alt

উপ-সম্পাদকীয়

সরিষা চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের গুরুত্ব

জগৎ চাঁদ মালাকার

: শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর ২০২২
image

মানুষ বাড়ছে জমি কমছে সেজন্য ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির চাপ আমাদের রয়েছে, ফলে অল্প জমিতে অধিক ফসল ফলানোর তাগিদও বাড়ছে। লক্ষ্য হচ্ছে এক জমি থেকে বছরে তিন ফসল ফলানো। আর এজন্য এমন সব ফসলের জাত প্রয়োজন যেন জমি প্রস্তুতের সময় ব্যতীত বাকি সময়ে তিনটি ফসল কেটে নিয়ে আসা যায়। অনেক শস্য বিন্যাসে, যেমন সরিষা-বোরো-রোপা আমন-এ তিনটি ফসলের জাত এমনভাবে নির্বাচন করতে হবে যেন ৩২০-৩৪৫ দিনের মধ্যে তিনটি ফসলই সংগ্রহ করা যায়। সরিষা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় ১০ লাখ বিঘা সরিষা চাষের প্রণোদনা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, যা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চলতি রবি মৌসুমে বাস্তবায়ন করছে। দেশ অচিরেই এর সুফল পাবে বলে আশা করা যায়।

বাংলাদেশে একটি জনবহুল দেশ। এদেশে তেল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম। এই জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা আমাদের এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। সামগ্রিকভাবে একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নির্ভর করে সে দেশের মোট খাদ্যর প্রাপ্যতা, জনগণের খাদ্য ক্রয়ক্ষমতা এবং খাবার গ্রহণের ওপর (সুষম বণ্টন)। তাছাড়া প্রাপ্যতা থাকলেও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকলে জনগণ কিনতে পারবে না। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদার ৫৩% আমরা পাই দানাদার খাদ্যশস্য থেকে যা দৈনিক ২১২২ কিলো-ক্যালোরির ৭৫% ভাগ। বাকি ২৫ ভাগ কিলো-ক্যালোরি আসে ফলমূল, শাকসবজি, ডাল ও তেল থেকে। মাথাপিছু তেল গ্রহণের চাহিদা ৩০ গ্রাম, আমরা গ্রহণ করি ২০-২২ গ্রাম। খাদ্য ও পুষ্টি দুটি বিষয় খুবই অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। আমরা খাদ্য খাই দেহের পুষ্টি সাধনের জন্য। খাদ্য গ্রহণের ফলে দেহে পুষ্টি উপাদান শোষিত হয় এবং দেহের পুষ্টি সাধন ঘটে। ভালোভাবে জীবন ধারণের জন্য আমাদের পুষ্টি সম্পর্কিত জ্ঞান খুবই জরুরি একটি বিষয়। দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব হলে দেহে নানাহ সমস্যা তৈরি হয়। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে পুষ্টি সমস্যা একটি মারাত্মক সমস্যা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের পুষ্টি সমস্যা খুবই প্রকট। অনেকেই পুষ্টি উপাদান, তার উৎস, অপুষ্টিজনিত সমস্য ও তার প্রতিকার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই।

স্নেহ পদার্থ-আমিষের মতো প্রাণী এবং উদ্ভিদ দুই উৎস থেকেই স্নেহ পদার্থ পাওয়া যায়। যেমন ঘি, মাখন, চর্বিযুক্ত মাংস, চর্বিযুক্ত মাছ ইত্যাদি প্রাণী থেকে এবং সরিষার তেল, তিলের তেল, বাদামের তেল, সয়াবিনের তেল ইত্যাদি উদ্ভিদ থেকে পাওয়া যায়।

কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের প্রায় ৭৫% জনগোষ্ঠী গ্রামে বসবাস করে, যারা কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের নানামুখী উৎপাদনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এ খাতের সফলতা প্রধান সামষ্টিক অর্থনৈতিক উপাদনসমূহ যেমন-কর্মসংস্থান সৃজন, দারিদ্র বিমোচন, মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রচলিত শস্য বিন্যাসে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রমাণিত স্বল্পমেয়াদি তেল ফসলের আধুনিক জাত অন্তর্ভুক্ত করে বর্তমান তেল ফসলের (সরিষা, তিল, সূর্যমুখী, চিনাবাদাম, সয়াবিন) আবাদি এলাকা ৭.২৪ লাখ হেক্টর থেকে ১৫-২০% বৃদ্ধি করা।

বিএআরআই ও বিনা কর্তৃক উদ্ভাবিত তেল ফসলের আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ এবং মৌ-চাষ অন্তর্ভুক্ত করে তেলজাতীয় ফসলের হেক্টরপ্রতি ফলন ১৫-২০% বৃদ্ধি করা। মৌ চাষ সম্প্রসারণের ফলে তেল ফসলের পরাগায়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া উৎপাদিত মধু থেকে বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি হবে। উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে মাথাপিছু ভোজ্যতেল ব্যবহার বাড়বে এবং পুষ্টি ঘাটতি পূরণ হবে।

বর্তমানে দেশ দানাজাতীয় খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও তৈল, চর্বি ও প্রোটিনের পুষ্টি সমৃদ্ধ শস্য বিশেষভাবে তেলজাতীয় ফসল উৎপাদনে অনেকটাই পিছিয়ে আছে, যা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএং) ২০৩০ এর পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা সেটি অর্জনের একটি প্রধান অন্তরায়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, গুণগত মানসম্পন্ন পরিমিত ভোজ্যতেল খাওয়া ব্যতিরেকে পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব নয়, কারণ ভোজ্যতেলে রয়েছে অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড যা মানবদেহে তৈরি হয় না। এ ঘাটতি পূরণে ভোজ্যতেল সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। সেজন্য দেহকে সুস্থ, সুগঠিত ও রোগ প্রতিরোধে কার্যকর রাখতে নিয়মিত সঠিক পরিমাণ ভালোমানের ভোজ্যতেল গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।

পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে মানবদেহে দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরির ৩০% তেল বা চর্বি জাতীয় খাদ্য থেকে আসা উচিত, কিন্তু আমাদের আসে মাত্র ৯% যা নিতান্তই অপ্রতুল। বর্তমানে দেশে ব্যবহৃত ভোজ্যতেলের ৯০%ই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এ আমদানিনির্ভরতার ফলে একদিকে যেমন বিদেশে প্রচুর অর্থ চলে যাচ্ছে, তেমনি আমদানি ও বিপণনে মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভরতা পণ্যটির বাজারকে প্রায়ই অস্থিতিশীল করছে। এখন সময় এসেছে দেশে তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে নিজেদের উৎপাদিত ভেজালমুক্ত তেল ব্যবহার করার। তেলফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির দুটো কৌশল রয়েছে- একটি হলো বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে হেক্টরপ্রতি ফলন বৃদ্ধি (Vertical Expansion) অন্যটি হলো প্রচলিত শস্যবিন্যাসে তেলফসলকে অন্তর্ভুক্ত করে তেল ফসলের আবাদি এলাকা বৃদ্ধি (Horizontal Expansion) ।

এই মুহূর্তে দেশে প্রায় ২০ লাখ হেক্টর বোরো-পতিত-রোপা-আমন শস্যবিন্যাস প্রচলিত আছে যাকে সরিষা-বোরো-রোপা-আমন শস্যবিন্যাসে রূপান্তরিত করতে পারলে সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধি অনেকাংশে সম্ভব। এ শস্য বিন্যাসটি প্রবর্তনের জন্য প্রয়োজন স্বল্পমেয়াদি রোপা-আমন (জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন) এবং স্বল্প জীবনকালের সরিষার জাত (জীবনকাল ৭৫-৮০ দিন) বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে ইতোমধ্যে স্বল্পমেয়াদি জাত অবমুক্ত করা হয়েছে যা এখন সহজলভ্য। তাছাড়া অন্যান্য তেলজাতীয় ফসল যেমন- তিল, চিনাবাদাম, সয়াবিন এবং সূর্যমুখীর বেশ কিছু উন্নত জাত রয়েছে যেগুলো উচ্চফলনশীল হওয়ায় চাষের আওতায় এনে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

দেশে তেলজাতীয় ফসল সূর্যমুখী আবাদের একটি অপার সম্ভাবনা বিদ্যমান রয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ফসলটি চাষাবাদে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় ঘানিতে নিষ্কাশন করে লোকজন ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার ও করছেন। উচ্চফলনশীল খাট জাতের প্রচলন এবং উপযুক্ত বাজারমূল্য নিশ্চিত করতে পারলে এ তেল ফসলটির আবাদ বৃদ্ধি করা সম্ভব। বর্তমানে তেল ফসলের আবাদি জমি ৭.২৪ লাখ হেক্টর থেকে ১৫% বৃদ্ধি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং মৌচাষকে অন্তর্ভুক্ত করে হেক্টরপ্রতি ফলন ১.৩৪ মে.টন থেকে ১৫% বৃদ্ধি করতে পারলে দেশে অতিরিক্ত ১.২৫ লাখ মে.টন তেল উৎপাদন করা সম্ভব যার বাজারমূল্য প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকা। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মৌচাষ পরাগায়ণের মাধ্যমে কেবল তেল ফসলের উৎপাদনই বাড়ায় না পাশাপাশি মধুও উৎপাদিত হয় যা থেকে বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি এবং আলাদা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব। এসব দিকগুলো বিবেচনা করে তেলজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ এবং উৎপাদন বৃদ্ধিপূর্বক ভোজ্যতেলের চাহিদাপূরণ ও আমদানি ব্যয় হ্রাসকরণের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির চাপ আমাদের রয়েছে, ফলে অল্প জমিতে অধিক ফসল ফলানোর তাগিদও বাড়ছে। লক্ষ্য হচ্ছে এক জমি থেকে বছরে তিন ফসল ফলানো। আর এজন্য এমন সব ফসলের জাত প্রয়োজন যেন জমি প্রস্তুতের সময় ব্যতীত বাকি সময়ে তিনটি ফসল কেটে নিয়ে আসা যায়। অনেক শস্য বিন্যাসে, যেমন- সরিষা-বোরো-রোপা-আমন এ তিনটি ফসলের জাত এমনভাবে নির্বাচন করতে হবে যেন ৩২০-৩৪৫ দিনের মধ্যে তিনটি ফসলই সংগ্রহ করা যায়। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় হলো আমদের দেশের কৃষি-পরিবেশ উপযোগী তেল উৎপাদনকারি তেলবীজ ফসল যেমন- সরিষা, তিল, তিসি, সূর্যমুখী, চিনাবাদাম ইত্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধি করা। ধান যেহেতু কৃষকদের প্রধান ফসল, তাই কৃষক সাধারণত তা চায় না ধানের ফলন কমে যাক বরং মাঝখানে একটি বাড়তি ফসল পেতে চান কৃষক।

ফলে কৃষকরা স্বল্পমেয়াদি কিন্তু অধিক ফলনশীল জাত পছন্দ করেন। ধানের স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের চাষ করা, বিনা ধান-৭, ১৬ ব্রি ধান-৩৩, ৩৯, ৪৯, ৫৬.৫৭, ৭১, ৭৫ ব্রি হাইব্্িরড ধান ৪ বাউ ধান-১ ও বোরো ধানের জাত যথাযথভাবে চাষাবাদ করতে পারলে ফলন খুব একটা না কমিয়ে ২৩০-২৫০ দিনের মধ্যে দুটি ধান ফসল সহজে সংগ্রহ করা সম্ভব। কৃষকের কাছে সেরকম জাতের তথ্য পৌঁছে দেয়া এবং শস্যবিন্যাসে এদের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা বড় প্রয়োজন। আর সেটা পারলে দুই ধানের মাঝখানে ৮০-৯০ দিনের উচ্চফলনশীল সরিষার জাত বারি সরিষা ১৪, ১৫, ১৭, বিনা সরিষা ৯. বাউ সরিষা ১, ২, ৩ আবাদ করা সম্ভব। উল্লেখ্য যে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত মাটিতে সূর্যমুখী সফলভাবে আবাদ হচ্ছে।

[লেখক: প্রকল্প পরিচালক, কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর প্রকল্প]

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

প্রসঙ্গ : নিত্যপণ্যের দাম

ছবি

টঙ্ক আন্দোলনের কুমুদিনী হাজং

ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে চাই বিকেন্দ্রীকরণ

দূষণমুক্ত পানির বিকল্প নাই

রম্যগদ্য : ‘দুনিয়ার বাঙালি এক হও”

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সরিষা চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের গুরুত্ব

জগৎ চাঁদ মালাকার

image

শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর ২০২২

মানুষ বাড়ছে জমি কমছে সেজন্য ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির চাপ আমাদের রয়েছে, ফলে অল্প জমিতে অধিক ফসল ফলানোর তাগিদও বাড়ছে। লক্ষ্য হচ্ছে এক জমি থেকে বছরে তিন ফসল ফলানো। আর এজন্য এমন সব ফসলের জাত প্রয়োজন যেন জমি প্রস্তুতের সময় ব্যতীত বাকি সময়ে তিনটি ফসল কেটে নিয়ে আসা যায়। অনেক শস্য বিন্যাসে, যেমন সরিষা-বোরো-রোপা আমন-এ তিনটি ফসলের জাত এমনভাবে নির্বাচন করতে হবে যেন ৩২০-৩৪৫ দিনের মধ্যে তিনটি ফসলই সংগ্রহ করা যায়। সরিষা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় ১০ লাখ বিঘা সরিষা চাষের প্রণোদনা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, যা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চলতি রবি মৌসুমে বাস্তবায়ন করছে। দেশ অচিরেই এর সুফল পাবে বলে আশা করা যায়।

বাংলাদেশে একটি জনবহুল দেশ। এদেশে তেল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম। এই জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা আমাদের এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। সামগ্রিকভাবে একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নির্ভর করে সে দেশের মোট খাদ্যর প্রাপ্যতা, জনগণের খাদ্য ক্রয়ক্ষমতা এবং খাবার গ্রহণের ওপর (সুষম বণ্টন)। তাছাড়া প্রাপ্যতা থাকলেও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকলে জনগণ কিনতে পারবে না। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদার ৫৩% আমরা পাই দানাদার খাদ্যশস্য থেকে যা দৈনিক ২১২২ কিলো-ক্যালোরির ৭৫% ভাগ। বাকি ২৫ ভাগ কিলো-ক্যালোরি আসে ফলমূল, শাকসবজি, ডাল ও তেল থেকে। মাথাপিছু তেল গ্রহণের চাহিদা ৩০ গ্রাম, আমরা গ্রহণ করি ২০-২২ গ্রাম। খাদ্য ও পুষ্টি দুটি বিষয় খুবই অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। আমরা খাদ্য খাই দেহের পুষ্টি সাধনের জন্য। খাদ্য গ্রহণের ফলে দেহে পুষ্টি উপাদান শোষিত হয় এবং দেহের পুষ্টি সাধন ঘটে। ভালোভাবে জীবন ধারণের জন্য আমাদের পুষ্টি সম্পর্কিত জ্ঞান খুবই জরুরি একটি বিষয়। দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব হলে দেহে নানাহ সমস্যা তৈরি হয়। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে পুষ্টি সমস্যা একটি মারাত্মক সমস্যা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের পুষ্টি সমস্যা খুবই প্রকট। অনেকেই পুষ্টি উপাদান, তার উৎস, অপুষ্টিজনিত সমস্য ও তার প্রতিকার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই।

স্নেহ পদার্থ-আমিষের মতো প্রাণী এবং উদ্ভিদ দুই উৎস থেকেই স্নেহ পদার্থ পাওয়া যায়। যেমন ঘি, মাখন, চর্বিযুক্ত মাংস, চর্বিযুক্ত মাছ ইত্যাদি প্রাণী থেকে এবং সরিষার তেল, তিলের তেল, বাদামের তেল, সয়াবিনের তেল ইত্যাদি উদ্ভিদ থেকে পাওয়া যায়।

কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের প্রায় ৭৫% জনগোষ্ঠী গ্রামে বসবাস করে, যারা কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের নানামুখী উৎপাদনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এ খাতের সফলতা প্রধান সামষ্টিক অর্থনৈতিক উপাদনসমূহ যেমন-কর্মসংস্থান সৃজন, দারিদ্র বিমোচন, মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রচলিত শস্য বিন্যাসে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রমাণিত স্বল্পমেয়াদি তেল ফসলের আধুনিক জাত অন্তর্ভুক্ত করে বর্তমান তেল ফসলের (সরিষা, তিল, সূর্যমুখী, চিনাবাদাম, সয়াবিন) আবাদি এলাকা ৭.২৪ লাখ হেক্টর থেকে ১৫-২০% বৃদ্ধি করা।

বিএআরআই ও বিনা কর্তৃক উদ্ভাবিত তেল ফসলের আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ এবং মৌ-চাষ অন্তর্ভুক্ত করে তেলজাতীয় ফসলের হেক্টরপ্রতি ফলন ১৫-২০% বৃদ্ধি করা। মৌ চাষ সম্প্রসারণের ফলে তেল ফসলের পরাগায়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া উৎপাদিত মধু থেকে বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি হবে। উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে মাথাপিছু ভোজ্যতেল ব্যবহার বাড়বে এবং পুষ্টি ঘাটতি পূরণ হবে।

বর্তমানে দেশ দানাজাতীয় খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও তৈল, চর্বি ও প্রোটিনের পুষ্টি সমৃদ্ধ শস্য বিশেষভাবে তেলজাতীয় ফসল উৎপাদনে অনেকটাই পিছিয়ে আছে, যা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএং) ২০৩০ এর পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা সেটি অর্জনের একটি প্রধান অন্তরায়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, গুণগত মানসম্পন্ন পরিমিত ভোজ্যতেল খাওয়া ব্যতিরেকে পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব নয়, কারণ ভোজ্যতেলে রয়েছে অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড যা মানবদেহে তৈরি হয় না। এ ঘাটতি পূরণে ভোজ্যতেল সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। সেজন্য দেহকে সুস্থ, সুগঠিত ও রোগ প্রতিরোধে কার্যকর রাখতে নিয়মিত সঠিক পরিমাণ ভালোমানের ভোজ্যতেল গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।

পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে মানবদেহে দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরির ৩০% তেল বা চর্বি জাতীয় খাদ্য থেকে আসা উচিত, কিন্তু আমাদের আসে মাত্র ৯% যা নিতান্তই অপ্রতুল। বর্তমানে দেশে ব্যবহৃত ভোজ্যতেলের ৯০%ই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এ আমদানিনির্ভরতার ফলে একদিকে যেমন বিদেশে প্রচুর অর্থ চলে যাচ্ছে, তেমনি আমদানি ও বিপণনে মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভরতা পণ্যটির বাজারকে প্রায়ই অস্থিতিশীল করছে। এখন সময় এসেছে দেশে তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে নিজেদের উৎপাদিত ভেজালমুক্ত তেল ব্যবহার করার। তেলফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির দুটো কৌশল রয়েছে- একটি হলো বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে হেক্টরপ্রতি ফলন বৃদ্ধি (Vertical Expansion) অন্যটি হলো প্রচলিত শস্যবিন্যাসে তেলফসলকে অন্তর্ভুক্ত করে তেল ফসলের আবাদি এলাকা বৃদ্ধি (Horizontal Expansion) ।

এই মুহূর্তে দেশে প্রায় ২০ লাখ হেক্টর বোরো-পতিত-রোপা-আমন শস্যবিন্যাস প্রচলিত আছে যাকে সরিষা-বোরো-রোপা-আমন শস্যবিন্যাসে রূপান্তরিত করতে পারলে সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধি অনেকাংশে সম্ভব। এ শস্য বিন্যাসটি প্রবর্তনের জন্য প্রয়োজন স্বল্পমেয়াদি রোপা-আমন (জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন) এবং স্বল্প জীবনকালের সরিষার জাত (জীবনকাল ৭৫-৮০ দিন) বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে ইতোমধ্যে স্বল্পমেয়াদি জাত অবমুক্ত করা হয়েছে যা এখন সহজলভ্য। তাছাড়া অন্যান্য তেলজাতীয় ফসল যেমন- তিল, চিনাবাদাম, সয়াবিন এবং সূর্যমুখীর বেশ কিছু উন্নত জাত রয়েছে যেগুলো উচ্চফলনশীল হওয়ায় চাষের আওতায় এনে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

দেশে তেলজাতীয় ফসল সূর্যমুখী আবাদের একটি অপার সম্ভাবনা বিদ্যমান রয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ফসলটি চাষাবাদে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় ঘানিতে নিষ্কাশন করে লোকজন ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার ও করছেন। উচ্চফলনশীল খাট জাতের প্রচলন এবং উপযুক্ত বাজারমূল্য নিশ্চিত করতে পারলে এ তেল ফসলটির আবাদ বৃদ্ধি করা সম্ভব। বর্তমানে তেল ফসলের আবাদি জমি ৭.২৪ লাখ হেক্টর থেকে ১৫% বৃদ্ধি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং মৌচাষকে অন্তর্ভুক্ত করে হেক্টরপ্রতি ফলন ১.৩৪ মে.টন থেকে ১৫% বৃদ্ধি করতে পারলে দেশে অতিরিক্ত ১.২৫ লাখ মে.টন তেল উৎপাদন করা সম্ভব যার বাজারমূল্য প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকা। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মৌচাষ পরাগায়ণের মাধ্যমে কেবল তেল ফসলের উৎপাদনই বাড়ায় না পাশাপাশি মধুও উৎপাদিত হয় যা থেকে বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি এবং আলাদা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব। এসব দিকগুলো বিবেচনা করে তেলজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ এবং উৎপাদন বৃদ্ধিপূর্বক ভোজ্যতেলের চাহিদাপূরণ ও আমদানি ব্যয় হ্রাসকরণের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির চাপ আমাদের রয়েছে, ফলে অল্প জমিতে অধিক ফসল ফলানোর তাগিদও বাড়ছে। লক্ষ্য হচ্ছে এক জমি থেকে বছরে তিন ফসল ফলানো। আর এজন্য এমন সব ফসলের জাত প্রয়োজন যেন জমি প্রস্তুতের সময় ব্যতীত বাকি সময়ে তিনটি ফসল কেটে নিয়ে আসা যায়। অনেক শস্য বিন্যাসে, যেমন- সরিষা-বোরো-রোপা-আমন এ তিনটি ফসলের জাত এমনভাবে নির্বাচন করতে হবে যেন ৩২০-৩৪৫ দিনের মধ্যে তিনটি ফসলই সংগ্রহ করা যায়। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় হলো আমদের দেশের কৃষি-পরিবেশ উপযোগী তেল উৎপাদনকারি তেলবীজ ফসল যেমন- সরিষা, তিল, তিসি, সূর্যমুখী, চিনাবাদাম ইত্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধি করা। ধান যেহেতু কৃষকদের প্রধান ফসল, তাই কৃষক সাধারণত তা চায় না ধানের ফলন কমে যাক বরং মাঝখানে একটি বাড়তি ফসল পেতে চান কৃষক।

ফলে কৃষকরা স্বল্পমেয়াদি কিন্তু অধিক ফলনশীল জাত পছন্দ করেন। ধানের স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের চাষ করা, বিনা ধান-৭, ১৬ ব্রি ধান-৩৩, ৩৯, ৪৯, ৫৬.৫৭, ৭১, ৭৫ ব্রি হাইব্্িরড ধান ৪ বাউ ধান-১ ও বোরো ধানের জাত যথাযথভাবে চাষাবাদ করতে পারলে ফলন খুব একটা না কমিয়ে ২৩০-২৫০ দিনের মধ্যে দুটি ধান ফসল সহজে সংগ্রহ করা সম্ভব। কৃষকের কাছে সেরকম জাতের তথ্য পৌঁছে দেয়া এবং শস্যবিন্যাসে এদের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা বড় প্রয়োজন। আর সেটা পারলে দুই ধানের মাঝখানে ৮০-৯০ দিনের উচ্চফলনশীল সরিষার জাত বারি সরিষা ১৪, ১৫, ১৭, বিনা সরিষা ৯. বাউ সরিষা ১, ২, ৩ আবাদ করা সম্ভব। উল্লেখ্য যে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত মাটিতে সূর্যমুখী সফলভাবে আবাদ হচ্ছে।

[লেখক: প্রকল্প পরিচালক, কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর প্রকল্প]

back to top