মিথুশিলাক মুরমু
কিছুদিন আগে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। কার্যালয়ের প্রধান ফটকের লেখায় চোখ আটকে যায়। সেখানে লেখা রয়েছে- ‘ধর্মীয় রাষ্ট্র নয় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই ॥ ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার।’ কার্যালয়ের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সি আর দত্তের প্রতিকৃতি। তার নিচে লেখা- ‘রাষ্ট্রধর্ম করার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি।’ এ যাবৎ শতাধিক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করার সুযোগ পেয়েছি। প্রশ্ন করেছি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি, এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী? দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিলো- রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সম্পর্কে। প্রত্যেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন। তারা বলেছেন, এটি আমাদের প্রত্যাশা ছিলো না। জাতির পিতা যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সেটিতে ছিলো সম্প্রীতি, সৌহার্দ, পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ব এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের।
স্বাধীন দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও লক্ষ লক্ষ মা-বোনের ত্যাগের বিনিময়ে সোনার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। পঁচাত্তরের পরে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা নির্বাসিত হতে শুরু করে। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে একটি ধর্মকে সামনে এনে জাতিকে বিভাজিত করতে সংবিধানের মাথায় তুলে দেওয়া হয়েছিলো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। পঞ্চদশ সংশোধনীতে স্বাধীনতার পক্ষের দল সেটাকে আরও সুন্দর করে লিখল- ‘দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে’ তার সঙ্গে যোগ করল ‘পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে’। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন মহান জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছিলো- ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও শান্তিতে পালন করা যাইবে।’ তখন সামরিক সরকারের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার মেজর জেনারেল সি আর দত্তের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।’ এর প্রতিবাদে তৎকালীন স্পিকার শামসুল হুদার কাছে প্রতিবাদ স্মারকলিপি পৌঁছে দিয়েছিলেন। সেদিনের স্মারকলিপিতে বলা হয়েছিলো- ‘এ বিল পাস করা হলে বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী থেকে কালক্রমে ইসলামি প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হবে।’ আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের হৃদয় আকাশে এটিই স্পষ্ট হচ্ছে যে, দেশ আজ ওই দিকেই ছুটে চলেছে।
ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে দেখানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘুরা দেশান্তরিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেখা গেছে, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব বাংলায় ২৯ দশমিক ৭ ভাগ ছিলো ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে এসে দাঁড়ায় ২০ শতাংশে; আর স্বাধীনতা উদযাপন করেছে মাত্র ১০ শতাংশ সংখ্যালঘু। বাকি ৩৭ শতাংশ স্থানচ্যুত হয়েছে ও নিরাপদ পোতাশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের উলসী চেতনা বৃহত্তর রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তির মধ্যেও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসছে। মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিজ নিজ প্রধান প্রধান উৎসব ও অনুষ্ঠানাদি উদযাপন করতে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে; এটি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকেও অস্বস্তিতে ফেলেছে। বিগত বছরগুলোতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সরব উপস্থিতির পরও কুমিল্লা, রংপুর, রামু ও নাসিরনগরের মতো জাতীয় দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। রাষ্ট্র নিরাপত্তা ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।
আওয়ামী লীগ দীর্ঘ প্রায় চৌদ্দ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সামনে থেকে দেশকে, দলকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। তারপরও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হৃদয় আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। অপরদিকে জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসছে, জাতীয় নির্বাচন আসা মানেই হচ্ছে- নির্যাতন, অত্যাচার, অবিচার ও উচ্ছেদের টেনশন। নির্বাচন হচ্ছে সংখ্যালঘুদের জন্য শাখের করাত। ভোট দিলেও বিপদ, ভোট না দিলেও বিপদ।
আদিবাসীদের নাগরিক অধিকার, রাষ্ট্রীয় অধিকারগুলো ভোগ ও চর্চা করার নিশ্চয়তা, নিরাপদে বসবাস ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা খুবই দরকার। আর এটির মূল শেকড়ই হচ্ছে-ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে সাম্প্রদায়িকতাকে আবর্জনাস্বরূপ ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে হবে।
সাম্প্রদায়িকতাই জাতি ও দেশের উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায়। আমরা আশা করতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতির পিতার স্বপ্ন ধর্মনিরপেক্ষতা নীতিকে বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার উদ্যোগী হবে।
[লেখক : কলামিস্ট]
মিথুশিলাক মুরমু
সোমবার, ১৪ নভেম্বর ২০২২
কিছুদিন আগে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। কার্যালয়ের প্রধান ফটকের লেখায় চোখ আটকে যায়। সেখানে লেখা রয়েছে- ‘ধর্মীয় রাষ্ট্র নয় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই ॥ ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার।’ কার্যালয়ের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সি আর দত্তের প্রতিকৃতি। তার নিচে লেখা- ‘রাষ্ট্রধর্ম করার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি।’ এ যাবৎ শতাধিক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করার সুযোগ পেয়েছি। প্রশ্ন করেছি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি, এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী? দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিলো- রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সম্পর্কে। প্রত্যেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন। তারা বলেছেন, এটি আমাদের প্রত্যাশা ছিলো না। জাতির পিতা যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সেটিতে ছিলো সম্প্রীতি, সৌহার্দ, পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ব এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের।
স্বাধীন দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও লক্ষ লক্ষ মা-বোনের ত্যাগের বিনিময়ে সোনার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। পঁচাত্তরের পরে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা নির্বাসিত হতে শুরু করে। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে একটি ধর্মকে সামনে এনে জাতিকে বিভাজিত করতে সংবিধানের মাথায় তুলে দেওয়া হয়েছিলো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। পঞ্চদশ সংশোধনীতে স্বাধীনতার পক্ষের দল সেটাকে আরও সুন্দর করে লিখল- ‘দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে’ তার সঙ্গে যোগ করল ‘পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে’। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন মহান জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছিলো- ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও শান্তিতে পালন করা যাইবে।’ তখন সামরিক সরকারের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার মেজর জেনারেল সি আর দত্তের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।’ এর প্রতিবাদে তৎকালীন স্পিকার শামসুল হুদার কাছে প্রতিবাদ স্মারকলিপি পৌঁছে দিয়েছিলেন। সেদিনের স্মারকলিপিতে বলা হয়েছিলো- ‘এ বিল পাস করা হলে বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী থেকে কালক্রমে ইসলামি প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হবে।’ আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের হৃদয় আকাশে এটিই স্পষ্ট হচ্ছে যে, দেশ আজ ওই দিকেই ছুটে চলেছে।
ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে দেখানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘুরা দেশান্তরিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেখা গেছে, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব বাংলায় ২৯ দশমিক ৭ ভাগ ছিলো ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে এসে দাঁড়ায় ২০ শতাংশে; আর স্বাধীনতা উদযাপন করেছে মাত্র ১০ শতাংশ সংখ্যালঘু। বাকি ৩৭ শতাংশ স্থানচ্যুত হয়েছে ও নিরাপদ পোতাশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের উলসী চেতনা বৃহত্তর রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তির মধ্যেও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসছে। মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিজ নিজ প্রধান প্রধান উৎসব ও অনুষ্ঠানাদি উদযাপন করতে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে; এটি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকেও অস্বস্তিতে ফেলেছে। বিগত বছরগুলোতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সরব উপস্থিতির পরও কুমিল্লা, রংপুর, রামু ও নাসিরনগরের মতো জাতীয় দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। রাষ্ট্র নিরাপত্তা ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।
আওয়ামী লীগ দীর্ঘ প্রায় চৌদ্দ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সামনে থেকে দেশকে, দলকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। তারপরও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হৃদয় আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। অপরদিকে জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসছে, জাতীয় নির্বাচন আসা মানেই হচ্ছে- নির্যাতন, অত্যাচার, অবিচার ও উচ্ছেদের টেনশন। নির্বাচন হচ্ছে সংখ্যালঘুদের জন্য শাখের করাত। ভোট দিলেও বিপদ, ভোট না দিলেও বিপদ।
আদিবাসীদের নাগরিক অধিকার, রাষ্ট্রীয় অধিকারগুলো ভোগ ও চর্চা করার নিশ্চয়তা, নিরাপদে বসবাস ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা খুবই দরকার। আর এটির মূল শেকড়ই হচ্ছে-ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে সাম্প্রদায়িকতাকে আবর্জনাস্বরূপ ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে হবে।
সাম্প্রদায়িকতাই জাতি ও দেশের উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায়। আমরা আশা করতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতির পিতার স্বপ্ন ধর্মনিরপেক্ষতা নীতিকে বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার উদ্যোগী হবে।
[লেখক : কলামিস্ট]