আকমল হোসেন
শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণে শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলন সর্বশেষ সরকার ২০১৬ সাল থেকে যে সব উপজেলায় সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই সে সব উপজেলায় ১টি কলেজ এবং ১টি করে স্কুল সরকারিকরণের ঘোষণা প্রদান করে। সেই আলোকে সারা দেশে ৩ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের কাজ শুরু করে। ২০২২ সালে এসে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে জিও করে প্রতিষ্ঠান সরকারি করলেও শিক্ষক-কর্মচারীদের পদায়ন হয়নি এমনকি তারা সরকারি নিয়মে বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন না, প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের আগের মতোই বেতন দিতে হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে গিয়েছেন, তারা না পাচ্ছেন তাদের কর্তনকৃত অবসর তহবিলের টাকা না পাচ্ছেন সরকারি সুবিধা, এমনতর ব্যবসায় নতুন সংকটের মধ্যে পরেছেন সরকারিকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে শিক্ষা জনগণের মৌলিক অধিকার হসেবে স্বীকৃতি পেলেও স্বাধীন বাংলাদেশে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি পায়নি, সংবিধানের ১৫ ধারায় রাষ্ট্রীয় মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি দাওয়ার যৌক্তিকতা, আন্দোলন সংগ্রামের অবস্থা, বিভিন্ন শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনের ভূমিকা এবং সরকারের রহস্যজনক নীরবতা নিয়ে দু-চারটি কথা বলতে চাই।
১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৫ ধারায় সবার জন্য শিক্ষ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় মৌলিক দায়িত্ব এবং ১৭ ধারায় একই ধারার অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের অঙ্গিকার করা হয়েছে। সর্বজনীন মানবাধিকার ২৬ ধারায় বিশ্বের সব মানুষের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার বিধান ঘোষিত হয়েছে। প্রাথমিক এবং এলিমেন্টারি শিক্ষা অর্থাৎ প্রথম শ্রেণী-দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার অর্থায়ন করবে রাষ্ট্র। সেই আলোকে জাতিসংঘের শিক্ষা ও বিজ্ঞান (ইউনেস্কো) শাখা জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সব দেশে স্ব-স্বদেশের জিডিপির ৭ শতাংশ শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দের সুপারিশ করেছে। সেই আলোকে স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালে গঠিত প্রথম শিক্ষা কমিশন কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে আপাতত জিডিপির ৫ শতাংশ এবং তা পর্যায়ক্রমে ৭ শতাংশে উন্নীত করার সুপারিশ করেছিল। সর্বশেষ ২০০৬ সালে সেনেগালের রাজধানী ঢাকার-এ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শিক্ষামন্ত্রীদের এক সম্মেলনে তাদের আর্থিক দৈন্যতার কথা বলে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করায় তাদের দেশের শিক্ষা ও শিক্ষক-কর্মচারীদের অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়েছে। আর্থসামাজিক অবস্থায় বাংলাদেশের চেয়ে দুর্বল এবং সমমানের দেশগুলোর মধ্যে নেপাল ৪.৬ শতাংশ, তানজানিয়া-৬.৮ শতাংশ, ভুটান-৪.৮ শতাংশ, মালদ্বীপ-১১.২০ শতাংশ, ভারত-৩.১ শতাংশ, ভিয়েতনাম-৫.৩ শতাংশ, সেনেগাল-৫.৮ শতাংশ, আর বাংলাদেশ-১.৯ শতাংশ (২০২১/২২) ব্যয় করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। স্বাধীনতার ৫১ বছরে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ ২.৪।
