রিয়াজ মাহমুদ
অসত্যের অন্ধকারে সত্যের মশাল ঊর্ধ্বে তুলে বন্ধ চক্ষু খুলে দেওয়ার সাহসী স্ব-উচ্চারণ বুদ্ধিজীবিতার অন্যতম শর্ত। বুদ্ধিজীবী যুগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমাজের গভীরে বাস করা দীর্ঘ দিনের চিন্তার বন্ধ্যত্বকে উন্মোচিত করে যুগ উপযোগী সত্য জনসাধারণের সামনে প্রকাশ করেন। কারণ সমাজ বাস্তবতায় সত্য সব সময় একই রকম থাকে না। পরিবর্তিত হয়; কিন্তু দীর্ঘ দিনের অভ্যস্থতায় তা সাধারণের চোখের আড়ালে থাকে। বুদ্ধিজীবী তার স্বরূপ উন্মোচিত করেন। সমাজের বদ্ধ মনে আঘাত করে অন্তরচক্ষু খুলে দেন। যুগ-উপযোগী সত্য প্রকাশের দায় বিবেচনায় নিয়ে কবি ও ভাষাতাত্ত্বিক হুমায়ন আজাদের বলিষ্ঠ উচ্চারণ- ‘যে বুদ্ধিজীবী নিজের সময় ও সমাজ নিয়ে সন্তুষ্ট, সে গৃহপালিত পশু।’ সুপরিচিত, নিকটাত্মীয়, কিংবা ঘনিষ্ঠজনের টলমল আঁখি মনের গভীরে বেদনা তৈরি করলেও সত্য প্রকাশ থেকে একপা পিছু না হাঁটার অনমনীয় মনোভাব বুদ্ধিজীবিতাকে দিয়েছে সমাজের হৃদয়ে স্থান। এমনকি রাষ্ট্রশক্তি শত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে জেনেও সত্য প্রকাশের ঝুঁকি গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না।
রাষ্ট্রের আছে ক্ষমতা। ক্ষমতা ব্যবহার করে সবাইকে দাবিয়ে রাখতে চায়। সত্যকে ঢেকে দেয়। বুদ্ধিজীবীর ক্ষমতা হলো- তিনি জনসাধারণকে জাগিয়ে দেন। জালিয়ে দেন পুরনো ঝঞ্ঝাট। শিকল ভাঙ্গার আহ্বান তার কলমে বেজে উঠে। দুনিয়ার সব মানুষের আবেগের বিরুদ্ধে গেলেও বুদ্ধিজীবী তার বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করে সত্য প্রকাশ করে; যা বুদ্ধিজীবিতাকে স্বতন্ত্র করেছে অন্যদের থেকে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দুই দিন আগে এ দেশের সূর্য সন্তানদের ধরে ধরে হত্যা করে পাকিস্তানি জান্তা। তার কারণ ছিল- পাকিস্তানি জান্তারা বুদ্ধিভিত্তিকতায় পূর্ব পাকিস্তানি মানুষকে প্রতিবন্ধী বানাতে চেয়েছে; কিন্তু যুগের দায় নিয়ে এগিয়ে এসেছে বুদ্ধিজীবীরা। তারা প্রথমে আঘাত করে ভাষার ওপর। ভাষার অধিকার কেড়ে নিলে জ্ঞান অন্বেষনের দরজায় শক্তিশালী দানবের পাহারা বসবে। দুরূহ হয়ে পড়বে জ্ঞানচর্চা। বুদ্ধিজীবীরা তখন মাতৃভাষার পক্ষে কলম ধরেছেন। মাতৃভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা দেশবাসীর সামনে হাজির করে শাসকের বুকে ত্রাস সৃষ্টি করে ছিলেন। ভাষা আন্দোলন যুক্তিবাদী মনন গঠন ও যুক্তির পক্ষে জনসাধারণের ঐক্য স্থাপনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছিল।
ইতিহাস বৃক্ষের শিকড়ের গভীরতা যত বেশি জাতির মেরুদন্ড তত শক্তিশালী। তা জানা সত্ত্বেও স্বৈরাচার আইয়ুবের শাসনকালে ইতিহাস চর্চার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। চর্যাপদ, শ্রী-কৃষ্ণকীর্তন ইত্যাদি গ্রন্থ পড়ানো বন্ধ করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তখন বুদ্ধিজীবীরা এগিয়ে আসেন এবং চর্যাপদকে চর্যাগীতিকা, বড়– চন্ডীদাসের কাব্য নামে পড়ানো শুরু করেন। যেখানেই শাসকরা জনগনকে বোকা বানিয়ে ঠকাতে চেয়েছে এগিয়ে এসেছে বুদ্ধিজীবীরা। তাদের লেখনি জাগিয়ে দিয়েছে জনসাধারণের ঘুমন্ত চেতনাকে। প্রভাবিত করেছে রাজনৈতিক আন্দোলনের গতিপথ। তারপর আইয়ুব সরকারের বাংলা নববর্ষ ও রবীন্দ্র সাহিত্য বন্ধের সিদ্ধান্তে জনগণ সাড়া দেয়নি। উপায়ন্তর না পেয়ে বুদ্ধিজীবীদের দমাতে আইয়ুব খান ভিন্ন কৌশলের অবতারণা করেন। তিনি রাইটার্স গিল্ড তৈরি করে বুদ্ধিজীবীদের পুরস্কার ও খেতাব দেওয়ার প্রচলন করেন। কিন্তু বাংলার সূর্য সন্তানরা আইয়ুবের লোভের ফাঁদে পা দেননি। বরং তারা খেতাব ফেলে বিদ্রোহের কবিতায়, গানে সাধারণ মানুষকে শত্রু-মিত্রের পার্থক্য বুঝিয়ে দিয়েছেন। ফলে পাকিস্তানি সেনারা দেশত্যাগ করার আগে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড পরিচালনা করেছেন। যতবার পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষকে অর্থব বানাতে চেয়েছে ততবার পরাস্থ হয়েছে বুদ্ধিজীবীদের কারণে। তাই বিজয়ের একদিন পূর্বে সকল প্রতিশোধের আগুনে জালিয়ে দিয়ে গেছে।
ইতিহাসের চোখে বুদ্ধিজীবিতা
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ফ্রান্সে বুদ্ধিজীবিতার সুচনা হয়। ডেফ্রুসে নামের একজন ফরাসি সেনার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে তিনি সামরিক তথ্য জার্মানিদের কাছে বিক্রি করেন। অভিযোগ প্রামাণের পূর্বেই বিচারক তার শাস্তির রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার কালে বিচারকের বিবেচনায় ছিল তিনি একজন ইহুদি। তার শাস্তি ছিল ক্যারিবিয়ান সাগরের আইল্যান্ডে যাবজ্জীবন কাটাতে হবে। যেটি ডেভিলস আইল্যান্ড হিসেবে পরিচিত ছিল। সে দ্বীপ ছিল আন্দামান দ্বীপ থেকেও শতগুণ বেশি ভয়ংকর। একই অভিযোগে এস্টারহেজি নামে ফরাসি সেনাদের অন্য আরেকজন অভিযুক্ত হন। তার অপরাধ প্রমাণ হলেও তিনি বেকুসর খালাস পেয়ে যায়। এ ঘটনা ফ্রান্সের জনসাধারণকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। জনতা প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। জনসাধারণ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল ডেফ্রুসের সমর্থক। ডেফ্রুসের সমর্থকদের দেশদ্রাহী হিসেবে চিহ্নিত করে বিরোধীরা। এদের বলা হয়- দেশের শত্রু। এই শত্রুরাই ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে পড়ে। সংকীর্ণ ও সংরক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে প্রতিবাদই বুদ্ধিজীবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ ‘অ্যমিল দুরখাইম’ ছিলেন ডেফ্রুসারের সমর্থক। ‘রোমা রোলা’ ডেফ্রুসের বিচারের প্রহসন নিয়ে একটি নাটক লিখেছিলেন। রোমা রোলা ছিলেন একজন প্রগতীপন্থি লেখক। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের তীব্র সমালোচনা করায় তাকে দেশান্তরি হতে হয়। তবুও তিনি শান্তির আদর্শ ত্যাগ করেননি। বুদ্ধিজীবীরা সব সময় লিখে প্রতিবাদ করেন এমন নয়।
বার্ট্রান্ড রাসেল শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী। তিনি যা কিছু সত্য মনে করতেন তাই প্রকাশ করতেন। সেজন্য বারবার মতাদর্শ পরিবর্তন করতে হয়েছে কিন্তু মার্কসবাদের প্রতি ছিল তার অগাধ শ্রদ্ধা। