রেজাউল করিম খোকন
ফোর্বসের বর্ষসেরা তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশি দূরশিক্ষণ অ্যাপ শিখো। ব্যবসা-বাণিজ্য ও পুঁজিবিষয়ক বিশ্বখ্যাত এ সাময়িকীর মতে, এ বছর এশিয়ার সেরা এক শ স্টার্টআপের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের শিখো। ফোর্বসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব ক্ষুদ্র কোম্পানি ও স্টার্টআপ নতুন ভাবনার সমন্বয় ঘটিয়ে সৃজনশীল পণ্য ও সেবার মাধ্যমে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সমাধানে কাজ করে চলেছে, ‘এশিয়া ১০০ টু ওয়াচ ২০২২’ তালিকায় সেসব কোম্পানিকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে স্টার্টআপের যে উত্থান ঘটেছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের মেধাবী তরুণরাও যুগোপযোগী স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারাবিশ্বে দেশের একটি স্বতন্ত্র পরিচিত গড়ে তুলেছে। বৈশ্বিক স্টার্টআপ মানচিত্রে বাংলাদেশের উজ্জ্বল সংযোজন শিখো। ২০১৯ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশে শেখার বিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে হাইপার-লোকালাইজড ডিজিটাল লার্নিং ইকোসিস্টেম তৈরি করে যাচ্ছে শিখো। দেশজুড়ে সব শিক্ষার্থীর জন্য মানসম্মত শিক্ষা সহজলভ্য করতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। দুই রাউন্ড মিলিয়ে শিখো মোট ৫৩ লাখ মার্কিন ডলার (৪৫ কোটি টাকা) বৈশ্বিক বিনিয়োগ পেয়েছে, যা এখন পর্যন্ত কোন বাংলাদেশি স্টার্টআপের সবচেয়ে বড় সিড রাউন্ড। এতে বিনিয়োগ করেছেন সিলিকন ভ্যালি ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক লগ্নিকারকরা।
বাংলাদেশে ‘স্টার্টআপ’ শব্দটি প্রায়ই ‘নতুন উদ্যোগ’-এর একটা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার হয়। যদিও অনুবাদ করলে স্টার্টআপের অর্থ দাঁড়ায় নতুন ব্যবসা। ধরে নেয়া যেতে পারে, সব স্টার্টআপই নতুন উদ্যোগ, তবে সব নতুন উদ্যোগ যে স্টার্টআপ, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। যে কোন নতুন উদ্যোগ হয় স্টার্টআপ, নয়তো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ বা এসএমই। তবে উদ্যোগটা স্টার্টআপ নাকি একটি এসএমই-এই চিন্তাধারাই প্রভাবিত করবে কোম্পানির ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত, ব্যবসায়িক বিকাশ এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদনের যোগ্যতা।
এসএমই এবং স্টার্টআপের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো একটা এসএমই, যা ১০ বছরে করে, একটা স্টার্টআপ সেটা ১ বছরে, অথবা তারও কমে করার স্বপ্ন দেখে। যে কোন স্টার্টআপ থেকে বিনিয়োগকারীরা সবার আগে যা আশা করে, তা হলো ব্যবসা প্রসার করতে পারার সম্ভাবনা। সে জন্য সবার আগেই প্রয়োজন, একটা বড় বাজার বা মার্কেট নিয়ে কাজ করা। বড় অর্থাৎ শুধু কতজন গ্রাহক আছেন তা নয়, বরং মোট কত টাকার ব্যবসা করা সম্ভব, সেটা। কোন কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা থেকে নিজের কোন বিজনেস আইডিয়া থেকে কিছু শুরু করাকেই বলা যেতে পারে স্টার্টআপ।
প্রতিটি স্টার্টআপের সহজ বাংলা ভাষায় উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতাকে বলা হয় একেকজন উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তাকে ইংরেজিতে বলা হয় এন্ট্রাপ্রেনিউর। আর এই এন্ট্রাপ্রেনিউর তথা এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ শব্দটির সঙ্গে বর্তমান সময়ে আমরা অনেক বেশি পরিচিত। একটি স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠাতা কিংবা উদ্যোক্তা তার দেখা স্বপ্ন থেকে নতুন কোন একটি কিছু সমাজকে উপহার দেয়, যা ইতিপূর্বে ছিলনা কিংবা কেউ করেনি। স্টার্টআপ যে এমন হতে হবে কেউ আগে কখনো করেনি, এমনো কিন্তু নয়। স্টার্টআপগুলো এমনও হতে পারে যে, সেই ধারণাগুলো ইতিপূর্বেও ছিল, তবে সেটিকে নতুন ধাচে ভিন্ন কোন উপায়ে শুরু করা হয়েছে। উন্নত বিশ্বে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যে, কোন স্টার্টআপ খুব অল্প সময়ে বিকশিত হয়ে সেটি একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতেও রূপান্তরিত হয়েছে। ফেসবুক যখন মার্ক জাকারবার্গ শুরু করেছিলেন, তখন কিন্তু তিনি ভাবেননি ফেসবুক এত বড় পরিমাণে সম্প্রসারিত হবে। তবে আজ আমরা দেখছি যে, মার্ক জাকারবার্গ এই স্টার্টআপ পৃথিবীর অন্যতম বড় আইটি কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। আর ফেসবুক (বর্তমান মেটা) হয়ে গিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট।
টাকার জন্য অপেক্ষা কিংবা যাতায়াত খরচের ঝক্কিঝামেলা পোহানোর চেয়ে মুহূর্তেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনদেন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দেশের মানুষের কাছে। ক্রমান্বয়ে মোবাইল ব্যাংকিং এখন দেশের মানুষের ভরসার জায়গায় পরিণত হয়েছে। ২০১০ সালে শুরু হওয়া মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশ দেশের প্রথম সফল স্টার্টআপ। এরপর একে একে আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান উঠে আসে। স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগে গাড়ি থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজের লোক খোঁজা-সবকিছুই এখন হাতের মুঠোয়।
সম্ভাবনাময় এ খাতে দেশি-বিদেশি অনেক উদ্যোক্তাই এগিয়ে আসছেন। ২০২১ থেকে ২০২২ সালে তাই ১০ গুণ বেড়েছে স্টার্টআপ বিনিয়োগ। তবে এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এখনো বেশ পিছিয়ে। দেরিতে শুরু করার কারণেই তুলনামূলক কম এগিয়েছে দেশ। অবশ্য এ খাতে বৈপ্লবিক সাফল্য সময়ের ব্যাপার। স্টার্টআপ বিনিয়োগে বাংলাদেশের ওপরে আছে এশিয়ার পাঁচটি দেশ। পেছনে আছে পাকিস্তান। এ সময়ে শীর্ষস্থানে থাকা সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এর পরই চীনের অবস্থান। ২০২১ থেকে ২০২২ সালে দেশটির বিনিয়োগ ছিল ১০ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে ভারত আছে তৃতীয় স্থানে। এ ছাড়া ফিলিপাইনে ১০০ কোটি, ভিয়েতনামে ১০০ কোটি ও পাকিস্তানে স্টার্টআপ বিনিয়োগ হয়েছে ৩৪ কোটি ১০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশে স্টার্টআপ বিনিয়োগ হয়েছে ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। যদিও বাংলাদেশে বিনিয়োগের হার সবচেয়ে বেশি, ৯৪০ শতাংশ। এ সময়ে পাকিস্তানে স্টার্টআপে বিনিয়োগ বেড়েছে ৪৩৫ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৩৩০, ভারতে ২৬৫, ফিলিপাইনে ১৮০, সিঙ্গাপুরে ১৮০ ও চীনে ৪৯ শতাংশ। বাংলাদেশে স্টার্টআপ বিনিয়োগ বাড়াতে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। এখন পর্যন্ত ১১টি হাই-টেক পার্কে অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে। প্রতিটি অবকাঠামোতেই একটি ফ্লোর স্টার্টআপের জন্য ফ্রি দেয়া হচ্ছে। এ জন্য তাদের কোন পয়সা দিতে হয় না। এমনকি বিনামূল্যে বৈদ্যুতিক সরবরাহ, বিনামূল্যে ইন্টারনেট, বিনামূল্যে ট্রেনিং, মেন্টরও বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বিশেষ স্টার্টআপদের ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সিড ফান্ড ফ্রি একটি বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে।
সরকার স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডকে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। কোম্পানিটি কোন ইন্টারেস্ট ছাড়াই সহজ শর্তে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত পুঁজি সরবরাহ দিয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত হাই-টেক পার্কে ফ্রি ইন্টারনেট, ফ্রি ট্রেনিং, ফ্রি স্পেস দেয়া হয়েছে ১৫১টি কোম্পানিকে। সিড ফান্ড দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে। এখন দেশের বাইরের অনেক কোম্পানিও এসেছে স্টার্টআপদের ফান্ডিংয়ের জন্য। সরকার ফ্রিল্যান্সারদের পাশাপাশি স্টার্টআপদেরও স্বীকৃতির ব্যবস্থা করেছেন। তাদের আইডি কার্ডের ব্যবস্থা করা, এটা যেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ার মতো হয়, সেটি দিয়ে তারা যেন ব্যাংক ঋণ পায় সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে। পুঁজি সরবরাহ দিয়ে ব্যাংকগুলো বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে এ ক্ষেত্রে। নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্টার্টআপ ফান্ড নিয়ে কাজ করছে।
কারণ, একশটি স্টার্টআপের মধ্যে ৫টি সফল হয় আর তার মধ্যে দুই-একটি হয় বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান। এটা হলেও তা অর্থনৈতিক খাতে বড় ধরনের উন্নয়ন ঘটতে পারে। এত সুবিধা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন এখনো এশিয়ার তলানিতে? বাংলাদেশ শুরুই করেছি অনেক পরে। বাংলাদেশর পাঁচ বছর আগে ভারত শুরু করেছে, স্বাভাবিকভাবেই তারা চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তবে আগামী পাঁচ বছর পর তুলনামূলক বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার হার ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণে নয়, বরং একটা আনুপাতিক হারে আমরা ভারতকে ছাড়িয়ে যাব। শুরুর বিবেচনায় দেশের স্টার্টআপে বিনিয়োগ এখন পরিপক্ব হচ্ছে। এ খাতে সরকার ও ব্যক্তি খাতের সমন্বয়ের একটা সময় ছিল। আমাদের স্টার্টআপদের তখন দেশের ব্যাংকই বিশ্বাস করত না, বিদেশি বিনিয়োগ আসবে কীভাবে?
সরকার অবশ্য এখন এ খাতে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। তাই গত দুই বছর ধরে ভালো করছে স্টার্টআপ উদ্যোগগুলো। আমাদের পরিপক্বতা অর্জনের সময় এখন। সামনের দিনগুলোতে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগও সমন্বয় হলে এ খাতে আমাদের সম্ভাবনা ব্যাপক। স্টার্টআপদের বিষয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নতুন করে ভাবা উচিত। আমাদের দেশে স্টার্টআপ বিনিয়োগের পথচলা বেশি দিনের নয়। মূলত এ কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা পেছনে আছি। তরুণ প্রজন্মের নিত্যনতুন ব্যবসা ধারণার সন্নিবেশ ঘটিয়ে অর্থনীতিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে স্টার্টআপ।
তরুণ প্রজন্ম স্টার্টআপ বিজনেসে এগিয়ে এসেছে। তারা মূলত আইসিটিনির্ভর স্টার্টআপ ফার্ম নিয়ে কাজ করছে। আর স্টার্টআপ ফার্ম মানে কিন্তু এমন নয় যে, ১০০টা শুরু করলে ১০০টাই দাঁড়িয়ে যাবে। আমাদের যদি ১০ থেকে ২০ শতাংশ সফল হয় তাহলেও কিন্তু অনেক। আমাদের নতুন প্রজন্মের তরুণ বয়সী ছেলেমেয়েরা অসাধারণ মেধাবী। তাদের মধ্যে নিত্যনতুন আইডিয়া, নতুন নতুন ব্যবসা উদ্যোগের অসাধারণ চিন্তাভাবনা রয়েছে। একসময় এ খাত গার্মেন্টকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী হতে পারি। আইসিটি ডিভিশনের পাশাপাশি বিডা থেকেও এদের নিয়ে ভাবা জরুরি। এতে দেশ ও দেশের অর্থনীতিই উপকৃত হবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
শুক্রবার, ০৭ অক্টোবর ২০২২
ফোর্বসের বর্ষসেরা তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশি দূরশিক্ষণ অ্যাপ শিখো। ব্যবসা-বাণিজ্য ও পুঁজিবিষয়ক বিশ্বখ্যাত এ সাময়িকীর মতে, এ বছর এশিয়ার সেরা এক শ স্টার্টআপের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের শিখো। ফোর্বসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব ক্ষুদ্র কোম্পানি ও স্টার্টআপ নতুন ভাবনার সমন্বয় ঘটিয়ে সৃজনশীল পণ্য ও সেবার মাধ্যমে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সমাধানে কাজ করে চলেছে, ‘এশিয়া ১০০ টু ওয়াচ ২০২২’ তালিকায় সেসব কোম্পানিকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে স্টার্টআপের যে উত্থান ঘটেছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের মেধাবী তরুণরাও যুগোপযোগী স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারাবিশ্বে দেশের একটি স্বতন্ত্র পরিচিত গড়ে তুলেছে। বৈশ্বিক স্টার্টআপ মানচিত্রে বাংলাদেশের উজ্জ্বল সংযোজন শিখো। ২০১৯ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশে শেখার বিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে হাইপার-লোকালাইজড ডিজিটাল লার্নিং ইকোসিস্টেম তৈরি করে যাচ্ছে শিখো। দেশজুড়ে সব শিক্ষার্থীর জন্য মানসম্মত শিক্ষা সহজলভ্য করতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। দুই রাউন্ড মিলিয়ে শিখো মোট ৫৩ লাখ মার্কিন ডলার (৪৫ কোটি টাকা) বৈশ্বিক বিনিয়োগ পেয়েছে, যা এখন পর্যন্ত কোন বাংলাদেশি স্টার্টআপের সবচেয়ে বড় সিড রাউন্ড। এতে বিনিয়োগ করেছেন সিলিকন ভ্যালি ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক লগ্নিকারকরা।
বাংলাদেশে ‘স্টার্টআপ’ শব্দটি প্রায়ই ‘নতুন উদ্যোগ’-এর একটা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার হয়। যদিও অনুবাদ করলে স্টার্টআপের অর্থ দাঁড়ায় নতুন ব্যবসা। ধরে নেয়া যেতে পারে, সব স্টার্টআপই নতুন উদ্যোগ, তবে সব নতুন উদ্যোগ যে স্টার্টআপ, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। যে কোন নতুন উদ্যোগ হয় স্টার্টআপ, নয়তো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ বা এসএমই। তবে উদ্যোগটা স্টার্টআপ নাকি একটি এসএমই-এই চিন্তাধারাই প্রভাবিত করবে কোম্পানির ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত, ব্যবসায়িক বিকাশ এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদনের যোগ্যতা।
এসএমই এবং স্টার্টআপের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো একটা এসএমই, যা ১০ বছরে করে, একটা স্টার্টআপ সেটা ১ বছরে, অথবা তারও কমে করার স্বপ্ন দেখে। যে কোন স্টার্টআপ থেকে বিনিয়োগকারীরা সবার আগে যা আশা করে, তা হলো ব্যবসা প্রসার করতে পারার সম্ভাবনা। সে জন্য সবার আগেই প্রয়োজন, একটা বড় বাজার বা মার্কেট নিয়ে কাজ করা। বড় অর্থাৎ শুধু কতজন গ্রাহক আছেন তা নয়, বরং মোট কত টাকার ব্যবসা করা সম্ভব, সেটা। কোন কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা থেকে নিজের কোন বিজনেস আইডিয়া থেকে কিছু শুরু করাকেই বলা যেতে পারে স্টার্টআপ।
প্রতিটি স্টার্টআপের সহজ বাংলা ভাষায় উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতাকে বলা হয় একেকজন উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তাকে ইংরেজিতে বলা হয় এন্ট্রাপ্রেনিউর। আর এই এন্ট্রাপ্রেনিউর তথা এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ শব্দটির সঙ্গে বর্তমান সময়ে আমরা অনেক বেশি পরিচিত। একটি স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠাতা কিংবা উদ্যোক্তা তার দেখা স্বপ্ন থেকে নতুন কোন একটি কিছু সমাজকে উপহার দেয়, যা ইতিপূর্বে ছিলনা কিংবা কেউ করেনি। স্টার্টআপ যে এমন হতে হবে কেউ আগে কখনো করেনি, এমনো কিন্তু নয়। স্টার্টআপগুলো এমনও হতে পারে যে, সেই ধারণাগুলো ইতিপূর্বেও ছিল, তবে সেটিকে নতুন ধাচে ভিন্ন কোন উপায়ে শুরু করা হয়েছে। উন্নত বিশ্বে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যে, কোন স্টার্টআপ খুব অল্প সময়ে বিকশিত হয়ে সেটি একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতেও রূপান্তরিত হয়েছে। ফেসবুক যখন মার্ক জাকারবার্গ শুরু করেছিলেন, তখন কিন্তু তিনি ভাবেননি ফেসবুক এত বড় পরিমাণে সম্প্রসারিত হবে। তবে আজ আমরা দেখছি যে, মার্ক জাকারবার্গ এই স্টার্টআপ পৃথিবীর অন্যতম বড় আইটি কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। আর ফেসবুক (বর্তমান মেটা) হয়ে গিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট।
টাকার জন্য অপেক্ষা কিংবা যাতায়াত খরচের ঝক্কিঝামেলা পোহানোর চেয়ে মুহূর্তেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনদেন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দেশের মানুষের কাছে। ক্রমান্বয়ে মোবাইল ব্যাংকিং এখন দেশের মানুষের ভরসার জায়গায় পরিণত হয়েছে। ২০১০ সালে শুরু হওয়া মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশ দেশের প্রথম সফল স্টার্টআপ। এরপর একে একে আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান উঠে আসে। স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগে গাড়ি থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজের লোক খোঁজা-সবকিছুই এখন হাতের মুঠোয়।
সম্ভাবনাময় এ খাতে দেশি-বিদেশি অনেক উদ্যোক্তাই এগিয়ে আসছেন। ২০২১ থেকে ২০২২ সালে তাই ১০ গুণ বেড়েছে স্টার্টআপ বিনিয়োগ। তবে এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এখনো বেশ পিছিয়ে। দেরিতে শুরু করার কারণেই তুলনামূলক কম এগিয়েছে দেশ। অবশ্য এ খাতে বৈপ্লবিক সাফল্য সময়ের ব্যাপার। স্টার্টআপ বিনিয়োগে বাংলাদেশের ওপরে আছে এশিয়ার পাঁচটি দেশ। পেছনে আছে পাকিস্তান। এ সময়ে শীর্ষস্থানে থাকা সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এর পরই চীনের অবস্থান। ২০২১ থেকে ২০২২ সালে দেশটির বিনিয়োগ ছিল ১০ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে ভারত আছে তৃতীয় স্থানে। এ ছাড়া ফিলিপাইনে ১০০ কোটি, ভিয়েতনামে ১০০ কোটি ও পাকিস্তানে স্টার্টআপ বিনিয়োগ হয়েছে ৩৪ কোটি ১০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশে স্টার্টআপ বিনিয়োগ হয়েছে ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। যদিও বাংলাদেশে বিনিয়োগের হার সবচেয়ে বেশি, ৯৪০ শতাংশ। এ সময়ে পাকিস্তানে স্টার্টআপে বিনিয়োগ বেড়েছে ৪৩৫ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৩৩০, ভারতে ২৬৫, ফিলিপাইনে ১৮০, সিঙ্গাপুরে ১৮০ ও চীনে ৪৯ শতাংশ। বাংলাদেশে স্টার্টআপ বিনিয়োগ বাড়াতে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। এখন পর্যন্ত ১১টি হাই-টেক পার্কে অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে। প্রতিটি অবকাঠামোতেই একটি ফ্লোর স্টার্টআপের জন্য ফ্রি দেয়া হচ্ছে। এ জন্য তাদের কোন পয়সা দিতে হয় না। এমনকি বিনামূল্যে বৈদ্যুতিক সরবরাহ, বিনামূল্যে ইন্টারনেট, বিনামূল্যে ট্রেনিং, মেন্টরও বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বিশেষ স্টার্টআপদের ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সিড ফান্ড ফ্রি একটি বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে।
