ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
১৯৭৮ সাল থেকে মায়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনা শুরু হয়। ২০১৭ সালে গণহত্যা সংঘটিত করে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গাকে মায়ানমার থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং তারা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে বাংলাদেশে আগে থেকে অবস্থান করা শরণার্থীর সঙ্গে এ বিপুলসংখ্যক যোগ হয়ে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। সে সময় মায়ানমারের আধা সামরিক আধা বেসামরিক সরকারের সৃষ্ট এই রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং নির্যাতন ভয়াবহ পরিস্থতির সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে এ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিলেও শরণার্থী সমস্যা নিরসনে মায়ানমার সরকারের ভূমিকা সব সময়ই নেতিবাচক ছিল।
বাংলাদেশের সীমান্তে এখন মায়ানমারের সামরিক বাহিনী আরসার সঙ্গে যে তুমুল সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, তার বড় ধরনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়ছে। তারা বারবার বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সীমানা লঙ্ঘন করেছে। এ পর্যন্ত তাদের রাষ্ট্রদূতকে জবাবদিহির জন্য চারবার তলব করা হয়েছে। কিন্তু এখানে মূল বিষয়টি হলো, মায়ানমারের সামরিক শাসক দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক সংকটের পাশাপাশি সামরিক সংকট সৃষ্টি করেছে। তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটাচ্ছে, গণহত্যার মতো যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করতেও পিছপা হচ্ছে না। তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। সম্প্রতি তারা একটি স্কুলে আক্রমণ চালিয়ে ১১ জন শিশুকে হত্যা করেছে। ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে তারা হত্যা করেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতৃত্ব এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা প্রকাশ করলেও সামরিক জান্তার উন্মত্ততা হ্রাস না পেয়ে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মায়ানমার তার সীমান্তে যে তীব্র সংঘাত সৃষ্টি করে চলেছে এবং রোহিঙ্গা সংকটকে জিইয়ে রাখার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তা এই গোটা অঞ্চলকে একটি বড় হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তারা এ অঞ্চলের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্য বৃহৎ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। মায়ানমারের সীমান্তে সংঘাত সৃষ্টি করে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টির অপতৎপরতার বিপরীতে বাংলাদেশ এখনো শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি মায়ানমারের সামরিক উসকানিকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে মোকাবিলা না করতাম, তা হলে এ অঞ্চলে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হতো। মায়ানমারের সামরিক জান্তারা তাদের শাসনপ্রক্রিয়াকে বৈধতা লাভ করানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশকে উসকানি দিয়ে সংঘাত সৃষ্টি করতে চাইছে। মায়ানমারের যে নিন্দিত, বেপরোয়া ও উসকানিমূলক আচরণ সীমান্তে দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাস্তবতাও জড়িত। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর মায়ানমার জান্ত দেশের ভেতরেই রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বেশ চাপে রয়েছে, যার সর্বশেষ সংস্করণ আরাকান আর্মির সঙ্গে তাদের তুমুল সংঘাত।
সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, জান্ত সরকার ১৭ শতাংশ ভূমিতে তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। এনইউজি তথা মায়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ ৫২ শতাংশ অঞ্চলে। বাকি অংশের আধিপত্য নিয়ে চলছে সংঘাত। রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধ তারই অংশ। এসব যুদ্ধে জান্তা সরকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এর জের ধরে এক ধরনের নাজুক রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে মায়ানমারের জান্তা সরকারকে। তবে মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি যা-ই থাকুক; সীমান্ত লঙ্ঘন হওয়া অথবা সীমান্তের ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই মায়ানমার জান্তা বাহিনীর।
চোরাচালান, অনুপ্রবেশ ইত্যাদি কারণে সীমান্ত পরিস্থিতি হয়তো কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে। কিন্তু মায়ানমারের ক্ষেত্রে তা যেভাবে নিয়মিতভাবে ঘটছে, সেটাই প্রমাণ করছে, দেশটির সামরিক বাহিনী কতটা বেপরোয়া। যদিও তারা ভেতরে-বাইরে উভয় দিক থেকেই চাপের মধ্যে রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব মায়ানমারের সামরিক নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে; রোহিঙ্গা গণহত্যার কারণে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে শুরু করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপে রয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মায়ানমারে যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা এখনো চলমান। বিভিন্ন নৃতাত্তিক গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত সংঘাত ছাড়াও সামরিক শাসনের বাইরে মায়ানমারের যে ঐক্য সরকার গঠিত হয়েছে, সে ঐক্য সরকারও দেশের মানুষ এবং বাইরের সমর্থন নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলছে এবং সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। এত চাপের মধ্যেও মায়ানমার সামরিক বাহিনীর বেপরোয়া মনোভাবের পেছনে চীন ও রাশিয়ার সমর্থন অত্যন্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাইওয়ান সংকট এবং ইউক্রেন যুদ্ধকে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