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া, চীন ভ্রমণ করে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে আপোস করেননি। বরং ফোবিয়ান সোসাইটি ত্যাগ করতে কুন্ঠাবোধ করেননি এবং ধীরে ধীরে মার্কসবাদের প্রতি শ্রদ্ধা শিথিল হয়ে যায়। আপোসহীনতার কারণে বার্ট্রান্ড রাসেলের বহুবার বন্ধু বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এমনি চরম দারিদ্র্যতাকে গ্রহণ করতে হয় তবু আপোস করেননি। সত্তর বছর বয়সে রাসেল আমেরিকায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বক্তৃতা করার জন্য; কিন্তু নীতিবগিশ আমেরিকার জনসাধারণ ‘ম্যারেজ এব মরেলস’ লেখকের বক্তৃতা শুনতে অপারগ। তারা কোর্টের আদেশ এনে তার বক্তৃতার কর্মসূচি স্থগিত করে দেয়। পৃথিবীর দেশে দেশে যুদ্ধের বিরুদ্ধে আপোসহীন লড়ে যান। এজন্য তার নিজ দেশের সরকার তার ওপর রুষ্ঠ হয়। নানাভাবে হয়রানি ও লাঞ্ছিত করেন। ভারত-চীন যুদ্ধের সময় তিনি নেহরুর কাছে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন। তারা তাতে কর্ণপাত করেননি।
প্রথম বিশ^যুদ্ধে তিনি ছিলেন চরম শান্তিকামী। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর শুরু করলেন পারমাণবিক অস্ত্র বন্ধ করার দাবিতে আন্দোলন। পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে রাসেল ছিলেন সভাপতি। পারমানবিক অস্ত্র বন্ধের দাবিতে আন্দোলন সচল রাখতে তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তোলেন। ৮৮ বছর বয়সের যুবক দলেবলে লড়ে গেলেন। ফলাফল শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে রাসেল দম্পতিকে কারাবরণ করতে হয়েছে। ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিলেন তুমুল শক্তিমান ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বুদ্ধিজীবী। সত্যের সান্নিধ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত চিন্তাকে ছুড়ে ফেলতে বিলম্ব করেননি। ‘সভ্যতার সংকট’ লিখে তিনি তীক্ষ্ম ভাষায় ইংরেজদের অন্যায়ের মুখোশ উন্মোচন করেছিলেন। বঙ্গবঙ্গের বিরুদ্ধে তিনি রাজপথে সক্রিয় ছিলেন। জালিয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের পর কলকাতায় এসে রাজনৈতিক নেতাদের সমাবেশের আয়োজন করার অনুরোধ করেছিলেন। ইংরেজ শাসনের প্রতি প্রবল ধিক্কার জানিয়ে তিনি সেখানে বক্তৃতা দিবেন- এ ছিল প্রত্যাশা।
কিন্তু নেতারা রাজি হলেন না। কারণ প্রথম বিশ^যুদ্ধের পর ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া রুলস তখনো বহাল ছিল। জালিয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদের নতুন রাস্তা খুঁজতে গিয়ে নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার এত বড় অপমানের প্রতিশোধ নেন। শান্তি নিকেতনের বরাদ্দ বাতিল করে দেন। কবির ইংরেজ বন্ধুরা রুষ্ঠ হন। কবি তবু পিছু হটেননি। বরং তিনি গান্ধীকে চিঠি লিখেন পাঞ্জাব যাওয়ার জন্য। তখন পাঞ্জাবে ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া রুলসের প্রয়োগ করে অনেক নেতার দীপান্তর হয়েছে, সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীকে অনুরোধ করেন সেখানে দু’জনে গিয়ে প্রতিবাদ জানাবেন। ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া রুলস বাতিলের দাবি তুলবেন। কিন্তু গান্ধী রাজি হননি। রবীন্দ্রনাথ সে যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে লিখেন- এর কোন উপায় নেই? কোন প্রতিকার নেই? কোন উত্তর দিতে পারবো না? কিছুই করতে পারবো না? এটা যদি নীরবে সইতে হয়, তাহলে জীবন ধারণ যে অসম্ভব হয়ে উঠবে। বুদ্ধিজীবিতার ইতিহাস নিরবচ্ছিন্ন লড়াইয়ের ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথও লড়াইয়ের বাহিরে থাকতে পারেনি।
বুদ্ধিজীবিতার দায়
বুদ্ধিজীবিতা ব্যক্তিনিষ্ঠ বটে তবে অসম্ভব রকমের বস্তুনিষ্ঠ। বুদ্ধিজীবীর দায় তার নিজের কাছে। সত্য প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণা বুদ্ধিজীবীকে তাড়িয়ে বেড়ায়। অন্তরকে পুড়িয়ে মারে। নিদ্রা কেড়ে নেয়। জনসাধারণ তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি প্রত্যাশা করে বুদ্ধিজীবীদের কাছে। বুদ্ধিজীবিতার দায় নিয়ে ১৯৮৬ সালে ভাক্লাভ হাভেল যা বলেছেন তা স্মরণ করা যাক- ‘বুদ্ধিজীবীর উচিত ক্রমাগত প্রশ্ন তোলা, পৃথিবীর দুর্দশার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া, স্বাধীন হওয়ার পথে ইন্ধন জোগানো, প্রকাশ্য ও গোপন সব চাপ ও কৌশলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, বিভিন্ন ব্যবস্থা, ক্ষমতা এবং এর সম্মোহন সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করা এবং এসব মিথ্যাচারের সাক্ষী হওয়া।’
বুদ্ধিজীবীদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে ভুলে গেলেন বুদ্ধিজীবীরা। আশির দশক থেকে বুদ্ধিজীবিতার পতন শুরু হয়। রুদ্রকে লিখতে হয়েছে- বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে রাজনীতিবিদের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের চাপ, বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে বুদ্ধিজীবির রক্তস্নায়ুতে সচেতন অপরাধ। অথাৎ বুদ্ধিজীবী তার বুদ্ধি ও বিবেচনা দিয়ে সঠিক কথাটা বলছেন না। তারা কথা বলছেন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের জন্য। হুমায়ূন আজাদ ও আহমদ ছফা দুজনের মতের অনেক পার্থক্য থাকলেও বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধি নিরপেক্ষ সত্য উচ্চারণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন- সে ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলস বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব কী হবে সে সম্পর্কে বলছেন- ‘বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব হলো শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে যুক্ত থেকে তাদের চিন্তা-ভাবনা যথোপযুক্ত ভাবাদর্শানুযায়ী গড়ে তোলা।’ স্বাধীনতার পূর্বে বুদ্ধিজীবীরা এ কাজটা করেছেন।
আজকের বিশে^ স্বৈরাচারী শাসকদের শাসনের অন্যতম হাতিয়ার হলো ইতিহাস। ইতিহাসের একটিমাত্র বয়ান নির্মাণ ও নির্দিষ্ট বিষয় শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকদের জন্য ঠিক করে দেয়। কোন বিষয়ে কথা বলা যাবে কোন বিষয়টা কথা বলা যাবে না- তার নির্দেশনা হাজির করে। ফলে ইতিহাস দুষ্টচক্রের চোরাগলিতে হারিয়ে যেতে থাকে। হারানো জায়গায় প্রতিস্থাপিত হয় নতুন ইতিহাস বা মনগড়া ইতিহাস। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথের সন্ধান দেয়ার চেষ্টা করেন নোয়াম চমস্কি। তিনি বলেন- ‘বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য সরকারের মিথ্যা উদঘাটন করা এবং সরকারের কাজের হেতু ও উদ্দেশ্য, এমনকি কখনো কখনো গুপ্ত অভিপ্রায়ের দিকে লক্ষ্য রেখে এর কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করা। ’ ফলে আজকের এই ঘনঘোর বরিষায় বুদ্ধিজীবী তাদের দায় নিয়ে এগিয়ে আসবেন- সেটাই প্রত্যাশিত।
[লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক]
রিয়াজ মাহমুদ
বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
অসত্যের অন্ধকারে সত্যের মশাল ঊর্ধ্বে তুলে বন্ধ চক্ষু খুলে দেওয়ার সাহসী স্ব-উচ্চারণ বুদ্ধিজীবিতার অন্যতম শর্ত। বুদ্ধিজীবী যুগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমাজের গভীরে বাস করা দীর্ঘ দিনের চিন্তার বন্ধ্যত্বকে উন্মোচিত করে যুগ উপযোগী সত্য জনসাধারণের সামনে প্রকাশ করেন। কারণ সমাজ বাস্তবতায় সত্য সব সময় একই রকম থাকে না। পরিবর্তিত হয়; কিন্তু দীর্ঘ দিনের অভ্যস্থতায় তা সাধারণের চোখের আড়ালে থাকে। বুদ্ধিজীবী তার স্বরূপ উন্মোচিত করেন। সমাজের বদ্ধ মনে আঘাত করে অন্তরচক্ষু খুলে দেন। যুগ-উপযোগী সত্য প্রকাশের দায় বিবেচনায় নিয়ে কবি ও ভাষাতাত্ত্বিক হুমায়ন আজাদের বলিষ্ঠ উচ্চারণ- ‘যে বুদ্ধিজীবী নিজের সময় ও সমাজ নিয়ে সন্তুষ্ট, সে গৃহপালিত পশু।’ সুপরিচিত, নিকটাত্মীয়, কিংবা ঘনিষ্ঠজনের টলমল আঁখি মনের গভীরে বেদনা তৈরি করলেও সত্য প্রকাশ থেকে একপা পিছু না হাঁটার অনমনীয় মনোভাব বুদ্ধিজীবিতাকে দিয়েছে সমাজের হৃদয়ে স্থান। এমনকি রাষ্ট্রশক্তি শত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে জেনেও সত্য প্রকাশের ঝুঁকি গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না।
রাষ্ট্রের আছে ক্ষমতা। ক্ষমতা ব্যবহার করে সবাইকে দাবিয়ে রাখতে চায়। সত্যকে ঢেকে দেয়। বুদ্ধিজীবীর ক্ষমতা হলো- তিনি জনসাধারণকে জাগিয়ে দেন। জালিয়ে দেন পুরনো ঝঞ্ঝাট। শিকল ভাঙ্গার আহ্বান তার কলমে বেজে উঠে। দুনিয়ার সব মানুষের আবেগের বিরুদ্ধে গেলেও বুদ্ধিজীবী তার বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করে সত্য প্রকাশ করে; যা বুদ্ধিজীবিতাকে স্বতন্ত্র করেছে অন্যদের থেকে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দুই দিন আগে এ দেশের সূর্য সন্তানদের ধরে ধরে হত্যা করে পাকিস্তানি জান্তা। তার কারণ ছিল- পাকিস্তানি জান্তারা বুদ্ধিভিত্তিকতায় পূর্ব পাকিস্তানি মানুষকে প্রতিবন্ধী বানাতে চেয়েছে; কিন্তু যুগের দায় নিয়ে এগিয়ে এসেছে বুদ্ধিজীবীরা। তারা প্রথমে আঘাত করে ভাষার ওপর। ভাষার অধিকার কেড়ে নিলে জ্ঞান অন্বেষনের দরজায় শক্তিশালী দানবের পাহারা বসবে। দুরূহ হয়ে পড়বে জ্ঞানচর্চা। বুদ্ধিজীবীরা তখন মাতৃভাষার পক্ষে কলম ধরেছেন। মাতৃভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা দেশবাসীর সামনে হাজির করে শাসকের বুকে ত্রাস সৃষ্টি করে ছিলেন। ভাষা আন্দোলন যুক্তিবাদী মনন গঠন ও যুক্তির পক্ষে জনসাধারণের ঐক্য স্থাপনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছিল।
ইতিহাস বৃক্ষের শিকড়ের গভীরতা যত বেশি জাতির মেরুদন্ড তত শক্তিশালী। তা জানা সত্ত্বেও স্বৈরাচার আইয়ুবের শাসনকালে ইতিহাস চর্চার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। চর্যাপদ, শ্রী-কৃষ্ণকীর্তন ইত্যাদি গ্রন্থ পড়ানো বন্ধ করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তখন বুদ্ধিজীবীরা এগিয়ে আসেন এবং চর্যাপদকে চর্যাগীতিকা, বড়– চন্ডীদাসের কাব্য নামে পড়ানো শুরু করেন। যেখানেই শাসকরা জনগনকে বোকা বানিয়ে ঠকাতে চেয়েছে এগিয়ে এসেছে বুদ্ধিজীবীরা। তাদের লেখনি জাগিয়ে দিয়েছে জনসাধারণের ঘুমন্ত চেতনাকে। প্রভাবিত করেছে রাজনৈতিক আন্দোলনের গতিপথ। তারপর আইয়ুব সরকারের বাংলা নববর্ষ ও রবীন্দ্র সাহিত্য বন্ধের সিদ্ধান্তে জনগণ সাড়া দেয়নি। উপায়ন্তর না পেয়ে বুদ্ধিজীবীদের দমাতে আইয়ুব খান ভিন্ন কৌশলের অবতারণা করেন। তিনি রাইটার্স গিল্ড তৈরি করে বুদ্ধিজীবীদের পুরস্কার ও খেতাব দেওয়ার প্রচলন করেন। কিন্তু বাংলার সূর্য সন্তানরা আইয়ুবের লোভের ফাঁদে পা দেননি। বরং তারা খেতাব ফেলে বিদ্রোহের কবিতায়, গানে সাধারণ মানুষকে শত্রু-মিত্রের পার্থক্য বুঝিয়ে দিয়েছেন। ফলে পাকিস্তানি সেনারা দেশত্যাগ করার আগে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড পরিচালনা করেছেন। যতবার পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষকে অর্থব বানাতে চেয়েছে ততবার পরাস্থ হয়েছে বুদ্ধিজীবীদের কারণে। তাই বিজয়ের একদিন পূর্বে সকল প্রতিশোধের আগুনে জালিয়ে দিয়ে গেছে।
ইতিহাসের চোখে বুদ্ধিজীবিতা
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ফ্রান্সে বুদ্ধিজীবিতার সুচনা হয়। ডেফ্রুসে নামের একজন ফরাসি সেনার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে তিনি সামরিক তথ্য জার্মানিদের কাছে বিক্রি করেন। অভিযোগ প্রামাণের পূর্বেই বিচারক তার শাস্তির রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার কালে বিচারকের বিবেচনায় ছিল তিনি একজন ইহুদি। তার শাস্তি ছিল ক্যারিবিয়ান সাগরের আইল্যান্ডে যাবজ্জীবন কাটাতে হবে। যেটি ডেভিলস আইল্যান্ড হিসেবে পরিচিত ছিল। সে দ্বীপ ছিল আন্দামান দ্বীপ থেকেও শতগুণ বেশি ভয়ংকর। একই অভিযোগে এস্টারহেজি নামে ফরাসি সেনাদের অন্য আরেকজন অভিযুক্ত হন। তার অপরাধ প্রমাণ হলেও তিনি বেকুসর খালাস পেয়ে যায়। এ ঘটনা ফ্রান্সের জনসাধারণকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। জনতা প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। জনসাধারণ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল ডেফ্রুসের সমর্থক। ডেফ্রুসের সমর্থকদের দেশদ্রাহী হিসেবে চিহ্নিত করে বিরোধীরা। এদের বলা হয়- দেশের শত্রু। এই শত্রুরাই ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে পড়ে। সংকীর্ণ ও সংরক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে প্রতিবাদই বুদ্ধিজীবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ ‘অ্যমিল দুরখাইম’ ছিলেন ডেফ্রুসারের সমর্থক। ‘রোমা রোলা’ ডেফ্রুসের বিচারের প্রহসন নিয়ে একটি নাটক লিখেছিলেন। রোমা রোলা ছিলেন একজন প্রগতীপন্থি লেখক। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের তীব্র সমালোচনা করায় তাকে দেশান্তরি হতে হয়। তবুও তিনি শান্তির আদর্শ ত্যাগ করেননি। বুদ্ধিজীবীরা সব সময় লিখে প্রতিবাদ করেন এমন নয়।
বার্ট্রান্ড রাসেল শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী। তিনি যা কিছু সত্য মনে করতেন তাই প্রকাশ করতেন। সেজন্য বারবার মতাদর্শ পরিবর্তন করতে হয়েছে কিন্তু মার্কসবাদের প্রতি ছিল তার অগাধ শ্রদ্ধা। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া, চীন ভ্রমণ করে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে আপোস করেননি। বরং ফোবিয়ান সোসাইটি ত্যাগ করতে কুন্ঠাবোধ করেননি এবং ধীরে ধীরে মার্কসবাদের প্রতি শ্রদ্ধা শিথিল হয়ে যায়। আপোসহীনতার কারণে বার্ট্রান্ড রাসেলের বহুবার বন্ধু বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এমনি চরম দারিদ্র্যতাকে গ্রহণ করতে হয় তবু আপোস করেননি। সত্তর বছর বয়সে রাসেল আমেরিকায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বক্তৃতা করার জন্য; কিন্তু নীতিবগিশ আমেরিকার জনসাধারণ ‘ম্যারেজ এব মরেলস’ লেখকের বক্তৃতা শুনতে অপারগ। তারা কোর্টের আদেশ এনে তার বক্তৃতার কর্মসূচি স্থগিত করে দেয়। পৃথিবীর দেশে দেশে যুদ্ধের বিরুদ্ধে আপোসহীন লড়ে যান। এজন্য তার নিজ দেশের সরকার তার ওপর রুষ্ঠ হয়। নানাভাবে হয়রানি ও লাঞ্ছিত করেন। ভারত-চীন যুদ্ধের সময় তিনি নেহরুর কাছে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন। তারা তাতে কর্ণপাত করেননি।
প্রথম বিশ^যুদ্ধে তিনি ছিলেন চরম শান্তিকামী। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর শুরু করলেন পারমাণবিক অস্ত্র বন্ধ করার দাবিতে আন্দোলন। পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে রাসেল ছিলেন সভাপতি। পারমানবিক অস্ত্র বন্ধের দাবিতে আন্দোলন সচল রাখতে তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তোলেন। ৮৮ বছর বয়সের যুবক দলেবলে লড়ে গেলেন। ফলাফল শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে রাসেল দম্পতিকে কারাবরণ করতে হয়েছে। ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিলেন তুমুল শক্তিমান ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বুদ্ধিজীবী। সত্যের সান্নিধ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত চিন্তাকে ছুড়ে ফেলতে বিলম্ব করেননি। ‘সভ্যতার সংকট’ লিখে তিনি তীক্ষ্ম ভাষায় ইংরেজদের অন্যায়ের মুখোশ উন্মোচন করেছিলেন। বঙ্গবঙ্গের বিরুদ্ধে তিনি রাজপথে সক্রিয় ছিলেন। জালিয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের পর কলকাতায় এসে রাজনৈতিক নেতাদের সমাবেশের আয়োজন করার অনুরোধ করেছিলেন। ইংরেজ শাসনের প্রতি প্রবল ধিক্কার জানিয়ে তিনি সেখানে বক্তৃতা দিবেন- এ ছিল প্রত্যাশা।
কিন্তু নেতারা রাজি হলেন না। কারণ প্রথম বিশ^যুদ্ধের পর ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া রুলস তখনো বহাল ছিল। জালিয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদের নতুন রাস্তা খুঁজতে গিয়ে নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার এত বড় অপমানের প্রতিশোধ নেন। শান্তি নিকেতনের বরাদ্দ বাতিল করে দেন। কবির ইংরেজ বন্ধুরা রুষ্ঠ হন। কবি তবু পিছু হটেননি। বরং তিনি গান্ধীকে চিঠি লিখেন পাঞ্জাব যাওয়ার জন্য। তখন পাঞ্জাবে ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া রুলসের প্রয়োগ করে অনেক নেতার দীপান্তর হয়েছে, সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীকে অনুরোধ করেন সেখানে দু’জনে গিয়ে প্রতিবাদ জানাবেন। ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া রুলস বাতিলের দাবি তুলবেন। কিন্তু গান্ধী রাজি হননি। রবীন্দ্রনাথ সে যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে লিখেন- এর কোন উপায় নেই? কোন প্রতিকার নেই? কোন উত্তর দিতে পারবো না? কিছুই করতে পারবো না? এটা যদি নীরবে সইতে হয়, তাহলে জীবন ধারণ যে অসম্ভব হয়ে উঠবে। বুদ্ধিজীবিতার ইতিহাস নিরবচ্ছিন্ন লড়াইয়ের ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথও লড়াইয়ের বাহিরে থাকতে পারেনি।
বুদ্ধিজীবিতার দায়
বুদ্ধিজীবিতা ব্যক্তিনিষ্ঠ বটে তবে অসম্ভব রকমের বস্তুনিষ্ঠ। বুদ্ধিজীবীর দায় তার নিজের কাছে। সত্য প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণা বুদ্ধিজীবীকে তাড়িয়ে বেড়ায়। অন্তরকে পুড়িয়ে মারে। নিদ্রা কেড়ে নেয়। জনসাধারণ তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি প্রত্যাশা করে বুদ্ধিজীবীদের কাছে। বুদ্ধিজীবিতার দায় নিয়ে ১৯৮৬ সালে ভাক্লাভ হাভেল যা বলেছেন তা স্মরণ করা যাক- ‘বুদ্ধিজীবীর উচিত ক্রমাগত প্রশ্ন তোলা, পৃথিবীর দুর্দশার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া, স্বাধীন হওয়ার পথে ইন্ধন জোগানো, প্রকাশ্য ও গোপন সব চাপ ও কৌশলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, বিভিন্ন ব্যবস্থা, ক্ষমতা এবং এর সম্মোহন সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করা এবং এসব মিথ্যাচারের সাক্ষী হওয়া।’
বুদ্ধিজীবীদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে ভুলে গেলেন বুদ্ধিজীবীরা। আশির দশক থেকে বুদ্ধিজীবিতার পতন শুরু হয়। রুদ্রকে লিখতে হয়েছে- বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে রাজনীতিবিদের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের চাপ, বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে বুদ্ধিজীবির রক্তস্নায়ুতে সচেতন অপরাধ। অথাৎ বুদ্ধিজীবী তার বুদ্ধি ও বিবেচনা দিয়ে সঠিক কথাটা বলছেন না। তারা কথা বলছেন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের জন্য। হুমায়ূন আজাদ ও আহমদ ছফা দুজনের মতের অনেক পার্থক্য থাকলেও বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধি নিরপেক্ষ সত্য উচ্চারণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন- সে ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলস বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব কী হবে সে সম্পর্কে বলছেন- ‘বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব হলো শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে যুক্ত থেকে তাদের চিন্তা-ভাবনা যথোপযুক্ত ভাবাদর্শানুযায়ী গড়ে তোলা।’ স্বাধীনতার পূর্বে বুদ্ধিজীবীরা এ কাজটা করেছেন।
আজকের বিশে^ স্বৈরাচারী শাসকদের শাসনের অন্যতম হাতিয়ার হলো ইতিহাস। ইতিহাসের একটিমাত্র বয়ান নির্মাণ ও নির্দিষ্ট বিষয় শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকদের জন্য ঠিক করে দেয়। কোন বিষয়ে কথা বলা যাবে কোন বিষয়টা কথা বলা যাবে না- তার নির্দেশনা হাজির করে। ফলে ইতিহাস দুষ্টচক্রের চোরাগলিতে হারিয়ে যেতে থাকে। হারানো জায়গায় প্রতিস্থাপিত হয় নতুন ইতিহাস বা মনগড়া ইতিহাস। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথের সন্ধান দেয়ার চেষ্টা করেন নোয়াম চমস্কি। তিনি বলেন- ‘বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য সরকারের মিথ্যা উদঘাটন করা এবং সরকারের কাজের হেতু ও উদ্দেশ্য, এমনকি কখনো কখনো গুপ্ত অভিপ্রায়ের দিকে লক্ষ্য রেখে এর কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করা। ’ ফলে আজকের এই ঘনঘোর বরিষায় বুদ্ধিজীবী তাদের দায় নিয়ে এগিয়ে আসবেন- সেটাই প্রত্যাশিত।
[লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক]