চিরঞ্জীব চ্যাটার্জী
সব প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে প্রথমবারের মতো সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের মেয়েদের আসরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করল ‘বাংলাদেশ’। এ বিজয় শুধু ফুটবলের নয়; এ বিজয় লিঙ্গ বৈষম্য, সামাজিক কুসংস্কার ও কূপমন্ডুকতার বিপরীতে দেশকে এগিয়ে নেয়ার মহত্তম বিজয়।
এর আগে সর্বশেষ ২০০৩ সালে বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল দ্বিতীয়বারের মতো সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। প্রথমবার তারা এ গৌরব অর্জন করে ১৯৯৯ সালে। অর্থাৎ দেশের হয়ে ১৯ বছর পর বাংলার মেয়েরাই আমাদের হারানো সেই ফুটবলের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আবারও পুনরুদ্ধার করল।
শুধু তা-ই নয়, এ অর্জন এমন একটি সময়ে অর্জিত হলো, যখন দেশের অন্যান্য ক্রিড়া অঙ্গনে ধারাবাহিক হতাশার সুর বইছে। সাম্প্রতি দেশের সম্ভাবনাময় ক্রিকেট অঙ্গনেও ব্যার্থতার পাল্লা অনেকটাই ভারী। কাবাডি, হকিতেও সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্জাতিক মানের তেমন কোন অর্জন নেই আমাদের।
এদিকে, কোভিড-১৯ মহামারী পরবর্তী তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সঙ্গত করণেই, বাংলাদেশর অবস্থাও তার বাইরে নয়। আর, আমাদের মেয়েরা সেই কঠিন সময়কেই জয় করেছে যেন ফুটবলের মধ্য দিয়ে। তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, স্বদেশপ্রেম ও আত্মবিশ্বাসের জোর কতটা শক্তিশালী। তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীকে আটকে রাখার অপকৌশল পুরুষকে কোনভাবেই সম্মানিত করে না। বরং, একটি দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে নারী ও পুরুষের সুযোগের সমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং তারা এটাও প্রমাণ করেছেন, দেশ ও জাতির মহত্তম কল্যাণে তারা সামাজিক কুসংস্কার ও কূপম-ুকতার বিপরীতে সত্যি অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন।
এখানেই শেষ নয়, এই অর্জনের অন্তরালে অবিশ্বাস্য একটি নাম বেরিয়ে এসেছে।
কী সেই নাম?
সেই নামটি হচ্ছে, ‘কলসিন্দুর’। হ্যাঁ, আজ সমগ্র বাংলাদেশ সাফ ফুটবলে (মেয়েদের) চ্যাম্পিয়ন হয়ে যে গৌরব বোধ করছে, এই কৃতিত্বের প্রায় অর্ধেক দাবিদারই একক এই গ্রামটি। ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলার এই গ্রাম থেকেই উঠে আসা আটজন মেয়ে ফুটবলারকে নিয়ে ‘বাংলাদেশ’ সাফ ফুটবলে অপরাজিত হয়ে হিমলয় জয় করেছে! আর মেয়েদের এই ফুটবলে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছেন যে দুজন শিক্ষক তারা হচ্ছেন, যথাক্রমে কলসিন্ধুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক মালা রানী সরকার ও কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. মফিজ উদ্দিন। মজিদ উদ্দিন স্যার অবশ্য এই ফুটবল কন্যাদের স্থানীয় ভাবে কোচিংয়ের দায়িত্বেও নিয়োজিত ছিলেন অনেক দিন।
উল্লেখ্য যে, ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে পরপর তিনবার কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ‘বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ড কাপে’র স্কুল ফুটবলে দেশ সেরা হয়। পরবর্তী সময়ে এর সুবাদেই এ দল থেকে তারা ১২ জন জাতীয় মহিলা ফুটবল দলে নিজেদের অবস্থান পাকা করেন।
এ ছাড়া, ৫ পাহাড়ি কন্যার ফুটবল দ্যুতিসহ অনান্য ফুটবল কন্যারাও স্ব-স্ব অবস্থানে নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়েই চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন নেপালের কাঠমুন্ডুর বিখ্যাত ‘দশরথ’ স্টেডিয়াম থেকে । কিন্তু এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে অনেক নির্মম সত্যও বেরিয়ে এসেছে। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে তর তর করে এগিয়ে চলেছে (করোনা পূর্ববর্তী)- যখন পদ্মা, মহাকাশ বিজয়ের গৌরবগাথা সম্ভব হয়েছে, সেই সম্ভাবনাময় বাস্তবতায় দাঁড়িয়েও এই মেয়ে ফুটবলাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তাদের অধিকাংশের পরিবারের যে হতদরিদ্র অবস্থা এখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে, তা একটি দেশ ও জাতির জন্য সত্যি বড়ই লজ্জার!