২০১৭ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে অনেকবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মায়ানমারের হেলিকপ্টার। বাংলাদেশকে অসম্মান জানানোর সে ঘটনাও নোট করা হয়েছে। ওই সময় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তারপরও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বলে দেয় যে, মায়ানমার অব্যাহতভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখারও পরিপন্থি। এসব ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
একটি স্থিতিশীল এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশী সব সময়ই পছন্দ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে তা যে কোনো দেশের জন্য প্রয়োজন। অস্থিতিশীল রাখাইন রোহিঙ্গাদের নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে হুমকি। অস্থিতিশীল সীমান্ত সেখানে বসবাসকারীদের জন্য হুমকি। তাই মায়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানানো, মর্টারশেলের বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া এবং এমন ঘটনা আর কখনো ঘটবে না- এমনটা দাবি করা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তা করা উচিত উভয় দেশ এবং এ অঞ্চলের স্বার্থের জন্য। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ মায়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে মর্টারশেলের ঘটনায় কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। একই সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সাম্প্রতিক ও আগের সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ফোরামগুলোতে তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে যেসব মানুষ বসবাস করেন, তারা যাতে নিরাপদ বোধ করেন, সেজন্য ওই সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে সরকার।
মায়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ। প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটাই কূটনীতির অংশ হওয়া উচিত। এমনিতেই আমরা ১১ লাখের বেশি মায়ানমারের অধিবাসী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি, যা আমাদের অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে। মায়ানমার তাদের নাগরিকদের ফেরত তো নিচ্ছেই না, উলটো বাংলাদেশ সীমান্তে তাদের নিক্ষেপ করা মর্টার শেল ও গোলা এসে পড়ছে। মায়ানমারের এ তৎপরতা অব্যাহত থাকলে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক জটিল আকার ধারণ করবে। তাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত কূটনৈতিক পন্থায় এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা। সেটি যেমন মায়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে হতে পারে, তেমনি জাতিসংঘের কাছে সহায়তা চাওয়ার মাধ্যমেও হতে পারে। এছাড়া মধ্যস্থতার জন্য বৃহৎ শক্তিগুলোর কাছে সহায়তাও চাইতে পারি আমরা। এ ব্যাপারে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা প্রয়োজন। আমরা আশা করব, তাদের নিক্ষেপ করা মর্টার শেল বা গোলা যাতে বাংলাদেশ সীমান্তে এসে না পড়ে, সে বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি রাখবে এবং ভবিষ্যতে মায়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করবে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মর্টার শেল নিক্ষেপের বিষয়ে মায়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে মায়ানমারের এসব কর্মকা- যে বন্ধুত্বের নিদর্শন নয়- সেটি দেশটির রাষ্টদূতকে ডেকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ, মায়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে চলমান স্থলযুদ্ধ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সীমান্তে টহল বাড়ানোর পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বৃদ্ধি করেছে। বিজিবি মায়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতের ওপরে নজর রাখছে ও অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ সব সময় শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানে বিশ্বাসী। মায়ানমারের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশ কখনো হস্তক্ষেপ করেনি। এরপর ও বাংলাদেশ গত পাঁচ বছর ধরে মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আসছে। এ ধরনের উস্কানিমূলক ঘটনা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি নষ্ট করে যা কারো কাম্য নয়। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ধীরে ধীরে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে উঠছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মায়ানমারে যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা এখনো চলমান। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত সংঘাত ছাড়াও সামরিক শাসনের বাইরে মায়ানমারের যে ঐক্য সরকার গঠিত হয়েছে, সে ঐক্য সরকারও দেশের মানুষ এবং বাইরের সমর্থন নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলছে এবং সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে
মায়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিক দেশগুলোকে আরও আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাতে হবে। আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে আসিয়ান, চীন, রাশিয়া ও জাতিসংঘকে মায়ানমারে আভ্যন্তরীণ সংঘাত বন্ধে এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবী। মায়ানমারের আভ্যন্তরীণ সংঘাত যেন আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দেখা না দেয় সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মায়ানমার আমাদের উসকানি দিতে চায়, বাংলাদেশ এর জবাবে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে সহিষ্ণুতা প্রদর্শন ও সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সামরিক বাহিনীর বাড়াবাড়ির কারণে শুধু মায়ানমারের অভ্যন্তরেই নয় বরং গোটা অঞ্চলের শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত দ্রুত মায়ানমারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ নিষেধাজ্ঞা জারী করা।
যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার মতো দেশগুলো আগে থেকেই মায়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সরব রয়েছে এবং বেশকিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে, তবে সেগুলো যথেষ্ট নয়। কিন্তু এসব রাষ্ট্রের মায়ানমারের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে অবস্থান এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে বলে মনে করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে আসিয়ান অধিভুক্ত দেশগুলো এখন যেমন মায়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে, তেমনি চীন এবং ভারতকে এ রকম ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। আমরা জানি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মায়ানমারকে এই দুটি রাষ্ট্র সমর্থন প্রদান করেছিল। এখনো যদি তারা সমর্থন অব্যাহত রাখে, তা হলে এ অঞ্চলকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এমনকি এই দুটি দেশের যে বিশাল বিনিয়োগ মায়ানমারে রয়েছে, যে কানেক্টিভিটির পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেটাও ব্যাহত হতে পারে। বাংলাদেশ তাই বহু আগেই বলে আসছে, মায়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত শুধু দুটি দেশের বিষয় নয়, এটি একটি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক বিষয়। ফলে এখনই দরকার জাতিসংঘে মায়ানমারের সামরিক জান্তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আঞ্চলিক শান্তি বিনষ্ট করার অপতৎপরতা বন্ধ করার ব্যাপারে আলোচনা করা এবং তাদের বিরুদ্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করা। তা না হলে এখানকার আঞ্চলিক শান্তি বিপন্নতার হুমকিতে পড়তে বাধ্য হবে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশকে বহুমাত্রিক কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাতে হবে। অন্যথায় এতে শুধু বাংলাদেশেরই নয়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এমনকি পূর্ব এশিয়ার দেশে ও তার বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। অর্থাৎ আঞ্চলিক শান্তি ও সৌহার্দ্য বিনষ্ট হবে। এক্ষেত্রে বৃহৎ দেশ যেমন চীন, ভারত ও জাপানকে আন্তরিক হতে হবে। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও মায়ানমার এর বিরুদ্ধে এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা জোরদার করে চাপ প্রয়োগ করতে পারে।
[লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক,
বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]
ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
রোববার, ০২ অক্টোবর ২০২২
১৯৭৮ সাল থেকে মায়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনা শুরু হয়। ২০১৭ সালে গণহত্যা সংঘটিত করে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গাকে মায়ানমার থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং তারা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে বাংলাদেশে আগে থেকে অবস্থান করা শরণার্থীর সঙ্গে এ বিপুলসংখ্যক যোগ হয়ে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। সে সময় মায়ানমারের আধা সামরিক আধা বেসামরিক সরকারের সৃষ্ট এই রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং নির্যাতন ভয়াবহ পরিস্থতির সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে এ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিলেও শরণার্থী সমস্যা নিরসনে মায়ানমার সরকারের ভূমিকা সব সময়ই নেতিবাচক ছিল।
বাংলাদেশের সীমান্তে এখন মায়ানমারের সামরিক বাহিনী আরসার সঙ্গে যে তুমুল সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, তার বড় ধরনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়ছে। তারা বারবার বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সীমানা লঙ্ঘন করেছে। এ পর্যন্ত তাদের রাষ্ট্রদূতকে জবাবদিহির জন্য চারবার তলব করা হয়েছে। কিন্তু এখানে মূল বিষয়টি হলো, মায়ানমারের সামরিক শাসক দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক সংকটের পাশাপাশি সামরিক সংকট সৃষ্টি করেছে। তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটাচ্ছে, গণহত্যার মতো যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করতেও পিছপা হচ্ছে না। তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। সম্প্রতি তারা একটি স্কুলে আক্রমণ চালিয়ে ১১ জন শিশুকে হত্যা করেছে। ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে তারা হত্যা করেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতৃত্ব এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা প্রকাশ করলেও সামরিক জান্তার উন্মত্ততা হ্রাস না পেয়ে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মায়ানমার তার সীমান্তে যে তীব্র সংঘাত সৃষ্টি করে চলেছে এবং রোহিঙ্গা সংকটকে জিইয়ে রাখার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তা এই গোটা অঞ্চলকে একটি বড় হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তারা এ অঞ্চলের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্য বৃহৎ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। মায়ানমারের সীমান্তে সংঘাত সৃষ্টি করে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টির অপতৎপরতার বিপরীতে বাংলাদেশ এখনো শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি মায়ানমারের সামরিক উসকানিকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে মোকাবিলা না করতাম, তা হলে এ অঞ্চলে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হতো। মায়ানমারের সামরিক জান্তারা তাদের শাসনপ্রক্রিয়াকে বৈধতা লাভ করানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশকে উসকানি দিয়ে সংঘাত সৃষ্টি করতে চাইছে। মায়ানমারের যে নিন্দিত, বেপরোয়া ও উসকানিমূলক আচরণ সীমান্তে দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাস্তবতাও জড়িত। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর মায়ানমার জান্ত দেশের ভেতরেই রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বেশ চাপে রয়েছে, যার সর্বশেষ সংস্করণ আরাকান আর্মির সঙ্গে তাদের তুমুল সংঘাত।
সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, জান্ত সরকার ১৭ শতাংশ ভূমিতে তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। এনইউজি তথা মায়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ ৫২ শতাংশ অঞ্চলে। বাকি অংশের আধিপত্য নিয়ে চলছে সংঘাত। রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধ তারই অংশ। এসব যুদ্ধে জান্তা সরকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এর জের ধরে এক ধরনের নাজুক রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে মায়ানমারের জান্তা সরকারকে। তবে মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি যা-ই থাকুক; সীমান্ত লঙ্ঘন হওয়া অথবা সীমান্তের ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই মায়ানমার জান্তা বাহিনীর।
চোরাচালান, অনুপ্রবেশ ইত্যাদি কারণে সীমান্ত পরিস্থিতি হয়তো কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে। কিন্তু মায়ানমারের ক্ষেত্রে তা যেভাবে নিয়মিতভাবে ঘটছে, সেটাই প্রমাণ করছে, দেশটির সামরিক বাহিনী কতটা বেপরোয়া। যদিও তারা ভেতরে-বাইরে উভয় দিক থেকেই চাপের মধ্যে রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব মায়ানমারের সামরিক নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে; রোহিঙ্গা গণহত্যার কারণে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে শুরু করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপে রয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মায়ানমারে যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা এখনো চলমান। বিভিন্ন নৃতাত্তিক গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত সংঘাত ছাড়াও সামরিক শাসনের বাইরে মায়ানমারের যে ঐক্য সরকার গঠিত হয়েছে, সে ঐক্য সরকারও দেশের মানুষ এবং বাইরের সমর্থন নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলছে এবং সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। এত চাপের মধ্যেও মায়ানমার সামরিক বাহিনীর বেপরোয়া মনোভাবের পেছনে চীন ও রাশিয়ার সমর্থন অত্যন্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাইওয়ান সংকট এবং ইউক্রেন যুদ্ধকে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
২০১৭ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে অনেকবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মায়ানমারের হেলিকপ্টার। বাংলাদেশকে অসম্মান জানানোর সে ঘটনাও নোট করা হয়েছে। ওই সময় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তারপরও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বলে দেয় যে, মায়ানমার অব্যাহতভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখারও পরিপন্থি। এসব ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
একটি স্থিতিশীল এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশী সব সময়ই পছন্দ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে তা যে কোনো দেশের জন্য প্রয়োজন। অস্থিতিশীল রাখাইন রোহিঙ্গাদের নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে হুমকি। অস্থিতিশীল সীমান্ত সেখানে বসবাসকারীদের জন্য হুমকি। তাই মায়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানানো, মর্টারশেলের বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া এবং এমন ঘটনা আর কখনো ঘটবে না- এমনটা দাবি করা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তা করা উচিত উভয় দেশ এবং এ অঞ্চলের স্বার্থের জন্য। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ মায়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে মর্টারশেলের ঘটনায় কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। একই সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সাম্প্রতিক ও আগের সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ফোরামগুলোতে তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে যেসব মানুষ বসবাস করেন, তারা যাতে নিরাপদ বোধ করেন, সেজন্য ওই সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে সরকার।
মায়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ। প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটাই কূটনীতির অংশ হওয়া উচিত। এমনিতেই আমরা ১১ লাখের বেশি মায়ানমারের অধিবাসী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি, যা আমাদের অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে। মায়ানমার তাদের নাগরিকদের ফেরত তো নিচ্ছেই না, উলটো বাংলাদেশ সীমান্তে তাদের নিক্ষেপ করা মর্টার শেল ও গোলা এসে পড়ছে। মায়ানমারের এ তৎপরতা অব্যাহত থাকলে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক জটিল আকার ধারণ করবে। তাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত কূটনৈতিক পন্থায় এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা। সেটি যেমন মায়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে হতে পারে, তেমনি জাতিসংঘের কাছে সহায়তা চাওয়ার মাধ্যমেও হতে পারে। এছাড়া মধ্যস্থতার জন্য বৃহৎ শক্তিগুলোর কাছে সহায়তাও চাইতে পারি আমরা। এ ব্যাপারে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা প্রয়োজন। আমরা আশা করব, তাদের নিক্ষেপ করা মর্টার শেল বা গোলা যাতে বাংলাদেশ সীমান্তে এসে না পড়ে, সে বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি রাখবে এবং ভবিষ্যতে মায়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করবে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মর্টার শেল নিক্ষেপের বিষয়ে মায়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে মায়ানমারের এসব কর্মকা- যে বন্ধুত্বের নিদর্শন নয়- সেটি দেশটির রাষ্টদূতকে ডেকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ, মায়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে চলমান স্থলযুদ্ধ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সীমান্তে টহল বাড়ানোর পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বৃদ্ধি করেছে। বিজিবি মায়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতের ওপরে নজর রাখছে ও অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ সব সময় শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানে বিশ্বাসী। মায়ানমারের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশ কখনো হস্তক্ষেপ করেনি। এরপর ও বাংলাদেশ গত পাঁচ বছর ধরে মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আসছে। এ ধরনের উস্কানিমূলক ঘটনা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি নষ্ট করে যা কারো কাম্য নয়। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ধীরে ধীরে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে উঠছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মায়ানমারে যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা এখনো চলমান। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত সংঘাত ছাড়াও সামরিক শাসনের বাইরে মায়ানমারের যে ঐক্য সরকার গঠিত হয়েছে, সে ঐক্য সরকারও দেশের মানুষ এবং বাইরের সমর্থন নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলছে এবং সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে
মায়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিক দেশগুলোকে আরও আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাতে হবে। আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে আসিয়ান, চীন, রাশিয়া ও জাতিসংঘকে মায়ানমারে আভ্যন্তরীণ সংঘাত বন্ধে এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবী। মায়ানমারের আভ্যন্তরীণ সংঘাত যেন আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দেখা না দেয় সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মায়ানমার আমাদের উসকানি দিতে চায়, বাংলাদেশ এর জবাবে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে সহিষ্ণুতা প্রদর্শন ও সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সামরিক বাহিনীর বাড়াবাড়ির কারণে শুধু মায়ানমারের অভ্যন্তরেই নয় বরং গোটা অঞ্চলের শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত দ্রুত মায়ানমারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ নিষেধাজ্ঞা জারী করা।
যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার মতো দেশগুলো আগে থেকেই মায়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সরব রয়েছে এবং বেশকিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে, তবে সেগুলো যথেষ্ট নয়। কিন্তু এসব রাষ্ট্রের মায়ানমারের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে অবস্থান এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে বলে মনে করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে আসিয়ান অধিভুক্ত দেশগুলো এখন যেমন মায়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে, তেমনি চীন এবং ভারতকে এ রকম ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। আমরা জানি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মায়ানমারকে এই দুটি রাষ্ট্র সমর্থন প্রদান করেছিল। এখনো যদি তারা সমর্থন অব্যাহত রাখে, তা হলে এ অঞ্চলকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এমনকি এই দুটি দেশের যে বিশাল বিনিয়োগ মায়ানমারে রয়েছে, যে কানেক্টিভিটির পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেটাও ব্যাহত হতে পারে। বাংলাদেশ তাই বহু আগেই বলে আসছে, মায়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত শুধু দুটি দেশের বিষয় নয়, এটি একটি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক বিষয়। ফলে এখনই দরকার জাতিসংঘে মায়ানমারের সামরিক জান্তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আঞ্চলিক শান্তি বিনষ্ট করার অপতৎপরতা বন্ধ করার ব্যাপারে আলোচনা করা এবং তাদের বিরুদ্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করা। তা না হলে এখানকার আঞ্চলিক শান্তি বিপন্নতার হুমকিতে পড়তে বাধ্য হবে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশকে বহুমাত্রিক কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাতে হবে। অন্যথায় এতে শুধু বাংলাদেশেরই নয়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এমনকি পূর্ব এশিয়ার দেশে ও তার বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। অর্থাৎ আঞ্চলিক শান্তি ও সৌহার্দ্য বিনষ্ট হবে। এক্ষেত্রে বৃহৎ দেশ যেমন চীন, ভারত ও জাপানকে আন্তরিক হতে হবে। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও মায়ানমার এর বিরুদ্ধে এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা জোরদার করে চাপ প্রয়োগ করতে পারে।
[লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক,
বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]