সরকার স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডকে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। কোম্পানিটি কোন ইন্টারেস্ট ছাড়াই সহজ শর্তে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত পুঁজি সরবরাহ দিয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত হাই-টেক পার্কে ফ্রি ইন্টারনেট, ফ্রি ট্রেনিং, ফ্রি স্পেস দেয়া হয়েছে ১৫১টি কোম্পানিকে। সিড ফান্ড দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে। এখন দেশের বাইরের অনেক কোম্পানিও এসেছে স্টার্টআপদের ফান্ডিংয়ের জন্য। সরকার ফ্রিল্যান্সারদের পাশাপাশি স্টার্টআপদেরও স্বীকৃতির ব্যবস্থা করেছেন। তাদের আইডি কার্ডের ব্যবস্থা করা, এটা যেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ার মতো হয়, সেটি দিয়ে তারা যেন ব্যাংক ঋণ পায় সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে। পুঁজি সরবরাহ দিয়ে ব্যাংকগুলো বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে এ ক্ষেত্রে। নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্টার্টআপ ফান্ড নিয়ে কাজ করছে।
কারণ, একশটি স্টার্টআপের মধ্যে ৫টি সফল হয় আর তার মধ্যে দুই-একটি হয় বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান। এটা হলেও তা অর্থনৈতিক খাতে বড় ধরনের উন্নয়ন ঘটতে পারে। এত সুবিধা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন এখনো এশিয়ার তলানিতে? বাংলাদেশ শুরুই করেছি অনেক পরে। বাংলাদেশর পাঁচ বছর আগে ভারত শুরু করেছে, স্বাভাবিকভাবেই তারা চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তবে আগামী পাঁচ বছর পর তুলনামূলক বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার হার ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণে নয়, বরং একটা আনুপাতিক হারে আমরা ভারতকে ছাড়িয়ে যাব। শুরুর বিবেচনায় দেশের স্টার্টআপে বিনিয়োগ এখন পরিপক্ব হচ্ছে। এ খাতে সরকার ও ব্যক্তি খাতের সমন্বয়ের একটা সময় ছিল। আমাদের স্টার্টআপদের তখন দেশের ব্যাংকই বিশ্বাস করত না, বিদেশি বিনিয়োগ আসবে কীভাবে?
সরকার অবশ্য এখন এ খাতে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। তাই গত দুই বছর ধরে ভালো করছে স্টার্টআপ উদ্যোগগুলো। আমাদের পরিপক্বতা অর্জনের সময় এখন। সামনের দিনগুলোতে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগও সমন্বয় হলে এ খাতে আমাদের সম্ভাবনা ব্যাপক। স্টার্টআপদের বিষয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নতুন করে ভাবা উচিত। আমাদের দেশে স্টার্টআপ বিনিয়োগের পথচলা বেশি দিনের নয়। মূলত এ কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা পেছনে আছি। তরুণ প্রজন্মের নিত্যনতুন ব্যবসা ধারণার সন্নিবেশ ঘটিয়ে অর্থনীতিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে স্টার্টআপ।
তরুণ প্রজন্ম স্টার্টআপ বিজনেসে এগিয়ে এসেছে। তারা মূলত আইসিটিনির্ভর স্টার্টআপ ফার্ম নিয়ে কাজ করছে। আর স্টার্টআপ ফার্ম মানে কিন্তু এমন নয় যে, ১০০টা শুরু করলে ১০০টাই দাঁড়িয়ে যাবে। আমাদের যদি ১০ থেকে ২০ শতাংশ সফল হয় তাহলেও কিন্তু অনেক। আমাদের নতুন প্রজন্মের তরুণ বয়সী ছেলেমেয়েরা অসাধারণ মেধাবী। তাদের মধ্যে নিত্যনতুন আইডিয়া, নতুন নতুন ব্যবসা উদ্যোগের অসাধারণ চিন্তাভাবনা রয়েছে। একসময় এ খাত গার্মেন্টকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী হতে পারি। আইসিটি ডিভিশনের পাশাপাশি বিডা থেকেও এদের নিয়ে ভাবা জরুরি। এতে দেশ ও দেশের অর্থনীতিই উপকৃত হবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]