alt

উপ-সম্পাদকীয়

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি

সাঈদ চৌধুরী

: বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২২

শিশু মামুনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কালো ছিপছিপে দেহ, ঠোঁট শুকিয়ে আছে। গায়ে একটা শর্ট প্যান্ট পরে থাকা ছেলেটি গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করছে। তখন রাত প্রায় ১২টা বাজে। মামুনের সঙ্গে আরও কয়েকজন শিশু এসে দাঁড়াল। মামুনকে জিজ্ঞেস করার পর জানা গেল সে শ্রীপুরেই থাকে। তার আরেক ভাইও ময়লারই কাজ করে। সারাদিন দোকানগুলোতে জমিয়ে রাখা ময়লাগুলো মামুন ও তার সঙ্গী অনায়াসে খালি হাতে ধরে ধরে ময়লার ভ্যানে তুলছে। সে ময়লাগুলোতে সব ধরনের ময়লা আছে। একদিকে যেমন পচা খাবার আছে তেমনি ফলের খোসা, ওষুধের খালি বোতল, ওষুধের প্যাকেট, স্যালাইনের প্লাস্টিকের প্যাকেট, ক্লিনিকের গজ, ব্যান্ডেজসহ প্লাস্টিকের বিভিন্ন ধরনের ময়লা আছে। কিছু ময়লা পচে এত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল যে কাছে থাকার কোনো উপায়ই নেই। অথচ ওদের কাছে তেমন কিছুই মনে হচ্ছে না। মামুনকে জিজ্ঞেস করার পর ও জানাল ময়লার কাছে থাকতে থাকতে ওদের এখন আর এগুলো দুর্গন্ধ মনে হয় না। মামুনদের মতো কিশোররা যারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে জড়িত, তাদের বেশির ভাগ কিশোরই ধূমপান ও নেশার সঙ্গে জড়িয়ে যায়।

ডাস্টবিন হিসেবে আমাদের দেশে এখনো রাস্তার পাশের জায়গাকেই বেছে নেয়া হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। শ্রীপুরের মতোই অন্যান্য জায়গায়ও শিশু-কিশোররাই ময়লা আনা নেয়ার এ কাজের সঙ্গে জড়িত। এর ফলে এই শিশুরা যে পারিশ্রমিক পায়, সে পারিশ্রমিকও এদের জীবনের জন্য তেমন কোনো উপকারে আসে না।

মামুনসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে ওদের অসুস্থতার কথা জানা গেল। অনেক সময়ই ওরা পেটের সমস্যায় ভোগে, খাওয়ায় অরুচি থাকে আর এ কারণেই তাদের যাতে হাতে গন্ধ অনুভব করতে না হয়, সেজন্য নেশার দিকে ধাবিত হয় তারা। বেশির ভাগ শিশুই ধূমপান করে খুব সাবলীলভাবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে যারা সম্পৃক্ত, বিশেষ করে, শিশু-কিশোররা তাদের ব্যাপারে সরকারসহ আমাদের সবার এখনই মনোযোগী হওয়া খুব বেশি প্রয়োজন। সরকার শিশুদের নিরাপত্তায় অনেক কাজ, প্রকল্প এবং বিশেষ ব্যবস্থাও নিয়েছে।

সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় একসঙ্গে হয়েও অনেক কাজ শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে গতিশীল রেখেছে। মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষার লক্ষ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে দুটি পৃথক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর। প্রকল্প দুটি হচ্ছে, চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) প্রকল্প এবং সার্ভিসেস ফর দ্য চিলড্রেন অ্যাট রিস্ক। সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) প্রকল্পটি দেশের ২০টি জেলার নারী, শিশু ও যুবাদের নিয়ে কাজ করেছে। প্রথম প্রকল্পটিতে পথ শিশুদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়ে খুব

গুরুত্ব দিয়ে কাজ করার বিষয়ে নির্দেশনা ছিল।

দ্বিতীয় প্রকল্পে কম্পোনেন্ট-১ এ স্পষ্ট করেই বলা আছে কর্মজীবী শিশুদের কথা, যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে শিশু সুরক্ষাকল্পে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার প্রতিষ্ঠিত করা এবং নিরাপদ পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করে কেইস বিশ্লেষণ,

পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা, আবাসন, কাউন্সেলিং এবং পুনঃএকীকরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।

