alt

উপ-সম্পাদকীয়

রক্তকরবী এবং অদৃশ্য বেড়ি

শেখর ভট্টাচার্য

: বুধবার, ২৩ নভেম্বর ২০২২
image

রক্তকরবী নাটকে নান্দনিক জীবনের প্রকাশের সম্পূর্ণ রূপকে রবীন্দ্রনাথ উপস্থাপন করেছেন ‘নন্দিনী’ চরিত্রের মাধ্যমে। প্রেম ও সৌন্দর্যের এক অসাধারণ প্রতীক, নন্দিনী

রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকটি আবার পড়তে ইচ্ছে হলো। কখনও কখনও অনেক ইচ্ছের কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না, এই ইচ্ছেটিও এ রকম। নিজের সংগ্রহে বইটি থাকায় ইচ্ছে পূরণ করতে বেগ পেতে হলো না। রয়ে সয়ে রক্তকরবীর চরিত্র, রক্তকরবীর বাণীকে আবারও বোঝার চেষ্টা করলাম। পাঠ করলে যেটা হয়, চরিত্রকে কল্পনা করা যায়, সংলাপগুলোকে বোধের মধ্যে নেয়ার চেষ্টা করা যায়। এ’ এক অন্যরকমের আনন্দ। মঞ্চে রক্তকরবী অনেকবার দেখা হয়েছে। শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথকে বইয়ের পাতায় স্বাধীনভাবে পড়ে, বুঝে যতোটুকু আবিষ্কার করতে পারি, মঞ্চ কিংবা টেলিভিশনে ঠিক ততটুকু পারি না। এ আমার একান্ত নিজস্ব সীমাবদ্ধতা।

দৃশ্যমাধ্যম এবং পঠন-পাঠন মাধ্যমের মধ্যে পঠন-পাঠন মাধ্যমের প্রতি আমার এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব আছে। দৃশ্যমাধ্যম জ্যামিতিক হারে জনপ্রিয় হচ্ছে। গদ্য পড়ার মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। এমনকী সংবাদপত্রের ছাপা সংস্ককরণও আর আগের মতো মানুষ পড়ছে না। অবাক করার বিষয় করোনা সংক্রমণের পর অনেকেই বাড়িতে সংবাদপত্র রাখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, সংক্রমণের হার কমে যাওয়ার পরও একই অভ্যাস বজায় রেখেছেন অনেকে। যারা খুব আগ্রহী তারা ইন্টারনেটে প্রিয় সংবাদপত্রের ইলেক্ট্রোনিক ভার্সন পড়ে নিচ্ছেন। বাধ্য না হলে এখন আর মানুষ বই আকারের কিছু ব্যাপকভাবে পড়ছেন বলে মনে হয় না।

তবে কিছু কিছু মানুষ পড়ছেন, যারা নিমগ্ন হয়ে পড়ছেন তারা কারা? তারা হলেন- লেখক, সাংবাদিক, গবেষক, কবিসহ সৃষ্টিশীল মানুষেরা। তাদের সংখ্যা একটি সমাজে খুব বেশি হয় না। মধ্যবিত্ত পরিবারে এক সময় কাড়াকাড়ি করে কবিতা, গল্প, উপন্যাস প্রবন্ধ পড়া হতো, সেই সংস্কৃতি এখন ক্ষয়িষ্ণু। একটি সমাজে যখন শিক্ষা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্থবির অবস্থা সৃষ্টি হয় তখন সে সমাজের মানুষের রুচিবোধ নিম্নগামী হয়, সাংস্কৃতিক মানের অবনমন হয়। প্রযুক্তির কারণে এমন হচ্ছে? আমার মনে হয় না। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে অন্তর্জাল থেকে নানা রকম পাঠ্য, অপাঠ্য বই পড়ছে মানুষ কিন্তু সাহিত্য সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের বই তেমন পড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। ঐতিহ্যকে আবিষ্কার করা, জাতীয় সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ, দেশপ্রেম জাগ্রত করা, এসব কিছুর জন্য পাঠের বিকল্প আর কিছু নেই। বড় ভয় হয়। যখন কোন সমাজে মানুষের নন্দন চর্চা কমে যায়, সে সমাজে তখন অসুন্দর, অসুরের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। এই দৌরাত্ম্য এখন দৃশ্যমান। রক্তকরবী নাটকের যক্ষপুরী ছিল এরকম অসুন্দর, নন্দন চর্চার অনুপযোগী একটি ক্ষেত্র।