দেশের গোটা শিক্ষার ৯০ ভাগ পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। তাদের মধ্যে এমপিও এবং নন এমপিও স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার মাধ্যমে পরিচালত হচ্ছে। এ সেক্টরে প্রায় পৌনে ৫ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত, ৭ হাজার প্রতিষ্ঠানের লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বীকৃতি থাকলেও তারা বেতনভাতা পান না। এই সব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং বড় ধরনের বৈষয়িক লেনদেনের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের পক্ষ থেকে এদের এমপিওভুক্ত বিভিন্ন দাবি বাস্তব নের প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন হয়েছে নিতান্তই কম। ১৯৮০ সালে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ভাতার ১টি অংশের ৫০ ভাগ দিয়ে শুরু হয়েছিল আজকে যা ১০০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। তবে ২৮ বছর পূর্বে যে ১০০ টাকার বাড়ি ভাড়া আর ১৫০ টাকার চিকিৎসা ভাতা শুরু হয়েছিল, সেটার কোন পরিবর্তন হয়নি। সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট থাকলেও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সারা জীবনে ১টি ইনক্রিমেন্ট পেতেন, সেটাও ১৯৯২ সালের বেতন স্কেল অনুযায়ী। তবে ২০১৮ সাল থেকে ৫শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাওয়া শুরু হয়েছে। একই ধরনের কাজ হওয়া সত্ত্বেও শুধু নিয়োগ প্রক্রিয়া ভিন্ন হওয়ায় সরকারি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর্থিক বৈষম্য ব্যাপক। অথচ সংবিধানের ১৯ (১) ধারায় “সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবেন” এমন নির্দেশনা রয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক মানে বাংলাদেশের সরকারি শিক্ষকদেরও সুবিধাও সন্তোষজনক নয়।
বেসরকারি শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন সরকারের ভাবনা :
দলের ক্ষমতাসীন আমলে ঘটেছে। তবে এটা বাস্তবায়ন করতে শিক্ষকদের জেল-জুলুম, হুলিয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাগাতার কর্মবিরতিসহ মিছিল মিটিং এবং পুলিশি হামলার শিকার হতে হয়েছে। ১৯৭০ সালে ২৪ দিন ধর্মঘটের পর আলোচনার মাধ্যমে ৫০/৪০/৩০ টাকা হারে কল্যাণভাতা, ১৯৭৩ সালে ৪৯ দিন ধর্মঘটের পর আলোচনার মাধ্যমে কল্যাণ ভাতা ৭৫ টাকা, এরপর ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০০, সালে অবিরাম ধর্মঘটসহ পাবলিক পরীক্ষা বর্জনে যেতে হয় এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়ন হয়। ২০০৩ সালেও বৃহৎ কর্মসূচিতে যেতে হয়। এই সকল আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমেই বেতন ভাতা ৫০ ভাগ থেকে আজ ১০০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি দাওয়ার প্রতি ক্ষমতাসীন দলগুলোর দ্বৈতনীতির প্রতিফলন আমরা দেখতে পেয়েছি। বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় আর ক্ষমতাসীনামলে বেমালুম সেটা শুধু ভুলেই যায় না, দাবী বাস্তবায়নের জন্য সভা সমাবেশের অধিকার হরণ করা হয়। পুলিশের হামলা, প্রিপার স্প্রে সর্বশেষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয় শিক্ষকদের। এই অবস্থার অবসান দরকার।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের সরকারগুলি ঋণ চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ায় প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন সদস্যের চুল-দাড়ি কাটার টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সরবরাহ করলেও স্বাধীনতার ৫১ বছরে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের বর্তমান সুযোগ-সুবিধা তিনটি রাজনৈতিক শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারসহ সেবা খাতে অর্থায়ন হ্রাস করেছে। অন্যদিকে বিভিন্ন ঋণদানকারী সংস্থার নিকট থেকে প্রকল্পের বিপরীতে টাকা নিয়ে হরিলুটের সংস্কৃতি চালু করেছে। ৮০ দশকে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর হাত দিয়েই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কাঠামোগত সংস্কার প্রকল্পের চুক্তি এবং ৯০ দশকে সেবা খাত উদারীকরণের নামে রাষ্ট্রায়াত্ত সেবখাতে সরকারি অর্থায়ন হ্রাস করা হয়। বর্তমান সরকারও ওই দুটি চুক্তি বহাল রাখায় বিভিন্ন সেবা খাতসহ শিক্ষায় অর্থায়ন ৭ শতাংশ না করে ২.৫ এ ঘুরপাক খাচ্ছে। মহাজোট সরকার তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে শিক্ষার উন্নয়ন এবং শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ ঘোষণা করেছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যা ও সমাধান বিষয়ক তিন সদস্যদের ১টি সংসদীয় উপকমিটি গঠন করেছিলেন, কমিটি একটি সুপারিশ করেছে, সেটা উপেক্ষা করেই সরকার জনবল কাঠামো ২০১০ ঘোষণা করেছে। একইভাবে ১৯৯৫ সালের জনবল কাঠামোর কুখ্যাত অনুপাত প্রথা (৫:২) বর্তমানেও বাতিল করে ২:১ করা হয়েছ। সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোনতির সুপারিশসহ বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা যুক্তিসংগতভাবে বৃদ্ধির সুপারিশ করলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ সম্পর্কে পূর্বে ইতিবাচক কথা বললেও বর্তমানে নেতিবাচক উক্তি করা হচ্ছে সরকারের ভেতর থেকে। হাইকোর্টে রিট করে টাইমস্কেল পেলেও বকেয়া পাওয়া যায়নি।
এরই মধ্যে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে গিয়েছেন, তারা না পাচ্ছেন তাদের কর্তনকৃত অবসর তহবিলের টাকা না পাচ্ছেন সরকারি সুবিধা, এমনতর অবস্থায় নতুন সংকটের মধ্যে পড়েছেন সরকারিকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীরা
বিশ্বায়ন ও শিক্ষক-কর্মচারীদের অবস্থা :
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ পুঁজিবাদী লুটেরাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সরকার ওয়াল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন এবং অসম বিশ্বায়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অবাধ বিশ্বায়নের অজুহাতে সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলে বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়ালেও বিশ্বায়নের আলোকে এ দেশের শিক্ষক-কর্মচারীসহ ছোট-খাট চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বাড়াননি। স্বাধীনতার ৫১ বছরে এমপিদের বেতন-ভাতা বেড়েছে ১২ বার, মন্ত্রীদের বেড়েছে-১৩ বার, বিচারপতিদের বেড়েছে, ১৪ বার, আর সিভিল প্রশাসনে বেড়েছে মাত্র ৮বার।
পার্শ্ববর্তী ভারতে একজন প্রভাষকের মাসিক বেতন ৪০,০০০-৫০,০০০ রুপি, সহকারী অধ্যাপক ৫০,০০০-৬০,০০০ রুপি, সহযোগী অধ্যাপক ৬০,০০০-৭০,০০০ রুপি, একজন অধ্যাপকের বেতন ৭০,০০০-৭৫,০০০ রুপি, একজন অধ্যক্ষের বেতন ৯০,০০০-৯৬,০০০ রুপি। তৃতীয় বিশ্বের দেশ ভেনিজুয়েলাতে একজন প্রাইমারি স্কুলশিক্ষকের বেতন ৮০০ ডলার (৬৪,০০০) টাকা, একজন হাইস্কুল শিক্ষকের বেতন ১৪০০ ডলার (১১,২০০) আর বাংলাদেশে একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ৮৩০০ টাকার স্কেলে সর্বোমোট ১৪০০০ টাকা, আর কলেজের প্রভাষক ২২০০০ টাকা স্কেলে বেতন তুলতে পারেন ২১৩০০ টাকা। বিশ্বায়নের আলোকে এটা একটা বড় ধরনের সমস্যা।
শিক্ষক আন্দোলনকে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও বেগবান করতে হবে : আন্দোলন ছাড়া দাবি আদায়ের বিকল্প পথ নেই। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এ পর্যন্ত যা প্রাপ্তি তা সবই আন্দোলন সংগ্রামের ফসল। তবে বর্তমানে শিক্ষক আন্দোলনের গতি প্রকৃতিতে পেশাদারিত্ব শিক্ষকদের অংশীদারিত্ব সংগঠনগুলোতে সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা গণতান্ত্রিকতার ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে সংগঠনকে দলীয় রাজনীতির প্রভাব বলয় থেকে দূরে রাখার বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে। বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মতো আজীবনের নেতৃত্ব কালচার বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনে চেপে বসেছে। একই ব্যক্তি ১ যুগ, ২ যুগ শিক্ষক সংগঠনের নেতা হয়ে বসে আছেন। কেউ আছেন সরকারের গৃহপালিত এবং অঙ্গসংগঠনের নেতা হিসেবে আবার কেউ আছেন বিরোধী দলের পক্ষ নিয়ে সরকার হটানোর আন্দোলনে। শিক্ষক সংগঠনের দায়িত্ব পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে পেশার দাবি আদায়ে কাজ করা। কোন দলকে ক্ষমতায় রাখা আবার কোন দলকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য নয়।
শিক্ষক নেতা কোন দলের সদস্য হতে পারেন তবে শিক্ষক নেতা হয়ে তিনি শিক্ষক সংগঠনকে তার দলের হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন না। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের শিক্ষক আন্দোলনে সেটা ঘটেছে, কল্যাণ ট্রাস্ট, অবসর সুবিধাবোর্ডসহ বিভিন্ন জায়গায় লোভনীয় পদের কারণে কেউ হোন সরকারের গৃহপালিত নেতা আবার কেউ হোন বিরোধী নেতা। এই সংস্কৃতি পরিহার হওয়া উচিত। বার কউন্সিলের মত এমপিওভুক্ত শিক্ষক- কর্মচারীদের দ্বারা এ পদগুলো পূরণ করলে, এই সমস্যার সমাধান হতে পারে বলে বাকবিশিস মনে করে।
শিক্ষক সংগঠনগুলোতে সাংগঠনিক ধারাবাহিকতার অভাব এবং সময় মত সম্মেলন না হওয়ায় একজন নেতা যুগের পর যুগ নেতা হয়ে বসে আছেন। সুস্থ ও জবাবদিহিমূলক পেশাজীবী শিক্ষক আন্দোলন গড়ে তুলতে নেতৃত্বের গতিশীলতা দরকার। এই জন্য শিক্ষক সংগঠনের সদস্য হওয়া, সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়া এবং নেতাদের সাংগঠনিক জবাবদিহিতায় আনতে হবে, নিয়মিত সম্মেলন করাও জরুরি।
শিক্ষকদের করণীয় : শিক্ষকের মর্যাদা সমান শিক্ষার গুণগত মান। অতএব শিক্ষককে অবহেলা করে অসম্মান করে শিক্ষার গুণগত মান অর্জন কোনভাবেই সম্ভব নয়। আর শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ছাড়া দেশের উন্নয়নও সম্ভব নয়। সবার জন্য বৈষম্যহীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার বিস্তারের কাজটি করার জন্যই শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ দরকার। আন্দোলন ছাড়া শাসক মহল শিক্ষা ও শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি বাস্তবায়ন করেছে এমন ইতিহাস বাংলাদেশে নেই।
তাই দাবি বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের বিকল্প নেই। শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের মধ্য দিয়েই শিক্ষক সমাজের পেশাগত দাবি সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আলোকে অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন বিজ্ঞান শিক্ষা বাস্তবায়ন হওয়া সম্ভব। সেই কাজটির জন্য শিক্ষকদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিহীন স্বাধীন এবং পেশাদারি শিক্ষক সংগঠন গড়ে তোলা জরুরি। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরকার সমর্থিত শিক্ষকদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং বৈষয়িক স্বার্থে হঠাৎ গড়ে ওঠা একাধিক সংগঠন এবং গভর্নিং বডির প্রভাবে গড়ে ওঠা সংগঠন দিয়ে শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজের জন্য ইতিবাচক কিছু হবে বলে মনে হয়না।
[লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক,
বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি]
আকমল হোসেন