কিন্তু এসব বিষয়গুলোতেও অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে। যারা ময়লার ভাগাড়ে শ্রম দিচ্ছে, তাদের খুঁজে এনে পুনর্বাসন করা কঠিন। এ কাজে যারা যুক্ত তারা এ থেকে সরেও আসতে চায় না। এর ফলে এদের স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমনি বাড়তে থাকে, তেমনি এদের ভেতর স্বাভাবিক জীবনযাপন করার ইচ্ছাশক্তিও মরে যায়। তলিয়ে যেতে থাকে এরা আসক্তি আর বিষন্নতার গভীর অন্ধকারে। ২০১১ সালের শিশু নীতির ৬.২ এ শিশুর দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বলা আছে; শিশুর দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে শিশুর পুষ্টি, স্বাস্থ্য, সার্বিক সুরক্ষা, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়কে অগ্রাধিকার প্রদান করার বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।

কিন্তু যে শিশুরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে কাজ করছে, তাদের কত শতাংশ শিশু এ ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের কার্যক্রমে যুক্ত হতে পেরেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান এবং বাস্তবায়ন সে অর্থে নেই। সরকারের ভালো ভালো প্রকল্প শিশুদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখলেও

কিছু কিছু জায়গায় আরও বেশি করে ভাববার এবং মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন আছে। যারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে কাজ করছে, সেসব শিশুদের ব্যাপারে সরকারের নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যমাত্রা নিতে হবেই। তা না হলে সব শিশুদের নিরাপত্তা এবং অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি অসমাপ্তই থেকে যাবে।

যাদের বয়স কম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এ পেশা থেকে তাদের বের করে ঝুঁকিমুক্ত অন্যপেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিতে হবে এবং যারা ষোল বছরের উপরে, তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। ময়লা সংগ্রহের সময় তারা যাতে সঠিক পিপিই (পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট) ব্যবহার করে, সেটা ইউনিয়ন পরিষদ অথবা পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে

নিশ্চিত করতে হবে। নেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া, ধূমপানে আসক্ত হওয়ার মতো ঘটনা থেকে বের করে আনতে কাউন্সিলিং বাড়াতে হবে কেননা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্জ্য

ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক। এ পেশায় জড়িত শিশু-কিশোরদের মারাত্বক নিউমোনিয়াসহ ফুসফুসের অন্যান্য সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। অনেকসময় এ ধরনের নিউমোনিয়া এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে থাকে, যার কারণে তাদের জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

যেহেতু বর্জ্যে রাসায়নিক মিশ্রণ আছে, এমন দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থেকে চোখ, নাক বা গলার সংক্রমণ বা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই সঙ্গে ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো ফুসফুসের নানাবিধ জটিলতা, মাথাব্যথা, অ্যাজমা এবং

নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। যক্ষা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে এ পেশার সঙ্গে অনিরাপদভাবে জড়িত মানুষদের, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের।

বর্জ্যদূষিত এলাকা, যেখানে সিসা দূষণেরও ঝুঁকি রয়েছে, এমন এলাকায় কাজ করা শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে বিঘ্ন ঘটতে পারে, হতে পারে স্নায়বিক ক্ষতি। এর সঙ্গে রয়েছে অবসন্নতা, মাদকাসক্তিসহ হতাশাজনক বিষাদময় জীবন। ভাগাড়গুলো থেকে যে মিথেন গ্যাস নিঃসৃত হয়, যারা এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের আরও বেশি করে স্নায়ুবিক দুর্বলতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। যাতে করে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবারও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাও এই শিশুদের টিকে থাকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

সবকিছু মিলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত শিশু-কিশোরদের নিয়ে ভাবা এবং এদের নিরাপত্তায় সরকারের মনোযোগী হওয়া এখন সময়ের দাবি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারসহ এ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে আরো বেশি মনোযোগী হলে ছিন্নমূল শিশুদের নিরাপত্তা যেমনি বাড়বে, তেমনি দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা এবং সমন্বিত উদ্যোগ সরকারের কাজকে করবে আরও বেগবান ও ফলপ্রসূ। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং এর সঙ্গে জড়িত সব পর্যায়ের কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারসহ সব সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট

প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বোচ্চ মনোযোগ, গুরুত্ব এবং প্রাধান্য অবশ্যই দিতে হবে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতসহ আামদের অস্তিত্ব রক্ষায় এর কোন বিকল্প নেই। প্রয়োজনে শুধু আমাদের সচেতনতা এবং এগিয়ে আসা।

(পিআইডি ফিচার)

[লেখক: রসায়নবিদ]

