বাবুল রবিদাস
ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানরা
আদিবাসী আইন দ্বারা পরিচালিত হবেন কিনা এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন সরকারি সুযোগ সুবিধা তারা পাবেন কিনা-এমন একটি প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমরা ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের ৪৯ ধারা ও ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারা এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০ আলোচনা, পর্যালোচনা ও নজির উল্লেখ করা যায়। এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন দেশের প্রচলিত উত্তম আইন। এই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য অনুন্নত পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জাতির কল্যাণের জন্য, আদিবাসী সমাজ যাতে নিঃস্ব বা ভূমিহীন হয়ে না পড়ে সেদিকে যত্ন নেয়া হয়েছে। তাদের স্বার্থ রক্ষার্থেই এই বিধান করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে যে, আদিবাসীদের মধ্যে কেউ ধর্মান্তরিত হচ্ছেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলাফল নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন মতামতের কারণে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আইনের বিধান নিয়ে যারা চিন্তাভাবনা করেন তাদের মধ্যেও মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন আদিবাসী সম্প্রদায় খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন বা মুসলিম ইত্যাদি ধর্মে ধর্মান্তরিত হলেও সেই ধর্মের রীতিনীতি অনুযায়ী চলতে হবে। তাদের সম্পত্তি বিক্রি বা যেকোন সম্পত্তি হস্তান্তর করতে হলে প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারার বিধান প্রয়োজ্য হবে না। আবার কেউ কেউ বলেছেন ধর্মান্তরিত হলেও ৯৭ ধারার বিধান অনুযায়ী সরকারের অনুমতি গ্রহণ করে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারবেন। বিভিন্ন বই পুস্তক গবেষণা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন সব অনুন্নত আদিবাসী মানুষের হিতার্থে প্রণয়ন করা হয়েছে। সুতরাং এটাই সঠিক যে, ধর্মীয় আইন শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য হয় এবং রাষ্ট্রীয় আইন প্রত্যেক ধর্মের মানুষকে মেনে চলতে হয়। কিন্তু ধর্মীয় বিধি-বিধান ব্যক্তি বিশেষের ওপর বর্তায় এবং বিষয়টি ধর্মীয় অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল। আইন কোন অনুভূতি বা কোন বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল নয়। রাষ্ট্রীয় আইন সব ধর্ম, বর্ণ বা জনগণকে বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলতে হয়। যদি কেউ ওই রাষ্ট্রীয় আইন না মেনে চলে তবে তাকে শাস্তি পেতে হয় এবং কেউ যদি রাষ্ট্রীয় আইন ভঙ্গ করে বা অমান্য করে তবে তাকে দন্ড পেতে হয়। পক্ষান্তরে, ধর্মের বিধান যদি কেউ মেনে না চলে তবে তাকে ধর্মের বিধান মানতে কেউ বাধ্য করতে পারে না। বিষয়টি উদাহারণ সহকারে নিম্নে তুলে ধরা হলো। মুসলিম আইনে সন্তানরা ১২-১৪ বৎসরে সাবালকত্ব অর্জন করে থাকে। আবার হিন্দু আইনে ১৫ বৎসরে সাবালকত্ব অর্জন করে থাকে। খ্রিস্টান ধর্মে ১৮ বৎসরে সাবালকত্ব অর্জন করে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন ধর্ম, বর্ণ ও সব ধর্মের জনগণকে অর্থাৎ ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর বেঁধে দেয়া হয়েছে। যা রাষ্ট্রে বসবাসকারী সব ধর্মের, বর্ণের ও সম্প্রদায়ের মানুষ মানতে বাধ্য এবং ওই আইন ভঙ্গ করলে দন্ড বা শাস্তির বিধান করা হয়েছে। তাহলে আমরা জোরালোভাবে বলতে পারি যে, মানুষ যে ধর্মই পালন করুক না কেন, রাষ্ট্রীয় আইন সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য এবং এটির পরিবর্তন হতে পারে না। যেহেতু ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন হচ্ছে রাষ্ট্রীয় আইন। এই আইন কোন ধর্মের দ্বারা পরিচালিত নয়। সেহেতু ৯৭ ধারার বিধানগুলো আদিবাসীদের ক্ষেত্রে বলবৎ থাকবে। আদিবাসীজনগণ যে ধর্মই পালন করুক না কেন, তাদের আসল পরিচয় তারা আদিবাসী। আবার দেখা গেছে যে কোন কোন ব্যক্তি কোন ধর্মই বিশ্বাস করেন না বা মানেন না। নাস্তিক ব্যক্তিরাও রাষ্ট্রীয় আইন মানতে বাধ্য। সুতরাং ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ প্রজাস্বত্ব আইন হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃক প্রণয়নকৃত একটি বিধিবদ্ধ আইন। এই আইন কোন ধর্মের দ্বারা পরিচালিত হবে না। ধর্ম হলো নিজস্ব ব্যক্তিগত চিন্তাধারা ও অনুভূতি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন সবার জন্য প্রযোজ্য, এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। এতদস্বত্বেও আদিবাসী সম্প্রদায় যদি অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করেও থাকে অর্থাৎ ধর্মান্তরিত হয়েও থাকলে তার সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ওই ৯৭ ধারার আইন প্রযোজ্য হবে এবং তার ওপর ৯৭ ধারা বর্তাবে। উপরোক্ত বিষয়টি আরও একটি উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করা হলো। যেমন জাতীয় নির্বাচনে বা যেকোন নির্বাচনে একজন আদিবাসী যদি তার নিজস্ব ধর্মের প্রার্থীকে অথবা যেকোন দলের প্রার্থীকে ভোট প্রদান করে থাকেন তাহলে কি তার আদিবাসীত্ব চলে যাবে? একজন আদিবাসীকে ভোটার হতে হলে তার কমপক্ষে ১৮ বৎসর বয়স লাগে। পক্ষান্তরে অন্য ধর্মের বা বর্ণের লোককেও ভোটার হতে হলে কমপক্ষে ১৮ বৎসর বয়স লাগবে। তাহলে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রীয় আইনকে অনুসরন করা প্রত্যেক নাগরিকদের ওপর বাধ্যতামূলক। তাছাড়া এই সহজ সরল, অজ্ঞ, পিছিয়ে পড়া আদিবাসী সম্প্রদায় ধর্মান্তরিত হলেই তারা অনুন্নত জাতি হতে সামাজিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে মুক্তি প্রাপ্ত হয়ে উন্নয়নের বা মান মর্যাদার চরম শিখরে অবস্থান করেন না। কিংবা ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে শিক্ষিত, চালাক-চতুর, সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি হয়ে যায় না। তারা আগে যা ছিল তাই থেকে যায়। আলোচনা হতে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, আদিবাসীরা যে ধর্মই পালন করুন না কেন ওই ৯৭ ধারার বিধান তাদের ওপর বর্তাবে। আইনের দৃষ্টিতে সব মানুষই সমান। ব্যক্তিগত বিশ্বাসের অনুভূতি ভিন্ন ভিন্ন থাকতে পারে; কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইনের সবার ওপর সমভাবে বাধ্যকর। রাষ্ট্রীয় আইনের ঊর্ধ্বে কেও নয়। ময়মনসিংহের গারো জাতি ৯০ ভাগ খ্রিস্টান হওয়া স্বত্বেও তারা ৯৭ ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা এখনো প্রাপ্ত হচ্ছে। তাহলে সমতলে কিছু সাঁওতালরা খ্রিস্টান হলে তারা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত কেন হবে? ধর্মান্তরিত সাঁওতালরাও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলে গণ্য হবে ও সব সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হতে আইনে কোন বাধা থাকতে পারে না। যা উপরোক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণ এমনিতেই সংখ্যালঘু। তাদের মধ্যে অর্থাৎ সাঁওতাল-সাঁওতাল বিভক্ত হলে অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে যাবে। এছাড়া সাঁওতালদের মধ্যে আরো এক দ্বন্দ্ব হচ্ছে ‘ভাষা’ নিয়ে। কেউ বলেন ‘বাংলা’ হরফে কেন বলেন অলচিকি, রোমান হরফে সাঁওতালী ভাষা শিক্ষায় চাই। দূরদৃষ্টির অভাবেই তারা আরো পিছিয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগে দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা ও আন্তর্জাতিক ভাষা শিক্ষা অর্জন বর্তমানে বিশেষভাবে প্রয়োজন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি করতে হলে ধর্মান্তরিত বা ভাষার দ্বন্দ্ব ভুলে এক ছত্রছায়ায় আসতে হবে। নিজেদের মধ্যে বসে আপস মীমাংসা বা দ্বন্দ্ব নিরসন হওয়া শুভ বুদ্ধির পরিচয় দেয়া হবে। অন্যথায় সাঁওতাল জাতি হবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত, যা মঙ্গল বয়ে আনবে না।
[ লেখক : আইনজীবী ]
বাবুল রবিদাস
বুধবার, ১৬ নভেম্বর ২০২২
ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানরা
আদিবাসী আইন দ্বারা পরিচালিত হবেন কিনা এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন সরকারি সুযোগ সুবিধা তারা পাবেন কিনা-এমন একটি প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমরা ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের ৪৯ ধারা ও ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারা এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০ আলোচনা, পর্যালোচনা ও নজির উল্লেখ করা যায়। এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন দেশের প্রচলিত উত্তম আইন। এই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য অনুন্নত পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জাতির কল্যাণের জন্য, আদিবাসী সমাজ যাতে নিঃস্ব বা ভূমিহীন হয়ে না পড়ে সেদিকে যত্ন নেয়া হয়েছে। তাদের স্বার্থ রক্ষার্থেই এই বিধান করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে যে, আদিবাসীদের মধ্যে কেউ ধর্মান্তরিত হচ্ছেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলাফল নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন মতামতের কারণে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আইনের বিধান নিয়ে যারা চিন্তাভাবনা করেন তাদের মধ্যেও মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন আদিবাসী সম্প্রদায় খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন বা মুসলিম ইত্যাদি ধর্মে ধর্মান্তরিত হলেও সেই ধর্মের রীতিনীতি অনুযায়ী চলতে হবে। তাদের সম্পত্তি বিক্রি বা যেকোন সম্পত্তি হস্তান্তর করতে হলে প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারার বিধান প্রয়োজ্য হবে না। আবার কেউ কেউ বলেছেন ধর্মান্তরিত হলেও ৯৭ ধারার বিধান অনুযায়ী সরকারের অনুমতি গ্রহণ করে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারবেন। বিভিন্ন বই পুস্তক গবেষণা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন সব অনুন্নত আদিবাসী মানুষের হিতার্থে প্রণয়ন করা হয়েছে। সুতরাং এটাই সঠিক যে, ধর্মীয় আইন শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য হয় এবং রাষ্ট্রীয় আইন প্রত্যেক ধর্মের মানুষকে মেনে চলতে হয়। কিন্তু ধর্মীয় বিধি-বিধান ব্যক্তি বিশেষের ওপর বর্তায় এবং বিষয়টি ধর্মীয় অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল। আইন কোন অনুভূতি বা কোন বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল নয়। রাষ্ট্রীয় আইন সব ধর্ম, বর্ণ বা জনগণকে বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলতে হয়। যদি কেউ ওই রাষ্ট্রীয় আইন না মেনে চলে তবে তাকে শাস্তি পেতে হয় এবং কেউ যদি রাষ্ট্রীয় আইন ভঙ্গ করে বা অমান্য করে তবে তাকে দন্ড পেতে হয়। পক্ষান্তরে, ধর্মের বিধান যদি কেউ মেনে না চলে তবে তাকে ধর্মের বিধান মানতে কেউ বাধ্য করতে পারে না। বিষয়টি উদাহারণ সহকারে নিম্নে তুলে ধরা হলো। মুসলিম আইনে সন্তানরা ১২-১৪ বৎসরে সাবালকত্ব অর্জন করে থাকে। আবার হিন্দু আইনে ১৫ বৎসরে সাবালকত্ব অর্জন করে থাকে। খ্রিস্টান ধর্মে ১৮ বৎসরে সাবালকত্ব অর্জন করে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন ধর্ম, বর্ণ ও সব ধর্মের জনগণকে অর্থাৎ ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর বেঁধে দেয়া হয়েছে। যা রাষ্ট্রে বসবাসকারী সব ধর্মের, বর্ণের ও সম্প্রদায়ের মানুষ মানতে বাধ্য এবং ওই আইন ভঙ্গ করলে দন্ড বা শাস্তির বিধান করা হয়েছে। তাহলে আমরা জোরালোভাবে বলতে পারি যে, মানুষ যে ধর্মই পালন করুক না কেন, রাষ্ট্রীয় আইন সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য এবং এটির পরিবর্তন হতে পারে না। যেহেতু ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন হচ্ছে রাষ্ট্রীয় আইন। এই আইন কোন ধর্মের দ্বারা পরিচালিত নয়। সেহেতু ৯৭ ধারার বিধানগুলো আদিবাসীদের ক্ষেত্রে বলবৎ থাকবে। আদিবাসীজনগণ যে ধর্মই পালন করুক না কেন, তাদের আসল পরিচয় তারা আদিবাসী। আবার দেখা গেছে যে কোন কোন ব্যক্তি কোন ধর্মই বিশ্বাস করেন না বা মানেন না। নাস্তিক ব্যক্তিরাও রাষ্ট্রীয় আইন মানতে বাধ্য। সুতরাং ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ প্রজাস্বত্ব আইন হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃক প্রণয়নকৃত একটি বিধিবদ্ধ আইন। এই আইন কোন ধর্মের দ্বারা পরিচালিত হবে না। ধর্ম হলো নিজস্ব ব্যক্তিগত চিন্তাধারা ও অনুভূতি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন সবার জন্য প্রযোজ্য, এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। এতদস্বত্বেও আদিবাসী সম্প্রদায় যদি অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করেও থাকে অর্থাৎ ধর্মান্তরিত হয়েও থাকলে তার সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ওই ৯৭ ধারার আইন প্রযোজ্য হবে এবং তার ওপর ৯৭ ধারা বর্তাবে। উপরোক্ত বিষয়টি আরও একটি উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করা হলো। যেমন জাতীয় নির্বাচনে বা যেকোন নির্বাচনে একজন আদিবাসী যদি তার নিজস্ব ধর্মের প্রার্থীকে অথবা যেকোন দলের প্রার্থীকে ভোট প্রদান করে থাকেন তাহলে কি তার আদিবাসীত্ব চলে যাবে? একজন আদিবাসীকে ভোটার হতে হলে তার কমপক্ষে ১৮ বৎসর বয়স লাগে। পক্ষান্তরে অন্য ধর্মের বা বর্ণের লোককেও ভোটার হতে হলে কমপক্ষে ১৮ বৎসর বয়স লাগবে। তাহলে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রীয় আইনকে অনুসরন করা প্রত্যেক নাগরিকদের ওপর বাধ্যতামূলক। তাছাড়া এই সহজ সরল, অজ্ঞ, পিছিয়ে পড়া আদিবাসী সম্প্রদায় ধর্মান্তরিত হলেই তারা অনুন্নত জাতি হতে সামাজিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে মুক্তি প্রাপ্ত হয়ে উন্নয়নের বা মান মর্যাদার চরম শিখরে অবস্থান করেন না। কিংবা ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে শিক্ষিত, চালাক-চতুর, সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি হয়ে যায় না। তারা আগে যা ছিল তাই থেকে যায়। আলোচনা হতে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, আদিবাসীরা যে ধর্মই পালন করুন না কেন ওই ৯৭ ধারার বিধান তাদের ওপর বর্তাবে। আইনের দৃষ্টিতে সব মানুষই সমান। ব্যক্তিগত বিশ্বাসের অনুভূতি ভিন্ন ভিন্ন থাকতে পারে; কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইনের সবার ওপর সমভাবে বাধ্যকর। রাষ্ট্রীয় আইনের ঊর্ধ্বে কেও নয়। ময়মনসিংহের গারো জাতি ৯০ ভাগ খ্রিস্টান হওয়া স্বত্বেও তারা ৯৭ ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা এখনো প্রাপ্ত হচ্ছে। তাহলে সমতলে কিছু সাঁওতালরা খ্রিস্টান হলে তারা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত কেন হবে? ধর্মান্তরিত সাঁওতালরাও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলে গণ্য হবে ও সব সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হতে আইনে কোন বাধা থাকতে পারে না। যা উপরোক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণ এমনিতেই সংখ্যালঘু। তাদের মধ্যে অর্থাৎ সাঁওতাল-সাঁওতাল বিভক্ত হলে অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে যাবে। এছাড়া সাঁওতালদের মধ্যে আরো এক দ্বন্দ্ব হচ্ছে ‘ভাষা’ নিয়ে। কেউ বলেন ‘বাংলা’ হরফে কেন বলেন অলচিকি, রোমান হরফে সাঁওতালী ভাষা শিক্ষায় চাই। দূরদৃষ্টির অভাবেই তারা আরো পিছিয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগে দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা ও আন্তর্জাতিক ভাষা শিক্ষা অর্জন বর্তমানে বিশেষভাবে প্রয়োজন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি করতে হলে ধর্মান্তরিত বা ভাষার দ্বন্দ্ব ভুলে এক ছত্রছায়ায় আসতে হবে। নিজেদের মধ্যে বসে আপস মীমাংসা বা দ্বন্দ্ব নিরসন হওয়া শুভ বুদ্ধির পরিচয় দেয়া হবে। অন্যথায় সাঁওতাল জাতি হবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত, যা মঙ্গল বয়ে আনবে না।
[ লেখক : আইনজীবী ]