গৌরমোহন দাস
শ্রী শ্রী চন্ডীমতে- দেবী দুর্গার অনেক হাত। তাঁর অষ্টাদশভুজা, ষোড়শভুজা, দশভুজা, অষ্টভুজা ও চতুর্ভুজা মূর্তি দেখা যায়। তবে দশভুজা রূপটিই বেশি পরিচিত। মায়ের হাত ১০টি, ১০ হাতেই আবার অস্ত্র ধারণ করে আছেন, তাই তার আরেক নাম- ‘দশপ্রহরণধারিণী’। দেবী দুর্গার বাম দিকের হাতে- ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, বাণ, ধনুক। আর ডান দিকের পাঁচ হাতে আছে- শঙ্খ, ঢাল, ঘণ্টা, অঙ্কুশ, নাগ পাশ অস্ত্র। শাস্ত্র মতে- উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত, ঊর্ধ্বঃ, অধঃ। ১০ দিক সমানভাবে সামলানোর প্রতীক মা দুর্গা। আর সে কারণেই মায়ের ১০ হাত।
অনেকের মনের প্রশ্ন- দেবী দশভুজা হওয়া সত্ত্বেও তার মূূর্তি ভাঙলে মূর্তি নিজেকে বাঁচাতে পারে না, অন্যকে বাঁচাবে কী করে? এতে প্রমাণ হয় মূর্তির কোন শক্তি নেই। এর উত্তর হলো- মূর্তি নিছক মূর্তিই। মূর্তি কখনো ঈশ্বর নন। ঈশ্বর অব্যয়, অক্ষয়। মূর্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। মূর্তিকে ঈশ্বর মনে করা বোকামি। আর অবুঝ সন্তান বাবা-মাকে আঘাত করলে বাবা-মা কিছু বলেন না, সেটাই মনে করে। কারণ, এত ছোট বাচ্চা বা অবুঝ কিছু বোঝে না। আর কেউ কোনো দেশের রাষ্ট্রপতির ছবি গোপনে পোড়ালে এর মানে এই নয় যে, সে রাষ্ট্রপতির শক্তি নেই। ত্রিভূবন বিজয়ী অপশক্তি সম্পন্ন মহিষাসুরের সঙ্গে দেবী যুদ্ধ করেছিলেন কিন্তু শুভ শক্তিসম্পন্ন মায়ের শক্তির কাছে পরাজিত হয়। কারণ, অশুভ ও আসুরিক শক্তি ক্ষণস্থায়ী, একসময় তাকে যথার্থ ফল ভোগ করতেই হয়। আমাদের হা-হুতাশে মা এ জগতে আসেন না, তাঁর সময় হলেই তিনি এসে আমাদের কৃপা করে যান।
কৃষি সম্প্রসারণ তথা প্রকৃতি দেবীপূজার উপকরণ থাকে দেবীর পূজায়। কলা, কালোকচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মানকচু, ধান ৯টি ঔষধি বৃক্ষ। নাম দিয়েছেন- নবপত্রিকা। অজ্ঞতায় অনেকে এ নবপত্রিকাকে কলাবউ বা গণেশের বউ বলে থাকেন, কেউবা না বোঝে হিন্দুরা গাছের পূজা করে বলে থাকেন, যা মোটেও ঠিক নয়।
আবার বাহন- প্রাণিকুলের সিংহ, হাঁস, ময়ূর, পেঁচা, ইঁদুর, ষাঁড় ছোটো-বড়ো প্রভৃতি প্রাণী দেবীর সঙ্গে শোভিত হচ্ছে। কেন? কারণ, প্রকৃতির সুরক্ষায় সে সব প্রাণীর ভূমিকা যেমনি অপরিসীম তেমনি সিংহ-ষাঁড়কে, ময়ূর-সাপকে, কিংবা পেঁচা-ইঁদুরকে দেখেও তেড়ে না এসে, হিংসা-বিবাদ ভুলে গিয়ে মায়ের আদর-শাসনে একত্রে রয়েছে; তারা আমাদেরও একত্রে থাকার শিক্ষা দিচ্ছে। প্রকৃতির দেবী বলে অপর নাম শাকম্ভরী। প্রকৃতি পূজায় গাছপালা ও প্রাণীগুলোর প্রতি ভালোবাসা থাকার শিক্ষা দেয়, তাদের প্রতি যতœশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়। আমাদের জীবনও সুস্থ, সুন্দর ও শান্তিময় হয়। তাই তো হাজার বছর পূর্বে আর্য-ঋষিগণবিভিন্ন প্রাণী ও প্রকৃতি পূজার বিধান করে দিয়েছেন।
শারদীয় শ্রী শ্রী দুর্গাপূজা সর্বজনীন উৎসব। দুর্গাদেবীর সঙ্গে অন্যান্য দেব-দেবীও আছে। মন্ত্রেও সর্বজনীনতা- “তিষ্ঠ দেবগণৈঃ সহ।” দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহারেও রয়েছে সর্বজনীনতা, সবার সম্পৃক্ততা। সপ্তঘাটের জল থেকে শিশির কতা, দেবদ্বার, বেশ্যাদ্বারের ‘মৃত্তিকা’ অনেক কিছু শ্রী শ্রী দুর্গাপূজায় লাগে। কারণ, সব মিলেই সমাজ। বেশ্যাদ্বারের মাটি কী ও কেন লাগে তা না জেনে কেউ ভিন্নভাবে প্রয়োগ করলে কিছু করার নেই।
অথচ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, কাঞ্চী দ্বারাবতীচৈব অবন্তিকাচ মথুরা/ অযোধ্যা মায়াতীর্থঞ্চ দ্বারকাতীর্থ মে বচ।/এতানি সপ্তানি সপ্তবেশ্যা প্রকীর্তিতা॥ এর অর্থ হলো- কাঞ্চী, দ্বারাবতী, অবন্তী, মথুরা, অযোধ্যা, মায়াতীর্থ, দ্বারকা এই সপ্তস্থান সপ্তবেশ্যা বলে খ্যাত। তন্ত্রোক্ত মহানির্বাণতন্ত্রের বচনে- “অভিষিক্তা ভবদ্বেশ্যা ন বেশ্যা কুলটা প্রিয়ে, রৌববং নরকং ব্রজেৎ॥” এখানে বেশ্যা শব্দটি কুলটা নয়, কুলটা বেশ্যা রৌরব নরকে গমন করে। দশমহাবদ্যিায় পূর্ণাভষিক্তি ব্রহ্মবাদিনী নারীকইে এখানে বেশ্যা বলা হচ্ছে। “বেশ্যা ন তু পতিতায়াং বেশ্যং ত্রিলোকং ততৌ বেশ্যা॥” এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে বেশ্যা মানে পতিতা নয়; ত্রিলোক যাঁর বশে তিনিই বেশ্যা।
লক্ষ্য ও মনে রাখার বিষয় হলো- হিন্দুরা মূর্তি বা প্রতিমা পূজা করে না, প্রতিমাতে/ মূর্তিতে পূজা করে। যেমন : আগুনকে এমনিতেই ধারণ করা যায় না। তার জন্য একটা মাধ্যম কাঠ, কয়লা, কাগজ, সলতে ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। ঠিক তেমনি মূর্তি ব্যবহার, আবারনিরাকার উপাসনা করা যায়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ১২/৫ শ্লোকে শ্রীভগবান বলেছেন- ক্লেশোধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম।/ অব্যক্তা হি গতির্দুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে॥ অর্থাৎ যারা অব্যক্ত নির্বিশেষ ব্রহ্মের আরাধনা করেন, তাদের সিদ্ধিলাভ অধিকতর কষ্টসাধ্য। কারণ, দেহধারী জীবদের পক্ষে ব্রহ্মে মনস্থির করা কঠিন ও দুঃখময়।
কিন্তু মূর্তি সামনে থাকলে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা সহজ হয়। প্রকৃত পক্ষে মূর্তিকে পূজা করা হয় না। ঈশ্বরকে কল্পনা করেই পূজা করা হয়। মূর্তি বা প্রতিমা শুধু মনকে স্থির করে। যেমন- চিত্র না এঁকে উপপাদ্য প্রমাণ করা কঠিন। চিত্র থাকলে প্রমাণ করা সহজ। সাকার-নিরাকার যেভাবে ভজনাকরে ভগবান সেভাবেই তাকে তুষ্ট করে থাকেন। প্রতিমার মাধুর্যতা, পূজকের মনের শুদ্ধ ভক্তি নিবেদন এবং পবিত্র স্থানে পূজা একান্ত প্রয়োজন।
দেবীর কাঠামোতে সুর বা দেবশক্তি লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, চালচিত্রে আছেন মঙ্গলকারী শিব; আছে অসুর শক্তি মহিষাসুর এবং তাঁদের বাহনেও রয়েছে শান্তি শিক্ষার কথা। সমাজের নিচু থেকে উঁচু শ্রেণীর পেশায় নিয়োজিত সবার অংশগ্রহণ থাকে এ পূজায়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আনন্দ উপভোগ করে, একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পূজায় মায়ের চরণে অঞ্জলি নিবেদন করে। ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত ৫ (পাঁচ) দিনব্যাপী মহাসমারোহে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কারণ, পূজা- ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক করার উত্তম পথ। আমাদের জীবনে প্রয়োগের অভাবেই অশান্তি। আর সব অশুভ শক্তি তথা অসুরকে পরাজিত করে, দশমী তিথিতে বিজয় লাভ করে। এ শুভ শক্তির জয়ই শুভ বিজয়া দশমী।
শুভ বিজায়ায় চলে অবাধ মিলন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সব ধর্মমতের লোকজনের সঙ্গে উদারচিত্তে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। দর্পণ বিসর্জনের পর মা মহামায়ার অপার শক্তিময়ী মাতৃমন্ডলী শক্তির প্রতীক সিঁদুর দেবীর চরণে উৎসর্গ করে একে অন্যের কপালে ছোঁয়ায়। আর আনন্দের সঙ্গে একে অন্যের শান্তির প্রার্থনা করে। ঐক্যের সুতায় এই উৎসব সবার মিলনমেলায় পরিণত হয়। তাই এই উৎসব একটি সর্বজনীন ও জাতীয় উৎসব। এই উৎসবের যথার্থ শিক্ষা নিয়ে পথ চললে সমাজে শান্তি বিরাজ অবশ্যম্ভাবী।
শ্রী শ্রী দুর্গা মায়ের অপার করুণা! মাতৃকরুণাতেই যতক্ষণ আমরা মায়ের সঙ্গে থাকি ততক্ষণ আমাদের কারও দুঃখ থাকে না। মাতৃক্রোড়েই সন্তানের সর্বশ্রেষ্ট শান্তির স্থল, মাতৃস্পর্শে সন্তান শান্তি লাভ করে। মায়ের মমতা ও ভালোবাসায় মা মহামায়া সবার মনে প্রকৃত ‘শান্তি’ দান করুন। শান্তিময়ীর দেবীর কাছে সে প্রার্থনা। সবার ত্রিবিধ শান্তি হোক।
[লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি]
গৌরমোহন দাস
মঙ্গলবার, ০৪ অক্টোবর ২০২২
শ্রী শ্রী চন্ডীমতে- দেবী দুর্গার অনেক হাত। তাঁর অষ্টাদশভুজা, ষোড়শভুজা, দশভুজা, অষ্টভুজা ও চতুর্ভুজা মূর্তি দেখা যায়। তবে দশভুজা রূপটিই বেশি পরিচিত। মায়ের হাত ১০টি, ১০ হাতেই আবার অস্ত্র ধারণ করে আছেন, তাই তার আরেক নাম- ‘দশপ্রহরণধারিণী’। দেবী দুর্গার বাম দিকের হাতে- ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, বাণ, ধনুক। আর ডান দিকের পাঁচ হাতে আছে- শঙ্খ, ঢাল, ঘণ্টা, অঙ্কুশ, নাগ পাশ অস্ত্র। শাস্ত্র মতে- উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত, ঊর্ধ্বঃ, অধঃ। ১০ দিক সমানভাবে সামলানোর প্রতীক মা দুর্গা। আর সে কারণেই মায়ের ১০ হাত।
অনেকের মনের প্রশ্ন- দেবী দশভুজা হওয়া সত্ত্বেও তার মূূর্তি ভাঙলে মূর্তি নিজেকে বাঁচাতে পারে না, অন্যকে বাঁচাবে কী করে? এতে প্রমাণ হয় মূর্তির কোন শক্তি নেই। এর উত্তর হলো- মূর্তি নিছক মূর্তিই। মূর্তি কখনো ঈশ্বর নন। ঈশ্বর অব্যয়, অক্ষয়। মূর্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। মূর্তিকে ঈশ্বর মনে করা বোকামি। আর অবুঝ সন্তান বাবা-মাকে আঘাত করলে বাবা-মা কিছু বলেন না, সেটাই মনে করে। কারণ, এত ছোট বাচ্চা বা অবুঝ কিছু বোঝে না। আর কেউ কোনো দেশের রাষ্ট্রপতির ছবি গোপনে পোড়ালে এর মানে এই নয় যে, সে রাষ্ট্রপতির শক্তি নেই। ত্রিভূবন বিজয়ী অপশক্তি সম্পন্ন মহিষাসুরের সঙ্গে দেবী যুদ্ধ করেছিলেন কিন্তু শুভ শক্তিসম্পন্ন মায়ের শক্তির কাছে পরাজিত হয়। কারণ, অশুভ ও আসুরিক শক্তি ক্ষণস্থায়ী, একসময় তাকে যথার্থ ফল ভোগ করতেই হয়। আমাদের হা-হুতাশে মা এ জগতে আসেন না, তাঁর সময় হলেই তিনি এসে আমাদের কৃপা করে যান।