এখানেই শেষ নয়, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে কলসিন্দুরের এই ফুটবল কন্যারা তাদের সতীর্থ এক ‘ফুটবলকন্যা’ সাবিনা ইয়াসমিনকে হারিয়ে মানসিকভাবে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। ফুটবলের মাঠে প্রতিপক্ষকে তোয়াক্কা না করলেও উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে কলসিন্দুরের সেই ফুটবলকন্যা সাবিনা ইয়াসমিন সেদিন সামান্য জ্বরকেই বিজয়ী ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন! ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়িয়া বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ আমরা কেউ কি মনে রেখেছি তারে, তার পরিবারকে? জানি না।
অবশ্য পরবর্তী সময়ে কলসিন্দুরের এই ফুটবলকন্যারা সতীর্থকে হারানোর সেই শোককে শক্তিতে রূপান্তর করেই, আবারও ফুটবলের সেই ছন্দময়তায় মেতে ওঠেন।
আবুধাবিতে আমাদের ক্রিকেটকন্যারাও না-কি টানা তৃতীয় বারে আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ (নারী) বাছাইয়ে লাল-সবুজের চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করেছে! ‘সত্যি ওরা পারছে...’
শুধু ফুটবল-ক্রিকেট নয়, সঙ্গে লিঙ্গবৈষম্য, সামাজিক কুসংস্কার ও কুপমুন্ডকতার বিপরীতে ওদের এ ধারাবাহিক বিজয়-এ যেন এক বিমুগ্ধ বিস্ময়! ওরা পেরেছে-, সত্যি আমরা এখন পারছি-পারছে ‘বাংলাদেশ’।
[লেখক : প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা, ফুলতলা মোজাম মহলদার কলেজ, খুলনা]
চিরঞ্জীব চ্যাটার্জী
শনিবার, ০১ অক্টোবর ২০২২
সব প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে প্রথমবারের মতো সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের মেয়েদের আসরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করল ‘বাংলাদেশ’। এ বিজয় শুধু ফুটবলের নয়; এ বিজয় লিঙ্গ বৈষম্য, সামাজিক কুসংস্কার ও কূপমন্ডুকতার বিপরীতে দেশকে এগিয়ে নেয়ার মহত্তম বিজয়।
এর আগে সর্বশেষ ২০০৩ সালে বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল দ্বিতীয়বারের মতো সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। প্রথমবার তারা এ গৌরব অর্জন করে ১৯৯৯ সালে। অর্থাৎ দেশের হয়ে ১৯ বছর পর বাংলার মেয়েরাই আমাদের হারানো সেই ফুটবলের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আবারও পুনরুদ্ধার করল।
শুধু তা-ই নয়, এ অর্জন এমন একটি সময়ে অর্জিত হলো, যখন দেশের অন্যান্য ক্রিড়া অঙ্গনে ধারাবাহিক হতাশার সুর বইছে। সাম্প্রতি দেশের সম্ভাবনাময় ক্রিকেট অঙ্গনেও ব্যার্থতার পাল্লা অনেকটাই ভারী। কাবাডি, হকিতেও সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্জাতিক মানের তেমন কোন অর্জন নেই আমাদের।
এদিকে, কোভিড-১৯ মহামারী পরবর্তী তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সঙ্গত করণেই, বাংলাদেশর অবস্থাও তার বাইরে নয়। আর, আমাদের মেয়েরা সেই কঠিন সময়কেই জয় করেছে যেন ফুটবলের মধ্য দিয়ে। তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, স্বদেশপ্রেম ও আত্মবিশ্বাসের জোর কতটা শক্তিশালী। তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীকে আটকে রাখার অপকৌশল পুরুষকে কোনভাবেই সম্মানিত করে না। বরং, একটি দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে নারী ও পুরুষের সুযোগের সমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং তারা এটাও প্রমাণ করেছেন, দেশ ও জাতির মহত্তম কল্যাণে তারা সামাজিক কুসংস্কার ও কূপম-ুকতার বিপরীতে সত্যি অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন।
এখানেই শেষ নয়, এই অর্জনের অন্তরালে অবিশ্বাস্য একটি নাম বেরিয়ে এসেছে।
কী সেই নাম?
সেই নামটি হচ্ছে, ‘কলসিন্দুর’। হ্যাঁ, আজ সমগ্র বাংলাদেশ সাফ ফুটবলে (মেয়েদের) চ্যাম্পিয়ন হয়ে যে গৌরব বোধ করছে, এই কৃতিত্বের প্রায় অর্ধেক দাবিদারই একক এই গ্রামটি। ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলার এই গ্রাম থেকেই উঠে আসা আটজন মেয়ে ফুটবলারকে নিয়ে ‘বাংলাদেশ’ সাফ ফুটবলে অপরাজিত হয়ে হিমলয় জয় করেছে! আর মেয়েদের এই ফুটবলে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছেন যে দুজন শিক্ষক তারা হচ্ছেন, যথাক্রমে কলসিন্ধুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক মালা রানী সরকার ও কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. মফিজ উদ্দিন। মজিদ উদ্দিন স্যার অবশ্য এই ফুটবল কন্যাদের স্থানীয় ভাবে কোচিংয়ের দায়িত্বেও নিয়োজিত ছিলেন অনেক দিন।
উল্লেখ্য যে, ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে পরপর তিনবার কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ‘বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ড কাপে’র স্কুল ফুটবলে দেশ সেরা হয়। পরবর্তী সময়ে এর সুবাদেই এ দল থেকে তারা ১২ জন জাতীয় মহিলা ফুটবল দলে নিজেদের অবস্থান পাকা করেন।
এ ছাড়া, ৫ পাহাড়ি কন্যার ফুটবল দ্যুতিসহ অনান্য ফুটবল কন্যারাও স্ব-স্ব অবস্থানে নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়েই চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন নেপালের কাঠমুন্ডুর বিখ্যাত ‘দশরথ’ স্টেডিয়াম থেকে । কিন্তু এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে অনেক নির্মম সত্যও বেরিয়ে এসেছে। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে তর তর করে এগিয়ে চলেছে (করোনা পূর্ববর্তী)- যখন পদ্মা, মহাকাশ বিজয়ের গৌরবগাথা সম্ভব হয়েছে, সেই সম্ভাবনাময় বাস্তবতায় দাঁড়িয়েও এই মেয়ে ফুটবলাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তাদের অধিকাংশের পরিবারের যে হতদরিদ্র অবস্থা এখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে, তা একটি দেশ ও জাতির জন্য সত্যি বড়ই লজ্জার!
এখানেই শেষ নয়, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে কলসিন্দুরের এই ফুটবল কন্যারা তাদের সতীর্থ এক ‘ফুটবলকন্যা’ সাবিনা ইয়াসমিনকে হারিয়ে মানসিকভাবে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। ফুটবলের মাঠে প্রতিপক্ষকে তোয়াক্কা না করলেও উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে কলসিন্দুরের সেই ফুটবলকন্যা সাবিনা ইয়াসমিন সেদিন সামান্য জ্বরকেই বিজয়ী ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন! ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়িয়া বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ আমরা কেউ কি মনে রেখেছি তারে, তার পরিবারকে? জানি না।
অবশ্য পরবর্তী সময়ে কলসিন্দুরের এই ফুটবলকন্যারা সতীর্থকে হারানোর সেই শোককে শক্তিতে রূপান্তর করেই, আবারও ফুটবলের সেই ছন্দময়তায় মেতে ওঠেন।
আবুধাবিতে আমাদের ক্রিকেটকন্যারাও না-কি টানা তৃতীয় বারে আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ (নারী) বাছাইয়ে লাল-সবুজের চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করেছে! ‘সত্যি ওরা পারছে...’
শুধু ফুটবল-ক্রিকেট নয়, সঙ্গে লিঙ্গবৈষম্য, সামাজিক কুসংস্কার ও কুপমুন্ডকতার বিপরীতে ওদের এ ধারাবাহিক বিজয়-এ যেন এক বিমুগ্ধ বিস্ময়! ওরা পেরেছে-, সত্যি আমরা এখন পারছি-পারছে ‘বাংলাদেশ’।
[লেখক : প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা, ফুলতলা মোজাম মহলদার কলেজ, খুলনা]