রোববার, ০২ অক্টোবর ২০২২
শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণে শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলন সর্বশেষ সরকার ২০১৬ সাল থেকে যে সব উপজেলায় সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই সে সব উপজেলায় ১টি কলেজ এবং ১টি করে স্কুল সরকারিকরণের ঘোষণা প্রদান করে। সেই আলোকে সারা দেশে ৩ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের কাজ শুরু করে। ২০২২ সালে এসে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে জিও করে প্রতিষ্ঠান সরকারি করলেও শিক্ষক-কর্মচারীদের পদায়ন হয়নি এমনকি তারা সরকারি নিয়মে বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন না, প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের আগের মতোই বেতন দিতে হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে গিয়েছেন, তারা না পাচ্ছেন তাদের কর্তনকৃত অবসর তহবিলের টাকা না পাচ্ছেন সরকারি সুবিধা, এমনতর ব্যবসায় নতুন সংকটের মধ্যে পরেছেন সরকারিকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে শিক্ষা জনগণের মৌলিক অধিকার হসেবে স্বীকৃতি পেলেও স্বাধীন বাংলাদেশে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি পায়নি, সংবিধানের ১৫ ধারায় রাষ্ট্রীয় মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি দাওয়ার যৌক্তিকতা, আন্দোলন সংগ্রামের অবস্থা, বিভিন্ন শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনের ভূমিকা এবং সরকারের রহস্যজনক নীরবতা নিয়ে দু-চারটি কথা বলতে চাই।
১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৫ ধারায় সবার জন্য শিক্ষ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় মৌলিক দায়িত্ব এবং ১৭ ধারায় একই ধারার অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের অঙ্গিকার করা হয়েছে। সর্বজনীন মানবাধিকার ২৬ ধারায় বিশ্বের সব মানুষের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার বিধান ঘোষিত হয়েছে। প্রাথমিক এবং এলিমেন্টারি শিক্ষা অর্থাৎ প্রথম শ্রেণী-দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার অর্থায়ন করবে রাষ্ট্র। সেই আলোকে জাতিসংঘের শিক্ষা ও বিজ্ঞান (ইউনেস্কো) শাখা জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সব দেশে স্ব-স্বদেশের জিডিপির ৭ শতাংশ শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দের সুপারিশ করেছে। সেই আলোকে স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালে গঠিত প্রথম শিক্ষা কমিশন কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে আপাতত জিডিপির ৫ শতাংশ এবং তা পর্যায়ক্রমে ৭ শতাংশে উন্নীত করার সুপারিশ করেছিল। সর্বশেষ ২০০৬ সালে সেনেগালের রাজধানী ঢাকার-এ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শিক্ষামন্ত্রীদের এক সম্মেলনে তাদের আর্থিক দৈন্যতার কথা বলে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করায় তাদের দেশের শিক্ষা ও শিক্ষক-কর্মচারীদের অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়েছে। আর্থসামাজিক অবস্থায় বাংলাদেশের চেয়ে দুর্বল এবং সমমানের দেশগুলোর মধ্যে নেপাল ৪.৬ শতাংশ, তানজানিয়া-৬.৮ শতাংশ, ভুটান-৪.৮ শতাংশ, মালদ্বীপ-১১.২০ শতাংশ, ভারত-৩.১ শতাংশ, ভিয়েতনাম-৫.৩ শতাংশ, সেনেগাল-৫.৮ শতাংশ, আর বাংলাদেশ-১.৯ শতাংশ (২০২১/২২) ব্যয় করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। স্বাধীনতার ৫১ বছরে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ ২.৪।
