ লেখা জনগণের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা পাইতে হলে বা প্রকাশ করতে হলে বিভিন্ন বইয়ের রেফারেন্স লাগে। আজকের বিষয়ে উত্তর দিতে গেলে ‘ভারতের মন্ডল কমিশনের’ রিপোর্ট থেকে বলতে হবে। পাঠকরা আপনারা যদি মন্ডল কমিশন রিপোর্টটি মনোযোগসহকারে পড়েন তাহলে দেখবেন যে, অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণী (OBC)+ তফসিলীজাতি (SC)+তফসিলী উপজাতি (ST)+সংখ্যালঘু (গরহড়ৎরঃরবং)=দলিত শ্রেণী বলে উল্লেখ রয়েছে। দলিত শ্রেণীর সংখ্যা ভারতে প্রায় ৮৫%। সবচেয়ে বৃহত্তর জনসংখ্যা হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতিতে তারা মাত্র ৩৪% চাকরিতে মাত্র ১৩%, ব্যবসাতে মাত্র ৬% আর ভূমি তাদের হাতে আছে মাত্র ৮% (তথ্য সূত্র : আম্বেদেকর প্রকাশী-কলকাতা, মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট)।
সমাজ ব্যবস্থার শিকার ৮৫ শতাংশ মানুষেরা হলেন ভারতে মুল অধিবাসী। এরা শূদ্র, অস্পৃশ্য ও আদিবাসী নামে অভিহিত। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সমূহের জনসাধারণের ৯৫ ভাগই শূদ্র, অস্পৃশ্য ও আদিবাসী থেকে ধর্মান্তরিত। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বড় বড় নেতারা প্রায়ই বলে থাকেন কেউ কি ধর্মান্তরিত হলে তারা রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষিত সুযোগ সুবিধা ও আদিবাসী আইন দ্বারা আর পরিচালিত হবেন না। এরকম অভিজ্ঞ নেতারা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাই যদি হয় তাহলে ময়মনসিংহের ‘গারো’ জাতি প্রায় ৯০ ভাগ খ্রিস্টান হয়েও তারা আদিবাসীদের বড় বড় অনুষ্ঠানে স্বগর্বে বক্তব্য পেশ করছেন।
কেউ কেউ বলছেন, ধর্মান্তরিত আদিবাসী খ্রিস্টানরা সাঁওতালদের ভাষা ছাড়া সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। ধর্মান্তরিত সাঁওতালদের রোমান হরফে সাঁওতালী ভাষায় শিক্ষাদান দেওয়ার চেয়ে বাংলা হরফে সাঁওতালী ভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার পক্ষে মতামত দেন অনেকে। এর ফলে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু বা চালুর ব্যবস্থা করা হলেও সাঁওতালী ভাষায় মতদ্বন্দ্বের কবলে পড়ে শিক্ষা কার্যক্রম এখন পর্যন্ত বন্ধ আছে। এটা কি যুক্তিযুক্ত ও আইন সঙ্গত?
আইন কী বলে? ধর্মান্তরিত হলে আদিবাসীরা কি তাদের আইন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাসহ বঞ্চিত হবে? বিজ্ঞ আইনজীবীরা সমস্যার সমাধান কল্পে প্রথমে দেশের আইন দেখবেন, এরপর দেশের নজির। অতঃপর বিদেশের নজির। ভারতের কলকাতা হাইকোর্ট বলেছেন- ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের ৪৯-কে ধারা মতে একজন আদিবাসী ধর্ম পরিবর্তনের কারণে আদিবাসী আইন থেকে বঞ্চিত হবেন না।
আরো একটি প্রশ্ন হলো কে আদিবাসী আর কে দলিত? দেশে কেউ কেউ একই জাতিকে দু’বার (কোচ, বর্মণ) অন্তর্ভূক্ত করার সুপারিশ করেছেন। পরবর্তীতে ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতির তালিকায় পাশের মধ্য দিয়ে সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে। অর্থাৎ কোচ ও বর্মণের স্থলে ‘রাজবংশী’ লেখা হয়। জানিনা কোন যুক্তির ভিত্তিতে ‘রাজবংশী’ জাতিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকায় আনতে তারা সুপারিশ করলেন। আর ‘রবিদাস’ জাতিকে তালিকা থেকে বাদ দিতে বিরোধিতা করলেন। শুধু তাই নয় তারা ‘রবিদাস’ জাতিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা ভুল হবে বলে মতামত দেন।
এ উত্তর দিতে আবার মন্ডল কমিশন রিপোর্টে যেতে হবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ তফসিলী জাতি (Scheduled Caste) সমূহের তালিকা মতে ভূঁইমালী, ঝালো-মালো, কোচ, রাজবংশী, রাজওয়ার, তুরী এবং চামার, চর্মকার মুচি, রবিদাস, রই দাস, ঋষি ইত্যাদির নাম পাওয়া যায়। ভারতের তফাসলী জাতি বাংলাদেশে যদি আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তালিকায় স্থান পায়, যেমন- রাজবংশী, কোচ, মালো, রাজওয়ার ইত্যাদি। তবে ‘রবিদাস’ জাতি বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তালিকায় স্থান পেতে নেতাদের আপত্তি থাকার কথা নয়।
নওগাঁ জজ কোর্ট বিজ্ঞ অ্যাডভোকেট মি. মতিলাল বর্মণ, পিতা-ননী গোপাল বর্মণ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ‘বর্মণ’ জাতির পক্ষ থেকে একটি পত্র পেরণ করেন এই বলে যে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ এর তফসিল থেকে ‘বর্মণ’ জাতির নাম বাদ দিতে (তারিখ-৩ মার্চ ২০১৫) তিনি মোবাইল ফোনে বলেন- যত দ্রুত সম্ভব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ থেকে রাজবংশী জাতিকে বাদ দেওয়া যায় ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।
‘বর্মণদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত করার প্রতিবাদে অতীতে নীলফামারীতে মানববন্ধন করেছে ও স্মারকলিপি দিয়েছে, বাংলাদেশ ক্ষত্রীয় সমিতি নীলফামারী জেলা শাখা।
এ প্রসঙ্গে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে রাজবংশী জাতির ঘরে জন্ম নেওয়া ব্যক্তির নাম ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি রাজবংশী সমাজের লোক ছিলেন। তিনি রংপুরে ১৯০১ সালে ওকালতি ব্যবসা আরম্ভ এবং ১৯১০ সালে ‘ক্ষত্রীয় সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার অন্যতম স্মরণীয় কাজ হলো নির্যাতিত দলিত সমাজের তফসিলী সংজ্ঞা প্রদান এবং রাজবংশী সমাজকে তফসিলী জাতির (Scheduled Caste) অন্তর্ভুক্ত করা। ১৯৩৫ সালের ‘ভারত শাসন আইন’ পাশের প্রাক্কালে গোপনে খবর পান যে, রাজবংশী জাতিকে তফসিলী জাতির (Scheduled Caste) তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এরপর তিনি সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ডকে টেলিগ্রাম করে রাজবংশী জাতির নাম তালিকাভুক্ত রাখার দাবি জানান। ভারতে এখনো তফসিলী জাতি (Scheduled Caste) হিসেবে রাজবংশী জাতি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন।
আদিবাসী হতে হলে অর্থাৎ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকা চাই। যেমন-ভাষা, সাংস্কৃতি, অলিখিত প্রথা, প্রকৃতি পুজারী, দূর্গম অঞ্চলে বসবাস, নিজেকে আদিবাসী বলে দাবী করা, তীর ধুনক ও বিভিন্ন অস্ত্র থাকা ইত্যাদি। ‘বর্মণ’ জাতির কোন নিজস্ব ভাষা নাই। সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন, তারা প্রকৃতির পুজারী নন, মাটির তৈরী হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীকে পূজা করেন। তারা ভারতে তফসিলী জাতি বলে দাবি করে ও বাংলাদেশে নিজেদের ক্ষত্রীয় বলে। এছাড়া নিজেদের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে দাবিও করে না। তাহলে কিভাবে তারা আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হলো? অধিকাংশ বর্মণ এখন শহরে বসবাস করেন, শিক্ষা-দীক্ষায় ও আধুনিকতায় অনেক এগিয়ে। অপরদিকে ‘রবিদাস’ জাতি একটি আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতি। তার প্রমাণ হচ্ছে- ‘রবিদাস’ জাতি নিজস্ব নাগরি ও ভূত নাগরি ভাষায় কথা বলে, তাদের পৃথক সাংস্কৃতি, প্রথা, রীতিনীতি, রেওয়াজ রয়েছে।
ইতিহাস থেকে দেখা যায়- পাঁচবিবি উপজেলা আদিবাসী বহুমুখী উন্নয়ন সংস্থা ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। তাদের প্রকাশিত তালিকায় ‘রবিদাস’ জাতি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত। সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরর জন্য গৃহীত উন্নয়ন কর্মসূচি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি অনন্য উদ্যোগ বইটিতে ‘রবিদাস’ জাতির নাম ছবিসহ উল্লেখ পাওয়া যায়; যা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ এর অনেক পরে প্রকাশিত। বহু রবিদাস ছাত্রছাত্রী স্টাইপেন্ড পেয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকায় যারা জমি ঘর পেয়েছেন তাদের মধ্যে বহু ‘রবিদাস’ জাতির নাম পত্রপত্রিকায় পাওয়া যায়। ‘রবিদাস’ জাতি আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে দাবিও করেন।
সুতরাং কিছু মানুষের বিরোধিতার কারণে ও কারও কারও নীরবতার কারণে ‘অনগ্রসর’ ‘রবিদাস’ জাতিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে বিরত রাখা হয়েছে কেন? যা বহুপ্রশ্নের জন্ম দেয়।
ময়মনসিংহের গারো জাতি সবাই খ্রিস্টান আর পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা বৌদ্ধ বটে। ভারতে দলিত ও আদিবাসীদের জন্য একই আইন। যেমন তফসিলী জাতি ও তফসিলী উপজাতি (নিষ্ঠুরতা নিবারণ) আইন ১৯৮৯। ব্রিটিশদের কৌশল হলো একত্রিত জাতিগুলোকে ভাগ করো আর শাসন করো, এ নীতি আধুনিক দেশে আর চলে না। এ দেশে যারা আদিবাসী আছেন তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ভাই-ভাইয়ের মধ্যে হিংসাবিদ্বেষ নয়। এতে শত্রুরা সুযোগ পাবে। অধিকার আদায় করতে হলে মিছিল, মিটিং, আন্দোলন প্রয়োজন হয়। তখন জনবলের ভোট প্রয়োজন। প্রকৃত বন্ধু দরকার। এখনও সময় আছে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না করে প্রকৃত সত্যকে উপলদ্ধি করে বিরোধিতা থেকে দূরে থাকবেন। শ্রমিক দলিত, বঞ্চিত, শোষিত, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের অধিকার আদায়ে ও একত্র করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন বলে প্রত্যাশা করছি।
গরিব, দুঃখী, অসহায় ও অনগ্রসর জাতিকে রাষ্ট্র যে নামে আখ্যায়িত করে তারা সেই নামেই পরিচিতি পায়। দলিত, বঞ্চিত, অন্ত্যজ, নমঃশূদ্র, হরিজন, মোথিত আদিবাসী, উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রান্তিক জাতি প্রায় সবাই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞানে অনগ্রসর বিধায় রাষ্ট্রের সুবিধা সব জাতিকে সমানভাবে প্রদান করা। যারা অনগ্রসর তাদের জন্য আলাদাভাবে বিশেষ যত্ন নিয়ে থাকে। এটিই হচ্ছে কোটা পদ্ধতি প্রবর্তন। যেমন- যুবক ও বৃদ্ধকে যদি দৌড় প্রতিযোগিতায় সমান অধিকার দিয়ে নামিয়ে দিই তাহলে যুবকটিই জয়লাভ করবে। এক্ষেত্রে বৃদ্ধের প্রতি বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
তাই দলিত, বঞ্চিত, মোথিত, অন্ত্যজ, নমঃশূদ্র, হরিজন, আদিবাসী, উপ-জাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণ প্রায় সবাই গরিব, দিনমজুর শ্রমিক শ্রেণী। এ গরিব দুঃখী শ্রমিক শ্রেণী মানুষদের উন্নয়ন দরকার। এজন্য রাষ্ট্র বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়ে মূল স্রোতধারায় তুলে আনে। উপরোক্ত আলোচনায় ‘রবিদাস’ জাতি অনগ্রসর ও বঞ্চিত তা ফুটে উঠেছে দলিত বা আদিবাসী যে নামেই ডাকি না কেন? তাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতির তালিকায় গেজেটে প্রকাশ (Live no one behind) পেতে বিরোধিতা নয়, সহযোগিতা আবশ্যক।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]