alt

উপ-সম্পাদকীয়

মোবাইল ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি

সুব্রত সরকার

: সোমবার, ২১ নভেম্বর ২০২২
image

মোবাইল ব্যাংকিং বাংলাদেশে খুবই পরিচিত একটা নাম। মোবাইল ব্যাংকিং শব্দের সাথে অনেকে পরিচিত না হলেও বিকাশ, নগদ, রকেট এই শব্দগুলোর সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আসলে বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়, ট্যাপ, শিওর ক্যাশ এগুলো প্রত্যেকটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের একেকটি অপারেটর। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ১৫টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা প্রদান করছে।

বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। খুব অল্প সময়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দ্রুত টাকা পাঠানো যায় বলে এই ব্যাংকিং সুবিধা আজ শহরে এবং প্রান্তিক পর্যায়ের অনেকেই গ্রহণ করছে। চলতি বছরে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬৯ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষ আছে। এই কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশেরও বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। আর এই ব্যাংকিং সুবিধা অপারেট হয় মোবাইলের মাধ্যমেই। তাই ব্যবহারকারীদের আলাদা করে ব্যাংকে যেতে হয় না, লাইনে দাঁড়াতে হয় না, কোনো অফিসে অপেক্ষা করতে হয় না। যেস্থানে আছেন সেখানেই নির্দিষ্ট অপারেটরের এজেন্ট দ্বারা টাকা লেনদেন করা সম্ভব হচ্ছে।

মোবাইল ব্যাংকিং শুধুমাত্র টাকা আনা-নেওয়া সুবিধার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল, ইন্টারনেট বিল, স্কুল-কলেজের ফিস প্রদান থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম লেনদেন করা যায় এক ক্লিকেই। ফলে বিল প্রদানে আগে যেখানে ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো এখন সেই অপেক্ষা আর কর?তে হচ্ছে না। কাজের ফাঁকেই বিল প্রদান ও বিভিন্ন প্রকার লেনদেন এখন ২ মিনিটের কাজ। এতে একদিকে যেমন সময় অপচয় কম হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে শ্রমজীবী, চাকরিজীবী মানুষদের কর্মঘণ্টা।

কিছুদিন আগেও দেশে করোনায় হাহাকার অবস্থা ছিল। যদিও করোনার প্রাদুর্ভাব এখন অনেকটাই কমে গেছে। কিন্তু যখন করোনা মহামারী বিশাল সাগর আকৃতি ধারণ করে বাংলাদেশের বুকে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন পুরো দেশ ঘরবন্দি হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় অনেক অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ধারণা করেছিল হয়তো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় বিশাল ধস নামতে পারে। যদিও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম ছিল না তখন, কিন্তু করোনা মহামারীতে নির্বিঘ্নে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন করতে পারায়, দেশের মানুষ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বাস্তবিক প্রয়োজনীয়তা ভালোভাবে উপলব্ধি কর?তে পেরেছে তখনই। ঘরে বসেই অনেকে দৈনন্দিন ও জরুরি প্রয়োজনীয় লেনদেন করেছিল। ফলে দেশের এমন খারাপ পরিস্থিতিতেও অর্থনীতির চাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কারণে কিছুটা হলেও সচল ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মধ্য দিয়ে দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে মাত্র ২টি সিম অপারেটরের সাহায্যে এই ব্যাংকিং সুবিধা নেওয়া যেত। সেগুলো হলো বাংলালিংক ও সিটিসেল। এর উদ্বোধন হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানের হাত ধরে। ডাচ-বাংলা ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রথম লেনদেন ছিল আতিউর রহমানের ২০০০ টাকা জমা ও ১৫০০ টাকা উঠানো। এর পরপরই ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে বিকাশ। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং বাজারের সিংহভাগই বিকাশের দখলে।

বর্তমানে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস ব্যবসায় পরিণত হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা বলতে মূলত বোঝায় এজেন্টের কাজ করা। ব্যবসা হিসেবে এটি বেশ উপযুক্ত একটি প্লাটফর্ম। অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে এই এজেন্ট ব্যবসার মাধ্যমে। পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ টাকা মূলধন হলেই এ ব্যবসায় নাম লিখানো যায়। তাছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠিত দোকানদার আছেন যারা দোকান সামলানোর পাশাপাশি এজেন্টের কাজও করছেন। কারণ এখান থেকে স্থানভেদে ভালো টাকাই উপার্জন করা যায়। তাই অনেকেই এ ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন। ফলে নিজের ওপর থেকে বেকারত্বের টেগ যেমন মুছে যাচ্ছে, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও কিছু কন্ট্রিবিউট করার সুযোগ হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চের শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ ৩০ হাজার ৪০৫ জন। এর মধ্যে গ্রামে ৫ কোটি ৬৬ লাখ ৭০ হাজার এবং শহরে ৫ কোটি ২৪ লাখ ৬০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। নিবন্ধিতদের মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি ৩১ লাখ ৭৫ হাজার এবং মহিলা গ্রাহক ৪ কোটি ৫৬ লাখ ২৬ হাজার। এই মাসেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা ৭৭ হাজার ২২ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। যেখানে গড় হিসাব করলে দাঁড়ায় প্রতিদিন লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। এর আগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয় জানুয়ারিতে- ৭৩ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। একই বছরের জুন মাসে মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন গত বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ বেড়ে ৯৪ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা হয়েছে; যা ২০২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ লেনদেনের একটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী এক মাসের ব্যবধানে জুনে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেন বেড়েছে ২৩ শতাংশ ও আগের অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে লেনদেন বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এই লেনদেনে গ্রাহকরা ক্যাশ ইন করেছে ২৭ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা এবং ক্যাশ আউট করেছে ২৬ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা এবং ব্যক্তিগত লেনদেন হয়েছে ২৪ হাজার ৫২০ কোটি টাকা।

এছাড়া জুন মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেতন দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা এবং টকটাইম কেনা হয়েছে ৭৯৭.৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে। এখন আপনার কি মনে হয়! এই বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেনে দেশের অর্থনীতিতে কী কোনোই প্রভাব ফেলবে না?

মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তারা বলছেন, এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। বর্তমানে দেশে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান এই মোবাইল ব্যাংকিং। এখানে বলাবাহুল্য- ২০২২ সালের মার্চ মাসে জরিপ করে দেখা গিয়েছিল দেশে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১১ লাখ ৫১ হাজার ২১৩ জনে। এখন এই সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও অধিকতর হয়েছে। ভেবে দেখার বিষয় শুধুমাত্র এজেন্টের কাজ করেই কত মানুষ নিজের কর্মসংস্থান গড়ে তুলেছে। ফলে দেশে বেকারত্ব যেমন ধীরে ধীরে কমছে তার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও পড়ছে। এতে অর্থনীতির গতি সঞ্চার হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা মানুষের দৈনন্দিন জীবন যেমন সহজ করেছে, তেমনি বাড়িয়েছে অর্থনৈতিক লেনদেন। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। অবদান রাখছে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে। ঘুরছে অর্থনীতির চাকাও। এখন মানুষ চাইলেই যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো সময় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করতে পারছে। শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল, যেকোনো জায়গা থেকে মুহূর্তেই টাকা পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের আপনজন বা প্রয়োজনীয় জায়গায়।

বর্তমান বিশ্ব খুব দ্রুততার সঙ্গে উন্নয়নের দিকে এগোচ্ছে। এ উন্নয়নের তালিকায় মোবাইল ব্যাংকিং একটি অন্যতম খাত। বিশ্বের এই পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের খাপ খাইয়ে নিতে হলে দেশীয় মোবাইল ব্যাংকিং খাতকে আরও উন্নত ও সহজ করতে হবে। যাতে দেশের নিম্নআয়ের মানুষও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আওতায় চলে আসে। কারণ আমরা সবাই জানি যে, আগামী দিনের বিশ্বে প্রচলিত মুদ্রার ব্যবহার কমে আসবে। ডিজিটাল মুদ্রা বা ই-মানি সেই জায়গা দখল করবে। মানুষের পকেটে কোনো টাকা থাকবে না। তাই মোবাইল ব্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষ ও স্বল্প আয়ের মানুষদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আগে থেকেই অভিজ্ঞ করে তোলাটা অনেক জরুরি। যদি দেশের সব আয়ের (স্বল্প-উচ্চ) মানুষ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আস্থা পায় এবং ব্যবহার করে তাহলে দেশের অর্থনীতিতে মোবাইল ব্যাংকিং এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

[লেখক : শিক্ষার্থী, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মোবাইল ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি

সুব্রত সরকার

image

সোমবার, ২১ নভেম্বর ২০২২

মোবাইল ব্যাংকিং বাংলাদেশে খুবই পরিচিত একটা নাম। মোবাইল ব্যাংকিং শব্দের সাথে অনেকে পরিচিত না হলেও বিকাশ, নগদ, রকেট এই শব্দগুলোর সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আসলে বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়, ট্যাপ, শিওর ক্যাশ এগুলো প্রত্যেকটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের একেকটি অপারেটর। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ১৫টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা প্রদান করছে।

বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। খুব অল্প সময়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দ্রুত টাকা পাঠানো যায় বলে এই ব্যাংকিং সুবিধা আজ শহরে এবং প্রান্তিক পর্যায়ের অনেকেই গ্রহণ করছে। চলতি বছরে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬৯ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষ আছে। এই কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশেরও বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। আর এই ব্যাংকিং সুবিধা অপারেট হয় মোবাইলের মাধ্যমেই। তাই ব্যবহারকারীদের আলাদা করে ব্যাংকে যেতে হয় না, লাইনে দাঁড়াতে হয় না, কোনো অফিসে অপেক্ষা করতে হয় না। যেস্থানে আছেন সেখানেই নির্দিষ্ট অপারেটরের এজেন্ট দ্বারা টাকা লেনদেন করা সম্ভব হচ্ছে।

মোবাইল ব্যাংকিং শুধুমাত্র টাকা আনা-নেওয়া সুবিধার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল, ইন্টারনেট বিল, স্কুল-কলেজের ফিস প্রদান থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম লেনদেন করা যায় এক ক্লিকেই। ফলে বিল প্রদানে আগে যেখানে ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো এখন সেই অপেক্ষা আর কর?তে হচ্ছে না। কাজের ফাঁকেই বিল প্রদান ও বিভিন্ন প্রকার লেনদেন এখন ২ মিনিটের কাজ। এতে একদিকে যেমন সময় অপচয় কম হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে শ্রমজীবী, চাকরিজীবী মানুষদের কর্মঘণ্টা।

কিছুদিন আগেও দেশে করোনায় হাহাকার অবস্থা ছিল। যদিও করোনার প্রাদুর্ভাব এখন অনেকটাই কমে গেছে। কিন্তু যখন করোনা মহামারী বিশাল সাগর আকৃতি ধারণ করে বাংলাদেশের বুকে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন পুরো দেশ ঘরবন্দি হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় অনেক অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ধারণা করেছিল হয়তো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় বিশাল ধস নামতে পারে। যদিও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম ছিল না তখন, কিন্তু করোনা মহামারীতে নির্বিঘ্নে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন করতে পারায়, দেশের মানুষ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বাস্তবিক প্রয়োজনীয়তা ভালোভাবে উপলব্ধি কর?তে পেরেছে তখনই। ঘরে বসেই অনেকে দৈনন্দিন ও জরুরি প্রয়োজনীয় লেনদেন করেছিল। ফলে দেশের এমন খারাপ পরিস্থিতিতেও অর্থনীতির চাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কারণে কিছুটা হলেও সচল ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মধ্য দিয়ে দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে মাত্র ২টি সিম অপারেটরের সাহায্যে এই ব্যাংকিং সুবিধা নেওয়া যেত। সেগুলো হলো বাংলালিংক ও সিটিসেল। এর উদ্বোধন হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানের হাত ধরে। ডাচ-বাংলা ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রথম লেনদেন ছিল আতিউর রহমানের ২০০০ টাকা জমা ও ১৫০০ টাকা উঠানো। এর পরপরই ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে বিকাশ। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং বাজারের সিংহভাগই বিকাশের দখলে।

বর্তমানে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস ব্যবসায় পরিণত হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা বলতে মূলত বোঝায় এজেন্টের কাজ করা। ব্যবসা হিসেবে এটি বেশ উপযুক্ত একটি প্লাটফর্ম। অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে এই এজেন্ট ব্যবসার মাধ্যমে। পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ টাকা মূলধন হলেই এ ব্যবসায় নাম লিখানো যায়। তাছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠিত দোকানদার আছেন যারা দোকান সামলানোর পাশাপাশি এজেন্টের কাজও করছেন। কারণ এখান থেকে স্থানভেদে ভালো টাকাই উপার্জন করা যায়। তাই অনেকেই এ ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন। ফলে নিজের ওপর থেকে বেকারত্বের টেগ যেমন মুছে যাচ্ছে, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও কিছু কন্ট্রিবিউট করার সুযোগ হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চের শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ ৩০ হাজার ৪০৫ জন। এর মধ্যে গ্রামে ৫ কোটি ৬৬ লাখ ৭০ হাজার এবং শহরে ৫ কোটি ২৪ লাখ ৬০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। নিবন্ধিতদের মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি ৩১ লাখ ৭৫ হাজার এবং মহিলা গ্রাহক ৪ কোটি ৫৬ লাখ ২৬ হাজার। এই মাসেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা ৭৭ হাজার ২২ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। যেখানে গড় হিসাব করলে দাঁড়ায় প্রতিদিন লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। এর আগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয় জানুয়ারিতে- ৭৩ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। একই বছরের জুন মাসে মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন গত বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ বেড়ে ৯৪ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা হয়েছে; যা ২০২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ লেনদেনের একটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী এক মাসের ব্যবধানে জুনে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেন বেড়েছে ২৩ শতাংশ ও আগের অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে লেনদেন বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এই লেনদেনে গ্রাহকরা ক্যাশ ইন করেছে ২৭ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা এবং ক্যাশ আউট করেছে ২৬ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা এবং ব্যক্তিগত লেনদেন হয়েছে ২৪ হাজার ৫২০ কোটি টাকা।

এছাড়া জুন মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেতন দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা এবং টকটাইম কেনা হয়েছে ৭৯৭.৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে। এখন আপনার কি মনে হয়! এই বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেনে দেশের অর্থনীতিতে কী কোনোই প্রভাব ফেলবে না?

মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তারা বলছেন, এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। বর্তমানে দেশে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান এই মোবাইল ব্যাংকিং। এখানে বলাবাহুল্য- ২০২২ সালের মার্চ মাসে জরিপ করে দেখা গিয়েছিল দেশে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১১ লাখ ৫১ হাজার ২১৩ জনে। এখন এই সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও অধিকতর হয়েছে। ভেবে দেখার বিষয় শুধুমাত্র এজেন্টের কাজ করেই কত মানুষ নিজের কর্মসংস্থান গড়ে তুলেছে। ফলে দেশে বেকারত্ব যেমন ধীরে ধীরে কমছে তার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও পড়ছে। এতে অর্থনীতির গতি সঞ্চার হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা মানুষের দৈনন্দিন জীবন যেমন সহজ করেছে, তেমনি বাড়িয়েছে অর্থনৈতিক লেনদেন। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। অবদান রাখছে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে। ঘুরছে অর্থনীতির চাকাও। এখন মানুষ চাইলেই যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো সময় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করতে পারছে। শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল, যেকোনো জায়গা থেকে মুহূর্তেই টাকা পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের আপনজন বা প্রয়োজনীয় জায়গায়।

বর্তমান বিশ্ব খুব দ্রুততার সঙ্গে উন্নয়নের দিকে এগোচ্ছে। এ উন্নয়নের তালিকায় মোবাইল ব্যাংকিং একটি অন্যতম খাত। বিশ্বের এই পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের খাপ খাইয়ে নিতে হলে দেশীয় মোবাইল ব্যাংকিং খাতকে আরও উন্নত ও সহজ করতে হবে। যাতে দেশের নিম্নআয়ের মানুষও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আওতায় চলে আসে। কারণ আমরা সবাই জানি যে, আগামী দিনের বিশ্বে প্রচলিত মুদ্রার ব্যবহার কমে আসবে। ডিজিটাল মুদ্রা বা ই-মানি সেই জায়গা দখল করবে। মানুষের পকেটে কোনো টাকা থাকবে না। তাই মোবাইল ব্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষ ও স্বল্প আয়ের মানুষদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আগে থেকেই অভিজ্ঞ করে তোলাটা অনেক জরুরি। যদি দেশের সব আয়ের (স্বল্প-উচ্চ) মানুষ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আস্থা পায় এবং ব্যবহার করে তাহলে দেশের অর্থনীতিতে মোবাইল ব্যাংকিং এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

[লেখক : শিক্ষার্থী, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top