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি

সাঈদ চৌধুরী

বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২২

শিশু মামুনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কালো ছিপছিপে দেহ, ঠোঁট শুকিয়ে আছে। গায়ে একটা শর্ট প্যান্ট পরে থাকা ছেলেটি গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করছে। তখন রাত প্রায় ১২টা বাজে। মামুনের সঙ্গে আরও কয়েকজন শিশু এসে দাঁড়াল। মামুনকে জিজ্ঞেস করার পর জানা গেল সে শ্রীপুরেই থাকে। তার আরেক ভাইও ময়লারই কাজ করে। সারাদিন দোকানগুলোতে জমিয়ে রাখা ময়লাগুলো মামুন ও তার সঙ্গী অনায়াসে খালি হাতে ধরে ধরে ময়লার ভ্যানে তুলছে। সে ময়লাগুলোতে সব ধরনের ময়লা আছে। একদিকে যেমন পচা খাবার আছে তেমনি ফলের খোসা, ওষুধের খালি বোতল, ওষুধের প্যাকেট, স্যালাইনের প্লাস্টিকের প্যাকেট, ক্লিনিকের গজ, ব্যান্ডেজসহ প্লাস্টিকের বিভিন্ন ধরনের ময়লা আছে। কিছু ময়লা পচে এত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল যে কাছে থাকার কোনো উপায়ই নেই। অথচ ওদের কাছে তেমন কিছুই মনে হচ্ছে না। মামুনকে জিজ্ঞেস করার পর ও জানাল ময়লার কাছে থাকতে থাকতে ওদের এখন আর এগুলো দুর্গন্ধ মনে হয় না। মামুনদের মতো কিশোররা যারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে জড়িত, তাদের বেশির ভাগ কিশোরই ধূমপান ও নেশার সঙ্গে জড়িয়ে যায়।

ডাস্টবিন হিসেবে আমাদের দেশে এখনো রাস্তার পাশের জায়গাকেই বেছে নেয়া হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। শ্রীপুরের মতোই অন্যান্য জায়গায়ও শিশু-কিশোররাই ময়লা আনা নেয়ার এ কাজের সঙ্গে জড়িত। এর ফলে এই শিশুরা যে পারিশ্রমিক পায়, সে পারিশ্রমিকও এদের জীবনের জন্য তেমন কোনো উপকারে আসে না।

মামুনসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে ওদের অসুস্থতার কথা জানা গেল। অনেক সময়ই ওরা পেটের সমস্যায় ভোগে, খাওয়ায় অরুচি থাকে আর এ কারণেই তাদের যাতে হাতে গন্ধ অনুভব করতে না হয়, সেজন্য নেশার দিকে ধাবিত হয় তারা। বেশির ভাগ শিশুই ধূমপান করে খুব সাবলীলভাবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে যারা সম্পৃক্ত, বিশেষ করে, শিশু-কিশোররা তাদের ব্যাপারে সরকারসহ আমাদের সবার এখনই মনোযোগী হওয়া খুব বেশি প্রয়োজন। সরকার শিশুদের নিরাপত্তায় অনেক কাজ, প্রকল্প এবং বিশেষ ব্যবস্থাও নিয়েছে।

সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় একসঙ্গে হয়েও অনেক কাজ শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে গতিশীল রেখেছে। মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষার লক্ষ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে দুটি পৃথক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর। প্রকল্প দুটি হচ্ছে, চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) প্রকল্প এবং সার্ভিসেস ফর দ্য চিলড্রেন অ্যাট রিস্ক। সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) প্রকল্পটি দেশের ২০টি জেলার নারী, শিশু ও যুবাদের নিয়ে কাজ করেছে। প্রথম প্রকল্পটিতে পথ শিশুদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়ে খুব

গুরুত্ব দিয়ে কাজ করার বিষয়ে নির্দেশনা ছিল।

দ্বিতীয় প্রকল্পে কম্পোনেন্ট-১ এ স্পষ্ট করেই বলা আছে কর্মজীবী শিশুদের কথা, যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে শিশু সুরক্ষাকল্পে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার প্রতিষ্ঠিত করা এবং নিরাপদ পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করে কেইস বিশ্লেষণ,

পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা, আবাসন, কাউন্সেলিং এবং পুনঃএকীকরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।

কিন্তু এসব বিষয়গুলোতেও অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে। যারা ময়লার ভাগাড়ে শ্রম দিচ্ছে, তাদের খুঁজে এনে পুনর্বাসন করা কঠিন। এ কাজে যারা যুক্ত তারা এ থেকে সরেও আসতে চায় না। এর ফলে এদের স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমনি বাড়তে থাকে, তেমনি এদের ভেতর স্বাভাবিক জীবনযাপন করার ইচ্ছাশক্তিও মরে যায়। তলিয়ে যেতে থাকে এরা আসক্তি আর বিষন্নতার গভীর অন্ধকারে। ২০১১ সালের শিশু নীতির ৬.২ এ শিশুর দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বলা আছে; শিশুর দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে শিশুর পুষ্টি, স্বাস্থ্য, সার্বিক সুরক্ষা, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়কে অগ্রাধিকার প্রদান করার বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।

কিন্তু যে শিশুরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে কাজ করছে, তাদের কত শতাংশ শিশু এ ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের কার্যক্রমে যুক্ত হতে পেরেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান এবং বাস্তবায়ন সে অর্থে নেই। সরকারের ভালো ভালো প্রকল্প শিশুদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখলেও

কিছু কিছু জায়গায় আরও বেশি করে ভাববার এবং মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন আছে। যারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে কাজ করছে, সেসব শিশুদের ব্যাপারে সরকারের নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যমাত্রা নিতে হবেই। তা না হলে সব শিশুদের নিরাপত্তা এবং অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি অসমাপ্তই থেকে যাবে।

যাদের বয়স কম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এ পেশা থেকে তাদের বের করে ঝুঁকিমুক্ত অন্যপেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিতে হবে এবং যারা ষোল বছরের উপরে, তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। ময়লা সংগ্রহের সময় তারা যাতে সঠিক পিপিই (পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট) ব্যবহার করে, সেটা ইউনিয়ন পরিষদ অথবা পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে

নিশ্চিত করতে হবে। নেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া, ধূমপানে আসক্ত হওয়ার মতো ঘটনা থেকে বের করে আনতে কাউন্সিলিং বাড়াতে হবে কেননা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্জ্য

ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক। এ পেশায় জড়িত শিশু-কিশোরদের মারাত্বক নিউমোনিয়াসহ ফুসফুসের অন্যান্য সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। অনেকসময় এ ধরনের নিউমোনিয়া এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে থাকে, যার কারণে তাদের জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

যেহেতু বর্জ্যে রাসায়নিক মিশ্রণ আছে, এমন দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থেকে চোখ, নাক বা গলার সংক্রমণ বা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই সঙ্গে ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো ফুসফুসের নানাবিধ জটিলতা, মাথাব্যথা, অ্যাজমা এবং

নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। যক্ষা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে এ পেশার সঙ্গে অনিরাপদভাবে জড়িত মানুষদের, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের।

বর্জ্যদূষিত এলাকা, যেখানে সিসা দূষণেরও ঝুঁকি রয়েছে, এমন এলাকায় কাজ করা শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে বিঘ্ন ঘটতে পারে, হতে পারে স্নায়বিক ক্ষতি। এর সঙ্গে রয়েছে অবসন্নতা, মাদকাসক্তিসহ হতাশাজনক বিষাদময় জীবন। ভাগাড়গুলো থেকে যে মিথেন গ্যাস নিঃসৃত হয়, যারা এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের আরও বেশি করে স্নায়ুবিক দুর্বলতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। যাতে করে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবারও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাও এই শিশুদের টিকে থাকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

সবকিছু মিলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত শিশু-কিশোরদের নিয়ে ভাবা এবং এদের নিরাপত্তায় সরকারের মনোযোগী হওয়া এখন সময়ের দাবি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারসহ এ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে আরো বেশি মনোযোগী হলে ছিন্নমূল শিশুদের নিরাপত্তা যেমনি বাড়বে, তেমনি দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা এবং সমন্বিত উদ্যোগ সরকারের কাজকে করবে আরও বেগবান ও ফলপ্রসূ। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং এর সঙ্গে জড়িত সব পর্যায়ের কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারসহ সব সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট

প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বোচ্চ মনোযোগ, গুরুত্ব এবং প্রাধান্য অবশ্যই দিতে হবে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতসহ আামদের অস্তিত্ব রক্ষায় এর কোন বিকল্প নেই। প্রয়োজনে শুধু আমাদের সচেতনতা এবং এগিয়ে আসা।

(পিআইডি ফিচার)

[লেখক: রসায়নবিদ]

back to top