রক্তকরবী নাটকটি লেখা হয়েছিল শিলংয়ের শৈলবাসে, ১৩৩০ সালে। নাটকটি যখন লেখা হয় তখন এর নাম ছিল ‘যক্ষপুরী’। নাটকটি পরবর্তীতে যখন প্রবাসীতে প্রকাশ করা হয় রবীন্দ্রনাথ তখন এর নামকরণ করেন ‘রক্তকরবী’। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী এখন ১৪২৯ বাংলা। প্রায় শত বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে রক্তকরবীর। রক্তকরবী নাটকটি প্রতীকাশ্রয়ী। প্রতীকীভাবে রবীন্দ্রনাথ নাটকটিকে শিল্প, সুষমা মন্ডিত করে যে বার্তা দিতে চেয়েছেন, সেই বার্তার আবেদন বিন্দুমাত্র কমে যায়নি, শুধুমাত্র উপমহাদেশে নয়, এই বিরাট ভূ-গ্রামে। এই যে আমরা মহৎ শিল্পকর্মকে বলি কালজয়ী, যুগজয়ী, রক্তকরবী হলো এরকম কালজয়ী একটি নাটক। আমার মনে হয় সুন্দর, অসুন্দর, সুর, অসুরের লড়াই এই পৃথিবীতে অনন্তকাল ধরে চলবে। রাজধর্ম যতদিন প্রজা শোষণ এবং মানুষকে যতদিন উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হবে ততদিন মানুষ রক্তকরবী নাটকটি পড়ে যাবে, মঞ্চায়ন করবে এবং এর বাণীকে বহু দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে যাবে।

রক্তকরবীর মূল বার্তা কী ছিল? শাসক বা রাজার রাজধর্ম যখন হয় শুধুমাত্র প্রজা শোষন তখন শাসক প্রজাদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে নিছক যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। সৌন্দর্যের চর্চা নির্বাসিত হয়। সুন্দরকে আহ্বান করলেও, যক্ষপুরীর লোহার বেড়িকে অতিক্রম করে সুন্দর সেখান প্রবেশ করতে পারে না। শাসকের ভোগবিলাস যখন সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন লোভও সীমাহীন হয়ে পড়ে। মানুষের অন্তহীন লোভ কীভাবে জীবনের সরল সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক বিকাশের সামনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তারই একটি প্রতীকী উপস্থাপনা হলো রক্তকরবী। যে শাসন ব্যবস্থা মানুষকে নিছক যন্ত্র ও উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপকরণে পরিণত করে সে ব্যবস্থাকে মানুষ কখনো গ্রহণ করতে পারে না। রক্তকরবীতে আমরা দেখেছি শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ। শিল্পের মান অক্ষুণ্ন রেখে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন শোষণের বিরুদ্ধে, সুন্দরের পক্ষে অবস্থান করে মানুষের প্রতিবাদ কীরূপ ধারণ করতে পারে। রক্তকরবীতে আমরা মানুষের প্রতিবাদের এক নান্দনিক প্রতিফলন দেখতে পাই। আলোচনাটি আনন্দদায়ক করার জন্য এ নাটকের সংক্ষিপ্ত কাহিনী পাঠকের সামনে তুলে ধরা যেতে পারে- যক্ষপুরীর রাজার রাজধর্ম প্রজাশোষণ; তার অর্থ ও সম্পদ লোভ দুর্দমনীয়। রাজার লোভের আগুনে পুড়ে মরে স্বর্ণের খনির কুলিরা। রাজার দৃষ্টিতে কুলিরা মানুষ নয় তারা স্বর্ণলাভের যন্ত্রমাত্র, তারা ৪৭ক, ২৬৯ফ মাত্র। শ্রমিকরা যন্ত্রকাঠামোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঙ্গমাত্র, মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মূল্য নেই। যক্ষপুরীতে মনুষ্যত্ব, মানবতা যন্ত্রবন্ধনে পীড়িত ও অবমানিত। মানবধর্ম নির্বাসিত, শোষণের জন্য অমানবিক অসুন্দর ব্যবস্থার লালন-পালনের নিয়ম-নীতি কার্যকর।

যক্ষপুরীতে জীবনের প্রকাশ ও বিকাশ দৃশ্যমান নয়। নান্দনিক জীবনের প্রকাশের সম্পূর্ণ রূপকে রবীন্দ্রনাথ উপস্থাপন করেছেন ‘নন্দিনী’ চরিত্রের মাধ্যমে। প্রেম ও সৌন্দর্যের এক অসাধারণ প্রতীক, নন্দিনী। জীবনে শুভ বোধ, শুভ শক্তি ক্রয়াশীল নন্দিনী চরিত্র ও অভিব্যক্তিতে। রক্তকরবীতে আমরা দেখতে পাই নন্দিনীর শুভ ও আনন্দস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন যক্ষপুরীর রাজা কারণ তিনি লোভের মোহে অসুরে পরিণত হয়েছেন। নন্দিনীর শুভ ও নান্দনিক সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন সন্ন্যাসী। ধর্ম ও সংস্কারের মোহে ডুবে থাকার কারণে সুন্দর থেকে বঞ্চিত সন্ন্যাসী। মজুররা নন্দিনীর সাহচর্য বঞ্চিত হয়েছে অত্যাচার ও অবিচারের লোহার শিকলে বাঁধা পড়ে। যক্ষপুরীর পন্ডিত দাসত্বের মোহে অন্ধ, সৌন্দর্যের সঙ্গে অন্ধত্ব কখনও মিলিত হতে পারে না তাই তিনিও সুন্দর ও সত্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

যক্ষপুরীর লোহার জালের বাইরে প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রতীক নন্দিনী সবাইকে হাতছানি দিয়ে ডাকে; এক মুহূর্তে মুক্ত জীবনানন্দের স্পর্শে সবাই চঞ্চল হয়ে ওঠে। রাজা নন্দিনীকে পেতে চাইলেন যেমন করে তিনি স্বর্ণ আহরণ করেন ঠিক সেভাবে, শক্তির বলে কেড়ে নিয়ে। কিন্তু প্রেম ও সৌন্দর্যকে এভাবে লাভ করা যায় না। এ কারণে রাজা নন্দিনীকে পেয়েও পাননি। একইভাবে মোড়ল, পন্ডিত, কিশোর, কেনারাম সবাই প্রাণপ্রাচুর্যের মধ্যে বাঁচার জন্য ব্যাকুল হয়ে জালের বাইরের দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু নন্দিনী রঞ্জনকে ভালোবাসে তাই তার মধ্যে প্রেম জাগিয়ে তুলেছে। কিন্তু রঞ্জন যন্ত্রের বন্ধনে বাঁধা। এ যন্ত্র তার প্রেমকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়-এটাই যান্ত্রিকতার ধর্ম এবং কবি তা বিশ্বাস করেন। নন্দিনীর প্রেমাস্পদ যান্ত্রিকতার যুপকাষ্ঠে নিঃশেষিত হলো এবং আবার যেন প্রেমকে ফিরে পাওয়া যায় সে লক্ষ্যে জীবন জয়ী হলো। আর এই দৃষ্টিভঙ্গী রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতায়, গাঁথায়, নাটকে, গল্পে পরিস্ফুট হয়েছে। কবি নাটকটিতে জড় যান্ত্রিকতা ও জীবনধর্মের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য সন্ধান করেছেন। সে সন্ধান এখনও চলছে। সামঞ্জস্য কিংবা জীবনধর্মের জয়ের প্রত্যাশা করে মহৎ পথের অনুসন্ধান করেও আমরা যক্ষপুরীর লোহার বেড়ির বাইরে এসে নন্দিনীর সাহচর্য পেতে ব্যর্থ হচ্ছি।

যক্ষপুরীর ভেতরের সংস্কৃতিকে মানবিক করে তোলার জন্য দেশে দেশে মানুষ সহস্র বছর থেকে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শোষণকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে শাসন সে শাসন কখনো মানবিক হতে পারে না। লৌহকপাটের ভেতর থেকে সুন্দরের আহ্বান শোনা যায় কিন্তু সুন্দরের সাহচর্য পাওয়া যায়না। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর হওয়ার যে বাসনা তাকে পাওয়ার জন্য লড়াই সারাপৃথিবীতে চলমান। বিচ্ছিন্ন লড়াই এবং সাময়িক সুন্দরের সঙ্গে বসবাস মানুষকে আশাবাদী করে তোলে। প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয় মানুষের মনে তবে সে লড়াইয়ের অবসান হয় না কখনো। তারপরেও শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আশার পালে হাওয়া লাগানোর চেষ্টা করে যান।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো মানুষেরা অভয় যোগান, ‘মানুষ পরাজিত হওয়ার জন্য তৈরি হয়নি। মানুষকে ধ্বংস করা যায় কিন্তু পরাজিত করা যায় না।’ ধ্বংস করার বিরামহীন চেষ্টা, মানুষকে নৈতিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। মানুষের চারদিকে অদৃশ্য লোহার বেড়ির বাঁধন ক্রমাগত দৃঢ় হচ্ছে। যক্ষপুরী তৈরি হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে। যক্ষপুরীর ভেতরে ‘খাঁচার পাখির’ মতো লোহার বেড়ির জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে মানুষ। কোনটি স্বাধীনতা, কোনটি স্বাধীনতা নয় এর মধ্যে বিভ্রম তৈরি হচ্ছে। সুন্দরকে পাওয়ার লক্ষ্যে ধর্মান্ধতা, চিন্তার বদ্ধতা, পুঁজির দাস হওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে মোহমুক্তির প্রয়োজন। এর মধ্যেই রয়েছে যক্ষপুরীর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এক মুক্ত জীবনের সম্ভাবনা।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রক্তকরবী এবং অদৃশ্য বেড়ি

শেখর ভট্টাচার্য

image

রক্তকরবী নাটকে নান্দনিক জীবনের প্রকাশের সম্পূর্ণ রূপকে রবীন্দ্রনাথ উপস্থাপন করেছেন ‘নন্দিনী’ চরিত্রের মাধ্যমে। প্রেম ও সৌন্দর্যের এক অসাধারণ প্রতীক, নন্দিনী

বুধবার, ২৩ নভেম্বর ২০২২

রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকটি আবার পড়তে ইচ্ছে হলো। কখনও কখনও অনেক ইচ্ছের কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না, এই ইচ্ছেটিও এ রকম। নিজের সংগ্রহে বইটি থাকায় ইচ্ছে পূরণ করতে বেগ পেতে হলো না। রয়ে সয়ে রক্তকরবীর চরিত্র, রক্তকরবীর বাণীকে আবারও বোঝার চেষ্টা করলাম। পাঠ করলে যেটা হয়, চরিত্রকে কল্পনা করা যায়, সংলাপগুলোকে বোধের মধ্যে নেয়ার চেষ্টা করা যায়। এ’ এক অন্যরকমের আনন্দ। মঞ্চে রক্তকরবী অনেকবার দেখা হয়েছে। শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথকে বইয়ের পাতায় স্বাধীনভাবে পড়ে, বুঝে যতোটুকু আবিষ্কার করতে পারি, মঞ্চ কিংবা টেলিভিশনে ঠিক ততটুকু পারি না। এ আমার একান্ত নিজস্ব সীমাবদ্ধতা।

দৃশ্যমাধ্যম এবং পঠন-পাঠন মাধ্যমের মধ্যে পঠন-পাঠন মাধ্যমের প্রতি আমার এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব আছে। দৃশ্যমাধ্যম জ্যামিতিক হারে জনপ্রিয় হচ্ছে। গদ্য পড়ার মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। এমনকী সংবাদপত্রের ছাপা সংস্ককরণও আর আগের মতো মানুষ পড়ছে না। অবাক করার বিষয় করোনা সংক্রমণের পর অনেকেই বাড়িতে সংবাদপত্র রাখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, সংক্রমণের হার কমে যাওয়ার পরও একই অভ্যাস বজায় রেখেছেন অনেকে। যারা খুব আগ্রহী তারা ইন্টারনেটে প্রিয় সংবাদপত্রের ইলেক্ট্রোনিক ভার্সন পড়ে নিচ্ছেন। বাধ্য না হলে এখন আর মানুষ বই আকারের কিছু ব্যাপকভাবে পড়ছেন বলে মনে হয় না।

তবে কিছু কিছু মানুষ পড়ছেন, যারা নিমগ্ন হয়ে পড়ছেন তারা কারা? তারা হলেন- লেখক, সাংবাদিক, গবেষক, কবিসহ সৃষ্টিশীল মানুষেরা। তাদের সংখ্যা একটি সমাজে খুব বেশি হয় না। মধ্যবিত্ত পরিবারে এক সময় কাড়াকাড়ি করে কবিতা, গল্প, উপন্যাস প্রবন্ধ পড়া হতো, সেই সংস্কৃতি এখন ক্ষয়িষ্ণু। একটি সমাজে যখন শিক্ষা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্থবির অবস্থা সৃষ্টি হয় তখন সে সমাজের মানুষের রুচিবোধ নিম্নগামী হয়, সাংস্কৃতিক মানের অবনমন হয়। প্রযুক্তির কারণে এমন হচ্ছে? আমার মনে হয় না। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে অন্তর্জাল থেকে নানা রকম পাঠ্য, অপাঠ্য বই পড়ছে মানুষ কিন্তু সাহিত্য সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের বই তেমন পড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। ঐতিহ্যকে আবিষ্কার করা, জাতীয় সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ, দেশপ্রেম জাগ্রত করা, এসব কিছুর জন্য পাঠের বিকল্প আর কিছু নেই। বড় ভয় হয়। যখন কোন সমাজে মানুষের নন্দন চর্চা কমে যায়, সে সমাজে তখন অসুন্দর, অসুরের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। এই দৌরাত্ম্য এখন দৃশ্যমান। রক্তকরবী নাটকের যক্ষপুরী ছিল এরকম অসুন্দর, নন্দন চর্চার অনুপযোগী একটি ক্ষেত্র।

রক্তকরবী নাটকটি লেখা হয়েছিল শিলংয়ের শৈলবাসে, ১৩৩০ সালে। নাটকটি যখন লেখা হয় তখন এর নাম ছিল ‘যক্ষপুরী’। নাটকটি পরবর্তীতে যখন প্রবাসীতে প্রকাশ করা হয় রবীন্দ্রনাথ তখন এর নামকরণ করেন ‘রক্তকরবী’। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী এখন ১৪২৯ বাংলা। প্রায় শত বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে রক্তকরবীর। রক্তকরবী নাটকটি প্রতীকাশ্রয়ী। প্রতীকীভাবে রবীন্দ্রনাথ নাটকটিকে শিল্প, সুষমা মন্ডিত করে যে বার্তা দিতে চেয়েছেন, সেই বার্তার আবেদন বিন্দুমাত্র কমে যায়নি, শুধুমাত্র উপমহাদেশে নয়, এই বিরাট ভূ-গ্রামে। এই যে আমরা মহৎ শিল্পকর্মকে বলি কালজয়ী, যুগজয়ী, রক্তকরবী হলো এরকম কালজয়ী একটি নাটক। আমার মনে হয় সুন্দর, অসুন্দর, সুর, অসুরের লড়াই এই পৃথিবীতে অনন্তকাল ধরে চলবে। রাজধর্ম যতদিন প্রজা শোষণ এবং মানুষকে যতদিন উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হবে ততদিন মানুষ রক্তকরবী নাটকটি পড়ে যাবে, মঞ্চায়ন করবে এবং এর বাণীকে বহু দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে যাবে।

রক্তকরবীর মূল বার্তা কী ছিল? শাসক বা রাজার রাজধর্ম যখন হয় শুধুমাত্র প্রজা শোষন তখন শাসক প্রজাদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে নিছক যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। সৌন্দর্যের চর্চা নির্বাসিত হয়। সুন্দরকে আহ্বান করলেও, যক্ষপুরীর লোহার বেড়িকে অতিক্রম করে সুন্দর সেখান প্রবেশ করতে পারে না। শাসকের ভোগবিলাস যখন সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন লোভও সীমাহীন হয়ে পড়ে। মানুষের অন্তহীন লোভ কীভাবে জীবনের সরল সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক বিকাশের সামনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তারই একটি প্রতীকী উপস্থাপনা হলো রক্তকরবী। যে শাসন ব্যবস্থা মানুষকে নিছক যন্ত্র ও উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপকরণে পরিণত করে সে ব্যবস্থাকে মানুষ কখনো গ্রহণ করতে পারে না। রক্তকরবীতে আমরা দেখেছি শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ। শিল্পের মান অক্ষুণ্ন রেখে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন শোষণের বিরুদ্ধে, সুন্দরের পক্ষে অবস্থান করে মানুষের প্রতিবাদ কীরূপ ধারণ করতে পারে। রক্তকরবীতে আমরা মানুষের প্রতিবাদের এক নান্দনিক প্রতিফলন দেখতে পাই। আলোচনাটি আনন্দদায়ক করার জন্য এ নাটকের সংক্ষিপ্ত কাহিনী পাঠকের সামনে তুলে ধরা যেতে পারে- যক্ষপুরীর রাজার রাজধর্ম প্রজাশোষণ; তার অর্থ ও সম্পদ লোভ দুর্দমনীয়। রাজার লোভের আগুনে পুড়ে মরে স্বর্ণের খনির কুলিরা। রাজার দৃষ্টিতে কুলিরা মানুষ নয় তারা স্বর্ণলাভের যন্ত্রমাত্র, তারা ৪৭ক, ২৬৯ফ মাত্র। শ্রমিকরা যন্ত্রকাঠামোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঙ্গমাত্র, মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মূল্য নেই। যক্ষপুরীতে মনুষ্যত্ব, মানবতা যন্ত্রবন্ধনে পীড়িত ও অবমানিত। মানবধর্ম নির্বাসিত, শোষণের জন্য অমানবিক অসুন্দর ব্যবস্থার লালন-পালনের নিয়ম-নীতি কার্যকর।

যক্ষপুরীতে জীবনের প্রকাশ ও বিকাশ দৃশ্যমান নয়। নান্দনিক জীবনের প্রকাশের সম্পূর্ণ রূপকে রবীন্দ্রনাথ উপস্থাপন করেছেন ‘নন্দিনী’ চরিত্রের মাধ্যমে। প্রেম ও সৌন্দর্যের এক অসাধারণ প্রতীক, নন্দিনী। জীবনে শুভ বোধ, শুভ শক্তি ক্রয়াশীল নন্দিনী চরিত্র ও অভিব্যক্তিতে। রক্তকরবীতে আমরা দেখতে পাই নন্দিনীর শুভ ও আনন্দস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন যক্ষপুরীর রাজা কারণ তিনি লোভের মোহে অসুরে পরিণত হয়েছেন। নন্দিনীর শুভ ও নান্দনিক সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন সন্ন্যাসী। ধর্ম ও সংস্কারের মোহে ডুবে থাকার কারণে সুন্দর থেকে বঞ্চিত সন্ন্যাসী। মজুররা নন্দিনীর সাহচর্য বঞ্চিত হয়েছে অত্যাচার ও অবিচারের লোহার শিকলে বাঁধা পড়ে। যক্ষপুরীর পন্ডিত দাসত্বের মোহে অন্ধ, সৌন্দর্যের সঙ্গে অন্ধত্ব কখনও মিলিত হতে পারে না তাই তিনিও সুন্দর ও সত্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

যক্ষপুরীর লোহার জালের বাইরে প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রতীক নন্দিনী সবাইকে হাতছানি দিয়ে ডাকে; এক মুহূর্তে মুক্ত জীবনানন্দের স্পর্শে সবাই চঞ্চল হয়ে ওঠে। রাজা নন্দিনীকে পেতে চাইলেন যেমন করে তিনি স্বর্ণ আহরণ করেন ঠিক সেভাবে, শক্তির বলে কেড়ে নিয়ে। কিন্তু প্রেম ও সৌন্দর্যকে এভাবে লাভ করা যায় না। এ কারণে রাজা নন্দিনীকে পেয়েও পাননি। একইভাবে মোড়ল, পন্ডিত, কিশোর, কেনারাম সবাই প্রাণপ্রাচুর্যের মধ্যে বাঁচার জন্য ব্যাকুল হয়ে জালের বাইরের দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু নন্দিনী রঞ্জনকে ভালোবাসে তাই তার মধ্যে প্রেম জাগিয়ে তুলেছে। কিন্তু রঞ্জন যন্ত্রের বন্ধনে বাঁধা। এ যন্ত্র তার প্রেমকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়-এটাই যান্ত্রিকতার ধর্ম এবং কবি তা বিশ্বাস করেন। নন্দিনীর প্রেমাস্পদ যান্ত্রিকতার যুপকাষ্ঠে নিঃশেষিত হলো এবং আবার যেন প্রেমকে ফিরে পাওয়া যায় সে লক্ষ্যে জীবন জয়ী হলো। আর এই দৃষ্টিভঙ্গী রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতায়, গাঁথায়, নাটকে, গল্পে পরিস্ফুট হয়েছে। কবি নাটকটিতে জড় যান্ত্রিকতা ও জীবনধর্মের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য সন্ধান করেছেন। সে সন্ধান এখনও চলছে। সামঞ্জস্য কিংবা জীবনধর্মের জয়ের প্রত্যাশা করে মহৎ পথের অনুসন্ধান করেও আমরা যক্ষপুরীর লোহার বেড়ির বাইরে এসে নন্দিনীর সাহচর্য পেতে ব্যর্থ হচ্ছি।

যক্ষপুরীর ভেতরের সংস্কৃতিকে মানবিক করে তোলার জন্য দেশে দেশে মানুষ সহস্র বছর থেকে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শোষণকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে শাসন সে শাসন কখনো মানবিক হতে পারে না। লৌহকপাটের ভেতর থেকে সুন্দরের আহ্বান শোনা যায় কিন্তু সুন্দরের সাহচর্য পাওয়া যায়না। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর হওয়ার যে বাসনা তাকে পাওয়ার জন্য লড়াই সারাপৃথিবীতে চলমান। বিচ্ছিন্ন লড়াই এবং সাময়িক সুন্দরের সঙ্গে বসবাস মানুষকে আশাবাদী করে তোলে। প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয় মানুষের মনে তবে সে লড়াইয়ের অবসান হয় না কখনো। তারপরেও শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আশার পালে হাওয়া লাগানোর চেষ্টা করে যান।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো মানুষেরা অভয় যোগান, ‘মানুষ পরাজিত হওয়ার জন্য তৈরি হয়নি। মানুষকে ধ্বংস করা যায় কিন্তু পরাজিত করা যায় না।’ ধ্বংস করার বিরামহীন চেষ্টা, মানুষকে নৈতিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। মানুষের চারদিকে অদৃশ্য লোহার বেড়ির বাঁধন ক্রমাগত দৃঢ় হচ্ছে। যক্ষপুরী তৈরি হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে। যক্ষপুরীর ভেতরে ‘খাঁচার পাখির’ মতো লোহার বেড়ির জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে মানুষ। কোনটি স্বাধীনতা, কোনটি স্বাধীনতা নয় এর মধ্যে বিভ্রম তৈরি হচ্ছে। সুন্দরকে পাওয়ার লক্ষ্যে ধর্মান্ধতা, চিন্তার বদ্ধতা, পুঁজির দাস হওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে মোহমুক্তির প্রয়োজন। এর মধ্যেই রয়েছে যক্ষপুরীর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এক মুক্ত জীবনের সম্ভাবনা।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top