কৃষি সম্প্রসারণ তথা প্রকৃতি দেবীপূজার উপকরণ থাকে দেবীর পূজায়। কলা, কালোকচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মানকচু, ধান ৯টি ঔষধি বৃক্ষ। নাম দিয়েছেন- নবপত্রিকা। অজ্ঞতায় অনেকে এ নবপত্রিকাকে কলাবউ বা গণেশের বউ বলে থাকেন, কেউবা না বোঝে হিন্দুরা গাছের পূজা করে বলে থাকেন, যা মোটেও ঠিক নয়।
আবার বাহন- প্রাণিকুলের সিংহ, হাঁস, ময়ূর, পেঁচা, ইঁদুর, ষাঁড় ছোটো-বড়ো প্রভৃতি প্রাণী দেবীর সঙ্গে শোভিত হচ্ছে। কেন? কারণ, প্রকৃতির সুরক্ষায় সে সব প্রাণীর ভূমিকা যেমনি অপরিসীম তেমনি সিংহ-ষাঁড়কে, ময়ূর-সাপকে, কিংবা পেঁচা-ইঁদুরকে দেখেও তেড়ে না এসে, হিংসা-বিবাদ ভুলে গিয়ে মায়ের আদর-শাসনে একত্রে রয়েছে; তারা আমাদেরও একত্রে থাকার শিক্ষা দিচ্ছে। প্রকৃতির দেবী বলে অপর নাম শাকম্ভরী। প্রকৃতি পূজায় গাছপালা ও প্রাণীগুলোর প্রতি ভালোবাসা থাকার শিক্ষা দেয়, তাদের প্রতি যতœশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়। আমাদের জীবনও সুস্থ, সুন্দর ও শান্তিময় হয়। তাই তো হাজার বছর পূর্বে আর্য-ঋষিগণবিভিন্ন প্রাণী ও প্রকৃতি পূজার বিধান করে দিয়েছেন।
শারদীয় শ্রী শ্রী দুর্গাপূজা সর্বজনীন উৎসব। দুর্গাদেবীর সঙ্গে অন্যান্য দেব-দেবীও আছে। মন্ত্রেও সর্বজনীনতা- “তিষ্ঠ দেবগণৈঃ সহ।” দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহারেও রয়েছে সর্বজনীনতা, সবার সম্পৃক্ততা। সপ্তঘাটের জল থেকে শিশির কতা, দেবদ্বার, বেশ্যাদ্বারের ‘মৃত্তিকা’ অনেক কিছু শ্রী শ্রী দুর্গাপূজায় লাগে। কারণ, সব মিলেই সমাজ। বেশ্যাদ্বারের মাটি কী ও কেন লাগে তা না জেনে কেউ ভিন্নভাবে প্রয়োগ করলে কিছু করার নেই।
অথচ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, কাঞ্চী দ্বারাবতীচৈব অবন্তিকাচ মথুরা/ অযোধ্যা মায়াতীর্থঞ্চ দ্বারকাতীর্থ মে বচ।/এতানি সপ্তানি সপ্তবেশ্যা প্রকীর্তিতা॥ এর অর্থ হলো- কাঞ্চী, দ্বারাবতী, অবন্তী, মথুরা, অযোধ্যা, মায়াতীর্থ, দ্বারকা এই সপ্তস্থান সপ্তবেশ্যা বলে খ্যাত। তন্ত্রোক্ত মহানির্বাণতন্ত্রের বচনে- “অভিষিক্তা ভবদ্বেশ্যা ন বেশ্যা কুলটা প্রিয়ে, রৌববং নরকং ব্রজেৎ॥” এখানে বেশ্যা শব্দটি কুলটা নয়, কুলটা বেশ্যা রৌরব নরকে গমন করে। দশমহাবদ্যিায় পূর্ণাভষিক্তি ব্রহ্মবাদিনী নারীকইে এখানে বেশ্যা বলা হচ্ছে। “বেশ্যা ন তু পতিতায়াং বেশ্যং ত্রিলোকং ততৌ বেশ্যা॥” এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে বেশ্যা মানে পতিতা নয়; ত্রিলোক যাঁর বশে তিনিই বেশ্যা।
লক্ষ্য ও মনে রাখার বিষয় হলো- হিন্দুরা মূর্তি বা প্রতিমা পূজা করে না, প্রতিমাতে/ মূর্তিতে পূজা করে। যেমন : আগুনকে এমনিতেই ধারণ করা যায় না। তার জন্য একটা মাধ্যম কাঠ, কয়লা, কাগজ, সলতে ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। ঠিক তেমনি মূর্তি ব্যবহার, আবারনিরাকার উপাসনা করা যায়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ১২/৫ শ্লোকে শ্রীভগবান বলেছেন- ক্লেশোধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম।/ অব্যক্তা হি গতির্দুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে॥ অর্থাৎ যারা অব্যক্ত নির্বিশেষ ব্রহ্মের আরাধনা করেন, তাদের সিদ্ধিলাভ অধিকতর কষ্টসাধ্য। কারণ, দেহধারী জীবদের পক্ষে ব্রহ্মে মনস্থির করা কঠিন ও দুঃখময়।
কিন্তু মূর্তি সামনে থাকলে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা সহজ হয়। প্রকৃত পক্ষে মূর্তিকে পূজা করা হয় না। ঈশ্বরকে কল্পনা করেই পূজা করা হয়। মূর্তি বা প্রতিমা শুধু মনকে স্থির করে। যেমন- চিত্র না এঁকে উপপাদ্য প্রমাণ করা কঠিন। চিত্র থাকলে প্রমাণ করা সহজ। সাকার-নিরাকার যেভাবে ভজনাকরে ভগবান সেভাবেই তাকে তুষ্ট করে থাকেন। প্রতিমার মাধুর্যতা, পূজকের মনের শুদ্ধ ভক্তি নিবেদন এবং পবিত্র স্থানে পূজা একান্ত প্রয়োজন।
দেবীর কাঠামোতে সুর বা দেবশক্তি লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, চালচিত্রে আছেন মঙ্গলকারী শিব; আছে অসুর শক্তি মহিষাসুর এবং তাঁদের বাহনেও রয়েছে শান্তি শিক্ষার কথা। সমাজের নিচু থেকে উঁচু শ্রেণীর পেশায় নিয়োজিত সবার অংশগ্রহণ থাকে এ পূজায়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আনন্দ উপভোগ করে, একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পূজায় মায়ের চরণে অঞ্জলি নিবেদন করে। ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত ৫ (পাঁচ) দিনব্যাপী মহাসমারোহে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কারণ, পূজা- ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক করার উত্তম পথ। আমাদের জীবনে প্রয়োগের অভাবেই অশান্তি। আর সব অশুভ শক্তি তথা অসুরকে পরাজিত করে, দশমী তিথিতে বিজয় লাভ করে। এ শুভ শক্তির জয়ই শুভ বিজয়া দশমী।
শুভ বিজায়ায় চলে অবাধ মিলন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সব ধর্মমতের লোকজনের সঙ্গে উদারচিত্তে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। দর্পণ বিসর্জনের পর মা মহামায়ার অপার শক্তিময়ী মাতৃমন্ডলী শক্তির প্রতীক সিঁদুর দেবীর চরণে উৎসর্গ করে একে অন্যের কপালে ছোঁয়ায়। আর আনন্দের সঙ্গে একে অন্যের শান্তির প্রার্থনা করে। ঐক্যের সুতায় এই উৎসব সবার মিলনমেলায় পরিণত হয়। তাই এই উৎসব একটি সর্বজনীন ও জাতীয় উৎসব। এই উৎসবের যথার্থ শিক্ষা নিয়ে পথ চললে সমাজে শান্তি বিরাজ অবশ্যম্ভাবী।
শ্রী শ্রী দুর্গা মায়ের অপার করুণা! মাতৃকরুণাতেই যতক্ষণ আমরা মায়ের সঙ্গে থাকি ততক্ষণ আমাদের কারও দুঃখ থাকে না। মাতৃক্রোড়েই সন্তানের সর্বশ্রেষ্ট শান্তির স্থল, মাতৃস্পর্শে সন্তান শান্তি লাভ করে। মায়ের মমতা ও ভালোবাসায় মা মহামায়া সবার মনে প্রকৃত ‘শান্তি’ দান করুন। শান্তিময়ীর দেবীর কাছে সে প্রার্থনা। সবার ত্রিবিধ শান্তি হোক।
[লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি]