এসএম জাহাঙ্গীর আলম
গতকালের সংবাদ-এর প্রধান খবর ছিল ‘আট মাসে ধর্ষণের শিকার ৫৭৪ কন্যাশিশু’। খবরে বলা হয়েছে- চলতি বছরের গত আট মাসে সারা দেশে ৫৭৪ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮৪ জন। পাশপাশি একক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৬৪ জন। যাদের মধ্যে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (প্রতিবন্ধী) কন্যাশিশু রয়েছে ৪৩ জন। এছাড়া একই সময়ের মধ্যে ২৩০১ কন্যাশিশুর বাল্যবিয়ে হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে ২৮৮ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে- এরই মধ্যে ৫৮৯টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে।’ এর আগে শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘জানুয়ারি-আগস্ট ২০২২ কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন’ উপস্থাপন অনুষ্ঠানে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম এসব তথ্য জানায়।
দেশে নতুন বা পুরনো যে কোনো ধরনের অস্থিরতাতেই কন্যাশিশু ও নারীর ওপর নির্যাতন কখনো থামে না। বরং তা সব সময় বৃদ্ধিই পায়। এ নির্যাতন শুধু ঘরের বাইরেই নয় নিজ ঘরেও ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়তই ঘটে যাওয়া ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাসমূহ সাধারণ মানুষকে আতঙ্কগ্রস্থ করে তুলেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মানুষের অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ভয়ঙ্কর বর্বরতা ও হিংগ্রতা। লঙ্ঘিত হচ্ছে কন্যাশিশু ও নারীর মানবাধিকার।
একটি সুস্থ সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কন্যাশিশুদের অধিকার, তাদের শিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, মাসিক ও শারীরিক বিকাশ নিশ্চিতকরণসহ নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। কন্যাশিশু ও নারীর প্রতি নির্যাতনের বিষয়ে অভিযোগ জানানোর ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নানা ধরনের ভুল ধারণা, শঙ্কা ও কুসংস্কার এখনো বিদ্যমান। নির্যাতিত কন্যাশিশু বা তার পরিবার নানা বাধা পেরিয়ে বিচার চাইতে গেলেও নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। শিশুর নির্যাতন প্রতিরোধ–সম্পর্কিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০২০ অনুসারে, প্রতিবছর বিশ্বের অর্ধেক শিশু (প্রায় ১০০ কোটি) শারীরিক, যৌন এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার। এর ফলে তারা আহত তো হয়ই, কেউ কেউ প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, কখনো কখনো শিশুদের মৃত্যুও ঘটে।
এ বছরের জুন মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউনেসকো এবং শিশুর নির্যাতন অবসানে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি কর্তৃক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। এতে বাংলাদেশসহ ১৫৫টি দেশে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও সাড়াদানের সাতটি কৌশলসংবলিত ‘ইন্সপায়ার’ এর অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য আছে। এই প্রথম, দেশগুলোর সরকার শিশু নির্যাতন মোকাবিলার জন্য তাদের কাজের বিষয়ে নিজস্ব প্রতিবেদন তৈরি করেছে। কিছু পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা থাকার পরও প্রতিবেদনটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের জন্য শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে দেশগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা দেয় এবং এতে ভবিষ্যতের জন্য বেশ কিছু পরামর্শ আছে।
নির্যাতন শিশু অধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন, যা তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এর মারাত্মক অর্থনৈতিক প্রভাবও রয়েছে। একটি হিসাবে দেখা যায়, শিশু নির্যাতনের ফলে বিশ্বে জিডিপিতে প্রতিবছর এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়। প্রায় সব দেশেই (৮৮ শতাংশ) নির্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য আইন রয়েছে, তবে অর্ধেকের কম দেশগুলোতে (৪৭ শতাংশ) আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে অপরাধীদের খুব কমই বিচারের আওতায় আনা হয়; যার কারণে শিশু নির্যাতন ঘটেই চলেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখিত এক হিসাবে, জরিপের আগের মাসে বাংলাদেশে ১ থেকে ১৪ বছরের শতকরা ৮৯ ভাগ শিশুকে ‘শৃঙ্খলা’ বা কোনো কিছু শেখানোর নামে নির্যাতন করা হয়েছে।
দেশে শিশুদের শাস্তি বেশির ভাগ মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য। এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সচেতনতা খুব কম। সব শিশুই নির্যাতনের ঝুঁকিতে আছে, তবে শিশুশ্রমিক, পথে বসবাসকারী শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, প্রতিষ্ঠানে বসবাসকারী শিশুসহ অনেক শিশু তাদের অবস্থানের কারণে অতিরিক্ত ঝুঁকিতে থাকে। শিশুরা ভয়ংকর নির্মমতার শিকার হলে মিডিয়ায় খবর হয়। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সবাই ভুলে যাই। শুধু ভয়াবহ ঘটনাগুলো আমরা জানতে পারি। প্রতিদিন অসংখ্য শিশু ঘরে এবং বাইরে নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করছে। তাদের খবর কে রাখে?
বাংলাদেশে শিশু, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে যথাযথ সমন্বয়ের অভাব সামগ্রিকভাবে শিশুর নির্যাতন মোকাবিলাকে কঠিন করে তুলেছে। তার সঙ্গে রয়েছে অপর্যাপ্ত পেশাদারি দক্ষতা এবং সীমিত বিনিয়োগ। বিভিন্ন বয়সী শিশুদের চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি আলাদা হয়। শিশু বিকাশের পর্যায়গুলো বুঝে তাদের বয়স উপযোগী ভালোবাসা এবং উষ্ণতা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষের দক্ষতা এবং আন্তরিকতার অভাব আছে। মনোযোগ দিয়ে শিশুদের কথা শোনা, কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হলে তাদের বুঝিয়ে বলা যে গুরুত্বপূর্ণ, সেই বিষয়ে আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই।
আমাদের সমাজে নারী ও শিশুদের ওপর ঘৃণ্য অপরাধের জন্য দন্ডবিধির বিধানসমূহ অপর্যাপ্ত থাকায় সরকার ১৯৯৫ সালে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-১৯৯৫’ প্রণয়ন করেন, যা সর্বশেষ ২০২০ সালে সংশোধিত হয় এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ নামে অভিহিত। তবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা ভিকটিম অনেক সমস্যার মুখোমুখি হন। প্রথম যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তা হচ্ছে, পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পরেও পুলিশ মামলা গ্রহণ করছে না। এখন কী করব? সাধারণত অপরাধের শিকার ব্যক্তির বর্ণিত ঘটনা এমন থাকে যে, অপরাধ যিনি করেছেন (অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি) তিনি স্থানীয়ভাবে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পুলিশ গ্রহণ করছেন না।
ওপরে বর্ণিত বর্ণনা অনুযায়ী কারণ বা অন্য যে কোনো কারণে হোক, কোনো অভিযোগকারী যদি পুলিশের কাছে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করার অনুরোধ করে ব্যর্থ হন, তাহলে এই আইনের ২৭ ধারা অনুযায়ী অভিযোগকারী ব্যক্তি কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে কোনো অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়েছেন এই মর্মে হলফনামা সহকারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের কাছে অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীন অপরাধ বিচারের জন্য প্রত্যেক জেলা সদরে একটি করে ট্রাইব্যুনাল থাকে (প্রয়োজন অনুসারে একাধিক ট্রাইব্যুনালও থাকতে পারে)। এইরূপ ট্রাইব্যুনাল ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল’ নামে অভিহিত বা পরিচিত। সে যাই হোক, আইন কাগজপত্রে থাকলেই হবে না, এর যথাযথ বাস্তবায়নের দরকার। মূলকথা হলো- শিশু নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।
[লেখক : সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.]
এসএম জাহাঙ্গীর আলম
শনিবার, ০১ অক্টোবর ২০২২
গতকালের সংবাদ-এর প্রধান খবর ছিল ‘আট মাসে ধর্ষণের শিকার ৫৭৪ কন্যাশিশু’। খবরে বলা হয়েছে- চলতি বছরের গত আট মাসে সারা দেশে ৫৭৪ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮৪ জন। পাশপাশি একক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৬৪ জন। যাদের মধ্যে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (প্রতিবন্ধী) কন্যাশিশু রয়েছে ৪৩ জন। এছাড়া একই সময়ের মধ্যে ২৩০১ কন্যাশিশুর বাল্যবিয়ে হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে ২৮৮ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে- এরই মধ্যে ৫৮৯টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে।’ এর আগে শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘জানুয়ারি-আগস্ট ২০২২ কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন’ উপস্থাপন অনুষ্ঠানে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম এসব তথ্য জানায়।
দেশে নতুন বা পুরনো যে কোনো ধরনের অস্থিরতাতেই কন্যাশিশু ও নারীর ওপর নির্যাতন কখনো থামে না। বরং তা সব সময় বৃদ্ধিই পায়। এ নির্যাতন শুধু ঘরের বাইরেই নয় নিজ ঘরেও ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়তই ঘটে যাওয়া ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাসমূহ সাধারণ মানুষকে আতঙ্কগ্রস্থ করে তুলেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মানুষের অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ভয়ঙ্কর বর্বরতা ও হিংগ্রতা। লঙ্ঘিত হচ্ছে কন্যাশিশু ও নারীর মানবাধিকার।
একটি সুস্থ সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কন্যাশিশুদের অধিকার, তাদের শিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, মাসিক ও শারীরিক বিকাশ নিশ্চিতকরণসহ নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। কন্যাশিশু ও নারীর প্রতি নির্যাতনের বিষয়ে অভিযোগ জানানোর ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নানা ধরনের ভুল ধারণা, শঙ্কা ও কুসংস্কার এখনো বিদ্যমান। নির্যাতিত কন্যাশিশু বা তার পরিবার নানা বাধা পেরিয়ে বিচার চাইতে গেলেও নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। শিশুর নির্যাতন প্রতিরোধ–সম্পর্কিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০২০ অনুসারে, প্রতিবছর বিশ্বের অর্ধেক শিশু (প্রায় ১০০ কোটি) শারীরিক, যৌন এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার। এর ফলে তারা আহত তো হয়ই, কেউ কেউ প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, কখনো কখনো শিশুদের মৃত্যুও ঘটে।
এ বছরের জুন মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউনেসকো এবং শিশুর নির্যাতন অবসানে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি কর্তৃক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। এতে বাংলাদেশসহ ১৫৫টি দেশে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও সাড়াদানের সাতটি কৌশলসংবলিত ‘ইন্সপায়ার’ এর অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য আছে। এই প্রথম, দেশগুলোর সরকার শিশু নির্যাতন মোকাবিলার জন্য তাদের কাজের বিষয়ে নিজস্ব প্রতিবেদন তৈরি করেছে। কিছু পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা থাকার পরও প্রতিবেদনটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের জন্য শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে দেশগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা দেয় এবং এতে ভবিষ্যতের জন্য বেশ কিছু পরামর্শ আছে।
নির্যাতন শিশু অধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন, যা তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এর মারাত্মক অর্থনৈতিক প্রভাবও রয়েছে। একটি হিসাবে দেখা যায়, শিশু নির্যাতনের ফলে বিশ্বে জিডিপিতে প্রতিবছর এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়। প্রায় সব দেশেই (৮৮ শতাংশ) নির্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য আইন রয়েছে, তবে অর্ধেকের কম দেশগুলোতে (৪৭ শতাংশ) আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে অপরাধীদের খুব কমই বিচারের আওতায় আনা হয়; যার কারণে শিশু নির্যাতন ঘটেই চলেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখিত এক হিসাবে, জরিপের আগের মাসে বাংলাদেশে ১ থেকে ১৪ বছরের শতকরা ৮৯ ভাগ শিশুকে ‘শৃঙ্খলা’ বা কোনো কিছু শেখানোর নামে নির্যাতন করা হয়েছে।
দেশে শিশুদের শাস্তি বেশির ভাগ মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য। এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সচেতনতা খুব কম। সব শিশুই নির্যাতনের ঝুঁকিতে আছে, তবে শিশুশ্রমিক, পথে বসবাসকারী শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, প্রতিষ্ঠানে বসবাসকারী শিশুসহ অনেক শিশু তাদের অবস্থানের কারণে অতিরিক্ত ঝুঁকিতে থাকে। শিশুরা ভয়ংকর নির্মমতার শিকার হলে মিডিয়ায় খবর হয়। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সবাই ভুলে যাই। শুধু ভয়াবহ ঘটনাগুলো আমরা জানতে পারি। প্রতিদিন অসংখ্য শিশু ঘরে এবং বাইরে নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করছে। তাদের খবর কে রাখে?
বাংলাদেশে শিশু, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে যথাযথ সমন্বয়ের অভাব সামগ্রিকভাবে শিশুর নির্যাতন মোকাবিলাকে কঠিন করে তুলেছে। তার সঙ্গে রয়েছে অপর্যাপ্ত পেশাদারি দক্ষতা এবং সীমিত বিনিয়োগ। বিভিন্ন বয়সী শিশুদের চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি আলাদা হয়। শিশু বিকাশের পর্যায়গুলো বুঝে তাদের বয়স উপযোগী ভালোবাসা এবং উষ্ণতা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষের দক্ষতা এবং আন্তরিকতার অভাব আছে। মনোযোগ দিয়ে শিশুদের কথা শোনা, কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হলে তাদের বুঝিয়ে বলা যে গুরুত্বপূর্ণ, সেই বিষয়ে আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই।
আমাদের সমাজে নারী ও শিশুদের ওপর ঘৃণ্য অপরাধের জন্য দন্ডবিধির বিধানসমূহ অপর্যাপ্ত থাকায় সরকার ১৯৯৫ সালে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-১৯৯৫’ প্রণয়ন করেন, যা সর্বশেষ ২০২০ সালে সংশোধিত হয় এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ নামে অভিহিত। তবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা ভিকটিম অনেক সমস্যার মুখোমুখি হন। প্রথম যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তা হচ্ছে, পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পরেও পুলিশ মামলা গ্রহণ করছে না। এখন কী করব? সাধারণত অপরাধের শিকার ব্যক্তির বর্ণিত ঘটনা এমন থাকে যে, অপরাধ যিনি করেছেন (অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি) তিনি স্থানীয়ভাবে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পুলিশ গ্রহণ করছেন না।
ওপরে বর্ণিত বর্ণনা অনুযায়ী কারণ বা অন্য যে কোনো কারণে হোক, কোনো অভিযোগকারী যদি পুলিশের কাছে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করার অনুরোধ করে ব্যর্থ হন, তাহলে এই আইনের ২৭ ধারা অনুযায়ী অভিযোগকারী ব্যক্তি কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে কোনো অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়েছেন এই মর্মে হলফনামা সহকারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের কাছে অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীন অপরাধ বিচারের জন্য প্রত্যেক জেলা সদরে একটি করে ট্রাইব্যুনাল থাকে (প্রয়োজন অনুসারে একাধিক ট্রাইব্যুনালও থাকতে পারে)। এইরূপ ট্রাইব্যুনাল ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল’ নামে অভিহিত বা পরিচিত। সে যাই হোক, আইন কাগজপত্রে থাকলেই হবে না, এর যথাযথ বাস্তবায়নের দরকার। মূলকথা হলো- শিশু নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।
[লেখক : সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.]