দেশের গোটা শিক্ষার ৯০ ভাগ পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। তাদের মধ্যে এমপিও এবং নন এমপিও স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার মাধ্যমে পরিচালত হচ্ছে। এ সেক্টরে প্রায় পৌনে ৫ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত, ৭ হাজার প্রতিষ্ঠানের লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বীকৃতি থাকলেও তারা বেতনভাতা পান না। এই সব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং বড় ধরনের বৈষয়িক লেনদেনের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের পক্ষ থেকে এদের এমপিওভুক্ত বিভিন্ন দাবি বাস্তব নের প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন হয়েছে নিতান্তই কম। ১৯৮০ সালে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ভাতার ১টি অংশের ৫০ ভাগ দিয়ে শুরু হয়েছিল আজকে যা ১০০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। তবে ২৮ বছর পূর্বে যে ১০০ টাকার বাড়ি ভাড়া আর ১৫০ টাকার চিকিৎসা ভাতা শুরু হয়েছিল, সেটার কোন পরিবর্তন হয়নি। সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট থাকলেও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সারা জীবনে ১টি ইনক্রিমেন্ট পেতেন, সেটাও ১৯৯২ সালের বেতন স্কেল অনুযায়ী। তবে ২০১৮ সাল থেকে ৫শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাওয়া শুরু হয়েছে। একই ধরনের কাজ হওয়া সত্ত্বেও শুধু নিয়োগ প্রক্রিয়া ভিন্ন হওয়ায় সরকারি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর্থিক বৈষম্য ব্যাপক। অথচ সংবিধানের ১৯ (১) ধারায় “সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবেন” এমন নির্দেশনা রয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক মানে বাংলাদেশের সরকারি শিক্ষকদেরও সুবিধাও সন্তোষজনক নয়।
বেসরকারি শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন সরকারের ভাবনা :
দলের ক্ষমতাসীন আমলে ঘটেছে। তবে এটা বাস্তবায়ন করতে শিক্ষকদের জেল-জুলুম, হুলিয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাগাতার কর্মবিরতিসহ মিছিল মিটিং এবং পুলিশি হামলার শিকার হতে হয়েছে। ১৯৭০ সালে ২৪ দিন ধর্মঘটের পর আলোচনার মাধ্যমে ৫০/৪০/৩০ টাকা হারে কল্যাণভাতা, ১৯৭৩ সালে ৪৯ দিন ধর্মঘটের পর আলোচনার মাধ্যমে কল্যাণ ভাতা ৭৫ টাকা, এরপর ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০০, সালে অবিরাম ধর্মঘটসহ পাবলিক পরীক্ষা বর্জনে যেতে হয় এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়ন হয়। ২০০৩ সালেও বৃহৎ কর্মসূচিতে যেতে হয়। এই সকল আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমেই বেতন ভাতা ৫০ ভাগ থেকে আজ ১০০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি দাওয়ার প্রতি ক্ষমতাসীন দলগুলোর দ্বৈতনীতির প্রতিফলন আমরা দেখতে পেয়েছি। বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় আর ক্ষমতাসীনামলে বেমালুম সেটা শুধু ভুলেই যায় না, দাবী বাস্তবায়নের জন্য সভা সমাবেশের অধিকার হরণ করা হয়। পুলিশের হামলা, প্রিপার স্প্রে সর্বশেষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয় শিক্ষকদের। এই অবস্থার অবসান দরকার।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের সরকারগুলি ঋণ চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ায় প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন সদস্যের চুল-দাড়ি কাটার টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সরবরাহ করলেও স্বাধীনতার ৫১ বছরে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের বর্তমান সুযোগ-সুবিধা তিনটি রাজনৈতিক শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারসহ সেবা খাতে অর্থায়ন হ্রাস করেছে। অন্যদিকে বিভিন্ন ঋণদানকারী সংস্থার নিকট থেকে প্রকল্পের বিপরীতে টাকা নিয়ে হরিলুটের সংস্কৃতি চালু করেছে। ৮০ দশকে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর হাত দিয়েই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কাঠামোগত সংস্কার প্রকল্পের চুক্তি এবং ৯০ দশকে সেবা খাত উদারীকরণের নামে রাষ্ট্রায়াত্ত সেবখাতে সরকারি অর্থায়ন হ্রাস করা হয়। বর্তমান সরকারও ওই দুটি চুক্তি বহাল রাখায় বিভিন্ন সেবা খাতসহ শিক্ষায় অর্থায়ন ৭ শতাংশ না করে ২.৫ এ ঘুরপাক খাচ্ছে। মহাজোট সরকার তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে শিক্ষার উন্নয়ন এবং শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ ঘোষণা করেছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যা ও সমাধান বিষয়ক তিন সদস্যদের ১টি সংসদীয় উপকমিটি গঠন করেছিলেন, কমিটি একটি সুপারিশ করেছে, সেটা উপেক্ষা করেই সরকার জনবল কাঠামো ২০১০ ঘোষণা করেছে। একইভাবে ১৯৯৫ সালের জনবল কাঠামোর কুখ্যাত অনুপাত প্রথা (৫:২) বর্তমানেও বাতিল করে ২:১ করা হয়েছ। সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোনতির সুপারিশসহ বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা যুক্তিসংগতভাবে বৃদ্ধির সুপারিশ করলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ সম্পর্কে পূর্বে ইতিবাচক কথা বললেও বর্তমানে নেতিবাচক উক্তি করা হচ্ছে সরকারের ভেতর থেকে। হাইকোর্টে রিট করে টাইমস্কেল পেলেও বকেয়া পাওয়া যায়নি।
এরই মধ্যে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে গিয়েছেন, তারা না পাচ্ছেন তাদের কর্তনকৃত অবসর তহবিলের টাকা না পাচ্ছেন সরকারি সুবিধা, এমনতর অবস্থায় নতুন সংকটের মধ্যে পড়েছেন সরকারিকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীরা
বিশ্বায়ন ও শিক্ষক-কর্মচারীদের অবস্থা :
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ পুঁজিবাদী লুটেরাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সরকার ওয়াল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন এবং অসম বিশ্বায়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অবাধ বিশ্বায়নের অজুহাতে সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলে বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়ালেও বিশ্বায়নের আলোকে এ দেশের শিক্ষক-কর্মচারীসহ ছোট-খাট চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বাড়াননি। স্বাধীনতার ৫১ বছরে এমপিদের বেতন-ভাতা বেড়েছে ১২ বার, মন্ত্রীদের বেড়েছে-১৩ বার, বিচারপতিদের বেড়েছে, ১৪ বার, আর সিভিল প্রশাসনে বেড়েছে মাত্র ৮বার।
পার্শ্ববর্তী ভারতে একজন প্রভাষকের মাসিক বেতন ৪০,০০০-৫০,০০০ রুপি, সহকারী অধ্যাপক ৫০,০০০-৬০,০০০ রুপি, সহযোগী অধ্যাপক ৬০,০০০-৭০,০০০ রুপি, একজন অধ্যাপকের বেতন ৭০,০০০-৭৫,০০০ রুপি, একজন অধ্যক্ষের বেতন ৯০,০০০-৯৬,০০০ রুপি। তৃতীয় বিশ্বের দেশ ভেনিজুয়েলাতে একজন প্রাইমারি স্কুলশিক্ষকের বেতন ৮০০ ডলার (৬৪,০০০) টাকা, একজন হাইস্কুল শিক্ষকের বেতন ১৪০০ ডলার (১১,২০০) আর বাংলাদেশে একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ৮৩০০ টাকার স্কেলে সর্বোমোট ১৪০০০ টাকা, আর কলেজের প্রভাষক ২২০০০ টাকা স্কেলে বেতন তুলতে পারেন ২১৩০০ টাকা। বিশ্বায়নের আলোকে এটা একটা বড় ধরনের সমস্যা।
শিক্ষক আন্দোলনকে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও বেগবান করতে হবে : আন্দোলন ছাড়া দাবি আদায়ের বিকল্প পথ নেই। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এ পর্যন্ত যা প্রাপ্তি তা সবই আন্দোলন সংগ্রামের ফসল। তবে বর্তমানে শিক্ষক আন্দোলনের গতি প্রকৃতিতে পেশাদারিত্ব শিক্ষকদের অংশীদারিত্ব সংগঠনগুলোতে সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা গণতান্ত্রিকতার ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে সংগঠনকে দলীয় রাজনীতির প্রভাব বলয় থেকে দূরে রাখার বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে। বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মতো আজীবনের নেতৃত্ব কালচার বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনে চেপে বসেছে। একই ব্যক্তি ১ যুগ, ২ যুগ শিক্ষক সংগঠনের নেতা হয়ে বসে আছেন। কেউ আছেন সরকারের গৃহপালিত এবং অঙ্গসংগঠনের নেতা হিসেবে আবার কেউ আছেন বিরোধী দলের পক্ষ নিয়ে সরকার হটানোর আন্দোলনে। শিক্ষক সংগঠনের দায়িত্ব পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে পেশার দাবি আদায়ে কাজ করা। কোন দলকে ক্ষমতায় রাখা আবার কোন দলকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য নয়।
শিক্ষক নেতা কোন দলের সদস্য হতে পারেন তবে শিক্ষক নেতা হয়ে তিনি শিক্ষক সংগঠনকে তার দলের হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন না। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের শিক্ষক আন্দোলনে সেটা ঘটেছে, কল্যাণ ট্রাস্ট, অবসর সুবিধাবোর্ডসহ বিভিন্ন জায়গায় লোভনীয় পদের কারণে কেউ হোন সরকারের গৃহপালিত নেতা আবার কেউ হোন বিরোধী নেতা। এই সংস্কৃতি পরিহার হওয়া উচিত। বার কউন্সিলের মত এমপিওভুক্ত শিক্ষক- কর্মচারীদের দ্বারা এ পদগুলো পূরণ করলে, এই সমস্যার সমাধান হতে পারে বলে বাকবিশিস মনে করে।
শিক্ষক সংগঠনগুলোতে সাংগঠনিক ধারাবাহিকতার অভাব এবং সময় মত সম্মেলন না হওয়ায় একজন নেতা যুগের পর যুগ নেতা হয়ে বসে আছেন। সুস্থ ও জবাবদিহিমূলক পেশাজীবী শিক্ষক আন্দোলন গড়ে তুলতে নেতৃত্বের গতিশীলতা দরকার। এই জন্য শিক্ষক সংগঠনের সদস্য হওয়া, সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়া এবং নেতাদের সাংগঠনিক জবাবদিহিতায় আনতে হবে, নিয়মিত সম্মেলন করাও জরুরি।
শিক্ষকদের করণীয় : শিক্ষকের মর্যাদা সমান শিক্ষার গুণগত মান। অতএব শিক্ষককে অবহেলা করে অসম্মান করে শিক্ষার গুণগত মান অর্জন কোনভাবেই সম্ভব নয়। আর শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ছাড়া দেশের উন্নয়নও সম্ভব নয়। সবার জন্য বৈষম্যহীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার বিস্তারের কাজটি করার জন্যই শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ দরকার। আন্দোলন ছাড়া শাসক মহল শিক্ষা ও শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি বাস্তবায়ন করেছে এমন ইতিহাস বাংলাদেশে নেই।
তাই দাবি বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের বিকল্প নেই। শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের মধ্য দিয়েই শিক্ষক সমাজের পেশাগত দাবি সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আলোকে অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন বিজ্ঞান শিক্ষা বাস্তবায়ন হওয়া সম্ভব। সেই কাজটির জন্য শিক্ষকদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিহীন স্বাধীন এবং পেশাদারি শিক্ষক সংগঠন গড়ে তোলা জরুরি। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরকার সমর্থিত শিক্ষকদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং বৈষয়িক স্বার্থে হঠাৎ গড়ে ওঠা একাধিক সংগঠন এবং গভর্নিং বডির প্রভাবে গড়ে ওঠা সংগঠন দিয়ে শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজের জন্য ইতিবাচক কিছু হবে বলে মনে হয়না।
[লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক,
বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি]